Home প্রবন্ধ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – দ্বিতীয় ভাগ – দ্বিতীয় পর্ব
প্রবন্ধসাহিত্য ও সংস্কৃতি

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – দ্বিতীয় ভাগ – দ্বিতীয় পর্ব

শৈবাল কুমার বোস

৩) বিবিধ বৈষ্ণবনিবন্ধ

জীব গোস্বামী বৈষ্ণবধর্মের গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের শেষ শাস্ত্রকার এবং চৈতন্যচরিতামৃত সে ধর্মের সর্বোচ্চ সংহিতা। তারপর এল ব্যাখ্যার আর অনুবাদের পালা। কৃষ্ণদাস কবিরাজই এই কাজের পথ দেখিয়েছিলেন। ব্যাখ্যা প্রধানত ও অনুবাদ একান্তভাবেই বাংলায়। রূপগোস্বামীর ভক্তিরত্নাকর ও উজ্জ্বলনীলমণি পদকর্তাদের আকর গ্রন্থরূপে পরিগণিত হয়েছিল। চৈতন্যচরিতামৃতের পরেই এই দুই গ্রন্থের ব্যবহার ও মর্যাদা সর্বাপেক্ষা বেশী ছিল। তাই এই দুই গ্রন্থের  সারাংশের অনুবাদের দিকেই ঝোঁক ছিল বেশী। বৃন্দাবনের শাস্ত্রকার গোস্বামীরা – বিশেষ করে রূপগোস্বামী, গোপালভট্ট ও জীবগোস্বামী – চৈতন্য-কৃষ্ণের শাস্ত্রবলে যে মত নিরূপণ করে দিলেন তা বাংলাদেশে আনীত ও শিরধার্য হল। জীবগোস্বামীর তিরোধানের পর বৃন্দাবনে আর কেউ শাস্ত্রকর্তা রইলেন না। বৃন্দাবনবাসী বাঙ্গালী বৈষ্ণবের শাস্ত্রচর্চা অতঃপর ব্যাখ্যায় আর সারসংগ্রহে নিরত রইল। যারা পান্ডিত্যের পথে চললেন না তারা অনুবাদের দিকে ঝুঁকলেন। এই কাজ ত্রিধারায়-ব্যাখ্যায়-সারসংগ্রহে-অনুবাদে সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রবলভাবে চলেছিল এবং সে প্রবলতরে হয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তও উল্লঙ্ঘন করেছিল।

এইসময়ে প্রাপ্ত রচনার মধ্যে অকিঞ্চনদাস ভণিতায় তিনখানি ছোট ছোট তত্বনিবন্ধের পুথি পাওয়া গেছে। পুথিগুলির নাম ভক্তিরসচন্ডিকা, ভক্তিরসাত্মিকা ও ভক্তরসালিকা। দাক্ষিণাত্য থেকে চৈতন্য বিল্বমঙ্গল রচিত কর্ণামৃত (কৃষ্ণকর্ণামৃত) নামে কৃষ্ণলীলা বিষয়ক কোশকাব্যের পুথি এনেছিলেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যচরিতামৃতে তার অনেক গুলো ভাবানুবাদ দিয়েছেন। কৃষ্ণদাস কাব্যটির বিশদ টীকাও দিয়েছিলেন। সে টীকার নাম সারঙ্গরঙ্গদা। মূল ও টীকার অনুবাদ কাব্যাকারে করেছিলেন যদুনন্দনদাস। তারও নাম কৃষ্ণকর্ণামৃত। অনুবাদ এমন সুললিত যে এর অনেকাংশ পদাবলীর মতন সুর করে গাওয়া হয়ে এসেছে। যদুনন্দন আরো যে বৈষ্ণব কাব্য নাটকের অনুবাদ করেছিলেন তাও সমাদৃত হয়েছিল। তার অপর অনুবাদ গ্রন্থ হল রসকদম্ব বা রাধাকৃষ্ণলীলারসকদম্ব – রূপগোস্বামীর বিদগ্ধমাধব নাটক অবলম্বনে, দানলীলাচন্দ্রামৃত রূপগোস্বামীর দানকেলীকৌমুদিভানিকা অবলম্বনে এবং গোবিন্দবিলাস বা গোবিন্দলীলামৃত – কৃষ্ণদাস কবিরাজের গোবিন্দলীলামৃত কাব্য অবলম্বনে। যদুনন্দন নামে একাধিক সমসাময়িক বৈষ্ণব লেখক ছিলেন। হরিভক্তিচন্দ্রিকা ও কর্ণানন্দ প্রথম যদুনন্দনের লেখা ধরা হলেও কবিশেখররায়ের হীরাবলীতত্ত্ব নামে সংস্কৃত নিবন্ধের লেখক যদুনন্দন দ্বিতীয় কোনো যদুনন্দন হতে পারেন।

ভাগবতের দশমস্কন্ধের সপ্তচত্বারিংশ অধ্যায়ের দশটি শ্লোক (১২-২১) ভ্রমরগীতা নামে প্রসিদ্ধ। রূপগোস্বামীর উজ্জ্বলনীলমণিতে ভ্রমরগীতার ভাবনা ব্যাখ্যাত আছে। মূল ও এই ব্যাখ্যা অবলম্বন করে একাধিক লেখক ছোটো ছোটো নিবন্ধ রচনা করেছিলেন। এর মধ্যে যদুনাথদাসের ভ্রমরগীতা সুপরিচিত ও সর্বাপেক্ষা পুরানো। ভ্রমরগীতার অপর লেখক হচ্ছেন রূপনাথদাস ও দেবনাথদাস। রূপের উদ্ধবসন্দেশ (নামান্তরে উদ্ধবদূত) একাধিক লেখক যেমন দ্বিজ নরসিংহ ও কিশরদাস দ্বারা অনূদিত হয়েছিল। রূপের হংসদূত কাব্যের অনুবাদকারী নরসিংহদাস বা নৃসিংহদাস উদ্ধবদূতের অনুবাদক দ্বিজ নরসিংহ হওয়াই সম্ভব। হংসদূত কাব্যের অপর অনুবাদকারী হলেন নরোত্তমদাস। স্কন্দপুরাণ (উৎকল খন্ড) ও ব্রহ্মপুরাণ কয়েকখানা জগন্নাথমাহাত্য লেখা হয়েছিল। গদাধরদাসের জগৎমঙ্গল সবার আগে লেখা হয়েছিল। দ্বিতীয় গ্রন্থের রচয়িতা চন্দ্রচূড় আদিত্য।  জগন্নাথমাহাত্য গ্রন্থের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত রচনাটির নাম নানাবিধ পাওয়া যায় – জগন্নাথবিজয়, জগন্নাথমঙ্গল, জগন্নাথচরিত্র, জগন্নাথমাহাত্ম্য অথবা ব্রহ্মপুরাণ।

রূপগোস্বামী যে রসশাস্ত্র প্রণয়ন করেছিলেন তার পূর্ণ অনুবাদের প্রয়োজন অনুভূত হয়নি। সে শাস্ত্রের সারসংগ্রহ করে তার তাৎপর্য সমেত কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যচরিতামৃতে ভরে দিয়েছিলেন। কিছুকাল পরে সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে কীর্তন গানে রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার সুক্ষ্ণতর অনুশীলনের হেতু রূপগোস্বামীর উজ্জ্বলনীলমণির মূল্য বাড়িয়েছিল। কীর্তনগানের  অনুশীলন কেন্দ্র বলে শ্রীখন্ডের সম্প্রদায়ের ও অঞ্চলের মধ্যে কীর্তন পদাবলী সংকলনের প্রথম ও প্রধান উদ্যোগ দেখা দিয়েছিল। সবার আগে যে বইটি  পাওয়া যায় তাকে রূপগোস্বামীর গ্রন্থের আংশিক ভাষ্য বলে নেওয়া চলে। নাম গোবিন্দরতিমঞ্জরী। রচয়িতা ঘনশ্যামদাস। বইটি সংস্কৃত শ্লোকমালায় গ্রথিত পদাবলী সংগ্রহ। সে শ্লোকরচনায় বৈদগ্ধ্যের পরিচয় আছে। বইটি পাঁচ স্তবকে ভাগ করা – গোবিন্দরত্নাঙ্কুর, গোবিন্দরতিপল্লব, গোবিন্দরতিকোরক, গোবিন্দরতিপ্রসূন, গোবিন্দরত্যামদ। প্রথমে তিন শ্লোকে গুরুবন্দনা, তারপর তিনশ্লোক ও একপদে চৈতন্যবন্দনা, দুইশ্লোক ও একপদে নিত্যানন্দ বন্দনা, দুই শ্লোক ও একপদে সনাতন-রূপ-জীব-গোবিন্দদাসের রচনার প্রশস্তি, তারপর আত্মদৈন্য নিবেদন।

রামগোপালদাসের রাধাকৃষ্ণরসকল্পবল্লী বা সংক্ষেপে রসকল্পবল্লী প্রথম পদসংকলন গ্রন্থ। পদাবলী-রচয়িতা, পদাবলী-গায়ক ও পদাবলী-রসিক ভক্ত বৈষ্ণবের প্রয়োজন মেটাবার উদ্দেশ্যে উজ্জ্বলনীলমণির নায়ক-নায়িকা প্রকরণের সংক্ষিপ্ত পরিচয় সহ উদাহরণ মালা রূপে এবং পদাবলীসংকলন গ্রন্থরূপে রসকল্পবল্লী উপস্থাপিত। বল্লীর পরিচ্ছেদের নাম কোরক। প্রথম কোরকে মঙ্গলাবরণ, দ্বিতীয়ে নায়কবর্ণন, তৃতীয়ে নায়িকার পরিবার বর্ণন, চতুর্থে ভাববিচার, পঞ্চমে নায়িকার বর্ণন, ষষ্ঠে বিপ্রলাম্ভের দিগদর্শন, সপ্তমে ভক্তি ও অনুরাগের বর্ণন, অষ্টমে নায়িকাবিভাগ বর্ণন, নবমে ও দশমে বিলাসবিবরণ, একাদশে বিবিধ লীলা বর্ণন দ্বাদশে উপসংহার। রামগোপালের দুটি ছোট রচনার পুথি পাওয়া গেছে।  একটি খুবই ছোটো, নাম অষ্টরসনিরূপণ, বিষয় রসকল্পবল্লীর অষ্টম কোরকের মত। দ্বিতীয় পুথিটি চৈতন্য-অবতারের গনোদ্দেশদীপিকার  মতো, নাম চৈতন্যতত্বসার। ব্রজলীলার পাত্রপাত্রী ও পরিবেশের সঙ্গে চৈতন্যলীলার পাত্রপাত্রী ও পরিবেশনার মিল রামগোপাল অনেকদূর পর্যন্ত দেখাতে চেষ্টা করেছিলেন। রামগোপালের পুত্র পীতাম্বরদাস পিতার আদেশে রসকল্পবল্লীর অষ্টম কোরকে বর্ণিত নায়িকাবিভাগ বিস্তারিত করে রসমঞ্জরী রচনা করেন।

বৃন্দাবনের গোস্বামীরা চৈতন্যকে রাধাকৃষ্ণের পটাবরণে ঢেকে দিলেন। নতুন করে বৈষ্ণব জীবনী রচনার প্রয়োজন অনুভূত হলো না। এদিকে বাংলাদেশে গুরুগোস্বামীরা চৈতন্যের প্রতিনিধির মতন গণ্য হচ্ছিলেন তাই তাদের জীবনীর আবশ্যকতা তাদের ভক্তশিষ্যরা বিশেষ ভাবে অনুভব করেছিলেন। নিত্যানন্দের কনিষ্ঠা পত্নি জাহ্নবা, জাহ্নবার শিষ্য ও সপত্নিপুত্র বীরচন্দ্র , গোপাকভট্টের শিষ্য শ্রীনিবাস আচার্য, লোকনাথ চক্রবর্তীর শিষ্য নরোত্তম দত্ত ও কালনার শ্যামানন্দদাস – এই সময় যে জীবনী লেখা হয়েছিল তা এই পাঁচজনকে নিয়েই। প্রথমেই নাম করতে হয় প্রেমবিলাস গ্রন্থ – রচয়িতার আসল নাম বলরাম। তবে গুরুদত্ত নাম নিত্যানন্দই ব্যবহৃত হয়েছে সর্বত্র। আরেকটি পুথির সন্ধান পাওয়া গেছে প্রেমামৃত নামে। নিত্যানন্দের কনিষ্ঠা পত্নী জাহ্নবার আদেশে যেমন প্রেমবিলাস লেখা হয়েছিল, শ্রীনিবাসের কনিষ্ঠা পত্নী গৌরাঙ্গপ্রিয়ার আদেশে তেমনি তার শিষ্য গুরুচরণদাস প্রেমামৃত লিখাছিলেন। চৈতন্যচরিতামৃতের আদিখন্ডে কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যভক্তিবৃক্ষের শাখাবর্ণন নামে মুখ্য ভক্ত ও শিষ্যদের তালিকা দিয়েছিলেন। সেইথেকে বৈষ্ণবজীবনী গ্রন্থে শাখাবর্ণন অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছিল। এই রচনাগুলো বৈষ্ণবজীবনীর এক প্রশাখা বিশেষ।  বাংলায় এই ধরণের রচনার প্রথম নিদর্শন যদুনন্দনদাসের কর্ণানন্দ বা কর্ণানন্দরস। বইটি সাত নির্যাসে সমাপ্ত। প্রথম নির্যাসে আছে শ্রীনিবাসের শিষ্যনামমালা, দ্বিতীয় নির্যাসে রামচন্দ্র, আচার্য পত্নী ঈশ্বরী, আচার্যকন্যা হেমলতা ও আচার্যপুত্র গতিগোবিন্দ – এই চারজনের শিষ্যনামমালা, তৃতীয় নির্যাসে রামচন্দ্রের মাহাত্ম্য কাহিনী, চতুর্থ নির্যাসে মল্লভূমের রাজা বীরহাম্বিরকে রামচন্দ্রের উপদেশদান, পঞ্চমে স্বকীয়া-পরকীয়া নিয়ে রাজার সংশয় ও জীবগোস্বামীর পত্রে সংশয়চ্ছেদ, ষষ্ঠ নির্যাসে রামচন্দ্রকৃত আচার্যবন্দনা উদ্ধৃত, সপ্তম নির্যাসে রঘুনাথগোস্বামীর তিরোভাব বিষয়ে যদুনন্দনের সংশয় ও হেমলতা কর্তৃক সে সংশয়চ্ছেদ। চৈতন্যর প্রতিবেশী ও ভক্ত বংশীবদন চট্টর জীবনমাহাত্ম্য দু-তিন খানি গ্রন্থে গ্রথিত হয়েছিল। রাজবল্লভ রচিত বংশীবিলাস নামান্তরে মূরলীবিলাস এবং প্রেমদাস বিরচিত বংশীশিক্ষা। গোপীজনবল্লভদাস শ্যামানন্দের প্রধান শিষ্য রসিকানন্দের জীবনী রচনা করেছিলেন, নাম রসিকমঙ্গল। রসিকমঙ্গল বর্ননাময়, শুধু ভক্তি উচ্ছ্বাসময় নয়। বইটিতে যে প্রথম সাতটি শ্লোক আছে তার প্রথম দুটিতে শ্যামানন্দের স্তুতি, তৃতীয় শ্লোকে রসিকানন্দের স্তুতি, চতুর্থ শ্লোকে ছয় গোস্বামীর বন্দনা, পঞ্চমশ্লোকে আবার শ্যামানন্দের বন্দনা, ষষ্ঠ শ্লোকে ফের রসিকানন্দের বন্দনা, সপ্তম শ্লোকে দ্ব্যর্থে কৃষ্ণের ও রসিকানন্দের বর্ণনা।

ঋণ স্বীকার :
১) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস দ্বিতীয় খন্ড – ডঃ সুকুমার সেন
২) বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা প্রথম পর্যায় – শ্রী ভূদেব চৌধুরি
৩) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আদি ও মধ্য যুগ – ডঃ দেবেশ কুমার আচার্য
৪) বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক ইতিহাস – ডঃ দীপঙ্কর মল্লিক
লেখক পরিচিতি
শৈবাল বসু

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পদার্থ বিদ্যা নিয়ে স্নাতক। পেশাগত ভাবে গত ৩৪ বছর ধরে ব্যাঙ্কার। নেশাগত ভাবে শরদিন্দু ও ইতিহাস প্রেমী। বর্তমানে কলকাতা ও বাংলার ইতিহাস নিয়ে চর্চারত।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!