Home গল্প সুরের আকাশে
গল্প

সুরের আকাশে

কলমে কল্পনায় – শিবনাথ ভট্টাচার্য্য


নমস্কার। সুধী দর্শকবৃন্দদের জানাই আমার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। আশাকরি সবাই ভালো আছেন। এবার আমাদের নবকল্যান সমিতির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের রজত জয়ন্তী বৎসর। এ বছর আমরা কাছে পেয়েছি এমন একজনকে, যিনি সঙ্গীতের জগতে নক্ষত্র বললেও কিছু কম বলা হবে। প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের সুর শ্রষ্ঠা স্বনামধন্য পণ্ডিত মুরলীধরণ! ভারতের ক্ল্যাসিকাল মিউজিক এর ধারার সঙ্গে যার এক আত্মার সম্পর্ক। দেশে বিদেশে তাঁর খ্যাতি আজ সর্বজন বিদিত। আর মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি মঞ্চে অবতীর্ণ হবেন। আপনাদের দীর্ঘ অধীর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে। দয়াকরে আপনারা ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থেকে যে যার আসন গ্রহন করুন। আমরা জানি একটা দীর্ঘ সময় ধরে আপনারা অপেক্ষায় রয়েছেন। তবে আর মাত্র ক্ষনিকের অবসর। সেই সময়টুকু আপনাদের কাছে চেয়ে নিচ্ছি। আশাকরি এটুকু সহযোগিতার হাত আপনারা নিশ্চয়ই বাড়িয়ে দেবেন। পরিশেষে উপস্থিত সকলকে পুনরায় আমার হার্দিক উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে আপাতত আমি মঞ্চ ছাড়লাম। ধন্যবাদ।

এইমাত্র সঞ্চালকের ঘোষণার মধ্যে দিয়ে অডিয়েন্স নড়েচড়ে বসে। আস্তে আস্তে পরিবেশ পাল্টায়। একে একে ভলেন্টিয়ার্সদের হাত ধরে মঞ্চে এনে হাজির করা হয় এসরাজ পাখোয়াজ সেতার সারেঙ্গী এমন আরও বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্র। সেইসব নির্দিষ্ট জায়গায় স্থানান্তরিত ও অ্যারেঞ্জ করতে যেটুকু যা সময়ের বিরতি। দেখা যায় সেখানে তারই একপাশে একটি আলাদা করে আসনের ব্যবস্থা রাখা রয়েছে। শিল্পীরা একে একে মঞ্চে উঠে আসেন। এবং যে যার আসন গ্রহণ করার পর, মুরলীধরণ একটি ছোট্ট ফুটফুটে বছর পাঁচেকের শিশুকে সঙ্গে নিয়ে এসে উপস্থিত হন। আলাদা করে নির্দিষ্ট করে রাখা সেই আসনে ছেলেটিকে বসিয়ে দিয়ে তিনি তাঁর নির্বাচিত স্থান গ্রহণ করেন। মুহূর্তে অডিটোরিয়াম হাততালিতে ফেটে পড়ে। সেইসঙ্গে শুরু হয়ে যায় মৃদু গুঞ্জন! “কে এই ছেলেটি, সংগীতের সঙ্গে তার কিইবা পরিচয়, কেনই বা তাকে মঞ্চে নিয়ে আসা হল”? এমন অজস্র প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এই শোরগোল। এর কিছুক্ষণ পর পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলে, মুরলীধরণ নিজেই ছেলেটির পরিচয় ঘটিয়ে দেন উপস্থিত শ্রোত্রিমন্ডলীর সাথে।
— প্রথমেই উপস্থিত প্রত্যেককে আমার ঐকান্তিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। এতক্ষণ ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করার জন্য আপনাদের আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। আজকে এই মঞ্চে আমার সঙ্গে উপস্থিত রয়েছেন স্বনামধন্য বিশিষ্ট বাদ্যকরেরা। তাঁদের পরিচয় আশাকরি আলাদা করে দেবার কোন প্রয়োজন নেই। যারা উপস্থিত আছেন তাদের আপনারা প্রত্যেকেই চেনেন জানেন। তাই আলাদা করে পরিচয় ঘটানোর কোন আগ্রহ বোধ করছিনা। এনারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব স্থানে যথেষ্ট যোগ্যতার সাথে সুপ্রতিষ্টিত। আপনারা এই গুনি শিল্পীদের ইতিপূর্বে নানান অনুষ্ঠানে টিভিতে বাজাতে দেখে থাকবেন। পরিশেষে জানাই, এই যে ছোট্ট ছেলেটিকে দেখছেন সে একজন অত্যন্ত সেনসেটিভ একটি বালক! আমার একমাত্র সন্তান। প্রতিটি প্রোগ্রামে সাধ্যমত সে আমার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকে। একজন বিশিষ্ট শ্রোতা হিসেবে তাকে আমি মানি। সুরের কান তার এতটাই পরিষ্কার, যা বিস্ময়ের এক নজির! তো আসুন। এবার আমরা সুর সাগরে ডুব দিই।

এরপর মুরলীধরণ শুরু করেণ তার মার্গ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান। রাত তখন একটু বেশিই। শুরু হয় তার দরবারী কানাড়া দিয়ে সুরের আরাধনা। দেখতে দেখতে রাত আরও বাড়ে। অনুষ্ঠান যত এগোয়, তাঁর সুরের মায়াজালে দর্শক ততই গভীর আবেকে মোহিত হতে থাকেন। ক্রমে গুরু গম্ভীর এক পরিবেশ! কোথাও কোন সুর ব্যাতিরেখে আওয়াজের বিন্দুমাত্র প্রকাশ নেই। সুরের আবেসে এতোটাই আচ্ছন্ন শ্রোতা সাধারণের ভাবাবেগ। এক সময় সেই বালক সুরের লয় কারিতে তার কানে কোথায় যেন সামান্য খটকা অনুভব করে। তাতে নাহ্ বলে সে মৃদু আওয়াজ করে বসে। মুহূর্তে অত্যন্ত দ্রুততায় চোখ চাওয়া-চায়ী হয়ে যায় বাপ ব্যাটায়। সবার অলক্ষ্যে। চোখের পলকে তা শুধরে নিয়ে পুনরায় মুরলীধরণ তার চলমান রাগ সঙ্গীত সচল রাখেন। উপস্থিত দর্শক তার বিন্দু বিসর্গও টের পাননা। এক সময় রাত্রি আরও গাঢ়ো হয়। আলাপের পর বিস্তার অতি মাত্রায় তার সুরমূর্ছনায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় এই স্বর্গীয় বেষ্টনীময় মায়াবী রাত! সেই সুর ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর রূপ নিয়ে এক সময় তার ইতি টানে। পণ্ডিতজী এরপর মঞ্চ ছেড়ে নীচে নেমে আসেন। মুহূর্তে রিপোর্টাররা তাঁকে চারিদিক থেকে একেবারে ছেঁকে ধরেন। সেই সঙ্গে বিস্তর প্রশ্ন ধেয়ে আসতে থাকে এক এক করে তাদের দিক থেকে। যারাই এতক্ষন ধরে প্রোগ্রামটা কভার করেছেন, তারাই এখন অদ্যকার প্রভাতি নিউজের হেডলাইন করার স্বার্থে নাতিদীর্ঘ নোটস তাঁর কাছ থেকে ক্রমান্নয়ে নিতে থাকেন। আর সঙ্গে সঙ্গে তা পৌঁছেও যায় ইলেকট্রনিক্স সিস্টেমে এক একটা সংবাদ মাধ্যমের দপ্তরে। একসময় তাদের প্রশ্নে উঠে আসে বিস্ময়কর বালকের কথা। তার টুকরো টুকরো সম্ভবনার কিছু নিদর্শন জানতে চাওয়ার আবদার।

মুরলীধরণ এই প্রশ্নে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। ভেবে পাননা এর কি উত্তর দেবেন। শুধুমাত্র তাঁর অনুমানেরর উপর ভিত্তি করে কি এই মুহূর্তে কোন জবাব হতে পারে? তবু তিনি সাধ্যমত কিছুটা তার আভাস দেওয়ার চেষ্টা করেন।
— আসলে এই মুহূর্তে এর কোন প্যাসিফিক নিদর্শন আমার হাতে নেই। তবে অনুমানের উপর ভিত্তি করে একটা সম্ভবনা আমার মধ্যে তৈরী হয়েছে। কিছুটা বা উপলব্ধিও। এমনই অনুভব যা কিনা আমিই শুধু অনুমান করতে পাচ্ছি। ওর ছোট ছোট কিছু কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে। আগামী দিনে হয়তো বা তার এই ব্যাপ্তি সুরের জগতে একটা বিপ্লব এনে দিতে পারে! সেদিন আমি বেঁচে থাকবো কিনা জানি না, তবে আমার আজকের এই অনুমান সেদিন হয়তো যথার্থ বলে বিবেচিত হতে পারে। সময় তার উত্তর দেবে আশাকরি। আপাতত আর কিছু বলার নেই। ব্যাস এইটুকুই।

এরপর এই মহাকাশের উপর দিয়ে বয়ে গেছে আরও বেশ কয়েকটা বছর। পরিবেশ পরিস্থিতি কোন দিনই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেনি থাকবেও না। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম কিছু ঘটেনি। পরিবর্তনশীল সমাজে পরিবর্তন এসেছে সর্বত্র। কিছু ক্ষেত্রে বিপ্লবও। সেই বালক এখন যুবক। ক্যালিফোর্নিয়ার একটি গবেষণাগারে সুর আর স্বরের ওপর তার রিসার্চ কমপ্লিট করে সে ফিরে এসেছে দেশে। মাত্র কিছুদিন আগে। ও দেশে ইতিমধ্যে তার থিসিসে প্রানিত হয়ে বহু ছেলে-মেয়ের মধ্যে মিউজিক নিয়ে বিস্তর ভাবনা চিন্তা শুরু হয়ে গেছে। সেদিন স্বদেশের মাটিতে একটি ভাষনে শুনছিলাম তার প্রাঞ্জল বক্তব্য।
— সুর প্রকৃতির দান। যা কিছু সৃষ্টি এখান থেকেই। যাকিছু পেয়েছি এখানেই। নতুন করে গবেষনা মূলক যাকিছু সৃষ্টি আত্মপ্রকাশ করেছে কি করছে, তার উপাদান সংগ্রহ করা হয়েছে এখান থেকেই। কোনটাই কেউ জন্মসূত্রে বয়ে আনিনি। আর আছে আমাদের আবেগ। এই দুইয়ের মিলিত মিশ্রনের ফলশ্রুতি সংগীতের এই সুর বৈচিত্রের গ্যালাক্সি! শুধু কিছু একাগ্র চিত্তের মানুষ, সেই স্বর্গীয় আনন্দ খুঁজে পাওয়ার কাজটা বিশুদ্ধ মননে দিনের পর দিন চালিয়ে গেছেন। তার বহমান সে ধারা আজও অবিচল। তাতেই “Music is a Part of Life” এই sentence-টা আমাদের জীবনের সঙ্গে আজ একেবারে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ শ্রষ্ঠার সুনির্দিষ্ট চর্চার মধ্যে দিয়েই তা সম্ভব হয়েছে। আমাদের গভীর অন্তরে অনুরণন ঘটিয়ে! এটা আজ প্রমানিত, music এক বৈজ্ঞানিক মাত্রা পেয়ে যন্ত্রণার উপশম ঘটায়। আবার তার অশুভ প্রয়োগে পক্ষান্তরে যন্ত্রণার উদ্রেক ঘটায়। সুতরাং সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধটা জরুরী। যা জন্ম দিতে পারে সুস্থ অনুভূতির। এক একজনের এক এক রকম ধারা। তাই নানান ঘরানার নানারূপ প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। যুগ যুগ ধরে তা চলে আসছে। আমি আমার অনুসন্ধিৎসু মননে এমনই একটি ভীন্ন ধারার অনুসন্ধান করে চলেছি। আশাকরি অচিরেই তা নতুন ভাবনার একটা দিক উন্মোচন করবে। আমার এই প্রচেষ্টার নাম “আদি অনন্ত সুর লহরী”। নিজের নাম অনন্ত’র সঙ্গেই তাকে জড়িয়ে রাখলাম।
এই বলে আর কোন কথা না বাড়িয়ে সে তার বক্তব্য শেষ করে।

এরও বেশ কিছুদিন পর প্রভাতী সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় একটি খবর প্রকাশিত হয়। বাঙালি যুবকের বিস্ময়কর সুরের মায়াজাল! Organised by California musical Academy প্রযত্নে আদি অনন্ত সুর লহরী। শহরের প্রাণ কেন্দ্রে বিখ্যাত Stadium-এ সেই বিচিত্র সুরের অভূতপূর্ব এক মেল বন্ধন! নির্দিষ্ট দিনে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মিলিত প্রয়াশে তিন দিন ব্যাপি অনুষ্টিত হবে সেই সুরবন্দনা। অচিরেই শহরের দিকে দিকে তার ব্যানার পোষ্টার হোডিং-এর ছয়লাপ! ক্রমশ আরও আকর্ষণ বাড়িয়ে ফেসবুক টুইটারে তার পোস্ট একপ্রকার ভাইরাল। কি হবে, কি হতে যাচ্ছে তাই নিয়ে একটা বিচিত্র চর্চা এখন শহরের সর্বত্র। ঘরে বাইরে তার প্রভাব পুরো মাত্রায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আসন্ন দিনের দুদিন আগে বিদেশি শিল্পীরা এসে হাজির হয়ে গেছেন। সঙ্গে তাদের প্রচুর লটবহর। যা কিনা আরো বেশি করে উৎসুক মানুষ জনের মনে জানার আগ্রহ বাড়ায়। শিল্পীর সঙ্গতের বাদ্যযন্ত্রাংশ কই কোথায়? শুধু দেখা যায় কিছু খাঁচাবন্দি বাক্স পেটরা! ফলে আকর্ষণ যেন আরো চরমে পৌঁছেছে মানুষের।

আসন্ন দিনে stadium ঘিরে যেন মানুষের ঢল! টিকিট নিঃশোষিত। কোথাও তিল ধরনের বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। অদ্ভুত এক নতুনত্বের দিশা জাগিয়ে এ কোন মহা সিন্ধুপারের সুরের জাদুকর নেমে এসেছেন মর্ত্যে!? জানতে যে হবেই। যে করেই হোক। এই মুহূর্তে অনেকের হাতে টিকিট নেই। তবে তা না থাকলেও হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। টিভিতে গোটাটাই telecast হবে বলে জানা গেছে। সুতরাং এতেই নিশ্চিন্ত বাকিরা। সকাল থেকে সময় যত এগিয়েছে ততই মানুষের অনুসন্ধিতসু মন কেবলই অপার উত্তেজনায় ভীড় জমিয়েছে যে যার টিভির পর্দায়। ইতিমধ্যে নবকল্যাণ সমিতির ছেলেরা জায়েন্ট স্ক্রিন লাগিয়ে দিয়েছে ক্লাব সংলগ্ন প্রাঙ্গণে। ভীড় সেখানেও নেহাত কম নয়। আজ সর্বত্র যেন এক অন্যরকম উৎসবের মেজাজ! গোটা ক্লাবের সদস্যবৃন্দের তাই নিয়ে অদ্ভুত মাতামাতি। আর হয়তো কিছুক্ষণ বাদেই শুরু হয়ে যাবে কাউন্টডাউন। যারা ভাগ্যবান, সরাসরি দেখার সুযোগ পেয়েছেন তারা এতক্ষণে stadium-এ প্রবেশ করে গেছেন আশাকরি।

ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সাংবাদিক তথা টিভি চ্যানেলের লোক জনেরা বাইট হাতে প্রস্তুত। আছেন তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রেক্ষাগৃহের এলাকা জুড়ে। আর রয়েছেন বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে তাক করা বেশ কিছু ক্যামেরাম্যান। তাদের ক্যামেরা হাতে মঞ্চের প্রতি দৃষ্টি স্থির করে। রয়েছেন সেখানে প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের বেশ কিছু লোকজনও। ইতিমধ্যে শহরের বিশিষ্ট গুণীজনেরা এসে গেছেন। উপবিষ্ট হয়েছেন তাঁরা তাদের নামে নির্দিষ্ট করা আসনে। একেবারে মঞ্চ সংলগ্ন প্রথম সারিতে। এই মুহূর্তে অনন্ত শুরু লহরীর স্বেচ্ছাসেবক বৃন্দ সমগ্র অনুষ্ঠানটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সামগ্রিক ভাবে দেখভালে ব্যস্ত। সম্পূর্ণ মঞ্চ এখন কালো পর্দায় আচ্ছাদিত। নির্দিষ্ট সময়সূচী ছাড়া এই অনুসন্ধিৎসু স্ক্রীন কোন ভাবেই উন্মোচিত হবার নয়। ততক্ষণ অধীর অপেক্ষায় জনতার রীতিমত ধৈর্যের পরীক্ষা! অজস্র শ্রোতার বিস্মিত চোখ এখন কালো পর্দা ঘিরে! এদিকে অনুষ্ঠান শুরু হবার এখনও মিনিট পাঁচেকের মত বাকি। ইতিমধ্যে পরপর দুটি বেল বেজে গিয়েছে। শেষোক্ত ঘণ্টার অপেক্ষায় যে যার এখন নিজের নিজের হাত ঘড়িতে ঘন ঘন চোখ বোলাচ্ছেন।

অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার হল অবসান। আস্তে আস্তে মঞ্চের পর্দা একটু একটু করে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। অন্ধকার পরিসরের ভেতরটায় এখন ডিমারের আলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে। তাতেই আলো-আঁধারির রঙিন খেলা! তারই সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রেখে শুরু হয়ে গেলো মনমুগ্ধকর এক বন্দনা সংগীত! তবে তা মানুষের কণ্ঠে নয়। এক ঝাঁক পাখির সুরেলা কলতান। অপূর্ব সে রাগাশ্রয়ী সুরমূর্ছনা! এতো মিষ্টতা এমন সুরেলা তাদের স্বরক্ষেপণ, মন মাতিয়ে দিয়ে যায়। দর্শকাসনে ক্রমশ সুরের ঘোরে বুঁদ হয়ে বসে রয়েছেন আপামর শ্রোত্রিমন্ডলী! অযাচিত শব্দহীন প্রেক্ষাগৃহ তখন যেন সুরের মায়াজালের বেষ্টনীতে ঘেরা! দৃশ্যত তাদের শ্রবন ইন্দ্রিয়তে সে এক অন্য রকম আবেশ। সমগ্র auditorium-এ তখন অদ্ভুত এক ধ্যানমগ্নতার পরিবেশ! নিছক পাখিদের এমন মঞ্চ মাতানো প্রোগ্রামে বাকরুদ্ধ! ভাবেন সবাই এও কি সম্ভব? এমনই মনোজ্ঞ সংগীতের অনুষ্ঠানটি এক সময় সমাপ্ত হতেই করতালির চাইতেও সকলের বিস্ফারিত দৃষ্টি তখনই গোটা মঞ্চ জুড়ে! এতক্ষণ যে symphony তৈরী হল, দেখা যায় সেখানে কোন মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট নেই। স্টেজের নান্দনিক দৃশ্যমানতার অবস্থান বজায় রেখে এক ঝাঁক দেশি বিদেশি পাখি! তারাই আজ সুরের জাদুকর। মঞ্চ জুড়ে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে non-traditional কিছু musical appliance, যাকিনা সুরের মাধুর্য্যের পরিমন্ডল রচণা করে। এ সবই এক ধরনের experimental যন্ত্রাংশ। কিছুক্ষণ পর তারই ব্যাখ্যা দিতে এগিয়ে এলেন শ্রষ্ঠা তথা গোটা শিল্প কর্মের আজকের কর্ণধার মাননীয় শ্রীযুক্ত অনন্ত কুমার।

— বন্ধুগণ আজ এমন কিছু বিষয়ে আলোকপাত করব যা ছিল এযাবৎকাল মানুষের একচেটিয়া অধিকারের একচ্ছত্র আধিপত্য। আমি সেই ধারাকে ভাঙতে চেষ্টা করেছি মাত্র। সা রে গা মা পা ধা নি এই সাতটা স্বরের উপর দাঁড়িয়ে সুরের ভিত্তিপ্রস্তর। যা কিছু রাগ রাগিনী এখান থেকেই সৃষ্টি। আমি আমার শৈশবে এমনটাই জেনে শিখে বড় হয়েছি। আমি দেখেছি আমার পিতৃদেব মুরলীধরণ আজীবনকাল তার নিরলস প্রচেষ্টায় সঙ্গীতের সাধনা করে গেছেন। বরাবরের তাঁর এমনই এক traditional ধারার উপর ভিত্তি করে। আমার প্রথম থেকেই সংগীতের নাড়া বাধা তাঁর কাছে। সেখান থেকেই আমাকে তিনি basic-টা জানতে সাহায্য করেছেন। তারপর পদার্পণ আমার আজকের এই বৃহত্তর অঙ্গনে। আজ তাই তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন। শুধুমাত্র তাঁকে স্মরণ করেই আজ আমার এই মঞ্চ নির্মাণ প্রকল্প তৈরী করা হয়েছে। তাই এই মঞ্চের backstage তাঁরই অজস্র সফল অনুষ্ঠানের প্রতিচ্ছবিতে চিত্রায়িত। তবে এই দিনটা জীবিত অবস্থায় তাঁকে উপহার দিতে না পারার আক্ষেপটা আমার কিন্তু রয়েই গেলো। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে আমি আমার এই অভিনব উদ্যোগের ইতিহাস তুলে ধরবো। আপাতত আর একটি ধ্রুপদী সংগীত দিয়ে বরং আপনাদের মনোরঞ্জন হোক। সুদুর অস্ট্রেলিয়ার গভীর অরণ্য থেকে আগত আমার আজকের এই শিল্পী মুনিয়া এখন তার দক্ষতা প্রমান করবে। সঙ্গে সেতার বেহালা সারেঙ্গী পাখোয়াজ এমনকি সংগতে থাকছেনা কোনরকম চামড়ার বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। যাদের নিয়ে আজকের এই সুরতরঙ্গ সৃষ্টি করা হবে, তারা সবই আমাদের জনজীবনের অবহেলিত বাতিল কিছু বস্তু সামগ্রী! গোটাটাই Organised by birds and animals দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তো আসুন আমরা আবার একটু সুর সাগরে ডুব দিই।

শুরু হলো আবার এক মোহময়ী সুরের মায়াবী পরিবেশ! ক্রমশ মন্ত্রমুগ্ধের মত আচ্ছন্ন করে রাখে তাদের পরিশীলিত কীর্তি! সুদীর্ঘ মঞ্চ ঘিরে আজ শুধু মনুষ্যবিহীন পাখি আর জন্তু-জানোয়ারের অনুপ্রবেশ। অবাক করে এই সান্ধ্য পরিবেশ! এক অসামান্য দক্ষতায় তাদের মধ্যে অদ্ভুত এক প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে! মুহূর্তে চমকে দিয়ে যায় stadium-এর প্রত্যেকটা শ্রোতাকে। মন্ত্রমুগ্ধের মত তারা তাদের শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে অনুভব করেন এক স্বর্গীয় সুখ! একে একে বিভিন্ন জাতের পাখিদের vocal cord আর বনের অন্যান্য প্রাণীদের নির্ভুল সঙ্গত যে কোন মাত্রায় পৌঁছতে পারে, তার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে রইল আজকের এই সন্ধ্যা! শুধু কিছু দক্ষ কারিগর যারা আগত সাত সমুদ্র পেরিয়ে, তাদের নিরলস প্রচেষ্টায় এই মাত্রা পেয়েছে। আর তার মূল কারিগর যিনি, তিনি সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলে মুরলীধরণের একমাত্র পুত্র অনন্ত সুন্দর।

প্রায় এ ধরণের আড়াই ঘন্টা প্রোগ্রামের শেষে সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরেন। অজস্র প্রশ্নবাণের উত্তর দিতে স্রষ্টার কালঘাম ছুটে যাচ্ছে! শেষে সামগ্রিক প্রশ্নগুলোকে একত্রিত করে অনন্ত বলতে শুরু করেন।
— দেখুন আমার প্রথম থেকেই একটা সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল। মানুষের কন্ঠের কি দামি instrument-এর এতকালের সুর সৃষ্টির দক্ষতা আমরা দেখেছি। এবার বুঝি একটু অন্য ভাবে ভাবা যেতে পারে। তাই নিয়ে আমার সর্বক্ষণের experiment এক অন্য মাত্রা পায়। সুযোগ পেয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার Musical Organisation-এ দীর্ঘদিন গবেষণা করি। আজ যারা এখানে এসেছেন তাদের সঙ্গে নিয়ে। দিনের পর দিন পৃথিবীর জঙ্গলে পর্বতে পাগলের মতন ছুটে বেরিয়েছি। sound collection করার অভিপ্রায়ে। দিনের পর দিন রাত কাটিয়েছি জঙ্গলে। সংগ্রহ করে এনেছি তাদের সুরের, আবেগের বহুমুখী স্বরক্ষেপন। সুদূর সাইবেরিয়ার সমুদ্র তটে অপেক্ষায় থেকেছি কি ভাবে সঙ্ঘবদ্ধ হলে তারা একে অপরকে প্রেম নিবেদন করে। সেই সব আওয়াজ collect করে আমার গবেষণার যাত্রা শুরু। তারপর বিচিত্র জাতের বিচিত্র ধরনের পশু পাখির বাচ্চা ধরে এনে চলে দিনের পর দিন প্রশিক্ষন। আজ তারই ফলশ্রুতি আমার এই ভিন্নমাত্রার musical journey আপনাদের পাদপ্রদীপের স্পর্শ পেয়ে আজ parallel সুরের স্বাক্ষর বহন করে।

সাংবাদিকরা এমনই দুষ্প্রাপ্য খবর সংগ্রহ করে প্রভাতী সংবাদপত্রে তাদের যে যার দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে উঠে পড়ে লেগে যান। নতুন দিগন্ত উন্মোচিত এই খবর public-কে কে কতটা খাওয়াতে পারে তারি প্রতিযোগিতায় উঠে পড়ে লেগে যান।


শিবনাথ ভট্টাচার্য্য

আমি সময়ের ফেরিওয়ালা। তুলে আনি অনুভবের মুলধণ জাগতিক এই সমাজ জীবন থেকে। তাকে কল্পনার রূপ দিয়ে ভবিষ্যতের বার্তা দিই। আশাবাদী মনের সেইসব গল্প ফেরি করাই অধমের লক্ষ্য। ইতিপূর্বে 2015 সালে আমার লেখা প্রথম সংস্করণ “ভাঙন” কবিতার বইটি আত্মপ্রকাশ করে। সেই থেকে পথ চলা শুরু। এছাড়াও “স্বীকৃতি” আমার দ্বিতীয় একটি প্রথম গল্পের বই (ফিল্মের জন্য নির্দিষ্ট)। ছ’টি গল্পের ভান্ডার নিয়ে পাঠককূলে স্বমহিমায় সুধী জনমানসে বিরাজ করছে। এমাজন, ফ্লিপকার্ট, এডিসন নেস্ট ডট কম তার পূর্ণ মার্কেটিং এর দায়িত্বে আজও নিয়োজিত। অধীনের পরবর্তী বইও আত্মপ্রকাশের মুখে। আপাতত এটুকুই আমার পরিচয়ের উত্তরীয়।
শুধুমাত্র মানুষের গ্রহন করার অদম্য ভালোলাগাই আমার পাথেয়। তাকেই আমার অজস্র কুর্নিশ।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!