গল্পরহস্য ও ভৌতিক

হীরা চুরি

অগ্নিধ্রু

প্রথম পর্ব

“মা, প্রান্তর এখনও বাড়ি ফেরেনি?”

প্রান্তর। পুরো নাম প্রান্তর রায়। ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয় টিউশানিতে আর সেখান থেকেই বন্ধুত্ব। ও গ্রামের ছেলে। গ্রামকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু আজ সভ্যতার কাছে হেরে গিয়ে এই শহরে থাকতে, একপ্রকার বাধ্য হয়েছে। তার এই বাধ্যতার কারণ অথচ একটাই, পড়াশোনা। আমরা দু’জনই টাকী সরকারী কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র।কিন্তু এখনও যেহেতু কলেজ আরম্ভ হয়নি। শুধুমাত্র টিউশানির সুবিধার জন্যই প্রান্তর আমাদের বাড়িতে উপরের একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। 

প্রান্তরকে প্রথম দিন দেখেই ধারণা করেছিলাম যে ওর বইয়ের প্রতি আগ্রহ খুব। আমার সেই ধারণা সত্যি হল যখন দেখলাম আমাদের বাড়িতে আসার সময় দুই ব্যাগ ভর্তি শুধু বই। পড়ার বইয়ের পাশাপাশি আরও  নানা ধরনের গল্পের বই, ব্যোমকেশ, ফেলুদাও বাদ নেই। বাদ নেই শার্লক হোমস সহ আরো নানান ডিটেকটিভের গল্প। এই মাসখানেক হল ও এসেছে। ওকে দেখে যা বুঝলাম — তা হল ও একটু সত্য অন্বেষণ করতে ভালোবাসে।

প্রান্তর শ্যাম বর্ণ হলেও স্বাস্থ্যবান আর খুব চতুর।ওর উচ্চতা ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি। মানে আমার থেকে ২ ইঞ্চি বেশি। প্রান্তর একটু উদাস প্রকৃতির। মাঝে মাঝেই  দেখি ও অবাক হয়ে কি ভাবে।কয়েক দিন আগে ওর ঘরে গিয়ে একটা ডাইরি খুলে দেখি কিছু কবিতা লেখা।কবিতাগুলো সবই প্রেম বিরহ নিয়ে। সম্ভবত প্রান্তরের লেখা। 

এবার আসল কথায় আসি। আজ আমাদের এক বন্ধু রাজদীপ  রায়চৌধুরীর জন্মদিন ছিল। আমি, প্রান্তর সহ আমরা মোট পাঁচজন বন্ধু গিয়েছিলাম। আমরা সবাই মিলে রাজকে একটা দামি ঘড়ি উপহার দিয়েছিলাম। রাজ খুব খুশি আমরা যাওয়াতে। এছাড়াও আরো অনেকেই এসেছিল।যেমন, ওর মামা- মামি, জ্যাঠা- জ্যেঠি, পিসি সহ আরো কিছু নিকট আত্মীয়। 

এখন একটা কথা বলে রাখা ভালো। রাজদীপ বুদ্ধিমান আর যথেষ্ট রসিক একজন। ওর মুখে আজও কখনও দুঃখের রেশ দেখিনি। সবসময় দেখেছি হাসতে ও হাসাতে। তবে যাই হোক,যতদূর রাজের মুখে শুনেছি সেটা হল এই যে, ওর পূর্বপুরুষরা এক সময় এখানকার জমিদার ছিলেন। তারাও নাকি খুব হাসিখুশি ছিলেন। রসিক ছিলেন। সেসব অনেক অনেক বছর আগের কথা। এখন সেই রাজপ্রাসাদের অবস্থা খুব শোচনীয়। সেজন্য ওরা পাশে নতুন বাড়ি করেছে। তবে তাদের সেই জমিদারিত্ব আজ না থাকলেও কিছু নীতি আজও তারা মেনে চলে। যেমন পরিবারের ছেলেদের আঠারো বছর পূর্ন হলেই তার জন্মদিনে তাকে একটা হীরার আংটি দেওয়া হয়। আর আংটিটা অবশ্যই বাবা পরিয়ে দেয়। আজ রাজের বয়স আঠারো পূর্ন হল। 

আমরা সহ রাজেদের বাড়িতে মোট কুড়ি জন মতো হবে। সেই পুরানো রীতি অনুযায়ী রাজের জন্মদিন পালন হল। ওর বাবা অর্থাৎ অভিলাষ রায়চৌধুরী ওর আঙুলে একটা হীরের আংটি পরিয়ে দিলেন।তারপর অনেক আড্ডা, হাসি, মজা করলাম। অবশেষে খাওয়া দাওয়া করে ফেরার কিছুটা আগে প্রান্তর আমাকে  বলল, “আমি চ্যাটার্জী লাইব্রেরীতে যাচ্ছি, তুই ওদের সাথে বাড়ি চলে যাস।” কেন এখন লাইব্রেরীতে যাচ্ছে সেটা জিজ্ঞাসা করার আগেই ও চলে যায়। তারপর আমি অন্য বন্ধুদের সাথে বাড়ি চলে আসি। কিন্তু মা জানাল এখনও প্রান্তর বাড়িতে আসেনি।  

এতক্ষণ এত কথা বললাম কিন্তু নিজের নামটাই এখনও বলা হয়নি। আমি দেবাকর দত্ত। সবাই ‘দেবা’ বলেই ডাকে। 

“কি ব্যাপার দেবা! এভাবে অবচেতন, উদাস হয়ে কি ভাবছিস?”– বলল প্রান্তর। 

আমি রেগে গিয়ে বললাম,”তোর কথা ভাবছি। ভাবছি এত রাতে লাইব্রেরীতে যাওয়ার কি প্রয়োজন ছিল, কাল যেতে পারতিস তো।”

তারপর প্রান্তর আমার খাটের উপর লম্বা  সটান হয়ে শুয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা বই অর্ডার দেওয়ার ছিল। তাই গিয়েছিলাম।” তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, “কাল যেতে পারতাম কিন্তু কাল গেলে বইটা হাতে আসতে আরও দেরী হয়ে যেত। কাল বুধবার সকালেই তো ওরা বই আনতে কলকাতা যাবে।”

দু’জনে আরও কিছুক্ষণ নানান বিষয়ে গল্প করে তারপর প্রান্তর নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

দ্বিতীয় পর্ব

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল প্রান্তরের ডাকে। ব্যস্ততার সাথে বলল, “তাড়াতাড়ি ওঠ। গুছিয়ে নে। রাজদীপদের বাড়িতে যেতে হবে।”

আমি অবাক হয়েই বললাম, ” কেন? এখন ওদের বাড়িতে যাবো কেন?”

প্রান্তর গুছাতে গুছাতে বলল, ” রাজের হীরের আংটির হীরেটা চুরি হয়ে গেছে। ও ফোন করেছিল। তাড়াতাড়ি যেতে বলল। এর বেশি আমি কিছু জানি না।”

তারপর মিনিট দশেকের মধ্যেই আমি গুছিয়ে নিয়ে প্রান্তরের সাথে রাজদের বাড়ির জন্য বেরিয়ে পড়লাম। যেতে যেতে প্রান্তরকে বললাম, ” আচ্ছা, আমাদের ডাকার কারণটা কি? ওর কি সন্দেহ আমাদের প্রতি নাকি!” কিন্তু প্রান্তর কোনো উত্তর দিল না। 

গিয়ে দেখি রাজদীপদের বাড়িতে যথেষ্ট শোরগোল পড়ে গিয়েছে। পুলিশও এসেছে দেখলাম। আমাদের দেখেই রাজদীপ ছুটে এলো। ওর মুখটা দেখে বুঝলাম, বেচারা বড়ো কষ্ট পেয়েছে হীরা চুরি হওয়ায়।সে প্রান্তরের হাতে হাত রেখে বলল, “শুনেছি, তুই ডিটেকটিভ গল্প পড়তে ভালোবাসিস। সত্য অন্বেষণ করতে ভালোবাসিস। তাহলে যে করেই হোক আমাদের ঐতিহ্যকে খুঁজে দে ভাই।” প্রান্তর আমতা আমতা করে বলল, “পুলিশ আছেন তো, ওরাই খুঁজে দেবেন। তুই  আমাকে বলছিস কেন?” একথা বলে চলে আসার জন্য সবেমাত্র ঘুরেছি, অমনি রাজ বলল, ” তুই যদি আমার ভালো বন্ধু ভাবিস তাহলে তুই কখনও এটা এড়িয়ে যাবি না। আমার বিশ্বাস, পুলিশের আগেই তুই এর রহস্যভেদ এবং অপরাধীকে খুঁজে বের করতে পারবি।” একথা শোনার পর, বলার মতো আর কোনো কথা থাকে না। অগত্যা প্রান্তরকে দায়িত্বটা নিতেই হলো। 

তারপর প্রান্তর মিনিট দুয়েক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর, মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “আচ্ছা, আমরা কাল চলে যাওয়ার পর ঠিক কি ঘটেছিল?”

রাজ প্রথমটাই বোধ হয় শুনতে পেল না। আমি কথাটা আর একবার বলায় রাজ তাড়াতাড়ি করে বলল, ” হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলছি …. কাল তোরা চলে যাওয়ার আগেই তো অনেকেই চলে গিয়েছিল। তারপর যারা ছিল তারা এখানেই আছে। আমার মামা-মামি, জ্যাঠা- জ্যেঠি, পিসি, মা- বাবা আর বাবার বন্ধু মলয় কাকু এনারাই। তোরা্ চলে যাওয়ার পর আরো কিছুক্ষণ সবাই এক জায়গায় বসে অনেক আড্ডা হয় তারপর রাত্রি প্রায় বারোটা নাগাদ সবাই যে যার রুমে চলে যায়। আমি যখন আমার রুমে ঘুমাতে যায় তখন হাতে আংটি ছিল, হীরাও ছিল। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি হীরা নেই, আংটি আছে।” হঠাৎ পাশ থেকে একজন বলল, ” দরজাটা কি ভেতর থেকে বন্ধ ছিল? ” তাকিয়ে দেখি বসিরহাট থানার ওসি দীপঙ্কর চক্রবর্তী। তিনি কখন তল্লাশি করে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন ,বুঝতেই পারলাম না। এবার রাজ দীপঙ্কর বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ” হ্যাঁ, দরজাটা ভেতর থেকে লক ছিল। “তারপর আমি একটা প্রশ্ন করতে যাবো এমন সময় রাজ আমাদের দিকে নির্দেশ করে দীপঙ্কর বাবুকে বলল, “স্যার, এরা আমার বন্ধু। আপনি আপনার মতো তদন্ত করুন। এরা এদের মতো করবে। ” তারপর আমি আর প্রান্তর দীপঙ্কর বাবুকে আমাদের পরিচয় দিলাম। দীপঙ্কর বাবু আমাদের দিকে একবার তাকালেন তারপর অভিলাশ কাকুকে বললেন, ” যতদিন না এই কেস সমাধান হবে ততদিন কেউ এ বাড়ি থেকে বেরোবেন না। এই বলে দীপঙ্কর বাবু চলে গেলেন। 

এবার এতক্ষণ পর প্রান্তর মুখ খুলল। ও বলল, ” তোর রুমে ঢোকার অন্য কোনো পথ আছে? ” রাজ একটু ভেবে বলল, ” না নেই।একটাই পথ আমার ঘরে ঢোকার।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে।” – বলে প্রান্তর অভিলাষ কাকুর সামনে গিয়ে বললেন, ” কেসটা যখন নিতেই হল, তখন সমাধান তো করতেই হবে। তো ভাবছি বাড়িতে এখনও পর্যন্ত যারা আছেন তাদের সব্বাইকে আলাদা আলাদা ভাবে জেরা করব। এজন্য আপনার অনুমতি চাইছি। “অভিলাষ কাকু তখন একটু অস্বস্তি প্রকাশ করলেও মুখে বললেন, “ঠিক আছে। করো।” প্রান্তর এবার সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রাজকে বলল, “একটা ঘর …..।” প্রান্তরের মুখের কথা শেষ না করেই রাজ বলল, “আমার ঘরে থেকে জেরা করতে পারিস।”

আমি আর প্রান্তর দোতলায় রাজের ঘরে গেলাম।রাজকে বললাম তলায় থাকতে আর যখন যাকে বলব তখন তাকে পাঠাতে। আমি রাজের ঘরের বাইরে দাঁড়ালাম।

তারপর একে একে সব্বাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। এমনকি রাজের মা, বাবা সহ রাজকেও।আমি যেহেতু ঘরের বাইরে ছিলাম তাই ভেতরে কি জিজ্ঞাসাবাদ চলছে সেটা জানতে পারিনি। প্রায় ৩০ মিনিট ধরে জিজ্ঞাসাবাদ চলেছিল। জিজ্ঞাসাবাদ  করার সময় অভিলাষ কাকুর বন্ধু একটু অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিল। পরে জেনেছিলাম উনি একজন স্কুল শিক্ষক। উনার নাম মলয় ব্যানার্জী। 

এরপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি  আর প্রান্তর বাড়ি ফিরে আসি।কিন্তু আবেগী মনকে বেশিক্ষণ সামলে রাখতে পারিনি।একটা প্রশ্নের উত্তর অনেকক্ষণ ধরে জানতে ইচ্ছা করছে। অবশেষে লাঞ্চ করতে করতে প্রান্তরকে জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না। বললাম, ” জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানতে পারলে?” প্রান্তর মুখ না  তুলেই বলল, ” খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই। পরে নিশ্চয়ই বলবো। এটুকুই জেনে রাখ এখন যে গুরুত্বপূর্ণ তেমন কিছু নেই, যা থেকে সন্দেহ করা যায়। ” আমি যে এই উত্তরে খুশি হলাম তা নয় তবুও আর একটা প্রশ্ন না করে পারলাম না। বললাম, ” তুই নিজে তল্লাশি করলি না কেন? “এবার ও আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললো, ” পুলিশ করেছে তো। আমার উনাদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা আছে।” আমি অবশেষে বললাম, “ভালো।”

বিকেলে মাঠে যাওয়ার জন্য যখন প্রান্তরকে ডাকতে গেলাম তখন দেখি জানালার দিকে ফিরে ও একটা পেন সুন্দর করে দেখছে। আমি নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে ওর পেছন থেকে দেখার চেষ্টা করবো ভাবছি এমনি সময় ও বললো, “আচ্ছা দেবা, বন্ধ ঘর থেকে কীভাবে চুরি হতে পারে বলে তোর মনে হয়?” আমি আবাক হয়ে বললাম, “তার মানে তুই্ বলছিস চুরি হয়নি, আর হলেও হীরা রাজের ঘরেই আছে?” প্রান্তর জামা পরতে পরতে বলল, “আমি কিছু বলছি না। সবকিছু সময় বলবে। চল, আজ আর মাঠে যাব না, একটু রাজ’দের বাড়িতে যেতে হবে।” যেতে যেতে প্রান্তর আমায় কি কি করতে হবে সবই বলে দিল। 

রাজ’দের বাড়িতে পৌঁচ্ছে শুনলাম রাজ বাড়িতে নেই। আর সেজন্য অত্যন্ত বাধ্য হয়েই মতলবটা পরিবর্তন করতে হল। অবশেষে, অভিলাষ কাকু’র থেকে অনুমতি নিয়েই প্রান্তর শুধুমাত্র রাজের ঘর তল্লাশি করল। আর আমি বাইরে অভিলাষ কাকুর সঙ্গে গল্প করছিলাম। শুনলাম কোথা থেকে আংটি তৈরি করা হয়েছিল। ইত্যাদি। প্রায় মিনিট দশেক পরে প্রান্তর বাইরে এসে বলল, ” না। এ ঘরেও নেই। “তারপর রাজ’দের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা একটু  সাহিত্য সংঘ লাইব্রেরীর দিকে গেলাম।দু’জনে কিছু বই ঘাটাঘাটি করে সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরে এসে প্রান্তর পকেট থেকে একটা আংটি বের করে বলল,” এই হল সেই হীরা। ” আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, ” তাহলে অভিলাষ কাকু’র সামনে মিথ্যা বললে কেন?”এবার প্রান্তর হাসতে হাসতে বলল, ” অঙ্কের উত্তর মিললেও একবার ক্রসচেক  করে নেওয়া ভালো। না হলে বলা যায় না ভেতরে কোথাও ভুল আছে কিনা! “

রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমি একবার প্রান্তরের ঘরে গেলাম। দেখলাম হীরাটাকে মুখের সামনে ধরে মুখের নিঃশ্বাস ওই হীরার উপর দিচ্ছে। তারপর ওর মুখে দেখলাম একটা হাসির রেশ দেখা যাচ্ছে। ও আমার দিকে ফিরে বলল, “তোর কাছে শিরিষ কাগজ আছে?” আমি বললাম, ” হ্যাঁ। আছে। ” যেহেতু বাড়িতে একটা পুরোনো সাইকেল ছিল, সেটাই কয়েকদিন ধরে অসময়ে ঘষছি। আমি নীচে আমার ঘর থেকে এক টুকরো শিরিষ কাগজ এনে প্রান্তরকে দিলাম। ও সেটা নিয়ে হীরার উপর ঘষতে শুরু করলো। তারপর হাসতে হাসতে বলল, “আমাকে ঠকানো এত সহজ নয়।” আমি কি হয়েছে জানতে চাইলে প্রান্তর বলল, ” কাল একবার সেই দোকানে যেতে হবে যেখান থেকে হীরার আংটি তৈরি করা হয়েছিল। 

পরের দিন সকালে আমি আর প্রান্তর দোকানের মালিক অর্থাৎ প্রকাশ রায়ের থেকে হীরার ব্যাপারে জানতে চাইলে, প্রকাশ কাকু বললেন,”অভিলাষ আমার ছোট্ট বেলার বন্ধু। তাছাড়া ও মাঝে মাঝেই আমার এখানে এসে বসে,গল্প করে।ওর ছেলের জন্মদিনেও তো আমার নিমন্ত্রণ ছিল। কিন্তু ওদিন প্রচন্ড ব্যস্ত থাকায় যেতে  পারিনি। তাই তাকে ঠকানোর কোনো প্রশ্নই নেই।” তারপর, প্রকাশ কাকু’র মাথার ঠিক পেছনে বাঁধানো একটা ছবি দেখে কথাটা বিশ্বাস করলাম। ছবিটি প্রকাশ কাকু আর অভিলাষ কাকু’র দীঘা’য় সমুদ্র তীরে তোলা। 

বাড়িতে ফিরে প্রান্তর হতাশ হয়ে বলল, ” যা ভেবেছিলাম সব তো ভেস্তে গেল। এ তো এবার আরো জটিল হয়ে গেল। তাছাড়া  এখন হাতে সময়ও খুব কম।”

বিকেল বেলা প্রান্তর চ্যাটার্জী লাইব্রেরি থেকে বইটা নিয়ে এল। দেখলাম রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর কবিতার বই। বাংলাদেশের এই কবি আমারও খুব প্রিয়। বইটা কয়েকটি পৃষ্ঠা পরে একটা কবিতা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম, ‘আমার ভেতর ও বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে’ এটা রবি ঠাকুরের নয়, এনারই লেখা। 

আজ তৃতীয় দিন সকাল বেলা। প্রান্তরকে আজই এই রহস্য ভেদ করতে হবে। কারণ কাল আমরা স্বপরিবারে ভ্রমণে যাবো, মুর্শিদাবাদে। আর প্রান্তরও আমাদের সঙ্গে যাবে। প্রান্তরের মা বাবা আজ সন্ধ্যাবেলা এখানে আসবে। 

তৃতীয় পর্ব

প্রান্তর সকালে আমার ঘরে এসে বলল, “তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নে, মধ্যমগ্রাম যেতে হবে।” প্রায় পনেরো মিনিটের মধ্যেই আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম। যখন ট্রেনে করে যাচ্ছি তখন আমি প্রান্তরকে বললাম, “আচ্ছা। আমরা মধ্যমগ্রামে যাচ্ছি কেন?” প্রান্তর বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, “রাজের পিসির বাড়ি।” আমি খুশি হয়েই বললাম, “তা বেশ ভালোই হল।”

কিছুক্ষণ পর আমি আবার প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা, রাজের পিসোমশাই আসেন নি তো। ওর পিসি তো সিন্দুর পরে ছিলেন, তারমানে ওর পিসোমশাই আছেন।” রাজ এবার হাসতে হাসতে বলল, ” আছেন তো। উনি উনার কাজের জন্য একটু বাইরে গেছেন। সেজন্য আসতে পারেন নি। জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় পিসি এটাই বলেছিলেন।” তারপর এ বিষয়ে আর কোনো কথা হয় নি। অনেক খোঁজা খুঁজির  পর পিসির বাড়িতে পৌঁচ্ছালাম। দেখলাম একটা সাদামাটা ঘর। আমি অবাক হয়েই বললাম, ” আমি ভেবেছিলাম পিসির বড়ো সুন্দর বাড়ি হবে, যেভাবে উনি রাজ’দের বাড়িতে ব্যক্তিগত গাড়িতে ব্যক্তিগত ড্রাইভার নিয়ে গিয়েছিলেন। তাতে এই ধারণাই হয়। ” প্রান্তর দেখলাম আমার সাথে সহমত পোষণ করল। আমরা বাড়িতে গিয়ে দেখি ঘরের ভেতরে যাওয়ার উপায় নেই। তাই বাইরের চারপাশটা ঘুরতে লাগলাম। প্রান্তর দেখলাম একটা জানালার ধারে গিয়ে ভেতরের কিসের একটা ফটো তুলছে। পরে জিজ্ঞাসা করলে ও বলল ফটোটা ওর খুব ভালো লেগেছে। তারপর ওখান থেকে বেরোনোর পর প্রান্তর বলল, “এবার বারাসাত যেতে হবে একটু, রাজের মামার বাড়ি। ” তখন আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, ” ওখানে তো আমার দিদির বাড়ি। চল, আমার দিদির বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।” কিন্তু প্রান্তর বলল, “না আজ নয়। তুই ঘুরে আয়। আমি বাড়ি যাওয়ার সময় তোকে কল করে নেব।” তারপর প্রান্তর রাজের মামার বাড়িতে গেল। আমি দিদির বাড়িতে গেলাম। প্রায় ঘন্টাখানেক পর প্রান্তর ফোন করলে স্টেশনে ওর সাথে দেখা করলাম। তারপর সারা রাস্তা দিদির বাড়িতে আনন্দ আর ভাগ্নের সাথে খুনসুটির গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরলাম। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি তখন তিনটে বেজে গেছে। 

ঘন্টাখানেকের মধ্যেই গুছিয়ে নিয়ে আমরা রাজ’দের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। পথে যেতে যেতে প্রান্তর থানায় ফোন করে দীপঙ্কর চক্রবর্তী কে অভিলাষ কাকু’র বাড়িতে আসতে বললেন। তারপর রাজদীপ’কে ফোন করে সব্বাইকে বাড়িতে থাকতে বলল। প্রায় মিনিট দশ পরে আমরা রাজ’দের বাড়িতে পৌঁচ্ছালাম। গিয়ে দেখি সব্বাই ব্যাগ পত্তর নিয়ে প্রস্তুত। শুধুমাত্র পুলিশের অনুমতির অপেক্ষায়। 

আমি আর প্রান্তর আরও দশ মিনিট অপেক্ষা করলাম, দীপঙ্কর চক্রবর্তীর জন্য। প্রান্তর আমার কানে কানে বলল, “পিসির গাড়ির ড্রাইভার বাইরে আছে, ভেতরে ডেকে নিয়ে আসতে। ” আমি ওর কথামত সেটাই করলাম। সবাই উপস্থিত হওয়ার পর প্রান্তর রাজ’কে জিজ্ঞাসা করল, ” বন্ধ ঘর থেকে বল তো কীভাবে হীরা চুরি হতে পারে? ” কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ থাকার পর প্রান্তর নিজেই বলল, ” যদি হীরাটাকে ঘরের কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়। ঠিক বললাম তো রাজদীপ রায়চৌধুরী! ” দেখলাম রাজ থতমত খেয়ে গেছে। আমতা আমতা করে রাজ বলল, ” হ্যাঁ, আমিই মানে…… “প্রান্তর বলল, ” থাক এখন তোর আর বলতে হবে না। আমি বলছি।”

“রাজ হীরাটাকে নিজেই নিজের ঘরে লুকিয়ে রেখেছিল, টেবিল ল্যাম্পের মধ্যে। তার কারণ সম্ভবত আমার সাথে রসিকতা। আগেরদিন ওর ঘর তল্লাশি করতে গিয়ে এটা খুঁজে পাই। আমি সেটা তুলে নিয়ে ওখানে একটা কাচের টুকরো রেখে দিয়েছিলাম, যেটা ও পরে বুঝতে পেরেছিলেন কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারিনি, লজ্জায়। তা যাই হোক ও ভুল কিছু করিনি। এর মাধ্যমে ও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। ও যে হীরাটা লুকিয়ে রেখেছিল ওটা আমি পরীক্ষা করে দেখেছিলাম।ওটা একটা নকল হীরা। আসল হীরা ওর জন্মদিনের দিন রাতে চুরি হয়নি।আমি নিশ্চিত তাঁর দু’একদিন আগেই চুরিটা হয়েছিল।সেটা ও বুঝতেই পারিনি।” 

এরপর প্রান্তর সেই নকল হীরাটা সকলের সামনে এনে রাখল। 

আবার প্রান্তর বলতে শুরু করল। 

“এখন প্রশ্ন একটাই আসল হীরা কোথায়? বা জহুরি কি খাঁটি হীরা দিয়েছিল? হ্যাঁ, দিয়েছিল। জহুরি খাঁটি হীরায় দিয়েছিল। কারণ জহুরি অভিলাষ কাকু’র খুব ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু। তাহলে প্রশ্ন একটাই আসল হীরা কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসল এক অজানা তথ্য।” 

রাজদীপ’কে সেই ফটোটা দেখিয়ে প্রান্তর বলল, ” এটা তোর কে হয় বলতো! পিসোমশাই তো। এবার এই মুখ টাতে গোঁপ দাড়ি লাগিয়ে দিলে আর একটা চেনা মুখ উঠে আসে।” বলতে বলতে প্রান্তর ড্রাইভারের সামনে গিয়ে গোঁফ আর দাড়ি ধরে দিল টান। আসলে ওগুলো সবই নকল ছিল। দেখলাম সবাই অবাক হয়ে গেল। এবার প্রান্তর পিসি আর পিসোমশাইকে বলল, ” এই ছদ্মবেশের কারণ কি?মাথা নীচু করে পিসি বলল,”গত বছর লকডাউনে ওর চাকরিটা চলে গেছে। যা একটু আধটু টাকা পয়সা জমিয়েছিলাম, সব খরচ হয়ে গিয়েছিল। আমরা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। ওর আর নতুন চাকরিও হল না। তাই ভেবেছিলাম যদি হীরাটি পাওয়া যাই। অনেক দাম ওটার। কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না।” প্রান্তর বলল, ” তার মানে আপনারা নেননি। তাহলে নিল কে? “

তারপর সবার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে প্রান্তর বলতে লাগল, ” প্রথমে এক বছর মতো একটা হীরা কাটার কারখানায় কাজ করেছিলাম। তারপর একটা স্বর্ণ কারের দোকানে দিন মজুরি করতাম। তারপর অবশেষে নিজের একটা জুয়েলারী খুলে বসলাম। কিন্তু মানুষকে এত পরিমাণে ঠকাতে শুরু করলাম যে আমার ভিটে মাটি, বিষয় সম্পত্তি সবই হারাতে হল। আর সেটা হওয়ায় স্বাভাবিক ছিল কারণ জনগণের ক্ষমতা অনেক।ঠিক বললাম তো মামা!” মামার দিকে তাকিয়ে প্রান্তর বলল।মামা’র কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মামা অস্বীকার করতে শুরু করলে দীপঙ্কর চক্রবর্তী’কে  প্রান্তর বলল, ” উনার ব্যাগটা কে ভালো করে দেখুন। তা না হলে পকেটগুলো। এখান থেকেই পেয়ে যাবেন। কারণ আসল হীরা সরিয়ে নিখুঁতভাবে নকল হীরা রাখা একমাত্র উনার পক্ষেই সম্ভব।” কিছুক্ষণ খানাতল্লাশি করার পর, ব্যাগের একদম ভেতরে একটা লুকানো পকেট থেকে খাঁটি হীরা উদ্ধার হল। 

ফিরে আসার সময় প্রান্তর রাজদীপ’কে বলল, ” কখনও কখনও আমাদের রসিকতা বড়ো কিছু করে দেখানোর সুযোগ করে দেই। তাই রসিকতা করতে ভুলো না। ” তারপর আমি বললাম, ” কাল আমরা সবাই মুর্শিদাবাদ যাবো রাজদীপ আমাদের সঙ্গে তুইও  চল। খুব মজা হবে। ” রাজ শুধু বলল, ” আমি রাতে জানিয়ে দেব। ” এরপর দীপঙ্কর বাবু আমাদের ধন্যবাদ দেওয়ার সাথে সাথে বলল, “কাল থেকে পাঁচ দিন আমি ছুটিতে আছি। তাহলে চলো আমিও তোমাদের সঙ্গে ঘুরে আসি।  আমি হাসতে হাসতে বললাম, “অবশ্যই।”

রাজ’দের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি প্রান্তরকে বললাম, “তুই মলয় কাকু’কে সন্দেহ করলি না কেন?”প্রান্তর শুধু বলল, ” আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম উনি একজন ইন্ডিয়ান আর্মি ছিলেম। কিন্তু একদিন হঠাৎ শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দেন। তারপর বসিরহাট হাই স্কুলের বাংলার শিক্ষক। শুনেছি মানুষটা ছাত্রছাত্রীদের কাছে ঈশ্বর সমতুল্য। তাছাড়া  আমার জিজ্ঞাসাবাদে উনার প্রতি কোনোপ্রকার সন্দেহের সৃষ্টি হয়নি। সুতরাং উনার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।”

মাঠ ঘুরে বাড়িতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। আসতে আসতে আমি প্রান্তরকে বললাম, “তুই খাঁটি হীরা চিনতে শিখলি কবে থেকে? “ও শুধু একটু মৃদু হেসে ছিল। বাড়িতে এসে প্রান্তর অবাক হয়ে গেল। ওর মা আর বাবা এসেছে। ওর মা ওকে বলল, “আবার তুই এখানে এসেও সত্য অন্বেষণ করা শুরু করলি!” রাত দশটা নাগাদ রাজদীপ ফোন করে বলল, “ওরাও সপরিবারে আমাদের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ যাবে।”

 

=== সমাপ্ত ===

লেখক পরিচিতি

অগ্নিধ্রু

শিক্ষাজীবন শুরু চিতুড়ী দক্ষিণ পাড়া অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর বালতি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ এবং তারপর বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে বিথারী কালীপ্রসন্ন উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ। বর্তমানে টাকি সরকারি মহাবিদ্যালয়ে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্র। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির শখ। অষ্টম শ্রেণীতে পড়া চলাকালীন প্রথম কবিতা ‘রংখেলা’ প্রকাশিত হয় বালতি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যাগাজিন ‘অভিষেক’ পত্রিকায়। ২০২১ সালে পরপর চারটি কবিতা (মা মানে, মৃত বহনকারী গঙ্গা, ছেঁড়া স্বপ্ন, পরীক্ষা বাতিলের পর) বসিরহাটের পরিমল দে সম্পাদিত ‘ইছামতি সংবাদপত্র’-এ প্রকাশিত হয়। 

পৃথ্বীজ গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়  লেখা কবিতা ‘মৃত্যু পথযাত্রী’ প্রকাশিত হয়েছে এবং আরও কয়েকটি লেখা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে প্রকাশিত হবে। 

কবিতা ছাড়াও ডিটেকটিভ ও ভৌতিক গল্প লিখতে ভালোবাসেন। 

বর্তমানে ‘সাহিত্য চেতনা’ পত্রিকার সাথে যুক্ত আছেন।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!