লেখিকা: গোপা মিত্র
।। কুলু ।।
মানালী থেকে দিল্লী ফিরতে হলে, আমাদের কাছে দুটো রাস্তা খোলা ছিলো – (১) সিমলা হয়ে ফেরা আর (২) কুলু হয়ে ফেরা। আমরা দ্বিতীয় রাস্তাটাই বেছে নিলাম, যেহেতু তার আগে সিমলা দেখা হয়ে গেছে। এবার তাই ঠিক হলো আমরা কুলুতে দুদিন থেকে সেখান থেকে প্লেনে চণ্ডীগড় – সেখান থেকে গাড়ি বা বাসে দিল্লী ফিরবো।
যাই হোক, সকালবেলায় গাড়িতে আমরা মানালী থেকে কুলু রওনা দিলাম। মালপত্রের কিছু রইলো গাড়ির ডিকিতে, কিছু চড়লো গাড়ির মাথায়। মানালী থেকে কুলুর দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। পাহাড়ী রাস্তা, আবার মানালীর চেয়ে কুলুর উচ্চতাও কম। গাড়ি ঘুরতে ঘুরতে নিচের দিকে নামছে। মাঝে মাঝে ঝাঁকুনিও দিচ্ছে। সামনের সীটে বসেছিলো সঞ্জয় (আমার মেজ ভগ্নীপতি)। সে হঠাৎ বলে উঠলো, “আচ্ছা, গাড়ির মাথায় আমাদের মালপত্রগুলো তোলা হয়েছিলো, সেগুলো সব ঠিক আছে তো, না কি ঝাঁকুনিতে রাস্তায় কোথাও পড়ে গেছে? তোমরা বরং মাঝে মাঝে পেছন দিকে চেয়ে দ্যাখো বা দুপাশের রাস্তা দেখতে দেখতে চলো।”
একথা শুনে আমার আর বোনটির মধ্যে (মেজ বোন) মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। মেয়েদের হাতব্যাগেই সবসময়েই ছোট হাত আয়না থাকে – আমাদেরও ছিলো। আমরা আমাদের ছোট আয়নাগুলো বার করে, গাড়ির জানলা দিয়ে দুপাশে বাড়িয়ে ধরে ওপরের মালগুলোর দিকে ফোকাস করে দেখে নিলাম, সব ঠিকই আছে।
এইভাবেই মজা করতে করতে আমরা একসময়ে কুলু এসে পৌঁছলাম। হিমাচল ট্যুরিজমের ট্যুরিস্ট লজে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। লজের অবস্থানটি দারুণ – পিছনে পাহাড়, সামনে সবুজ গাছের সারি দিয়ে ঘেরা বিশাল ঢালপুর ময়দান। এছাড়া বিপাশা নদী তো আছেই। মানালী আর কুলুর তফাৎ এটাই যে, মানালীর অবস্থান পাহাড়ের পটভূমিকায় আর কুলুর অবস্থান পাহাড়ের পাদদেশে।
কুলু মন্দিরময় শহর। আমাদের হাতে সময়ও অল্প – তাই আহারান্তেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম স্থানীয় মন্দির দর্শনার্থে। আগামীকাল সময় হবে না; কারণ আমরা যাবো ‘মণিকরণ’-এ।
রঘুনাথজী মন্দির, বিজলী মহাদেব মন্দির, বৈষ্ণোদেবী মন্দির – এমন আরোও কতো মন্দির! আমরা কয়েকটি দেখলাম। সবগুলোর কথা অবশ্য আজ আর মনে নেই, তবে বৈষ্ণোদেবী মন্দির মনে আছে। সরু খাড়া সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হলো, তারপর নিচু হয়ে মন্দিরে প্রবেশ করে দেবীদর্শণ হলো।
কুলুর প্রাণকেন্দ্র ঢালপুর ময়দান। পাহাড়ের পাদদেশে বৃক্ষপরিবেষ্টিত বিশাল এই ময়দানে ইতিউতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কতো না মানুষজন। কেউ গল্প করছে, কেউ রোদ পোহাচ্ছে, কেউ বা অলস একটা দিন কাটাচ্ছে নিজের মতো করে। কুলুর জগৎবিখ্যাত দশেরার মেলায় এখানেই জমা হয় দেশী বিদেশী মিলিয়ে কয়েক লক্ষ মানুষজন।
লোকমুখে শুনলাম একসময়ে কুলুর রাজা জগৎ সিংজী কুলুতে প্রতিষ্ঠা করেন রঘুনাথজীর মূর্তি এবং তখন থেকেই কুলুর দেবতা হিসাবে মান্যতা পান রঘুনাথজী। প্রতিবছর বিজয়া দশমীর দিন এই দশেরা মেলার সুচনা হয়, চলে এক সপ্তাহ ধরে। এই মেলা সূচিত করে অশুভ শক্তির পরাজয় ও শুভ শক্তির জয়। কুলুর দেবতা রঘুনাথজী তখন তাঁর রথে চড়ে মেলায় আসেন ও তাঁর জন্য নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় অবস্থান করেন। মেলা উপলক্ষ্যে নাচ, গান, নাটক ইত্যাদি একক বা সমবেতভাবে নানান অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। লোকমুখে রঘুনাথজীর মাহাত্ম্য বা মেলার বর্ণনা শুনতে শুনতে, মানসচক্ষে আমি যেন পৌঁছে গেলাম – দশেরার সেই দিনে। সেই, যেদিন রঘুনাথজী তাঁর রথে চড়ে নেমে এসেছেন জনতার মাঝে আর ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে লক্ষ কণ্ঠ উল্লাসে ফেটে পড়ছে রঘুনাথজীর নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে। মনে হলো, এটাই তো আমাদের প্রকৃত ভারতবর্ষ, যেখানে কোনোও ভেদাভেদ নেই, যেখানে আমাদের একমাত্র পরিচয় আমরা মানুষ। চমক ভাঙলো আনুর (ছোট বোন)ডাকে। সে বললো, “দিদি, এবার ফিরতে হবে।”
পরদিন আমাদের গন্তব্য মণিকরণ। কুলু থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মণিকরণে রয়েছে শিখদের পবিত্র “গুরুদোয়ারা সাহিব” ও হিন্দুদের পবিত্র “শিব-পার্বতী” মন্দির। কাজেই শিখ ও হিন্দু উভয় ধর্মাবলম্বীদের কাছেই মণিকরণ পবিত্র তীর্থক্ষেত্র।
গাড়ির রাস্তা অত্যন্ত খারাপ, রাস্তা পাকা নয়। গাড়ি কখনোও এদিকে হেলছে তো কখনোও ওদিকে। জনমানবশূণ্য রাস্তা – বাড়ি-ঘর, দোকানপাট কিছুই নেই। দুপাশে সার দিয়ে চলা পর্বতশ্রেণী, পাশ দিয়ে বয়ে চলা পার্বতী নদী আর নিস্তব্ধ নির্জনতারও একধরণের মুগ্ধতা আছে। এই মুগ্ধতা আমাদের সবাইকেই চুপ করিয়ে দিয়েছিলো। গাড়ির চালকের একটা কথা আমাদের নীরবতা ভঙ্গ করলো। দূরের এক পর্বতশিখর নির্দেশ করে সে তখন বলছে, “ওই যে দেখছেন, ওই হলো কৈলাস পর্বত।” তার কথার সত্য-মিথ্যা আমি জানি না। তবে মনে হলো, ঠিক ঠিক, এমন জায়গাতেই তো শিব-পার্বতীর বাসস্থান হওয়ার কথা – এমন সুন্দরের মাঝে, শান্ত নির্জনতায়!
অবশেষে পৌঁছে গেলাম মণিকরণ। পার্বতী উপত্যকায় পার্বতী নদীর ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে গুরুদোয়ারা। নদীর এপারেই গাড়ি থেমে গেলো। নদী পেরিয়ে আমাদের ওপারে যেতে হবে। নদীর ওপরে রয়েছে পারাপারের জন্য একটা সরু দড়ির সেতু। দু-তিনজন একসঙ্গে উঠলেই সেটা দুলতে থাকে। আমরা কোনোওক্রমে একজন একজন করে সেতুর দুদিক ধরে নড়তে নড়তে ওপারে পৌঁছে গেলাম।
বিশাল গুরুদোয়ারা। তবে আমরা ছাড়া আর কোনোও পর্যটক নেই। বেশ কয়েকজন শিখ কোমরে কৃপাণ ঝুলিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের গা ছমছম করতে লাগলো। এরকম নিরিবিলি জায়গায় আমাদের আসা কি উচিত হয়েছে – সবার মনেই এই প্রশ্ন। তবে ওদের উষ্ণ অভ্যর্থণা ও আদর আপ্যায়ন খুব দ্রুত প্রমাণ করে দিলো, আমাদের মনের ভয় অমূলক ছিলো। আমরা খুব সহজেই ওদের সঙ্গে মিশে গেলাম।
এখানে রয়েছে ফুটন্ত জলের পবিত্র কুন্ড। কাপড়ে বেঁধে কুন্ডের জলে চাল ডুবিয়ে দিলে, সেই চাল ভাতে পরিণত হয়। শিখ ধর্মমতে অনেককাল আগে এখানে শিখধর্মের প্রবর্তক গুরুনানক এসেছিলেন তাঁর এক শিষ্যের সঙ্গে। কথিত আছে গুরুনানকের কৃপায় এই কুন্ডের উৎপত্তি। আমরা এখানে ওদের লঙ্গরে অংশগ্রহণ করলাম আর রুটি ডাল সব্জি দিয়ে নিজেদের পেট ভরালাম।
হিন্দুমতে একবার শিব-পার্বতী এই পার্বতী উপত্যকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানে বেড়াচ্ছিলেন। তখন পার্বতীর একটি কর্ণাভরণ এখানে পড়ে যায় ও মহাসর্প শেষনাগ সেটি নিয়ে জলের তলায় পালিয়ে যায়। পার্বতীর অনুরোধে শিব তাঁর তৃতীয় নয়ন দিয়ে কর্ণাভরণটি দেখতে পান ও শেষনাগের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে সেটি ফেরত চান। শেষনাগ তখন “হিস্স্” করে শব্দ করে ও তার সঙ্গেই বেরিয়ে আসে এই ফুটন্ত জলের ধারা। শিব তার মধ্যে থেকে কর্ণাভরণটি নিয়ে পার্বতীকে ফেরৎ দেন। কথিত আছে, মণিকরণ দর্শন করলে কাশী-দর্শণের পূণ্য হয়।
এসব দেখে ফেরার পথে আবার সেই সরু দড়ির সেতু আমাদের পেরোতে হলো।
কুলু ভ্রমণ শেষ। এবার ঘরে ফেরার পালা। তার আগে এখানকার শালের বৈশিষ্ট্যের কথা বলতেই হয়। কাশ্মীরের শাল আর কুলুর শালের মধ্যে একেবারেই মিল নেই। এই শালে কাজের বা বুননের একটা অন্যরকম ধরন আছে।
পরদিন ভোরবেলাতেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম ভূন্টার এয়ারপোর্টের (কুলুর এয়ারপোর্ট) পথে। কুলু থেকে যার দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। এখানেই এবারের মতো কুলু-ভ্রমণ শেষ।
একদিন নিশ্চয়ই কুলুর স্মৃতি ফিকে হয়ে যাবে, সাংসারিক প্রাত্যহিকতায় আমার অনুভব মনের অতলে তলিয়ে যাবে, তবুও আমি প্রতীক্ষা করে থাকবো সেই সেদিনের, যেদিন হয়তঃ আবার সীমাবদ্ধ গণ্ডীর ঊর্ধ্বে উঠে আমার অনুভব ধরা দেবে, কোনোও এক নতুন রূপে, কোনোও এক নতুন জায়গায়।
—-
গোপা মিত্র
ফিজিক্স অনার্স। এক সময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।
বাঃ! দারুণ!
খুব বর্ণনাময় আর সুন্দর ভ্রমণচিত্র । ভাল লেগেছে ।
Bah bah
কুলু ভ্রমণের বর্ণনা খুব ভালো লাগলো
Thoroughly enjoyable and vivid narrative. Kulu trip has seldom received such realistic and authentic description.
ধন্যবাদ সকলকেই ।
দারুণ। আমরাও গেছি মণিকরণ। তবে তোমাদের তিরিশ বছর পরে। খুব ভাল লিখছো তুমি।