সুদেষ্ণা মিত্র
২৫ শে জুলাই ১৯৮০। তার আগের দিনই অর্থাৎ ২৪ শে জুলাই, ১৯৮০ তারিখে, বাংলা ছায়াছবির জগতে ঘটে গেছে ইন্দ্রপতন। সেই সময় আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। তখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। টেলিভিশন সম্প্রচারণ এতো উন্নত ছিলো না। বাড়ির বড়রা কি করে খবর পেয়েছিলেন জানিনা তবে ২৫ তারিখ স্কুল থেকে বাড়ি ফেরবার পর সবার দুঃখ দুঃখ মুখ আর আমার ঠাকুমার কান্না ভেজা চোখ আজ ও মনে আছে।
উত্তমকুমারের সিনেমা না দেখলেও নামটা শোনাই ছিল। লুকিয়ে চুরিয়ে ‘আনন্দলোক’ বা ‘উল্টোরথ’-এর ছবিতে সব সিনেমা আর্টিস্টদের চেনাটাই আমার সিনেমার জগৎ ছিল। সেই অর্থে আমার কাছে “উত্তমকুমার সিনেমার নায়ক” এইভাবেই পরিচিত ছিল।
তাই তিনি মারা গেছেন বলে বাড়িতে সবাইয়ের এতো মন খারাপের কারণ বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শুধু বুঝতে পারছিলাম, দিনটা আর পাঁচটা দিনের মতো নয়। আরো অবাক লাগলো যখন দেখলাম মা আমার ঠাকুমার সঙ্গে পাড়ার গোধুলি পিসির বাড়ি টিভি দেখতে যাচ্ছে কারণ উত্তমকুমারের শেষযাত্রা দেখাবে।
সাধারনতঃ পাড়ায় কোথাও টিভি দেখতে আমার ঠাকুমাই যেত আর আমি মাঝে মাঝে খেলতে যাবো সেই বাহানায় সঙ্গী হতাম। বকুনিও খেতাম অবশ্য। সেদিন কিন্তু বকুনি খেলাম না। কে জানে, হয়তো উত্তম ভক্ত আমার মা, ঠাকুমা চেয়েছিল শেষবারের মতো আমি দেখে নিই উত্তমকুমারকে।
কি দেখেছিলাম টিভিতে আজ সবটা মনে না থাকলেও মনে আছে এতো লোক যে ওনার ট্রাকটাকেই ভালো করে দেখা যাচ্ছিলো না। আর মনে আছে গোধুলি পিসির বাড়িতে যারা বসে দেখছিল সবাই কাঁদছিল। সেদিন বুঝিনি। পরে বুঝেছি, উত্তমকুমার ছিলেন বাঙালীর আবেগ।
এর পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৮১ সালে, রিলিজ হলো তাঁর শেষ ছবি ‘ওগো বধু সুন্দরী’। এর আগে ঠাকুর দেবতা আর ছোটদের সিনেমা দেখেই আমার সিনেমা দেখার আশ মেটাতে হতো। সেই প্রথম গেলাম সিনেমা হলে বড়দের সিনেমা দেখতে। সঙ্গে বাড়ির সবাইকে ছাড়াও আমার পিসি। যে শ্বশুরবাড়ির থেকে এসেছে তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে এই সিনেমা দেখতে; কারণ শো হাউসফুল চলছিল।
আমার বাবা অতিকষ্টে তিনবারের বার টিকিট কাটতে পারে। আমাদের ছোটোদের যাওয়ার কারণ একটাই, বাড়ির সব বড়রা সিনেমা দেখতে যাবে, তাই আমরা কোথাও থাকতে পারবো না। মনে আছে উত্তর কলকাতার ‘দপর্ণা’ সিনেমা হলে সেদিন লোক দেখে, বাবা আর দাদু আমাদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে হলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি পোস্টার দেখার অনেক চেষ্টা করেও দেখতে পারেনি। উত্তমকুমার এক উন্মাদনা।
১৯৮১ সালের কোনো একসময় উত্তমকুমার অভিনীত ‘বিকেলে ভোরের ফুল’ সিনেমাটি বাংলা দূরদর্শনে দেখানো হবে বলে, ঘোষণা করা হয়। সেই সময় গরমের ছুটিতে মা মাসীদের সঙ্গে আমরা ছোটোরাও মামারবাড়িতে। যথারীতি মামারবাড়িতে টেলিভিশন ছিল না। মা এবং মাসীরা মামাকে ধরলো সিনেমা টি তারা দেখতে চায়। তাই টিভি কিনতে হবে। দুদিন ধরে রাজী করিয়ে অবশেষে এলো ‘সোনোডাইন’ টিভি। শুরু হলো বিকেলে ভোরের ফুল। আমরা দেখার পারমিশন পাইনি। পর্দার আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে সিনেমা দেখার থেকেও অবাক লাগছিল এই ভেবে শুধু একটা সিনেমা দেখার জন্যে টিভি কেনা হলো!
আজ জানি এর জবাব। উত্তমকুমার এক চিরকালীন অমোঘ আকর্ষণের নাম। যাঁর মৃত্যুর চল্লিশ বছর পরেও মিডিয়ার সব রকম মাধ্যমে যিনি সর্বাধিক আলোচিত, সেই উত্তমকুমার শুধু মহানায়ক নন – তিনি হয়ে ওঠেন এক কিংবদন্তী।
বাংলা সিনেমার অবিসংবাদিত “মহানায়ক” উত্তমকুমার এক কিংবদন্তী। যতদিন বাংলা সিনেমার অস্তিত্ব বজায় থাকবে, উত্তমকুমারের নামও সগৌরবে উচ্চারিত হবে।
সুন্দর লিখেছিস
Khub bhalo lichechis
ধন্যবাদ সবাইকে।