সামাজিকগল্প

স্বরাজ

লেখিকা: শর্মিলা মজুমদার

বিকেলে বারান্দায় আরামকেদারায় বসে চা হাতে নিয়ে পা দোলাতে দোলাতে ঝুমুর পার্কে বাচ্চাদের খেলা দেখছিল।  তার নিজের ছোটোবেলার কথা মাঝেমাঝে মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের পরিবার যৌথ ছিল না; চারজনের। বাবা, মা, ভাই আর ঝুমুর। উচ্চমধ্যবিত্ত নাহলেও নিম্ন নয়। যাই হোক তাদের ছোটবেলায় এইরকম সাজানো পার্ক ছিল না। মা বা আয়ারা তাদের খেলার জন্য পার্কেও নিয়ে যেত না। তবে মেয়েরা পুতুল বা খেলনা বাটি আর ছেলেরা ব্যাটমিন্টন বা ক্রিকেট খেলত। ঝুমুরের পাড়ায় যেসব তার সমবয়সী মেয়েরা থাকত, তাদের সঙ্গেই স্কুলছুটির পর খেলায় মেতে থাকত। না। তাদের ছোটবেলায় এখনকার বাচ্চাদের মতো একঘেয়ে দোলনা, স্লিপ বা সিশ-র মতো খেলা ছিল না। নিত্য নতুন খেলা তারা উদ্ভাবন করত। হয়ত তার জন্য অনেক সময়েই বকুনি খেতে হত। কারণ, অনেক সময় বাড়ির অনেক জিনিস ভা্ঙত। মনে পড়ে একবার রাস পুজোর কথা। তাদের মনে হল রাসের পুতুল সাজাবে। ব্যস্‌, বাড়ির আলমারিতে যত পুতুল আছে, বের করে সাজানো শুরু হলো, অসাবধানে কটা ভাঙল, ব্যাস্‌, শুরু হলো বকুনি, দু-চারটে চড় থাপ্পড়। তাতেও তাদের উৎসাহ কমত না। কারণ মার বকুনির পর আদর পেয়ে সব ভুলে যেত।

এখনকার বাচ্চারা অন্য রকম। রাস তো দূর; অনেক খেলাই তারা জানে না । সব যেন মেকি। মায়েরা সব মেপে কথা বলে। খেলনাও সব যান্ত্রিক, মায়েদের বকুনিও মেপে মেপে, ভয়ে ভয়ে। কি জানি, যদি বাচ্চা কিছু করে বসে বা বাড়ি থেকে চলে যায়। এই তো সেদিন পাশের বাড়ি অমলবাবুর ছেলে পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়েছে বলে ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিয়েছিল। ভাগ্যিস ডোজটা ঠিক করতে পারে নি।

আরে নম্বরটাই কি জীবনের সব? ঝুমুরদের সময় নম্বর নিয়ে কারুর এত মাথা ব্যথা ছিল না। নম্বর কম! ঠিক আছে, পরেরবার ভালো করো। আসলে, এত প্রতিযোগিতা ছিল না। মা-বাবা কখনো বলতো না, অন্যজন এত বেশী পেয়েছে তুমি পাওনি  কেন? বরং উল্টে উৎসাহ দিতেন। মন দিয়ে পড়। ঠিক হবে।

ভাগ্যিস ঝুমুরের সন্তান নেই। কে জানে, সেও হয়তো এই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতো। সন্তানকে প্রতিযোগী করে তোলা। বড় অফিসে চাকরি পেতে হবে, বিদেশে যেতে হবে। বিদেশ না হলেও, নিদেনপক্ষে দিল্লি, পুনে বা  বেঙ্গালুরু। ঝুমুর বড় বাঁচা বেঁচেছে। গভীর নিশ্বাস ফেলল ঝুমুর।  বিয়ের পর কয়েক বছর বড় মনোকষ্টে ছিল ঝুমুর,  সন্তান না হবার যন্ত্রণা। তবে সে জানে না শারীরিক  ত্রুটি কার। সবটাই সে নিজের দায় মনে করে নিয়েছে। তখন সমাজে সব দোষ ত্রুটি মেয়েদের মনে করা হতো। শ্বশুরবাড়ি,  পাড়া, এমন কি বাপেরবাড়ি পযর্ন্ত। না, তবে এখনকার সমাজের অবস্থা দেখে ঝুমুর নিজেকে সুখী মনে করে।

এই তো কাল খবরের কাগজে পড়ছিল বিদেশে থাকা দুই সন্তান  মা বাবার দেখভাল করতে অপারগ। তাই তাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে নিজেদের কর্তব্য পালন করেছে। আর একটা খবর পড়ে ঝুমুর স্তম্ভিত বৃদ্ধ মা বাবাকে মেরে বার করে দিয়েছে। রবিবারের কাগজে বৃদ্ধাশ্রমের ছবি ও বর্ণনা দেখে মনেহয় তার মতো সুখী আর কেউ নয়। অন্তত সন্তানের অত্যাচারে তাকে বৃদ্ধাশ্রম যেতে হবে ন।  হয়ত স্বামীর অবর্তমানে সে একা হয়ে যাবে, তখন ভাবতে হবে কি করবে। সেটা নিজের বিবেচনা, ঝুমুরের  অনেক  বন্ধু আছে; সবাই ত স্বার্থের জন্য মেশে না। ‘শেষের সে দিন কি ভয়ংকর’ মনে হলেও, সবাই মিলে হয়ত ভয়ংকর দিনগুলো  ভয়হীন করতে হবে।

ঝুমুর ভালো গান জানে। হাতের কাজেও সে পারদর্শী। আর্থিক স্বাবলম্বী হলেও  ঝুমুর ভাবে, অন্যকেও স্বাবলম্বী করার দীক্ষা দেবে। সকলের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে জীবন কাটিয়ে দেবে।

“কি গো বৌদি, খালি কাপ হাতে নিয়ে কি এত ভাবছো?” – আচমকা পেছন থেকে বেলার কণ্ঠস্বর শুনে ঝুমুর চমকে উঠলো।

বেলা তার বাড়ির দেখভাল করে। ঝুমুর মুখ তুলে দেখলো, সন্ধে হয়ে গেছে।

“না রে, এই নানা কথা মনে হচ্ছে। বল্‌, কি বলবি?”

“না, সন্ধে হয়ে গেছে, আনমনে বসে আছ, রাতের কি রান্না হবে তাই জানতে এলাম।” – বেলা বলল।

“হ্যাঁ, চল্‌।” – ঝুমুরের সব চিন্তা ভেসে গেল। তবে ঝুমুর বেলাকে বলল – “হ্যাঁ রে বেলা, তোদের কখনোও পড়তে বা কিছু হাতের কাজ শিখতে, ইচ্ছে করে না?”

“তা তো করেই গো বৌদি। শুধু  আমার কেন, আমার বাচ্চাগুলোর জন্যও ভাবি, কিন্তু ভেবে কি করব, আমাদের জীবন এইভাবেই শেষ হবে।” – বেলা বেশ দুঃখের সঙ্গেই বলল।

ঝুমুর তখনই মনে মনে ঠিক করল স্বামী অজিতের সাথে আলোচনা করবে যাতে সে কোন অবৈতনিক স্কুল খুলতে পারে। সেখানে শুধু পড়াশুনা নয় মনের বিকাশ থেকে খেলা, নাচ, গান, হাতের নানা শিল্প শেখানো যায়। যেখানে ধনী দরিদ্র শিশুরা এক সঙ্গে মিলেমিশে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারবে, কোন প্রতিযোগিতা নয়, সবাই এক হয়ে কাজ করবে, হয়ত কিছু তৈরি করবে যাতে সবার মিলিত শ্রম থাকবে, কেউ প্রতিযোগী হবে না। ঠিক যেন ‘দশে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’। ঝুমুর ফোন করলো তার কাছের বন্ধুদের। সব বলল। তারাও সব শুনে উৎসাহিত হলো এবং বলল – দারুণ হবে, আমরাও সঙ্গে আছি।

স্বামী অজিত বাড়ি ফেরার পর তাকে চা-জলখাবার দিয়ে শান্ত মনে এই কথাগুলো বলল ঝুমুর।  অজিত তাকে নিরাশ করলো না, বরং উৎসাহের সাথে বলে উঠল – “খুব ভালো লাগলো তোমার এই ভাবনাটা। যত তাড়াতাড়ি পারো শুরু করে দাও। আমরা যারা আস্তে আস্তে রির্টায়মেন্টের দিকে এগিয়ে চলেছি তারা তোমার সাথে থেকে নতুনভাবে সব শুরু করতেই পারি। নাম কি দেবে?”

একটুও না ভেবে ঝুমুর বললো – “আমাদের এই স্কুল আমাদের রাজত্ব এখানে যারা পড়তে আসবে আর যারা পড়তে সাহায‍্য করবে সবাই এখানে নিজেরাই রাজা। আমাদের স্কুলের নাম তাই হবে-‘স্বরাজ’।

সমাপ্ত

 

Author

Du-কলম

Join the Conversation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!