Home বিবিধ, গল্প স্মৃতির পাতায় পাতায়…
বিবিধগল্প

স্মৃতির পাতায় পাতায়…

সুনন্দা দাস

উমাও কৈলাস থেকে মর্তে তার সন্তানদের নিয়ে বছরে একবার বাপের বাড়ি আসে। কিন্তু আমি আর ভাই জন্মাবার পর আমার উমার বছরে কেন, দু বছরেও একবার বাপের বাড়ি যাওয়া হত না। আমার মামার বাড়ি ঝাড়খণ্ডের পাকুরিয়া নামে একটা গ্রাম। তখন সেটা বিহারের অন্তর্গত ছিল। সে সময় ভয়ঙ্কর খারাপ যোগাযোগ ব্যবস্থা, দিদিদের পড়াশোনা, হাতে কোলে আমি ভাই এই সব কারণে বেশ কয়েক বছর পর পর আমরা মামার বাড়ি যেতাম। তাই মামার বাড়ি যাওয়াটা আমাদের কাছে খুব, খুব স্পেশ্যাল ছিল। আজ আমি আমার মামার বাড়ি যাবার গল্প বলব। বিশেষ একবারের গল্প।

যে সময়ের কথা বলছি, তখন আমি ভাই অনেক বড় হয়েছি তাও না, ঠিক কোন ক্লাস তাও মনে নেই। তবে প্রাইমারী ক্লাসেই পড়ি। ঠিক হল গ্রীষ্মের ছুটিতে আমাদের চার ভাই বোনকে নিয়ে মা মামার বাড়ি যাবে। ওই সময় আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও বেড়াতে যাওয়া আমাদের হতো না। আমার পিসিদের বাড়ি ও বোলপুরে, বা কাছাকাছি। কিন্তু মামার বাড়ি যেতে গেলে ট্রেন বাস সবেই চাপতে হত। সুতরাং এটা আমাদের কাছে আলাদা স্বাদ এনে দিত। এটাই আমাদের কাছে বেড়াতে যাওয়ায় ছিল।

প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে দিনটা এসেও গেল। লটবহর নিয়ে আমরা চার ভাই বোন আর মা ট্রেনে চড়ে বসলাম। তখন একমাত্র মামার বাড়ি গেলেই ট্রেনে চাপা হত, তাই এই ট্রেন জার্নিও কম আনন্দের ছিল না আমাদের কাছে। প্রথমেই ট্রেনে জানালার ধারে সিট পেলে ওখানে কে বসবে সেটা নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে বেশ একটা খণ্ড যুদ্ধ বেঁধে যেত। সবাই তো সবসময় এক সঙ্গে জায়গা পেতাম না, ছাড়া ছাড়া বসতে হত। মা কিছুক্ষণ পরপর দেখে নিত আমরা সব কটা ছেলেমেয়ে ঠিক ঠাক আছে কিনা। তারপর জানালার ফাঁক দিয়ে গাছ পালা নদী নালা গরু বাছুর দেখতে দেখতে রাস্তা পার হয়ে যেতাম। রামপুরহাটের আগের স্টেশনে ট্রেন এলেই মা সবাইকে জানিয়ে দিত, পরের স্টেশনে আমরা নামবো। আগের স্টেশনে  ট্রেনটা যেই ছেড়ে দিত আমরাও পরের স্টেশনে  নামার জন্য রেডি হতাম। এক স্টেশন থেকে আর এক স্টেশন আসতে অনেকটা সময় লাগে কিন্তু যদি এত গুলি ছেলে পুলে নিয়ে মা নামতে না পারে, তাই আগের স্টেশন থেকেই মা ব্যাগ পত্তর নিয়ে আমাদের কে নিয়ে দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকত।

রামপুরহাট স্টেশনে নেমেই দৌড় শুরু হত। বাস ধরতে হবে। আগে গেলে তবেই জায়গা পাবো। যাইহোক  সবাই মিলে বাসে ও চড়ে বসলাম, কিন্তু বাস ছাড়েই না আর ছাড়েই না। একে গ্রীষ্ম কাল, বীভৎস গরম। একটু একটু খিদেও পাচ্ছে। বেস কিছুক্ষণ পর বাসের ভিতরে, ছাদে, দরজায়, চারিদিকে যখন লোক থিক থিক করছে তখন বেশ খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে, বিকট আওয়াজ করে বাসটা নড়ে উঠত। বুঝতাম এবার তিনি যাত্রা শুরু করবেন। ধুঁকতে ধুঁকতে ধুলো উড়িয়ে বাসটা এগিয়ে যেতো। ঘণ্টা খানেক বাদে নারায়ণপুর নামে একটা জায়গায় বাসটা এসে থামতো। ওটাই বাসের শেষ স্টপেজ। তাই ধীরে সুস্থে নামতাম। বাস থেকে নেমেই মনটা আমাদের আনন্দে ভরে উঠত। পাশেই নদী। নাম মনে নেই। তখনও আমরা পশ্চিমবঙ্গে দাঁড়িয়ে, নদী পার হলেই বিহার। মানে মামার বাড়ির কাছে চলে এসেছি।

আগেই বলেছি গ্রীষ্মকাল। নদীতে জল নেই বললেই চলে। সবাই চটি জুতো হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটে নদী পেরিয়ে চলে এলাম। নদীর এপারটা ভীষণ সুন্দর। প্রচুর গাছ। খুব ঠান্ডা। নদীতে হাত মুখ ধুয়ে একটা গাছ তলায় এসে বসলাম। আসে পাশে কোন দোকান নেই। মা বাড়ি থেকে খাবার এনে ছিল। সবাই বসে খেলাম। এবার অপেক্ষা। একটা মাত্র বাস দিনে একবার আসে আমার মামার বাড়ির গ্রাম থেকে। এদিকটা তে প্রচুর সাঁওতালদের বসবাস। আমরা পাঁচজন আর একজন ছাড়া সব সাঁওতাল। সবাই বাসের অপেক্ষায় বসে আছি। আমরা ছাড়া যে আর একজনের কথা বলছি, মা তার সঙ্গে আলাপ করল। সে’ও একই গ্রামে যাবে, এবং সে মায়ের গঙ্গাজলের (বান্ধবীর) ভাই। বসে থাকতে থাকতে দেখি সাঁওতালরা নিজেরা কী সব কথা বলছে, আর হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছে। তখন সেই মামাটা (মায়ের বন্ধুর ভাই) এসে বললো, আজ আর বাস আসবে না। মায়ের তো মাথায় বাজ পড়ল। এত দূর এসে বাড়ি ফিরে যেতে হবে!! আমাদেরও খুব মন খারাপ। আবার বাড়ি ফিরে যাওয়াও তো কম হ্যাপা নয়। এদিকে প্রচণ্ড রোদ্দুর। বেলা তখন এগারোটা। সাঁওতালী মানুষগুলো সব হাঁটতে শুরু করেছে। সেই মামাও হেঁটে যাবে। মা’ কে জিজ্ঞেস করছে আমরা হাঁটতে পারবো কিনা, তাহলে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাবে। ব্যাগ পত্তর ও মামাই নিয়ে যাবে। আমাদের বাড়ি ফিরে আসতে একদম ইচ্ছে নেই। আমরা জোর দিয়ে বলছি আমরা হাঁটতে পারব। মা’ও এতদিন বাদে বাপের বাড়ি যাচ্ছে, তাই মা’ও রাজি হয়ে গেল। আমরাও নতুন উদ্যোমে হাঁটা শুরু করলাম।

এখন লিখতে বসে মনে হচ্ছে ভাগ্যিস সেদিন বাস আসেনি। তাই জীবনে এত সুন্দর একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। পরবর্তী জীবনে বহু জায়গা বেড়াতে গেছি, কিন্তু সেদিনের পায়ে হেঁটে মামার বাড়ি যাওয়াটাই আমার জীবনের সেরা ভ্রমণ কাহিনী।

গাছের ছায়ায় ছায়ায় বেশ কিছুটা যাবার পর দেখি ছোট ছোট পাহাড় গুলো খুব কাছে চলে এসেছে। দুদিকে ছোট ছোট পাহাড়ের মাঝ দিয়ে হাঁটা রাস্তা ধরে আমরা কত মানুষ সার দিয়ে এগিয়ে চলেছি। মামার বাড়ি এসেই আমার প্রথম পাহাড় দর্শন। কিন্তু এই বার যেন পাহাড়ের কোলে কোলে হেঁটে চলেছি। তারই ফাঁকে ফাঁকে ছায়া দেওয়া গাছ। একটু এগিয়ে যায়, আর একটা করে ছোট্ট সাঁওতালি গ্রাম। এত সুন্দর সাজানো তাঁদের বাড়ি, মনে হবে দাঁড়িয়ে দেখেই যাই। ছোট্ট মাটির বাড়ি। দেওয়াল জুড়ে ছবি আঁকা। বাড়ির আশপাশ ভীষণ পরিষ্কার। এই প্রত্যেকটি গ্রামে আমরা থেমেছি। বিশ্রাম নিয়েছি। মায়ের অভ্যাস ছিল আমাদের নিয়ে দূরে গেলেই সঙ্গে নুন চিনি লেবু গ্লাস চামচ এসব সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। ওই গরমে এতটা রাস্তা হাঁটতে মায়ের ওই জিনিস গুলো খুব কাজে দিয়েছিল। ওই গ্রামগুলোতে প্রত্যেকটি মানুষও খুব আন্তরিক ছিলেন। এতোজনের শরবত তো আর গ্লাসে হয় না, ওনারাই বড় জায়গা দিতেন, তাতেই গ্রামের কল থেকে জল নিয়ে মা শরবত বানাতো। শরবত খেয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু। মামার বাড়ির গ্রামটি চারপাশ পাহাড় দিয়ে ঘেরা। মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে দেখলে মনে হত এই তো দৌড়ে গেলেই পাহাড়টাকে ছুঁতে পারবো, কিন্তু মামারা বলতো দেখে মনে হয় খুব কাছে, কিন্তু অনেকটা পথ। আর সেই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আমরা হেঁটে চলেছি, এটা ভেবেই খুব আনন্দ হচ্ছিল। এরকম হাঁটতে হাঁটতে যখন নদীর কাছে চলে এলাম, তখন আমাদের সে কি আনন্দ। নদীর ওপর ছোট্ট ব্রিজ, তারপর একটা বড় আম বাগান পেরিয়ে যে গ্রাম, সেটাই আমাদের গন্তব্য। মানে আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি।

বাগান পেরিয়ে যখন গ্রামের ভিতরে ঢুকলাম, তখন প্রায় বিকেল। অনেক বাড়ির মেয়ে বৌরা বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে। তখন কার দিনে, গ্রামের মেয়েরা অনেকদিন পরে বাপের বাড়ি গেলে পুরো গ্রাম যেন খুশি হত। প্রতি দরজায় দরজায় বয়স্ক মানুষরা গ্রামের মেয়েকে স্বাগত জানাত। মায়ের এতটা পথের ক্লান্তি নিমেষে উধাও, “মম এই এলি? মম কেমন অছিস?” এই সব শুনে। মায়ের ডাক নাম মমতা। সবাই ডাকে মম বলে। দিদারাও জানত না যে, আমরা আসব। চিঠি পৌঁছায়নি। আমাদের দেখে তাই সবার খুব আনন্দ।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!