সুদেষ্ণা মিত্র
।। শেষ পর্ব ।।
গড় পঞ্চকোট আমাকে বেশ অনেকক্ষণ মুগ্ধ করে রেখেছিল তার ধূলি ধুসর বিষাদময়তায়। তার ভাঙ্গা মিনার আর কেল্লার ধ্বংসাবশেষ চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছিল যতক্ষন অবধি আমাদের গাড়ীটা কেল্লার রাস্তার শেষ বাঁক না ঘুরলো। আমরা গড় পঞ্চকোটকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চললাম জয়চন্ডী পাহাড়ের দিকে।
জয়চন্ডী পাহাড়ের আকৃতি আর দশটা পাহাড় থেকে তাকে আলাদা করে রেখেছে। ‘হীরক রাজার দেশে’ খ্যাত এই পাহাড়টি আমাকে তেমন ভাবে না টানলেও আমার বাড়ির লোকেদের উৎসাহের কোনো অভাব ছিল না। প্রায় পাচঁশো সিঁড়ি ভেঙ্গে পাহাড়ের ওপরে উঠে আমার দুই ভাই মন্দির দেখে এল এবং সেই পাহাড় চুড়োর মন্দির দেখে তাদের অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজকাহিনীর বাপ্পাদিত্য গল্পটি মনে পড়ে গেল। যখন জয়চন্ডী পাহাড় থেকে নেমে আসছি সুর্য্য অস্ত গেছে পাহাড়ের আড়ালে। ফেরবার পথে রঘুনাথপুর শহরে ছোট বড় বাড়ীর মাঝখান থেকে জয়চন্ডী পাহাড়ের উকিঁঝুঁকি নতুন করে ভাল লাগালো এই পুরুলিয়া শহরটিকে।
সারাদিনের ক্লান্ত শরীর হোটেলে ফিরে বিশ্রাম চাইলো। হোটেলের ঘরে পকৌড়া সহযোগে চা খেতে খেতে ম্যানেজার বাবুর কথা শুনছিলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম চাহিদা অনুযায়ী যোগান কম থাকায় পুরুলিয়াতে হোটেলের মালিকপক্ষরা আর গাড়ীর চালক বা মালিকরা একত্রিত হয়ে পযটকদের নিশ্চিন্তে ঘোরাফেরার ব্যবস্থা করেছেন। প্রত্যেকের নিজ্বস্ব গাড়ী ও চালকের ব্যবস্থা আছে এবং তাই নিয়ে কারুর মধ্যে কোনোও রেষারেষি নেই। এমনকি কাছেপিঠের সব দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার খরচাপাতিও সব সমান। তাই নেই কোনও অভিযোগ দুপক্ষেরই।
অয্যোধা পাহাড়ের পাদদেশে চড়ীদা গ্রাম। মুলত ছৌনাচের মুখোশ বানানো হয় এখানে। আগে গ্রামবাসীদের জীবিকা মূলতঃ কৃষিনির্ভর হলেও এখন প্রায় প্রতেকেই এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ীর দেওয়াল, তুলি দিয়ে উজ্জ্বল রঙে রাঙানো। মাটির ছাচঁ বা ‘মাথামাটি’ বানিয়ে তার ওপর কাগজ বা কাপড় বসিয়ে তৈরী হয় মুখোশের কাঠামো। এরপর চিত্রশিল্পীর দক্ষতায় ফুটে ওঠে চোখ মুখ এবং বিভিন্ন আবেগের সুক্ষ প্রকাশ। এরপর নানা রকমের মাটি থেকে তৈরী রঙ লাগানো হয় মুখোশগুলোতে।
মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম আর শুনছিলাম অসম্ভব দারিদ্র্য থাকা সত্ত্বেও কাজে কোনো গাফিলতি নেই। অমলিন হাসি ও আতিথেয়তা আমাদের মুগ্ধ করলো। যেখানেই বেড়াতে যাই না কেন সেখনাকার স্যুভেনিওর সংগ্রহ করা আমার শখ। বলা বাহুল্য যে আমরা সবাই বেশ কিছু মুখোশ সগ্রহ করলাম। সৃজনশিল্পের দাম দেয়া যায় না, না এই অপূর্ব কারিগরী দক্ষতার কোনোও মূল্য হয়। শুধুমাত্র শিল্পীদের মুখের হাসিই আমাদের এই শিল্পকে সংগ্রহ করে রাখার পাথেয়। বেরিয়ে পড়লাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। তখন গোধূলির রঙ সারা আকাশ জুড়ে। শুনেছি বসন্তে নাকি শিমুল পলাশের রঙে মনে হয় সারা পুরুলিয়াতে আগুন লেগেছে। চড়ীদা গ্রাম থেকে ফেরবার রাস্তার দু ধারে রাঙা হয়ে থাকা শিমুল পলাশে মনে হচ্ছিল রাঙা নেশা বোধহয় কবি একেই বলেছেন।
হোটেলে ফিরতে ফিরতে অন্ধকার হয়ে এলো। আজ আমাদের মনটা একটু খারাপ। ছুটি শেষ। সত্যি ছেড়ে যেতে মন চাইছে না। যদিও শহুরে বিলাসিতায় অভ্যস্ত আমরা বেশিদিন এই পরিবেশে হয়ত থাকতে পারব না; তবে কখনো যদি আবার আসবার সুযোগ পাই, তবে সময় হাতে নিয়ে আসব।
সকালবেলা তল্পিতল্পা গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম আসানসোলের উদ্দেশে। গাড়ী ছুটে চলল শহরের দিকে। পেছনে পড়ে রইলো প্রকৃ্তির সব সৌন্দর্যে সেজে থাকা পুরুলিয়া। তার রুক্ষ পথঘাট, সবুজ বনাঞ্চল, সবুজ পাহাড় আর পলাশের বন, আমাকে আবার ফিরিয়ে আনবে এই পুরুলিয়ায়। মন পরে থাকলো এই —“লাল মাটির সোরানে”।

সুদেষ্ণা মিত্র
এডিটর, দু~কলম
Porte porte jeno amaro purulia ghora hoye gelo.khub sundor lekha.
লেখিকার কলমে জাদু আছে।নিজের সাথে পাঠক কেও পুরুলিয়া ভ্রমণ করিয়ে দিলেন।