Home বিবিধ, গল্প অপারেশন ঠাম্মা
বিবিধগল্প

অপারেশন ঠাম্মা

ভাস্কর সেনগুপ্ত

অধুনা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ‘করোনা’ নামধারী মহামারীটা একটা বিশেষ গুরুত্বপূণ’ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। মিডিয়াও ব্যাপারটা নিয়ে নানা তথ্যপূণ’ ছবি ও আলোচনা সব সময় এমনভাবে চালাচ্ছে, যার ফলে এই রোগ ও আক্রান্ত ব্যক্তির বিষয়ে একটা  বেশ ভয়ের আবহাওয়া, তার বা সেই  পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের একেবারে এক ঘরে করে দেবার একটা প্রবণতা তাদের অন্যান্য আত্নীয় ও প্রতিবেশীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। মানুষের মনের মধ্যে এই যে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে এই রোগটির প্রতি তা থেকে অনেক স্বরচিত ঘটনা বা গল্প জন্ম নিচ্ছে যার সঙ্গে বাস্তবের কোন যোগাযোগ নেই। ‘এই ফ্ল্যাটটাতে বা এই বাড়িতে করোনার কেস আছে’ এই খবরটুকু যদি একবার চাউর হয়ে যায় তবে আর রক্ষা নেই। দাবানলের মত সেই খবরটা চার দিকে ছড়িয়ে পড়বে, সেই হতভাগ্য বাড়ি বা ফ্ল্যাটটা যেন ‘সামাজিক দূরত্ব মেনে দশ’নীয় স্থান’ ‘বলে এলাকায় চিহ্নিত হয়ে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো পাড়ার লোক, প্রতিবেশীরা এমন ভাব দেখাতে থাকে যেন ওই বাড়ি বা ফ্ল্যাট থেকে বসন্তের ঝরা পাতার মত ‘করোনা’ ভাইরাস টুপটুপ করে ঝড়ে পড়ছে। উল্টো গল্প যা অনেক মানবিক তা যে নেই তা নিশ্চয় নয় তবে তা খুবই সামান্য।

জুলাই মাসের মাঝামাঝি একটা দিন। সন্ধ্যাবেলা বাড়ির বৈঠকখানায় সোফায় গা এলিয়ে টিভি দেখছিলেন কুশল ও কাবেরী।দু বছর হল চাকরী থেকে অবসর নিয়েছেন কুশল, দক্ষিণ  কলকাতার এক প্রান্তে দো’তলা বাড়ি। একমাত্র ছেলে কুণাল তিন বছর হল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে অফিসার গ্ৰেডে চাকরী করে। একদম শান্তির, সুখের নিলয় তাদের বাড়ি ‘শান্তিকুঞ্জ’। পুকুরের শান্ত জলে ঢিল পড়লে যেমন বুদ্বুদ তৈরী হয় তেমনি এই বাড়ীর শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাতেই যেন বেজে উঠল কু্শলের মুঠোফোন। কানে দিতে ওপারে ছোট ভাই কাজলের গলা ভেসে এল। প্রাথমিক কুশল প্রশ্নের পর মূল বক্তব্যে তাড়াতাড়ি চলে আসে কাজল। ওদের ঠিক একটা বাড়ি পড়েই মুকুলবাবুর বাড়ি, স্বামী-স্ত্রী ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তাদের সংসার। মুকুলবাবু এক বছর আগে অবসর নিয়েছেন, ওনার স্ত্রী এখনও একটি প্রাইভেট সংস্থায় চাকরী করেন। আজ কিছুক্ষণ আগে কিছু প্রয়োজনে পাড়ার মুদিখানা দোকানটায় যাবার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল কাজল। ওর সামনেই মুকুলবাবুর বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। মুকুলবাবু নিশ্চয় গাড়িটা আসার অপেক্ষায় ছিলেন – বাড়ি থেকে বেরিয়ে একদম গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। পিছনের সীটে বৌদি বসে আছেন, দেখতে পেল কাজল। বৌদি তো বাসে করেই অফিসে যাতায়াত করেন, তাছাড়া উনি সন্ধ্যা সাতটার আগে কখনও ফেরেন না। তাহলে এখন, তাও গাড়িতে করে! মুকুলবাবু গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলে দাঁড়ালেন। ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নামলেন বৌদি, বেশ ভেঙ্গে পড়া উস্কো খুস্কো চেহারা। মুকুলবাবু বৌয়ের হাতটা ধরে তাকে দাঁড় করালেন, সশব্দে বন্ধ করলেন গাড়ির দরজা। গাড়ির সামনের সীটে ড্রাইভারের পাশে বসে থাকা ভদ্রলোক বললেন, ‘আমরা তাহলে চলি। রিপোর্টটা পেতে তিন দিন লাগবে। ওরাই ফোনে জানাবে, আমরাও যোগাযোগ রাখব। ঘরদোর সব ভাল করে স্যানিটাইজ করে রেখেছেন তো।’ মাথা নেড়ে ও হাত তুলে ওই প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর দিলেন মুকুলবাবু, তারপর ধীরে ধীরে বৌদিকে নিয়ে বাড়ির দিকে অগ্ৰসর হলেন। পড়লেন একেবারে কাজলের সামনে। ‘শরীরটা খুব খারাপ লাগছে না বৌদি?’,  কাজলের প্রশ্নের উত্তরে যেভাবে মাথা নাড়লেন বৌদি তার মানে হ্যাঁ-ও হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। পাশ থেকে মুকুলবাবু বলে উঠলেন, ‘না না, তেমন কিছু নয়।’ ওনারা কাজলকে পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেলেন। কিন্তু কাজলের মনটা খচ্ খচ্ করতে থাকল। দোকান থেকে বাড়িতে ফিরতেই দেখল স্ত্রী শ্যামলী ভীষণ উত্তেজিত। নীচু স্বরে কাজলকে যা বললেন শ্যামলী তার মানে হল যে, কিছুক্ষণ আগে ওদের ঠিকা কাজের লোক প্রতি দিনের জন্য ওদের বাড়িতে এসেছিল। এই মেয়েটি মুকুলবাবুদের বাড়িতেও কাজ করে। আজ এ বাড়িতে আসার আগে ও মুকুলবাবুর বাড়ি হয়ে এসেছিল। ওকে আজ  মুকুলবাবু ডেকে বলে দিয়েছেন যে তাকে আগামী তিন সপ্তাহ  আর কাজে আসতে হবে না। মাইনে সে নিয়মমত  সব পাবে শুধু তাকে এ ক’দিন কাজে আসতে হবে না। মেয়েটি নিজের চোখে দেখেছে বাবা-ছেলে মিলে বৌদির ঘরটা ঝাড়পোঁছ করছে, কিসব বোতলে করে ছিটিয়ে দিচ্ছে বাড়ির সব ঘরে।

দু’য়ে দু’য়ে যোগ করলে যে চার হয়, তা কে না জানে। বোঝাই যাচ্ছে বৌদির ‘করোনা’ হয়েছে। ওরা দুজনে মিলে বসে আলোচনা করে প্রথমেই যেটা ভেবেছে তা হল এই অবস্থায় মা’কে ওদের কাছে রাখাটা ঠিক হবে না।’ করোনা’র মত একটা অসুখ একদম দোরগোড়ায় এসে গেছে। কাজলের মার প্রায় চুরাশী বছর বয়স। ওনার হার্টের সমস্যা আছে। মা তার দুই ছেলের কাছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে থাকেন। সেই হিসাবে মা কুশলদের বাড়িতে আগস্ট মাসে আসতেন। এই পরিস্থিতিতে কুশলরা  যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যদি মাকে তাদের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখেন তাহলে অন্ততঃ মায়ের ব্যাপারে ওরা নিশ্চিন্ত হতে পারেন।

এ তো ভয়ানক এক খবর। অবশ্যই মাকে ওখানে রাখা ঠিক হবে না। কুশল ভাইকে বলেন, ‘আমরা পারলে আজকেই মাকে নিয়ে আসছি। কুণাল অফিস থেকে ফিরুক। একটু রাত হতে পারে। আমি কুণালকে একটা ফোন করে তোকে কনফার্ম করছি। আর তোরা ওই ঠিকা মেডটাকে এক সপ্তাহ ছুটি দিয়ে দে। করোনা হওয়া লোকের বাড়িতে কাজ করেছে। ওর মাধ্যমেও তো তোরা ইনফেক্টেড হয়ে যেতে পারিস।’ তখনকার মত ফোন নামিয়ে রাখে কুশল।কাবেরীকে সব খুলে বলে কুশল। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মা’কে আজকেই নিয়ে এস। আমি মা এসে যে ঘরে থাকেন সেটা গুছিয়ে নতুন চাদর পেতে দিচ্ছি। কিন্তু কুণালের তো ফিরতে সেই আটটা বাজবে। একটু বিশ্রাম নিয়ে কিছু খেয়ে তারপর তো যাবে। বেশী দেরী হয়ে যাবে না? তার থেকে ঠাকুরপোরা যদি মাকে পৌছে দিয়ে যেত… ”না  না, ওদের নিজের গাড়ি নেই, আসবে আবার ফেরত যাবে, ওলা-উবের রাত বেশী হলে রেট অনেক বাড়িয়ে দেয়, ও সবের  দরকার নেই। আমরাই গিয়ে নিয়ে আসব’। ‘আচ্ছা,কুনুরা যেমন করেছিল সেরকম করলে কেমন হয়, ‘মুখে হাসি ফুটে উঠে কাবেরীর। হাসে কুশলও, বলে, ‘বাদ দাও তো।যত ছেলেমানুষী কাজ। আমি কুণালকে ফোন করে সব সেট করে নিই। তারপর তো কাজুদের জানাতে হবে। ওরা মাকে সব জানাবে,ওনার ব্যাগ  গুছিয়ে তৈরী করবে।’
কুণালকে ফোন করে সব জানায় কুশল। ঠিক হয় অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে রাত দশটার মধ্যে কুশলরা পৌঁছাবে কাজলদের বাড়ি। এখন ওই সময় সাধারণতঃ পাড়ার কেউ বাইরে থাকছে না, তাই লোকজন এসে ভীড় করে দাড়াবে না। শান্তিতে চটপট মাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে আসবে ওরা। কাজলকে ফোন করে পুরো প্ল্যানটা জানায়। মা রাতের খাবার সাড়ে ন’টার মধ্যে খেয়ে নেন। তাই ঠিক হল আজ রাতের খাবারটা কাজলদের বাড়িতেই খেয়ে মা তৈরী থাকবেন, ওরা গেলেই যাতে সাথে সাথেই গাড়িতে উঠতে পারেন।

কুনু মানে ওদের মেয়ে কুন্তলা। প্রায় তিন বছর হল ওর বিয়ে হয়েছে অরিত্রের সাথে। জামাই একটি বহুজাতিক কম্পানীর মাকেটিং ম্যানেজার, প্রতি মাসেই তার ট্যুরের প্রোগ্ৰাম থাকে। মার্চ মাসের কুড়ি তারিখে অরিত্র দশ দিনের ট্যুরে আমেদাবাদে গিয়েছিল। সেই সুযোগে কুনু ওর শাশুড়ীকে নিয়ে ওর ননদের  বাড়িতে গিয়েছিল রাজপুরে। ইচ্ছে ছিল ক’দিন ওখানে থেকে জামাই ফেরার আগে ওদের টালিগঞ্জের বাড়িতে ফিরে আসবে। ওরা যাবার একদিন পরেই তো প্রধানমন্ত্রী লকডাউন ঘোষণা করলেন।চব্বিশ তারিখ সন্ধ্যার সময় অরিত্রর ফোন এল। পরিস্থিতির চাপে ওদের ট্যুর ক্যানসেল হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করে পঁচিশ তারিখ রাতে ফ্লাইটের একটা টিকিট পাওয়া গেছে। ওই ফ্লাইটে অরিত্র বেশী রাতে বাড়িতে ফিরবে। খবরটা পেয়ে ওরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল বাড়ি ফিরবার জন্য। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কোন ওলা/উবের পাওয়া গেল না। কোন ভাড়ার গাড়িও রাজি হল না। সব জায়গায় নাকি ভীষণ চেকিং হচ্ছে, এক অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া অন্য যে কোন গাড়ি পুলিশ থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, গাড়ির কাগজ চেক করছে। কি করা যায়? কুনু আর তার নন্দাইয়ের মাথায় তখন একটা বুদ্ধি খেলে। কুবুদ্ধিই বলা উচিত। ওরা একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে। রুগী সাজলেন ওর শ্বাশুরীমা। অ্যাম্বুলেন্সে  তুলে তাকে শুইয়ে দিয়ে নিজেও ব্যাগ নিয়ে শাশুড়ীর পাশে বসে পড়ে। ওদের কথামত অ্যাম্বুলেন্স কোন বাধা ছাড়াই চলে আসে টালীগঞ্জের এক প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে। এমারজেন্সীর সামনে ওদের নামিয়ে দিয়ে পয়সা নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চলে যাওয়ার পর ওরা কিছুক্ষণ ওখানে একটা চাতালে বসে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে ব্যাগ নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে মিনিট দশেক হেঁটে নিজের বাড়িতে পৌঁছে যায়।

কুণাল অফিস থেকে ফিরল প্রায় আটটার সময়। তারপর প্ল্যান মত শুরু হল ওদের জরুরী অ্যাকশন, কুণালের ভাষায় অপারেশন ঠাম্মা। পৌনে দশটা নাগাদ গাড়ি নিয়ে ওরা বের হয় বাড়ি থেকে। রাস্তা একদম ফাঁকা, শুনশান। কলকাতার এ এক অন্য রূপ। হুহু করে গাড়ি ছুটিয়ে দেয়  কুণাল, পনেরো মিনিটের মধ্যে ওরা কাজলদের পাড়ায় পৌছে যায়।   পাড়ায় ঢোকার মুখে কুশল ফোন করে কাজলকে জানিয়ে দেন যে, ওনারা এসে গেছেন। একদম ওদের বাড়ির সামনে গিয়ে গাড়িটা দাঁড় করায় কুণাল। রাস্তায় কোন লোক নেই, সব চুপচাপ, শান্ত। গাড়ি দাঁড়ানো মাত্র দরজা খুলে বেড়িয়ে আসেন কাজল। ওনার হাতে এদের পরিচিত বড় কাপড়ের একটা ব্যাগ। এই ব্যাগটা মা সবসময় সাথে রাখেন। পিছনেই নাতি কানুর হাত ধরে মা বেড়িয়ে আসেন। ওদের পিছনে দরজায় এসে দাঁড়ায় শ্যামলী। গাড়ি থেকে নেমে পিছনের দরজাটা খুলে দাড়ান কুশল,কাজল ব্যাগটা গাড়ির পিছনের সীটে প্রথমে তুলে সরে দাঁড়ায়, তারপর কানু হাত ধরে তার ঠাম্মাকে গাড়িতে তুলে দেয়। দরজাটা বন্ধ করে নিজে সামনের সীটে বসে সীটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে, ভাই ও ভাইপোকে উদ্দেশ্য করে কুশল বলেন, ‘চলি তাহলে। সবাই সাবধানে থাকিস।’ ওরাও এদের ‘গুড নাইট’ জানায়। কুণাল এবার বাড়ির পথ ধরে।

পথে খুব কিছু কথা হয় না। সাড়ে দশ’টার মধ্যে ওরা পৌছে যায় ওদের বাড়িতে। কাবেরী আগ্ৰহের সাথে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ‘এস মা, এস’,’ ‘দেখ তো কি ব্যাপার। হুট করে কি রকম আমাকে এ বাড়িতে পাঠিয়ে দিল’, ‘কি করবে মা। এ যা এক রোগ এসেছে আমাদের মধ্যে, আগে তো তার থেকে বাঁচতে হবে। আর এটাও তো তোমারই বাড়ি।’ হাত ধরে শাশুড়ীকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায় কাবেরী। ‘তাহলে বাবা, আমাদের অপারেশন ঠাম্মা সাকসেসফুল’, কুণালের কথায় হাসি মুখে দুজনে ভিক্ট্ররী স্টাইলে  হাতে হাত মেলান। ব্যস্ত গলায় কুশল বলেন, ‘দাঁড়া, তোর কাকাকে আমাদের পৌঁছ-সংবাদটা দিয়ে দিই।’

সমাপ্ত

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!