Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ “নিজামের দেশে : দুদিনের ছুটিতে হায়দ্রাবাদে”
ভ্রমণপ্রবন্ধ

“নিজামের দেশে : দুদিনের ছুটিতে হায়দ্রাবাদে”

সোম শেখর বোস


অষ্টমীর দুপুর। অঞ্জলি দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম প্যাণ্ডেল হপিং-এ। বাঙালীর সব থেকে বড় পার্বণ, সারা বছর ধরে অপেক্ষায় থাকি এই পাঁচটি দিনের জন্যে। আড্ডা-আনন্দ, ঘোরাফেরা, খাওয়া-দাওয়া – চলতেই থাকে। খাওয়া-দাওয়া মানে এই সময়ে প্রত্যেকের মনে একটাই কথা – বিরিয়ানী। তাই দুপুরের খাবার শুরু করলাম বিরিয়ানী দিয়েই। মেনুকার্ডে চোখ বোলাতে গিয়ে নজর কাড়লো হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানী। মনে মনে ভাবলাম পুজো যেমন বাঙালীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে, তেমনই বাঙালীর পায়ে তো শর্ষে লাগানোও আছে। ভ্রমণ পাগল বাঙালী। সুযোগ খোঁজে ঘুরতে যাওয়ার, সে কাছে হোক বা দূরে। দরকার শুধু একটা বাহানা। আমরাও পেয়ে গেলাম ঘোরবার বাহানা। বিরিয়ানী খেতে চলো যাই হায়দ্রাবাদ – নিজামের দেশে। ঠিক করলাম ঝটিকা সফরে হায়দ্রাবাদ যাবো। ডিসেম্বরের শেষে বেরিয়ে পড়লাম হায়দ্রাবাদের উদ্দেশ্যে।

এই শহরকে ঘিরে জড়িয়ে রয়েছে কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস। ১৫৯১ সালে মহম্মদ কুতুব শা-এর তৈরী এই শহর। ১৭২৪ সালে তা চলে যায় মুঘলদের অধীনে। মুঘল ভাইসরয় প্রথম আসফ জাহ এখানেই তাঁর নিজস্ব সাম্রাজ্য স্থাপন করে, হায়দ্রাবাদের প্রথম নিজাম হলেন। ১৩ বছর রাজত্ব চালাবার পর, তাঁর তিন ছেলে – নাসির জং, মুজাফর জং এবং সালাবাদ জং রাজত্ব সামলান।

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পর হায়দ্রাবাদ, অন্ধ্রপ্রদেশের রাজধানী ছিলো। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে কয়েক বছর আগে অন্ধ্রপ্রদেশ দুটি পৃথক রাজ্যে বিভক্ত হয় – অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানা। হায়দ্রাবাদ আজ তেলেঙ্গানার রাজধানী। মুসি নদীতীরে অবস্থিত এই শহরকে “The City of Pearl” নামেও সম্বোধণ করা হয়।

প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে শহরটিকে খাদ্যরসিকদের মক্কা বলা হয়। বিরিয়ানী থেকে শুরু করে বিহারী, মাটন গোস্ত্‌, কাবাব, হালিম, মাটন দালচা, ক্ষুবানী কা মিঠা – আরোও কতো কি! সঙ্গে বেকারীর খাবার এবং সকাল-বিকেলের জলখাবার, সঙ্গে ইরানী চা তো আছেই। তবে হ্যাঁ – পেট রোগা লোকেদের জন্যে বলি, একটু সাবধানে খেতে। খেতে গিয়ে যেন ঘোরাটাই পণ্ড না হয়ে যায়। আমরা যে একেবারে পেটুকের বংশধর, তা বলছি না; তবে, বলতে কি মুঘলরা চলে গেছে, কিন্তু তাদের খাবারের সম্মান বজায় রাখবার দায়িত্বটা আমাদের ওপর ছেড়ে গেছে। তাই হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানী দিয়ে শুরু করলাম আমাদের হায়দ্রাবাদ ভ্রমণ স্থানীয় লোকেদের মুখে শুনে প্যারাডাইস সার্কেল অঞ্চলে গিয়ে হোটেল প্যারাডাইসে গিয়ে মাটন বিরিয়ানীর স্বাদ নিলেও মন ভরলো না। গেলাম সদরের হেঁসেলে। রায়তা ও ক্ষুরসার সঙ্গে পরিবেশিত মাটন দম গোস্ত্‌ বিরিয়ানী যেন সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি ভুলিয়ে দিলো। বিশ্ব দরবারে নিজামরা যেভাবে বিরিয়ানীকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো, তা আক উপলব্ধি করতে পারলাম। অনেকে বলে, তৈমূর না কি এই দেশে বিরিয়ানীর প্রচলণ করেন। ইতিহাসবিদ্রা বলেন তাজমহল আর মমতাজের সঙ্গে ওতোপ্রতভাবে জড়িত এই মহার্ঘ খাবারটি। প্রশংসা যেই নিক্‌ না কেন, আমরা কোনোও তর্কে যেতে রাজি নই। গোলাপজল, কেওড়ার জল, জাফরানের সঙ্গে আরোও কতো রকম মশলায় তৈরী এই অমৃতকুম্ভের সন্ধানে এই ভ্রমণের আয়োজন। সারা ভারতবর্ষে বিভিন্ন জায়গায় বিরিয়ানীর ধরণ বিভিন্ন রকম। হায়দ্রাবাদী, লক্ষ্ণৌই, ঢাকাই, দিন্দুগাল, কলকাতা … এক একটি শহরে একেক রকম পদ্ধতি। বিরিয়ানী নেশায় বুঁদ হয়ে ভুলেই যেতে বসেছিলাম হাতে মাত্র দুটো দিন। প্রথম দিন মিশন বিরিয়ানী দিয়ে শুরু করলাম বটে; কিন্তু কাল সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে, নিজামের শহরটিকে খুব কাছ থেকে দেখে নিতে।

সকালে ইরানী যা ও মালাই রুটি দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম গোলকুন্ডা ফোর্টের দিকে। কাকাতীয়া ও কতুবশাহী বংশের এক অনবদ্য নিদর্শন এই দূর্গ। স্থানীয় বাসিন্দারা একে “গোল্লা কোন্ডা” বলে ডাকে। যার মানে “Shepherd’s Hill”শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত গোলকুন্ডা ফোর্টে ঢোকার ৮টি দরজা আছে। তার মধ্যে ফতেহা দরওয়াজা (Fetch Darwaza) বিখ্যাত। প্রায় ১৩ ফুট চওড়া এবং ২৫ ফুট লম্বা দূর্গ আজ প্রায় ধ্বংসস্তুপের আকার নিয়েছেযেটুকু রয়েছে সরকার ও ASI-এর তত্ত্বাবধানে সুরক্ষিত রয়েছে। কাকাতীয় বংশের পর ১৩৪৬ থেকে ১৫১৮ পর্যন্ত গুলবর্গার বাহমনি সুলতানদের দখলে থাকে দূর্গ। ১৫১৮-এ পারস্য থেকে আসা সুলতান কুলী কুতুব শাহ কুতুবশাহীরাজের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৫১৮ – ১৬৮৭ পর্যন্ত গোলকুন্ডায় রাজধানী গড়ে রাজত্ব করেন। ১৬৮৭ তে দ্বিতীয় বারের প্রচেষ্টায় এবং আব্দুল্লা খান পানির বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে দূর্গ দখল করে মুঘল বাহিনী। গোলকুন্ডা দখলের পর দুই রত্নখণ্ড কোহিনূর ও হোপ যায় ঔরংজেবের দখলে, গোলকুন্ডার হীরার না কি যথেষ্ট সুনাম ছিলো। সুদূর পারস্য, তুরস্ক থেকে ব্যবসায়ীরা আসতেন হীরা কিনতে।

দূর্গের আর এক আকর্ষণ হলো এর স্থাপত্য। হারেম মহল, মন্দির মসজিদ, ত্রিতল তোপখানা, কারাকক্ক, মনোহর বাগিচা ইত্যাদি। প্রত্যেকদিন এখানে Light & Sound-এর মাধ্যমে গোলকুন্ডার ইতিহাস বলা হয়। অমিতাভ বচ্চনের কণ্ঠে এই “Son-et-Lumiere” Show-টিও খুব বিখ্যাত। দূর্গ দেখতে গেলে কিছুটা সময়হাতে নিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। কমপক্ষে ঘন্টা তিনেক সময় দিতেই হবে। যদি Light & Sound Show-টিও দেখতে চান, তাহলে বেকেলের আগেই দূর্গে প্রবেশ করা বাঞ্ছনীয়। প্রত্যেকদিন সন্ধ্যা ৬:৩০ থেকে  শুরু হয় শুরু হয় এই প্রদর্শনী। প্রত্যেকদিন দুটি Show হয় মাস-কাল তারতম্যের জন্যে বদলায় Show-এর সময়ে। বানজারা দরজা দিয়ে দূর্গ থেকে বেরিয়ে ১ কিলোমিটার এগোলেই রয়েছে ইব্রাহিমবাগ যেখানে শায়িত আছে। কুতুবশাহী বংশের সাত কুতুবশাহীর সমাধিক্ষেত্র। গ্রানাইট পাথরের তৈরী ছোট্ট মসজিদ রয়েছে এখানে। ঔরংজেব না কি এখানে এসে নামাজ পড়তেন।

দূর্গ থেকে ইব্রাহিমবাগ হয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চললো ওসমান সাগরের দিকে। বর্ষায় ইসা নদী দরুন বন্যার হাত থেকে পেতেই গান্ধীপেট গ্রামে নির্মান করা হয় বাঁধ ও কৃত্রিম জলাশয়। এই জলাশয়ের ধারেই গড়ে উঠেছে সুন্দর বাগিচা এবং রেসর্ট। চাইলে এই জলাশয়ে নিতে পারেন Water Sports-এর আনন্দ। কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে, শহরের দিকে এগোলাম। বিরিয়ানী অভিযান যে এখনোও শেষ হয়নি। দুপুরের সারতে পৌঁছলাম Medina-র দরবারে। এখানকার খাবারের যথেষ্ট সুনাম আছে। খাবারের শেষে ফিরনী খেতে ভুলবেন না। কলকাতার সঙ্গে মিল খুঁজতে যাবেন না। শুধু মনে রাখবেন, আপনি নিজামদের রান্নাঘরে আছেন।

খুব তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করলাম। কারণ এখনোও বাকি – বিড়লা মন্দির, Sudhakar Car Museum, লুম্বিনী পার্ক, হুসেন সাগর, সেকেন্দ্রাবাদ। আমিষের ছোঁয়া, তাই বিড়লা মন্দিরের বাইরে থেকেই প্রণাম জানিয়ে এগিয়ে গেলাম Sudhakar Car Museum-এর দিকে। এক অবিশ্বাস্য সংগ্রহশালা। মিউজিয়ামে প্রবেশের আগেই নজর কাড়ে ২৭ ফুট লম্বা তিনচাকা সাইকেলটি। মাত্র ৫০ টাকার বিনিময়ে ঘুরে দেখলাম এই Automobile Museum-টি। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। রয়েছে হরেক রকমের গাড়ি, সাইকেল, মোটর বাইকের সম্ভার। ক্যামেরা গাড়ি, পিৎজা গাড়ি, কম্পিউটার, ব্যাট, কাপ, ক্যামেরা, বার্গার ইত্যাদি আরোও অনেক কিছু। আছে ১ তলার সমান উঁচু মোটর সাইকেল, দোতলা বাস, বিভিন্ন রকম Vintage গাড়ি। প্রায় ৩০ রকম মোটর বাইকের সম্ভার রয়েছে এখানে। এটি একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা। সুধাকর যাদব তৈরী করেন এই সংগ্রহশালা। সমস্ত গাড়ি, সাইকেল, মোটর বাইকে অলঙ্করণ ও রূপদান তাঁরই হাতে। প্রত্যেকটি তৈরী করতে কমবেশী প্রায় ২০ দিন থেকে ১ মাস সময় লাগে। প্রত্যেকটিই যে তিনি রাস্তায় চালিয়েছেন, তার Video চাইলে দেখতে পারেন। তৈরীর খরচ প্রায় ৩ থেকে ৪ লক্ষ টাকা। তাঁর এই ব্যক্তিগত সংগ্রহশালার নাম ও বিবরন “Guinness Book of World Records” এবং “Replay’s Believe of Not”-এ স্থান পেয়েছে দেশী-বিদেশী বহু পত্র-পত্রিকায় ওনার সুখ্যাতি ছাপা হয়েছে।

 

আক্ষেপ রয়ে গেলো সুধাকরজীর সঙ্গে দেখা না হওয়ায়। আবার আসবো ফিরে এই আশা নিয়ে এগিয়ে গেলাম হুসেন সাগরের দিকে।

শহরের মাঝে অবস্থিত হুসেন সাগর। ১৫৬৩-তে ইব্রাহিম কুইল কুতুব শাহ এই কৃত্রিম লেকটির নির্মাণ করেন। এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম লেক। মুশি নদীর জলে সমৃদ্ধ এই লেকের ড্যাম হায়দ্রাবাদ ও সেকেন্দ্রাবাদকে যুক্ত করেছে। ৭ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এই লেকের মধ্যমণি ১৮ মিটার ঊঁচু, ৪৫০ টনের বুদ্ধমূর্তি, ১৯৯২ সালে গুরু দলাই লামার হাতে এই মূর্তির উন্মোচন হয়। লেকটি Heart-এর আকারে দেখতে বলে United Nation World Tourism Organisation (UNWTO) এটিকে ‘Heart of the World’ আখ্যা দিয়েছে। লেকে Boating, Parasailing ইত্যাদির ব্যবস্থা আছে। Boat-এ করে খুব কাছ থেকে দেখে আসতে পারেন ‘Rock of Gibraltar’-কে। অর্থাৎ বুদ্ধের মূর্তিটিকে। এই নামেও অনেকে ডাকেন। লেকের ধারে রয়েছে আরো আকর্ষণ। লেকটিকে ঘিরে রয়েছে তিনটি পার্ক – Indira Park, Lumbini Park এবং Sanjeevaiah Park রয়েছে অসংখ্য খাবারের দোকান। খেতে খেতে দেখে নিতে পারেন, Light & Sound Show, Lumbini Park-এর প্রধাণ আকর্ষণ। সময় গড়ীয়ে যে কখন সন্ধ্যা নেমেছে বোঝা যায়। সন্ধ্যা ৭:১০-এ Lumbini Park থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গেলাম সেকেন্দ্রাবাদের দিকে। দূরত্ব মাত্র ৮ কিলোমিটার।

নেকলেস রোড ধরে হুসেন সাগরের উত্তরে পাড়ি দিলাম ১৮০৬-এ ব্রিটিশের হাতে গড়া ক্যান্টনমেন্টে। হায়দ্রাবাদের দ্বিতীয় রেলস্টেশন এখানে অবস্থিত। এখান থেকেই আমাদের ট্রেন ধরতে হবে বেঙ্গালুরুর উদ্দেশ্যে। নিজাম সিকান্দার জাহ-এর নামানুসারে সেকেন্দ্রাবাদের নামকরণ হয়েছে। স্টেশন চত্বরে রয়েছে প্রুচুর খাবারের হোটেল। কাবাব, হালিম থেকে ইডলি, ধোসা সমস্ত খাবারের যেন আসর বসেছে এখানে। না, আজ আর ওইদিকে হাত বাড়ালাম না। গেলাম M. G. Road-এর Golden Dragon-এ। চীনা খাবারের জন্যে এর সুনাম যথেষ্ট। নিজামের দেশে চীনা খাবার? একটু বেমানান লাগলেও, খাবার খুবই সুস্বাদু। আজ একটু স্বাদ বদলালাম। কাল থেকে আবার নিজামদের উত্তরসূরীদের রান্নাঘরে উঁকি দেবো। রাত যেন শেষ হয় না। ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে ভিড়। এখানে যেন রোজই উৎসবের মেজাজ। মনকে সান্ত্বনা দিয়ে ফিরলাম হোটেলে। হাতে সময় কম অথচ কতো কি দেখা বাকি এখনোওকাল ফিরে যেতেই হবে।

সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই মনটা খুব উদাস লাগছিলো। তিনদিনের জন্যে নিজামদের দেশে এলাম বটে। কিন্তু শহরটাকে কিছুতেই চিনতে পারছিলাম না। হায়দ্রাবাদের সেই গন্ধটাই যেন উধাও। আজ হায়দ্রাবাদ Hi-Tech  City-তে রূপান্তরিত হয়েছে, সর্বত্র আধুনিকতার ছোঁয়া। পুরনো নবাবীয়ানা, পুরনো মহল্লা – কোথায় যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। তারই খোঁজে আজ আমরা যাবো পুরনো শহরের প্রাণকেন্দ্র চারমিনারের কাছে। সমস্ত প্রশ্নের জবাব যেন খুঁজে পেলাম এখানে এসে। চারিদিকে দোকানপাট, গাড়ি, অটো, রিক্সা, খাবের গন্ধ – এ যেন ভ্রমন ও খাদ্য রসিকদের পীঠস্থান। গাড়ি রাখবার জায়গা নেই, অগত্যা আজ অটো করেই ঘোরা শ্রেয় মনে করলাম। হোটেল থেকেও বলেছিলো, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট্টাই ব্যভার করা যুক্তিসম্মত কাজ হবে। পায়ে হেঁটেই আজ আমরা হায়দ্রাবাদকে ঘুরে দেখবো। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে। অটো ধরে সোজা চারমিনারের দোরগোড়ায় হাজির হলাম।

এলাকার প্রাণকেন্দ্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে শতাব্দী প্রাচীন এই মিনারটি। ১৫৯৩ সালে মহম্মদ কুলী কুতুব শাহ প্লেগ মহামারী দূর করে তার স্মারক হিসাবে এই মিনারটি তৈরী করেন। ৫৬ মিটার উঁচু মিনারটির দ্বিতীয় তলে মন্দির এবং তৃতীয় তলে রয়েছে মসজিদ। মিনারে রয়েছে প্রায় ১৫০টি সিঁড়ি। মিনারের ওপর থেকে শহরের দৃশ্য খুবই চমকপ্রদ। একদিকে বিখ্যাত মক্কা মসজিদ। আর একদিকে চৌমহল্লা প্যালেস। অন্যদিকে শহরের পুরনো লাডবাজার। রয়েছে ১৫৯৪ সালে কুতুব শাহের তৈরী জ্বামা মসজিদ (Jama Masjid)চারমিনারের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত বিখ্যাত মক্কা মসজিদ, ১৬১৪ সালে শুরু হয়ে ১৬৮৭ সালে ৮ লক্ষ টাকা ব্যায়ে নির্মিত হয় এই পবিত্র স্থানটি। একসঙ্গে প্রায় ১০,০০০ জন বসে নামাজ পড়তে পারে। মসজিদের বাঁয়ে অবস্থিত নিজাম পরিবারের সমাধিস্থল। মসজিদের স্থাপত্য এককথায় অনবদ্য। মুঘল সাম্রাজ্যের আর এক সুন্দর নিদর্শণ। চূণবালির কারুকার্য, চিত্র, সুবিশাল খিলান সত্যিই মুগ্ধ করে। মক্কা মসজিদের প্রদক্ষিণ শেষ করে বেরোতেই বাঁদিকে নিমরাহ বেকারীর সুগন্ধে মনটা যেন পাগল হয়ে ঊঠলো। হায়দ্রাবাদের বিখ্যাত বেকারী বলে কথা। প্রচুর দ্রষ্টব্যের মধ্যে এটাও স্থান পেয়েছিলো। তাই পেটে ক্ষিধে না থাকলেও কোনোও দিকে না তাকিয়ে সোজা হাজির হলাম এখানকার বিখ্যাত কেক, কুকীজ ও কফি খেতে। দাম সামান্য বেশী হলেও, একবার খাওয়াই যায়। রোজ কি আর খাচ্ছি? ঠিক পোষালো না। ইচ্ছে করছে সব কটা Item একবার করে খেয়ে দেখতে – যদিও সেটা সম্ভব নয়। মনকে সান্ত্বনা দিলাম, নিজেকে বোঝালাম – ওরে! দুপুরে কাচ্চি বিরিয়ানী আছে তো!

পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলাম চৌমহল্লার দিকে, ১৮ শতকের তেহেরানের শাহ-র প্রাসাদের আদলে তৈরী। চার প্রাসাদের সমন্বয়ে তৈরী ১৭৫৩-এ সালার জং-এর গড়া এই স্থাপত্য। প্রাসাদের চারপাশে রয়েছে ইতিহাসের আরো নিদারুণ সাক্ষী। ঘড়িতে তখন ১২:৪০ বাজে। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়লাম। গেলাম বিখ্যাত লাডবাজারে, চুড়িবাজার বলেও বিখ্যাত। সরু গলির দুধারেই অসংখ্য পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানীরা। নানান ধরণের বিশেষ করে কাচের চুড়ির এক সম্ভার এখানে। দাম ১০০ টাকা থেকে শুরু করে কয়েক হাজার টাকা অবধি। রয়েছে বালা-কঙ্কণ, সোনা-রূপার ঝালরের বসন-ভূষণ, শাড়ি, শেরওয়ানী, দোপাট্টা ইত্যাদি। চোখ ধাঁধানো সমস্ত কারুকার্য যা না দেখলে হায়দ্রাবাদের বাজার ও শিল্প সম্পর্কে ধারণা অধরাই থেকে যাবে। সময় গড়ীয়ে তখন বেলা ২টো। বাজার ঘোরা শেষ করে এগিয়ে গেলাম সাদাব রেস্টুরেন্টের দিকে। মন ভরে খেলাম এবং উপলব্ধি করলাম নিজামের দেশের বাবুর্চিদের রান্নার দক্ষতা ও তার স্বাদ। এই সাদাবের টানেই যেন হায়দ্রাবাদে বারবার ফিরে আসতে হবে। ঘড়ির কাঁটা যেন দৌড়চ্ছে। বাকি এখন সালার জং মিউজিয়াম। মুসী নদীর তীরে অবস্থিত চারতলা সুবিশাল বাড়িতে গড়ে উঠেছে ভারত তথা এশিয়ার সুবিখ্যাত এই সংগ্রহশালা। পুরো ঘুরে দেখতেই ৪/৫ ঘন্টা লাগে, খুঁটিয়ে দেখতে গেলে দিনদুয়েক লেগে যায়। তবে বলবো, সমস্ত সংগ্রহশালা কমবেশী একই হলেও সালার জং-এর হাতির দাঁতের তৈরী জিনিস এবং Water-Oil Colour Painting – অনবদ্য। ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেইআড়াই ঘন্টার ম্যারাথন দর্শনে অনেক কিছু প্রাপ্তি হলো বটে কিন্তু বেশ কিছু ঐতিহাসিক জিনিসের সাক্ষী হতে পারলামও না। ইতিহাসকে পরখ করতে চাইলে অবশ্যই হাতে সময় নিয়ে যাওয়া উচিত।

শহরের পশ্চিমে তখন সূর্য ঢলে পড়েছে। ফিরতে হবে সেকেন্দ্রাবাদে। ঘরে ফেরার পালা। মনে একরাশ বাসনা নিয়ে। আবার অপেক্ষার পালা। আবার কখনোও আচমকা বেরিয়ে পড়তে হবে কোনোও অচেনা পথের উদ্দেশ্যে। বেঁচে থাকার অক্সিজেন নিতে। নিজের মনকে উজ্জীবিত করতে।  



Som Sekhar Bose

I am a Travel & Food Blogger. I want to promote the Tourism & Food Sector. We can discuss Travel Trip and Tricks, Problems, New Places, Offbeat Places etc.

 

 

 


 

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. দারুণ লিখেছিস্ সোম। এমন আরোও লেখ।

Leave a Reply to Srijit Mitra Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!