Home বিবিধ, প্রবন্ধ লকডাউন ডায়েরী
বিবিধপ্রবন্ধ

লকডাউন ডায়েরী


সুস্মিতা রায়


হে ভগবান! ২০২০ সালটা কি নিয়ে এলো আমাদের কাছে! বছরের প্রথম দু মাস কাটতে না কাটতেই চারিদিকে জমাট বাঁধতে থাকলো এক আতঙ্ক। ইনফেকশন আমাদের জানা ছিল, কিন্তু তার প্রকোপ এতো সাংঘাতিক হতে পারে তা ২০২০ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো। শুরু হলো লকডাউন। প্রথম কিছুসপ্তাহ সংসারের সব জিনিস জোগাড়পাতি, সেগুলোকে গুছিয়ে রাখা, ঘরবাড়ী পরিষ্কার করা এসবের পেছনে বেশ ব‍্যস্ততার মধ্যে কেটে গেল। সবথেকে বড় কথা মনের কোথাও উৎকণ্ঠা থাকলেও দুশ্চিন্তা ছিল না। সবসময় ঘর ও বাইরে সামলাতে ব‍্যস্ত আমার এই হঠাৎ ছুটি পাওয়াটা বেশ খুশির আমেজ এনে দিয়েছিল। সবাই মিলে বাড়ীতে একসঙ্গে থাকা, সারাদিন নানা কাজে সবাই সবাইকে সাহায্য করা বেশ ভালোভাবেই চলছিল। আমার মেয়ে ছোট ছিল যখন আমরা তিনজনে খুব বোর্ড গেম খেলতাম। আজ কতো বছর পর আমার মেয়ে নানারকম বোর্ড গেমস কিনে ফেলল আর আবার আমরা ওর ছোটবেলার দিনগুলোতে ফিরে গেলাম। এছাড়া সময় কাটতে লাগলো নানারকম রেসিপির এক্সপেরিমেন্ট, সেই সূত্র ধরে নিত‍্যনতুন রান্না আবার সেগুলো সোশ‍্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে বাহবা পাওয়া, সবই বেশ আনন্দ এনে দিচ্ছিল। আমার মা আমাদের সঙ্গে আছে, নিজের কর্মব‍্যস্ততায় বেশী সময় দিতে পারতাম না এখন আবার মায়ের সাথে সময় কাটাতে শুরু করলাম। এছাড়া ক্রিয়েটিভ কাজ ও চলছিল বৈকি। রেগুলার মায়ের সঙ্গে বসে গান প্র‍্যাকটিস করা, নিজের নাচের স্কুলের অনলাইন ক্লাস করানো, ছবি আঁকা , বন্ধুর ব্লগের জন্যে লেখা -যা হয়তো নরম‍্যাল সময় কখনো সম্ভবই হতো না। এর পাশাপাশি অবশ‍্যই চলছিল সংসারের নানা খুঁটিনাটি কাজ, তার সঙ্গে ছিল  আমার শখের গাছগাছালির আদর যত্ন। বাড়তি কাজ কিছু নিশ্চয়ই বাড়লো – বারবার হাত ধোয়া, এসেনশিয়াল সার্ভিসের লোকজন এসে চলে যাবার পর বাইরেটা পরিষ্কার করা বা স‍্যানিটাইস করা, ফল তরিতরকারি নুন জলে ধুয়ে শুকিয়ে ফ্রিজে তুলে রাখা, কিন্তু তা সত্ত্বেও ফোনে বা অনলাইনে বন্ধুদের সাথে আড্ডা, রিহার্সাল বেশ ভালোই হচ্ছিল।

দিনের পর দিন যেতে থাকলো, ইনফেকশন বাড়তে থাকলো সারা বিশ্বে, বাড়লো লকডাউনের মেয়াদ। একটু চিন্তা শুরু হলেও দূষণমুক্ত প্রকৃতি তার সবুজ গাছপালা নীল আকাশ যা কুড়ি বছরে দিল্লীতে দেখিনি সেসব দেখে মনটাকে মানিয়ে নিচ্ছিলাম। হয়তো এই জীবনটা আমাদের প্রাপ‍্য ছিল, কোথাও আমরা একটু বেশী বেহিসাবী হয়ে পড়েছিলাম। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পাওয়ার আশায় নিজেদের জীবন তো বটেই প্রকৃতিও নষ্ট করতে শুরু করেছিলাম। শুনলাম কলকাতার গঙ্গায় আর মুম্বাইতে ডলফিন দেখা গেছে। পশু পাখি সবাই যেন প্রাণ ফিরে পেল।

যখন এই ইনফেকশনের ভয়াবহতায় আমরা একটু ধাতস্থ হচ্ছিলাম হঠাৎ করে প্রকৃতি আবার শাস্তি দিল আমাদের উমফুনের মাধ্যমে। তিনঘন্টার ধ্বংসলীলায় কলকাতা আর উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা তছনছ হয়ে গেল। দূষণমুক্ত প্রকৃতি কেন আবার এমনভাবে কিসের প্রতিশোধ এলো কে জানে! বটানী অর্নাসের ছাত্রী আমি বহু সময় কাটিয়েছি শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে। আমার প্রিয় ২৪০ বছরের পুরোনো, আমার নস্টালজিয়া আজ ধ্বংস। উপড়ে গেছে আকাঁবাকাঁ পাতা নিয়ে ম‍্যাড ট্রি। প্রায় ছয় হাজারের ওপর গাছ শেষ হয়ে গেছে। গ্ৰামের পর গ্ৰাম ধুলিস‍্যাৎ। কেন! এমন কেন হলো!

উপর ওয়ালার কাছে আমার একটাই প্রশ্ন কেমন হিসেব ওনার! কি চান উনি? প্রাকৃতিক বিপর্যয় কারুর হাতে থাকে না। প্রযুক্তি দিয়ে তাকে আটকানো ও যায় না তাই কি ভগবান আমাদের এইভাবে শাস্তি দিচ্ছেন! সোশ‍্যাল ডিসটেন্টসিং পশ্চিমবঙ্গে যে আর মানা সম্ভব হলো না তার ফল কি হবে ভেবে শিউরে উঠছি। বছরের অর্ধেক কেটে গেল আতঙ্কের মধ্যে আরো কি কি দেখার বাকি আছে কে জানে! যদিও মনে বিশ্বাস রাখি কলিযুগের এটাই শেষ নয়; বিপদ একদিন না কেটে যাবেই।


 

Susmita Roy

Kathak dance teacher and choreographer at Chittaranjan Park Bangiya Samaj, for the last 10 years. Botany honors graduate and B.Ed from Calcutta Univeristy. Lives in CR Park, New Delhi. Loves to travel, read, sing, edit music, paint, and cook special dishes. Loves to hang out with friends, watch movies. Loves to drive and obviously teach dance. Crazy about dance costume designing and shopping.

 


 

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!