Home বিবিধ, গল্প খালি লটারি ধরো
বিবিধগল্প

খালি লটারি ধরো

শ্রী দেবাশিস পোদ্দার 


শিশুনিকেতনের ক্লাস সিক্স বা সেভেন। বাল্যকাল প্রায় শেষ। কৈশোর দুয়ারে দাড়িয়ে। বাড়ির কোনো কথাই আর ভালো লাগে না। বারবার করে বাড়ি থেকে স্কুলে টিফিন নিয়ে যেতে বললেও তা নিতে প্রবল অনীহা,বিরক্তি । স্কুলে টিফিন বেলায় যে খুব একটা খিদে পেত তাও নয়। টিফিনে খাওয়ার থেকে খেলা,দৌড়দৌড়ি,দুষ্টুমি — এসবেই বেশি আগ্রহ। শিশুনিকেতনের একদম লাগোয়া কোনো লোকালয় নেই বলে স্কুলের কাছাকাছি কোনোরকম দোকানপাট, এমনকি খাবারের দোকানও ছিল না। গুডি গুডি ছেলেমেয়েরা যারা বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসত তারা সেটাই খেত। আর অন্যেরা স্কুলের সামনে টিফিনের সময় যেসব ফেরিওয়ালা আসত তাদের থেকে কিছু না কিছু খাবার কিনে খেত। খুব ভালো কিছু নয় সেসব—হজমিগুলি, ঝালমুড়ি, ঘুঘনি,

আলুকাবলি, ঝুড়িভাজা,কালো রং য়ের কারেন্ট নুন্—-ইত্যাদি নিয়ে দুএকজন ফেরিওয়ালা আর গরমের দিনে নানা রংয়ের কাঠি আইসক্রিম বিক্রেতা জনাদুয়েক। পেট ভরে ভাত খেয়ে স্কুলে আসতাম কিন্তু টিফিন আনতে ইচ্ছে করত না।

টিফিন নিয়ে এলে নিজেকে কেমন যেন আনস্মার্ট মনে হত।

বদলে খুচরো পয়সা দেবার জন্য বাড়িতে আবদার করতাম। আদরের ছেলের আবদার মিটেও যেত।সাধারণত কপালে জুটত দশ পয়সার একটি কয়েন বা পাঁচ পয়সার দুটি কয়েন—অর্থাৎ সাকুল্যে অর্থমূল্য দশ পয়সা। যে দুজন কাঠি আইসক্রিম ওয়ালা স্কুলের সামনে টিফিনের সময় বসত তারা যে আমাদের পাড়ারই বাসিন্দা তা অনেক পরে জেনেছিলাম।দুজনকেই চিনতাম আমি। একজন গোবিন্দ র বাবা আর একজন পরিদার বাবা ।পরিদার বাবা ছিল খিটখিটে বুড়ো। পরিদা পরে দুর্দান্ত ফুচকা বিক্রি করত আমরা যখন বড় হয়েছি। বেশ টক,ঝাল,বিটনুন দিয়ে জমজমাট ফুচকা বানাত পরিদা। টকজল টাতে থাকত দেশী গন্ধরাজ লেবুর মনমাতানো গন্ধ। রীতিমতো লাইন পড়ে যেত ওর ফুচকার দোকানে। এখানে অবশ্য আমার অলোচ্য পরিদা বা পরিদার বাবা নয়——গোবিন্দ র বাবা,যদিও গোবিন্দকে আমি কোনোদিনই দেখিনি। শুধু শুনেছিলাম উনি গোবিন্দ র বাবা। ব্যাস্ —– সদাশয় ভালোমানুষ গোছের একদম গোবেচারা চেহারা।

একজন মানুষ কতটা দরিদ্র হতে পারে তার চরমতম নিদর্শন ছিল গোবিন্দ র বাবা। অত্যন্ত সস্তার একটা ধুতি খাটো করে পড়া যেটা হাঁটুর উপরেই উঠে থাকত আর গায়ে থাকত জীর্ন একটা ফতুয়া।ফতুয়ার আসল রং টা যে কি ছিল তা বোঝার উপায় নেই। গোবিন্দ র বাবা স্কুলের গেটের বাইরে হাঁটু ভাজ করে বসত। তার সামনে থাকত আইসক্রিমের বাক্সটা। বাক্সের মধ্যে কয়েকটা লেয়ারে টুকরো প্লাস্টিকের ওপরে থরে থরে নানা রং য়ের আইসক্রিম গুলি সাজানো। একটা লেয়ার শেষ হয়ে গেলেই প্লাস্টিক সরিয়ে তার নীচের লেয়ারের আইসক্রিম তুলে আনত গোবিন্দ র বাবা। অন্যান্য ফেরিওয়ালারা যেমন তাদের বিক্রির পসরা নিয়ে ক্রেতাদের উদ্দেশ্যে হাঁক দেয় বা তার জিনিসটা যে ভালো সেকথা চিৎকার করে বলতে বলতে খদ্দেরকে ডাকতে থাকে—–গোবিন্দ র বাবা কিন্তু সেসব কিছুই করত না। ওর স্টাইলটা ছিল একদম অন্য রকমের। শুধু নিজের মতো সুর করে স্বাভাবিক গলায় বলতে থাকত—-“খালি লটারি ধরো—খালি লটারি ধরো”।

বারবার এই একই কথা। ফাটা রেকর্ডের মতো। শুধু লটারি কথাটা একটু জোরে বলত। ব্যাস্ আর কিছু না। আগে আমরা চিঠিপত্র,দরকারি কাগজ ইত্যাদি যাতে গেঁথে রাখতাম সেইরকম সরু ছুঁচালো লোহার শিকের মধ্যে ১,২,৩,৪ লেখা কাগজগুলি উল্টো করে গাঁথা থাকত। 

সংখ্যা গুলি লেখা থাকত একদম কাগজগুলির নীচে ভেতরের দিকে। কোনোভাবেই বাইরে থেকে নেড়েচেড়ে বোঝার কোনো উপায় নেই যে কোন কাগজে কোন সংখ্যা  লেখা আছে। রীতিমতো লাইন পরে যেত গোবিন্দ র বাবার আইসক্রিম কেনার জন্যে। ওর প্রায় ঘাড়ের ওপর উঠে যেতাম আমরা।কারনটা যতটা না আইসক্রিম তার থেকেও বেশি ওই লটারি। দাম মাত্র পাঁচ পয়সা। পাঁচ পয়সা দিয়ে একটা সাদা কাগজ টানলে ওই কাগজের নীচে যে সংখ্যা টা  লেখা থাকবে ততগুলি আইসক্রিম পাওয়া যাবে। কমপক্ষে একটা আর ভাগ্য ভালো থাকলে সংখ্যা টা  ২, ৩ অথবা ৪ ও হয়ে যেতে পারে। মানে নো রিস্ক ফুল গেইন। একটা কিনলে আরও এক বা একাধিকের লোভনীয় অফার। এটা একদম আমাদের মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। ফলে টিফিনে অন্য যা কিছুই খাই না কেন শেষে একবার লটারির আইসক্রিম ট্রাই করা চাই ই চাই।

বেশিরভাগ দিনই টিফিনে একটা ফুটবল নিয়ে গান্ধী ময়দানে দাপিয়ে বেড়াতাম। একটা বল আর তিরিশ চল্লিশটা ছেলেপেলে। দমাদ্দম চলত ফুটবল।সবাই ঘেমেনেয়ে একসার। শেষে যেতাম লটারির আইসক্রিম কিনতে। একটা পেলে নিজর পেটে আর একাধিক পেলে পছন্দের বন্ধুদের ডেকে এনে খাওয়াতাম। মানে আমি কতটা উদার মনের সেটা বোঝানোর জন্যে। শুধু তাই ই নয়—-যাতে অন্য কোনোদিন ওই বন্ধুও আমাকে একইরকম ভাবে লটারির আইসক্রিম খাওয়ায় বা অন্য কোনো ট্রিট্ দেয়—এটাও মনে মনে ভাবতাম। ওই বয়সে এরকম ভাবনাতে মনে কোনো পাপবোধের অনুভূতির কথা মনে পড়ে না। টিফিনের শেষে চপচপে ঘামে ভেজা শরীরে স্যাকারিন দেওয়া ওই আইসক্রিম ছিল আমাদের কাছে অমৃত। চুষে খেলে শুধু রং আর স্যাকারিনের মিষ্টি টা উঠে আসত।জিভ রঙিন হয়ে যেত।পড়ে থাকত শুধু ফ্যাকাশে বরফটুকু।তখন কুড়মুড় করে বরফটুকুই চিবিয়ে খেতাম। আর হাতে থেকে যাওয়া আইসক্রিমের কাঠিটাকে এক শটে পাঠিয়ে দিতাম দুরে বহুদুরে।আবার জিভটা বার করে নিজেই দেখতাম আর বন্ধু দের দেখাতাম কতটা রঙিন হল সেটা।

এই আনন্দ ছিল নির্মল,অনাবিল, অকলুষ আর স্বচ্ছ। এ আনন্দের প্রকাশ আজ আর কোনো ভাষাতেই সম্ভব নয়।

এখন শপিংমলে বা শহরের নামী রেষ্টুরেন্টে কয়েকশ  টাকার বিনিময়ে ডেসার্টরূপী আইসক্রিম খেয়ে রসনা পরিতৃপ্ত হলেও তা ওই পাঁচ পয়সার রঙিন কাঠি আইসক্রিম  খাওয়ার আনন্দের কাছে কিছুই না। জাষ্ট নস্যি।

তাইতো এখন মাঝেমােঝই মনে হয়———

“আনন্দ” ব্যাপারটা অন্যকিছু।

টাকা-পয়সা,ধন-দৌলত,বিলাস-বৈভব,প্রভাব-প্রতিপত্তি  দিয়ে কি তার নাগাল পাওয়া যায় ??



শ্রী দেবাশিস পোদ্দার 

এম.এস্.সি. পদার্থ বিদ্যা, বি.এড.
প্রধান শিক্ষক, বনমালিপুর প্রিয়নাথ ইনস্টিটিউশন 
বারাসাত, কলকাতা – ৭০০১২৪।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্স ব্লু ( ১৯৮৫-১৯৮৭) ফুটবলার।
হৈ হৈ করে বাঁচতে পছন্দ করি।
খেলাধূলা, সিনেমা দেখা, গান শোনা, আড্ডা দেওয়া প্রভৃতিতে আগ্রহী।
Facebook আর WhatsApp-এ প্রবল আসক্তি।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!