লেখক : দীপঙ্কর ঘোষ
একটা একমাথা কোঁকড়া কাঁচা পাকা চুল। মোটা ঝুলো ভুরু। শুঁয়োপোকার মতো সাদা বাদামি গোঁফ। মোটা কাঁচের চশমার ভেতর থেকে অত্যুজ্জ্বল চোখে মোবাইল ফোনে কিছু পড়তে পড়তে হেসে কুটিপাটি। হাসতে হাসতে লোকটার চোখ দিয়ে জল আসছে। নিঃশব্দে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অপু ঝুল ঝাড়ছিলো। রবিবারের সকাল। ভাবলো দেবে নাকি একটা মাকড়সা লোকটার কানে ছেড়ে? কিন্তু দিলো না। জানে তাতেও ওর হাসি কমবে না। অপু অপর্ণা। লোকটার বৌ। শ্যামলা রং। অল্প ভুঁড়ি আছে। কপালের চুল সরিয়ে ফের ঝুলঝাড়ু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সারা সপ্তাহ অপুর অফিস থাকে। রবিবার ছুটি। সপ্তাহ জুড়ে লোকটা গড়াগড়ি খায় – রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় – চায়ের দোকানে কোথায় না কোথায় ঠিক নেই। ঘরের কাজে কোনও নজর নেই। রিটায়ার করার পর লোকটা কেমন যেন হয়ে গেল। সবাই বলে রিটায়ার করলে সবারই ওরম হয়। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। কোথায় ঠিক? আরও ক্ষ্যাপাটে হয়ে যাচ্ছে। সেদিন রাস্তা থেকে একটা মরোমরো বুড়ো কুকুর কোলে তুলে নিয়ে এলো। গোটা শরীরে নোংরা মাখা – কাদা মাখা একটা কুকুর। উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। কে জানে কতোদিন খেতে পায় নি। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা কোথা থেকে মাংস কিনে আনলো। অপুকেই সেই অতিথির জন্যে হালকা করে নুন হলুদ দিয়ে রান্না করে দিতে হলো। তো সেই কুকুরের খাওয়ার ক্ষমতাও নেই। লোকটা ওষুধ কিনে ড্রপারে করে একটু একটু করে খাওয়ালো। লোকটা বসে রইলো কুকুরটার পাশে। অপু ক্লান্ত ছিলো। শুয়ে পড়লো। রাত কতো অপু জানে না লোকটা জ্বলজ্বলে চোখে অপুকে নাড়া দিয়ে ঘুম থেকে তুলে বললো জানো ওটা খেয়েছে? জল খেলো একটু ঝোল একটু মাংস। অপু শুনে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে উঠে দেখে লোকটা কখন যেন পাশে এসে শুয়ে পড়েছে। চশমাটা হাতে ধরা। ও উঠে দেখে কুকুরটা উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। টানা টানা চোখে অপুর দিকে তাকিয়ে আছে। বড্ড মায়াময় চোখদুটো। অপুকে দেখে ধপ করে শুয়ে পড়লো। অপু বুঝতে পারলো আর ও চোখ খুলবে না। ও লোকটাকে ডেকে তুলে কুকুরটার কাছে নিয়ে এলো। লোকটা কিচ্ছু বললো না। রান্না করা বাকি মাংসটুকু নিয়ে পাড়ার বাকি কুকুরদের খাইয়ে কর্পোরেশনের গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। অপু লোকটাকে ডেকে জলখাবার খাওয়ালো। ওরও এক রাতের অতিথির জন্য মন খারাপ লাগছিলো। কি রকম মানুষের মতো তাকিয়ে ছিলো, কিছু কি বলতে চাইছিলো? ওর এটুকু আশীর্বাদ ভালবাসা এই বাড়িতেই রয়ে গেল। যাই হোক রাস্তায় পড়ে তো মরে নি, মুখে জল পেয়েছে খেয়েছে, এসো তুমি মুখটুখ ধুয়ে খেয়ে নাও। কদিন আগে বসন্তের বৃষ্টিতে শিশির যখন বৃষ্টি হয়ে লাইটপোস্টের আলোয় হীরের টুকরো হয়ে ঝরে ঝিঁঝিপোকার মতো একটানা ডেকে চলেছে। তখন লোকটা সেই ডাক উপেক্ষা করে ঘরে থাকতে পারে নি। ছাতে গিয়ে আকুল ভিজে গুনগুন করে অদ্ভুত সুরে কোন যেন গান করছিলো। অপু ভাবলো বুড়োটা মরে বুঝি এবার। ওকে ছাদ থেকে আনতে গিয়ে অপুরই ঠান্ডা ফান্ডা লেগে একাকার। মাঝের থেকে তিন দিন অফিস কামাই। তখন লোকটা দিব্যি রান্না বান্না করে অপুকেই খাইয়ে দাইয়ে চাঙ্গা করলো।
ফিরে এসে অপু একটু টেলিভিশন দ্যাখে। দ্যাখা শেষ হলে মোটা চশমার ভেতর চোখ বন্ধ করে লোকটা হার্মোনিয়াম বাজিয়ে একটার পর একটা গান গেয়ে যায়। একটা গানের সঙ্গে অন্য গান জুড়ে যায়। আবার প্রথম গান ফিরে আসে। অপু কাজ করতে করতে গান শোনে। কখনও গলা মেলায়। কখনও শীতের দুপুরে অপুকে বেনে বৌ পাখি চেনায় – টুনটুনির বাসা খুঁজতে জঙ্গলে চলে যায়। শীতের দুপুরে ছুটির দিনে ছাদে দুজনে অলস বসে বসে সময় কাটানো।
তখন ভরা শীত। রাতে খাওয়ার পরে লোকটা জোর করে ওকে নিয়ে হাঁটতে বেরোলো।রাস্তায় কুয়াশা জড়িয়ে আছে। ঠান্ডা হাওয়ায় গাল চিড়বিড় করছে। রাস্তার যত কুকুর লোকটার গায়ে উঠছে, পাজামা কামড়ে ধরে টানাটানি করছে। ওরা ধীর পায়ে এগোতে এগোতে খালের পাড়ে যেখানে গাছেরা ডালপালা জলে নামিয়ে দিয়ে শীত পোয়াচ্ছে – গায়ে কুয়াশার চাদর মেখে সময়ের অপেক্ষা করছে। যেন সকাল হলেই ওদের ডানা গজাবে শিকড় বাকড় উপড়ে টুপড়ে আদিগন্ত আকাশে উড়ে যাবে। অপুর রোমাঞ্চ হয়। ও লোকটার হাত চেপে ধরে। লোকটা কি যেন দেখতে পেয়েছে। অপুরও চোখ যায়। একটা ছোট্ট মানুষ শীতে কুঁকড়ে মুঁকড়ে গাছতলায় শুয়ে আছে। দুজনে দ্রুত পায়ে কাছে যায়। অপু হাঁটু গেড়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে ন্যায়। ঘুমোচ্ছে। ন্যাতার মতো। অপু হাঁটতে থাকে। গরম লাগছে – ঘেমে যাচ্ছে তবুও পা চালায়। উলোঝুলো চুল বাচ্চাটার মুখে এসে পড়েছে। একটা মেয়ে। লোকটা অপুকে অনুসরণ করে। বাড়ির চাবিটা অপুর হাত থেকে নিয়ে দরজা খুলে দ্যায়।অপু মেয়েটাকে সোফায় শুইয়ে রাখতেই মেয়েটা চোখ খোলে। ভীষন ভয় পাওয়া দুটো চোখ। অপু ঘেমে গ্যাছে। চাদরটা খুলে রাখে। দ্যাখে মেয়েটা ওর স্তনের দিকে তাকিয়ে আছে। বোধহয় নারী দেখে ভরসা পায়। অপুর বুকদুটো টনটন করে ওঠে। কতদিন সন্তানের মুখ লাগে নি। ও মেয়েটার মাথার চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে ঠিক করে দ্যায়। লোকটা হড়বড় করে দুধ কর্নফ্লেক বেশী করে চিনি দিয়ে তৈরি করে দিয়ে যায়। অপু একটা চামচ চায়। লোকটা চামচ ধুয়ে এনে দ্যায়। অপু চামচে করে ভালবাসা আর কর্নফ্লেক খাইয়ে দিতে থাকে। খাওয়াতে খাওয়াতে ঐ মোটা চশমার লোকটা গরম জল করে খবর দ্যায়। অপু ওর হাত ধরে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে স্পঞ্জ করে দ্যায়। তারপর বাচ্চাটাকে নিজের একটা কুর্তি পরিয়ে বাথরুম থেকে বার করে। চশমাচোখে লোকটা ওই ছোট্ট মানুষটার হাস্যকর বেঢপ পোষাক দেখে ফের মিচিকি মিচকি হাসতে শুরু করায় অপু চোখ পাকিয়ে ধমকে দ্যায়। লজ্জা পাওয়া বাচ্চাটাকে নিয়ে শোওয়ার ঘরে খাটে শুয়ে পড়ে। লোকটা একটা চাদর মুড়িয়ে সোফায় বসে মোবাইল ফোনে গল্প পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে পাখি ডাকার আগে দুজন বড় মানুষ উঠে পড়ে। বাচ্চাটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়ে ঘুমিয়ে কাদা। ও ওঠার আগেই লোকটা সাইকেল নিয়ে বাজারে দোকান খুলিয়ে ওর একটা জামা আর প্যান্টু নিয়ে এসেছে। সুতির তো? লোকটা চশমা ছোঁয়া হাসিতে হ্যাঁ জানায়। দুপুরে টাটকা মাছের হালকা ঝোল, আলু ভাজা আর ভাত “ও” তৃপ্তি করে খায়।
রোদ তখন মাথার ওপর। ফাঁকা ট্রেন পেয়ারা বাগান আম লিচুর গাছ কেটে মাঝখান দিয়ে নিজের বকরটগর গতিতে চলেছে। একটা ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দাঁড়ালো। তিনজন মানুষ দুজন বয়স্ক আর একজন ছোট্ট মানুষ – নুয়ে পড়া বাঁশঝাড় – এঁদো পুকুরের পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। ছোট মানুষটা পথ দেখিয়ে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। মিনিট দশেক হাঁটার পর বাবুই পাখির বাসার মতোন ঝকঝকে ছোট্ট একটা ঘরে এসে ওরা দাঁড়ালো। না আসলে ওরা দুজনে দাঁড়ালো। ছোটো মানুষ ছিলে ছেঁড়া তীরের মতো ছুট্টে একটা দাড়ি না কামানো অস্থিচর্মসার আধবুড়ো লোকের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। শীর্ণকায় লোকটা উদাস চেয়ে রইলো। কেউ কোনও ধন্যবাদ জানায় নি। মা’টা এসে অপুর হাতটা চেপে ধরে আঁচলে চোখ মুছছিলো। ফিরে আসার সময় ফিরে আসা ছোটো মানুষটা আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে অপুর একটা আঙ্গুল চেপে ধরেছিলো – আবার আসবে। কথাটা প্রশ্নবোধক না অনুরোধ ওরা বুঝতে পারলো না। দুজনে আশশ্যাওড়া গাছ, ঘেঁটু ফুলের বন, শূণ্য ক্ষেতে হাট্টিমাটিম পাখির ডাক শুনতে শুনতে ফুলে নুয়ে পড়া কলকে গাছের তলায় ঝগড়া করা ছাতারে পাখির দলের মধ্যে দিয়ে সেই নিরালা প্ল্যাটফর্মের দিকে হাঁটা দিলো। ছোট মানুষটা তার ঘর ফিরে পেয়েছে।
দীপঙ্কর ঘোষ
একজন বৃদ্ধ চিকিৎসক। এক কালে মেডিক্যাল কলেজে পড়াতেন। লেখালেখিই বাতিক। প্রবন্ধ কবিতা এবং ছোটো গল্প লিখে থাকেন। এ যাবৎ প্রকাশিত বইয়ের নাম “মানদাসুন্দরী ও মাতাল ডাক্তার” – এক মাতালের বেদনাবিধুর গল্প সমষ্টি। আর প্রকাশিতব্য “রঙিন কৈশোর” এবং “কিছু অসুখ কিছু কথা”, রূপালী প্রকাশনী থেকে।