Home বিবিধ, প্রবন্ধ ফেলুদার বাড়িতে কিছুক্ষণ
বিবিধপ্রবন্ধ

ফেলুদার বাড়িতে কিছুক্ষণ

  কাবেরী ঠাকুর


তোপসে তার লেখায় ফেলুদার বাড়ির যে ঠিকানাই দিয়ে থাকুক না কেন আমার কাছে ফেলুদার বাড়িটা হলো ১/১, বিশপ লেফ্রয় রোডে। কয়েক বছর আগে কলকাতা শহরের এই পুরনো অভিজাত রাস্তাটার নাম বদলে এমনই একটা খটমট নাম রাখা হয়েছে যে ফেলুদা বেঁচে থাকলে নিশ্চই দু চারটে কড়া কথা শুনিয়ে দিতো এই কুকর্মটি করার জন্যে। এতক্ষণে আশা করি বোঝা গেছে যে ফেলুদা বলতে আমি তার স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়ের কথাই বলতে চাইছি – যে বরেণ্য বাঙালির শততম জন্মদিন পেরিয়ে এলাম গত দোসরা মে। সত্যজিৎ রায়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতি তাঁর কালজয়ী সব চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্যে, কিন্তু হিসেব করলে দেখা যাবে জনপ্রিয়তার নিরিখে তাঁর ফেলুদা অনেকটাই এগিয়ে কেননা সদ্যকিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সের বাঙালি পাঠকের মধ্যে তার অনুরাগীদের সংখ্যাটা তাক লাগানোর মতোই। ভাগ্যিস ফেসবুকের জমানা তখনো শুরু হয়নি! আর বলাই বাহুল্য, ক্ষুরধার বুদ্ধি, সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আধুনিক চিন্তাধারাসম্পন্ন দৃঢ়চিত্ত ফেলুদাকে আমরা তাঁর স্রষ্টারই প্রতিচ্ছবি বলে ধরে নিই।

এ কথাটা শোনা ছিল যে দোসরা মে তারিখটায় তাঁর ভাড়া বাড়ির তিন তলার দরজাটা সকাল থেকেই খোলা থাকে চেনা অচেনা সব অনুরাগীদের জন্যে। কিন্তু অল্প বয়সে প্রবল ইচ্ছে সত্বেও সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়নি যে সুযোগটা এলো মাত্র কয়েক বছর আগে। এ সুযোগটা আসার বহু বছর আগেই অবশ্য সত্যজিৎ রায় প্রয়াত হয়েছেন। তবু জন্মদিনের দিন যাচ্ছি বলে কথা, তাই শুধু হাতে তো যাওয়া যায় না। উপহার হিসেবে ফুল কিংবা মালার ভাবনা তিন জন অনুরাগীই এক কথায় বাতিল করলাম কেননা ওগুলো দিলেই পরদিন সকালেই জঞ্জালের গাড়িতে তা ফেলে দিতে হবে। তাই ভেবে চিন্তে ওরই মধ্যে ভালোগোছের টবসমেত সুদৃশ্য একটি পাতাবাহার গাছ কেনা হলো যে কিনা কোনও ঝামেলা করবে না, রোজ একটু জল পেলেই খুশি।

তবুও নার্ভাস যে একটুও লাগছিল না বললে মিথ্যে বলা হবে। বাড়ির লোকেরা কে কীভাবে নেবেন! শেষ অবধি বড় রাস্তার একেবারে ওপরেই পুরনো আমলের বাড়িটার পুরনো আমলের লিফটে উঠে পৌঁছলাম তাঁর ফ্ল্যাটে। খোলা দরজা দিয়ে ঢুকতেই নজরে পড়লো এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তজোড়া বারান্দায় সার সার টব যেখানে বেশিরভাগই পাতাবাহার গাছ। একেই বোধ হয় বলে টেলিপ্যাথি, যে কথাটা ফেলুদার মুখ থেকে শুনে শুনে তোপসে ভালোই শিখে ফেলেছিল। বৈঠকখানার ঘর পেরিয়ে ঢুকলাম ভেতরের একটি ঘরে সত্যজিৎ রায়ের ছবিটি যেখানে চাপা পড়ে আছে মালার তলায়।

বাড়ি দেখতে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য তো বাড়িটা দেখা নয়, যেখানে বসে সত্যজিৎ রায়ের মহৎ সব সৃষ্টিকর্মের বেশিরভাগটা রূপ পেয়েছিল সেই পরিবেশের একটা আঁচ নেওয়া। ইংরিজি Ambience কথাটা বললে বোধহয় ভালো বোঝা যাবে। বাহুল্যবর্জিত আসবাবপত্র, আড়ম্বরহীন গৃহসজ্জা, উচ্চমানের এক সাংস্কৃতিক আবহ সব কিছুর মধ্যেই বুদ্ধিজীবী এক শিল্পীর ব্যাক্তিত্ব যেন সম্পৃক্ত হয়ে আছে।

ফিরে আসছি, পেছন থেকে কে যেন অনুরোধ করলেন, ‘চা খেয়ে যান’। হালকা জলখাবারের পর্ব (যা ছিল অপ্রত্যাশিত) শেষ করে ফিরছি, হঠাৎই চোখ পড়লো দেওয়ালের একটা কোণে টাঙানো রামকৃষ্ণদেবের রেখাচিত্রটির ওপর।। মনে পড়লো, ‘পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ’ বইটির প্রচ্ছদটি ছিল সত্যজিৎ রায়েরই আঁকা। বিজ্ঞাপন সংস্থায় কর্মরত ছিলেন তিনি প্রথম জীবনে, সে সময় ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের ছোটদের সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’ বইয়ের প্রচ্ছদ করতে গিয়েই বিভূতিভূষণ সম্বন্ধে আগ্রহী হন আর চলচ্চিত্র সৃষ্টির প্রথম প্রয়াসেই সাড়া ফেলে দেন বিশ্বের দরবারে।

সুন্দর এক অনুভূতি সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। টিভিতে তখন সত্যজিৎ রায়কে নিয়েই অনুষ্ঠান চলছে-জন্মদিনের দিন অতীত স্মৃতি রোমন্থন। আমন্ত্রিত বক্তা বলছেন — আমি তখন পাইলটের চাকরি করি ভারতীয় এক বিমান সংস্থায়। কলকাতা থেকে প্লেন চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে বোম্বাই। যাত্রীরা উঠে পড়েছেন, প্লেনের দরজা বন্ধ, বিমানসেবিকা যাত্রীদের শেষ নির্দেশ দিচ্ছেন, প্লেন ছাড়বার সময় হয়ে এসেছে কিন্তু একটি সিট তখনও খালি। হঠাৎই দরজায় টোকা। আমি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলতে যাচ্ছি হবে না, তার আগেই দীর্ঘদেহী এক ভদ্রলোক ভরাট গলায় বললেন- আমি সত্যজিৎ রায়। এঁকে তো আর না বলা যায় না। তবে আমার পক্ষে ওঁকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়ার কাজটি একটু সহজ হয়েছিল কেননা রায় মশায়ের সঙ্গে ছিল একটি মাত্র হালকা ব্যাগ আর কোনও লাগেজ নয়’।

শুনে মনে মনে একটু মজা পেলাম-ফেলুদার ও তাহলে এক আধবার লেট হয়েছে! তবে এও জানি জরুরি কোনও কারণ ছাড়া এমন কাজ করা ফেলুদার পক্ষে সম্ভব নয়। আরও মনে হলো রেল আর বিমান কোম্পানিগুলো বলে বলে হয়রান হয়ে যাচ্ছে যাত্রীরা যেন যথাসম্ভব হালকা মালপত্র নিয়ে গাড়িতে ওঠেন। কে শোনে কার কথা! ফেলুদার ভক্ত পাঠকদের অনেকেই কিন্তু তার কাছ থেকে এই অভ্যাসটি শিখতে রাজি নয় এখনও।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. নামেই “ফেলু”দা। আসলে সব সময়েই পাস !!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!