Home বিবিধ, প্রবন্ধ এক বাজার বিলাসীর ইতিকথা
বিবিধপ্রবন্ধ

এক বাজার বিলাসীর ইতিকথা

অঞ্জন বসু চৌধুরী


বাজার — অত্যন্ত এক জনবহুল জায়গা, যেখানে বহু মানুষের জমায়েত, তাদের দৈনন্দিন জিনিসপত্র কেনা বেচার এক প্ল্যাটফর্ম।

কলকাতায় বড় বড় লোকেদের নামে বাজার রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম আশুবাবুর বাজার,  চূনিবাবুর বাজার, ছাতুবাবুর বাজার, যদুবাবুর বাজার, অমৃতবাবুর বাজার ইত্যাদি।

বাজার করতে আমার দারুন লাগে, সেই ছোটবেলা থেকেই। বলবেন, কত ছোটবেলা থেকে? তা আমার বয়স যখন ৯-১০বছর, তখন থেকেই, সংসারে সাহায্য করার জন্য আর বাবার সঙ্গে আমার বাজার যাওয়া। হয়তো, সব কিছু অনেক বেশি উপভোগ করতে পারতাম বলে।

বাজার করা একটা দারুণ আর্ট, সেটা সকলে পারে না কিন্তু। মানে, বাজার যাওয়ার আগে সব দেখতে হবে যে আজ কি কি রান্না হবে আগামী দুদিন কি হতে পারে। আমি রোজ বাজার করতে ভালোবাসি, আগে তাই করতাম। একদিন বাজারে না গেলে মনে হতো কি একটা ইমপর্ট্যান্ট কাজ আজ করা হলো না, তার রেশ থাকত সেই পর্য্যন্ত, যতক্ষণ না আবার বাজার যাচ্ছি।

আগেকার দিনে জমিদার বা রাজা রাজাদের বাজার সরকার থাকতো, আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে কর্তা বা তাঁর সাহায্যকারীরা বাজার করতেন। বাজারে যাওয়ার মজাই আলাদা, কত পরিচিতদের সাথে দেখা হবে, বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা হবে, এক প্রস্থ চা খাওয়া হবে, তবেই বাজার করার অনুভূতি আসবে।

যাইহোক, মনে হয় অনেক আজেবাজে বকলাম, পাঠকেরা মাফ করবেন। এবার আমি আগে যেখানে থাকতাম, সেই বাগবাজারের বাজার কি রকম ছিল! সে সম্বন্ধে আপনাদের একটা ধারণা দিই। বছর চল্লিশ পঞ্চাশ আগের কথা তো হবেই; তখন এখনকার মতো এতোটা অর্গানাইজড ছিল না। তবে একটা মেন বাজার আর তার আশেপাশে রাস্তায় অনেক ছোট ছোট বাজার বসতো। জিনিসপত্র এখনকার তুলনায় অনেক টাটকা থাকতো, মাছ প্রায় খাবি খেত এখনকার মত মরা বা বরফ দেওয়া ছিল না কিন্তু। তখনকার সময়ে হাতে ২০/৩০ টাকা থাকলে ভালোই বাজার করা যেত মাছ বা মাংস সমেত।  টাটকা শাক-সবজি ও আসতো ওই টাকায়। মাংসের দাম ছিল ৩০ টাকা পার কিলো। মাংসের ব্যাপারে একটা কথা বলি। তখন মাংস (খাসি, মুরগি তখন কেউ খেত না) কাটা হলে কর্পোরেশন থেকে লোক এসে রাবার দিয়ে স্ট্যাম্প দিয়ে আপডেট করে যেত; তারপর মাংস কাটা হত। এ আমার নিজের চোখে দেখা।

আনাজের মধ্যে বাজারের মধ্যে পটল ফুলকপি বাঁধাকপি টমেটো এগুলি সিজনাল ছিল দাম একেবারে হাতের মধ্যে। থাকতো বাঁধাকপি, এ সময় ৫০ পয়সা। আর ফুলকপি ১২ টাকায় ভালো পাওয়া যেত।

চচ্চড়ি করতে হলে আলু বেগুন পটল কিছু অন্যান্য জিনিস ও প্রয়োজন সেগুলো দেখে আনতে হবে। পেঁপে কিনলে টমেটো আনতে হবে। বাঁধাকপি একটু পুরনো হলে চিংড়ি মাছ অথবা মাছের মুড়ো চাই-ই চাই। ডিম তখন লোকে হাঁসের ডিম খেতো। ডিমের ডালনা বা ডিম কষা, আহা, লিখতে গিয়েই জিভে জল এসে যাচ্ছে।

আমার মেজদা মানে কালুদা ডিমের অন্ধ ভক্ত ছিল। কলকাতার বাড়িতে জেঠিমার নানান বাঁধনের জন্য বাইরের খাবার খেতে পেত না তাই আমাদের তমলুকের বাড়িতে গেলে চিত্তদার দোকানের লাল লাল ডিম কষা কিনে আনত আর চিলেকোঠায় বসে খাওয়া চলতো। কলকাতার কতগুলো অর্গানাইজড বাজার যেমন শ্যামবাজার, শোভাবাজার, হাতিবাগান, নাগেরবাজার, দমদম, মানিকতলা বাজার, হগ মার্কেট, ভবানীপুরের যদুবাবুর বাজার, লেক মার্কেট, গড়িয়াহাট বাজার,বালিগঞ্জ বাজার, এগুলো খুব ভাল বাজার। সমস্ত জিনিস পাওয়া যায়।

আমাদের এখনকার স্থানীয় পাইকপাড়ার বাজার খুব ভালো নয়; তবে চালিয়ে নিতে হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম বেশি অন্য বাজারের তুলনায়। উপায় নেই তাই এখান থেকে বাজার করতে হয়। এখন কোন আনাজ ৪০ টাকা পার কিলোর নিচে নেই। কাটা মাছ আর গোটা মাছ সবই সাড়ে ৩৫০ টাকা, তার নিচে পাওয়া যায় না। চিংড়ি ট্যাংরা, পমফ্রেট,‌ ইলিশ এসব মাছে মধ্যবিত্তরা হাত দিতে পারে না। তাহলে কি বিক্রি থেমে আছে? না, কখনোই না। যাঁরা ভালো জায়গায় কাজ করেন, ভালো ইনকাম করেন, তাঁরা প্রায়ই ভালো মাছ ইত্যাদি কেনেন। আগে পথ্য হিসেবে সিঙ্গি মাগুর মাছ প্রায়ই খাওয়া হতো। এখন? হাত দেওয়া যায় না।

একটা তুলনা দিই। বাগুইআটি বাজার থেকে ভাল চাল কিনতাম তিন টাকা কিলো দরে; আর আজ সেই চালের দাম ৬০ টাকা কিলো। কুড়িগুণ দাম বেড়ে গেছে, কিন্তু লোকের ইনকাম সেই তুলনায় বাড়েনি।

আগে আমি বাজারে যেতাম রোজ কমপক্ষে তিনবার। পরিচিতরা দেখে জিজ্ঞেস করত কত রাউন্ড? আর এখন এই লকডাউনে জেরে একবার বাজারে গিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।

আশাকরি গুছিয়ে নিজের অভিজ্ঞতাটা বলতে পারলাম।

একটা কথা বলা হয়নি। ঠাকুরের ভোগের রান্নায় যে কুমড়ো দেওয়া হয় সেটা কিন্তু বঁটি বা ছুরি দিয়ে কাটা হয় না। গোটা কুমড়োটা মাটিতে আছড়ে ভাঙ্গা হয়। তারপর সেগুলো ধুয়ে রান্নার কড়াইতে দিয়ে দেওয়া অন্যান্য আনাজের সঙ্গে। কিন্তু তরকারির টেস্ট … লা জবাব!

একটা সত্যি ঘটনা বলি। সমিত ভঞ্জের বাবা, আমাদের নতুন কাকা, মা মহিষালীর ভক্ত ছিলেন। মা মহিষালী বছরে একবার বেরোতেন আর ভক্তদের বাড়ি বাড়ি ৬/৭ দিন করে থেকে সেবা নিতেন। নতুন কাকাও এক সপ্তাহের জন্য মাকে নিয়ে আসতেন আর পাড়া-প্রতিবেশী সকলের নিমন্ত্রণ থাকতো ভোগ খাওয়ার। ভোগের রান্না হত ভাত, ডাল (সে একেবারে অমৃত), আলু ভাজা আর বিচেকলা আর কুমড়োর তরকারি। কুমড়ো গুলো ঐভাবে ভেঙে খোসা না ছাড়িয়ে রান্নায় দেওয়া হতো (বিচে কলার তরকারি মাস্ট … দিতেই হবে)। সে তরকারির স্বাদ ভোলা যায় না এখনো মুখে লেগে আছে।

কলকাতার বাজারের সঙ্গেই লাগোয়া মুদিখানার দোকান থাকা একটা বিশেষত্ব।

আমাদের পাইকপাড়া বাজারও তার ব্যতিক্রম নয়। গ্রোসারি শপ ওনার বনিকদা; তার দোকান। বণিকদা বলে ডাকি। সব রকম জিনিসপত্র পাওয়া যায়। সকালবেলায় দোকান খুলতে ভোর সাড়ে ছ’টা। আবার সন্ধ্যেবেলায় চলত রাত্তির দেড়টা-দুটো পর্যন্ত।

আমার মেয়ের অন্নপ্রাশনের সব জিনিস ওনার দোকান থেকে প্রথমবার কিনেছিলাম। টোটাল কস্ট হয়েছিল প্রায় ছয় হাজার টাকা মত। আমি যেদিন মানে আগের দিন যখন জিনিসপত্র কিনে তখনই আমি পুরো টাকাটা ওনাকে দিয়ে দিই। উনি একটু অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন “দাদা পুরো টাকাটা দিয়ে দিলেন? আমার দোকানে কেউ পুরো টাকা দিয়ে জিনিস নেয় না, অর্ধেক বা তার কম দেয় আর বাকি টাকা খেপে খেপে দেয়।

আপনিই প্রথম যিনি পুরো টাকাটা একসঙ্গে দিয়ে বাজার করলেন।” আমি বললাম “বণিকদা আমি আগে দাম দিই আর পরে জিনিস নিই, সেটা কাঁচা আনাজের ক্ষেত্রেও। যাই হোক। আমাকে তো টাকাটা আজ নাহলে কাল দিতেই হত।”

বণিক দা হেসে বললেন “দাদা আপনার যা যা জিনিস বাঁচবে অন্নপ্রাশনের পরে এসে ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে যাবেন।” আমিও মোটামুটি কিছু জিনিস যেগুলো বেশি ছিল দিয়ে টাকা ফেরত নিয়ে নিয়েছিলাম।

বণিকদার সঙ্গে আজও সম্পর্ক অটুট আছে।

এই গল্পটি হয়ত খুব প্রাসঙ্গিক নয়, বাজার প্রসঙ্গ লেখার ক্ষেত্রে। কিন্তু কলকাতার বাজার এবং মুদিখানার সম্পর্ক অটুট। কলকাতার এক ব্যবসায়ী শুধুমাত্র পয়সার খাতিরে দোকানদারি করেন না। মানবিকতার পরিচয়টাই আসল, একথা না বললে বোধহয় কলকাতার বাজারের গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

কলকাতার ঐতিহ্যে অনেকক্ষেত্রে বদলে গেছে কিন্তু ধনী দরিদ্র্য মধ্যবিত্ত নির্বিশেষে বাজার করবার ইচ্ছে কিন্তু বদলায়নি।

 



অঞ্জন বসু চৌধুরী

কর্মাসে স্মাতক ও এম বি এ পাস করে চাকুরি জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও গান এবং গল্পের বই পড়া অঞ্জন বসু চৌধুরীর অন‍্যতম নেশা। এক সময়ে অসম্ভব সুন্দর মাউথ অরগ‍্যান বাজাতেন।

 

 


 

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!