Home প্রবন্ধ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – দ্বিতীয় ভাগ – চতুর্থ পর্ব
প্রবন্ধসাহিত্য ও সংস্কৃতি

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – দ্বিতীয় ভাগ – চতুর্থ পর্ব

শৈবাল কুমার বোস

মাইকেল মধুসূদন বলেছিলেন – ‘মহাভারতের কথা অমৃত সমান, হে কাশী কবীশদলে তুমি পুণ্যবান’। কাশীরাম সম্বন্ধে এই উক্তি সার্থক। কেননা কাশীরাম দাস তার ভারত পাঁচালীর মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতিকে তাদের হৃদয়ের সামগ্রীর দ্বারা পুণ্যফল বিতরণ করেছেন। সমগ্র বাঙ্গালী জাতির হৃদয়, সামাজিক আদর্শ ও নীতি কর্তব্যকে কৃত্তিবাস ছাড়া অন্য কোনো কবি এমনভাবে ব্যাক্ত করতে পারেননি।সপ্তদশ শতকে রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের যে সমস্ত ভাবানুবাদ হয়েছিল তার মধ্যে কাশীদাসই শ্রেষ্ঠ অনুবাদক।

ব্যাসদেব রচিত মূল মহাভারত গ্রন্থে মোট শ্লোক ছিল ৮৮০০। পরে নানাকবির দ্বারা শ্লোক সংযোজিত শ্লোকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় একলক্ষ। তবে, কাশীদাসী মহাভারতে শ্লোকসংখ্যা অনেক কম। তবে তিনি পুরো মহাভারত অনুবাদ করেছিলেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় আছে। তার কোনো একটি পুথিতে প্রাপ্ত শ্লোক অনুযায়ী আদি, সভা, বন ও বিরাট পর্ব অনুবাদ করেই কবি দেহান্তরিত হন। পরবর্তী চোদ্দটি পর্ব রচনা করেন কবির ভ্রাতুষ্পুত্র নন্দরাম দাস, জামাতা ও অন্যান্যরা। তবে এই নন্দরাম দাস কে নিয়ে বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করেন।

কাশীরাম দাসের কবি কৃতিত্বগুলো হলো –

১) বাঙ্গালীর চরিত্র বৈশিষ্ট্য ও বাঙ্গালীর দৈনন্দিন জীবনচর্চা কাশীদাসী মহাভারতের চরিত্রগুলিতে প্রকট। বীররসের বর্ণনায় তার যেমন দক্ষতা, অভাবনীয় ও করুণরস সৃষ্টিতেও একই রকম সক্ষমতা পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে কৌতুক পরিবেশনে কবির মৌলিকতা প্রমাণিত।

২) কবির ব্যবহৃত নির্মল ও সহজবোধ্য ভাষা কাব্যটির গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দের সঠিক ব্যবহার ও অলংকার প্রয়োগেও কবি নিজের দক্ষতা সঠিকভাবে এই কাব্যে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। জনপ্রিয়তার দিক থেকে কৃত্তিবাসের শ্রীরামপাঁচালী কাশীরাম দাসের ভারত পাঁচালীর স্থান।

৩) কাশীরাম দাসের মহাভারতে যে আখ্যান গৃহীত তা মূল মহাভারতের সমান্তরালে সম্পুর্ণ নিজের অনুভূতির সাথে ব্যাসের ভারতব্যাপি চিন্তা ভাবনার সংমিশ্রিত রূপ।

৪) কাশীরাম দাস পন্ডিত কবি ছিলেন। তিনি যে সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ ছিলেন তার বড় প্রমাণ ব্যাসদেবের মহাভারতের যথেষ্ট ভাষাগত সাদৃশ্য তার কাব্যের। কাশীরাম দাসের ভাষা সহজ, সরল, আন্তরিক। সেই ভাষা পড়বার জন্য আমাদের অভিধান নিয়ে বসতে হয় না। তিনি পূর্ববর্তী কবিদের লেখা পড়েছেন। উপরন্তু সংস্কৃত ভাষায় অত্যন্ত দক্ষ হওয়ায় তিনি যতটা সম্ভব সংস্কৃত সাহিত্যের রস পাঠকের কাছে হাজির করেছেন। সুতরাং তার সে গুণাবলির প্রশংসা করতেই হয়। তিনি একমাত্র বাঙ্গালী কবি যিনি মূলত পরিপূর্ণ একটি আখ্যানকাব্য পাঠকের সামনে উপস্থাপনা করেছেন। তার বর্ণনা সহজ, সরল, স্বাভাবিক ও চিত্তাকর্ষক। চরিত্রগুলো রক্ত-মাংসে বিশ্বস্ত  মর্যদা সম্পন্ন।

৫) ছন্দ বৈচিত্রেও কাশীরামের প্রতিভাকে সাদরে বরণ করতে হয়। ত্রিপদী ছন্দে তিনি এত সুন্দর আখ্যানকে বেঁধে দিয়েছেন যে সেই ছন্দের দোলায়িত রূপ আমাদের অভিভূত করে। ইন্দ্রপ্রস্থে শ্রীকৃষ্ণের আগমনকে কাশীরাম অসাধারণ শৈল্পিক জাল বুনেছেন। কোথাও কোথাও অষ্টক্ষরা ভৃঙ্গাবলী ছন্দের প্রয়োগ করেছেন।

৬) কাশীরাম দাস মহাভারতের মূল আখ্যানকে নিজের মতন করে পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করেছেন। আবার কোথাও নিজের মতন নতূন কাহিনীর সংযোজন করেছেন। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর ভীষ্ম লক্ষভেদ এসে শিখন্ডীকে দেখে ধনুত্যাগ করেছেন, দ্রোণ ও কর্ণের বাণ সুদর্শন চক্রে প্রতিহত হয়েছে – এমন কথা মূল মহাভারতে নেই কিন্তু কাশীরামে আছে। মুল মহাভারতে যে কাহিনীগুলো নেই, সেই কাহিনীগুলো কাশীরাম আপন কবি প্রতিভার জারক রসে জারিত করে সমস্ত বাঙ্গালী পাঠকের কাছে সরস ভাবে উপস্থপনা করেছেন। যেমন – পারিজাত হরণ, সত্যভামার তুলাব্রত, রাজসূয় যজ্ঞে বিভীষণের আগমন ও অপমান, শ্রীবৎস-চিন্তার উপাখ্যান, জনা-প্রবীর উপাখ্যান, ভানুমতি-লক্ষ্মণার স্বয়ংবর ইত্যাদি।

৭) বনপর্বে শ্রীক্ষেত্র মাহাত্ম্য, শান্তিপর্বে একাদশী মাহাত্ম্য ও হরিমন্দির মার্জনের ফল প্রভৃতি মূল রামায়ণে নেই। এমনকি কাশীদাসী মহাভারতে হরিভক্তির যে প্রাধান্য তাও মূল মহাভারতে নেই।

৮) কাশীদাসী মহাভারতে মূল থেকে সবচেয়ে বেশী ঘটেছে অশ্বমেধ পর্বে। যেমন মূলের নীলরাজার কাহিনী কাশীদাসী মহাভারতে নীলধ্বজ-জনা উপাখ্যানে পরিণত হচ্ছে।

৯) অনুবাদের ক্ষেত্রে তিনি ভাবানুবাদের রীতিকে গ্রহণ করেছেন। ব্যাসের ভারত ও জৈমিনি ভারত কাহিনী প্রভাবে কাশীরামের নামে প্রচলিত মহাভারতের কাহিনী পর্যায় বিন্যস্ত হয়েছে। কাশীরাম কোথাও আক্ষরিক অনুবাদ করেননি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৌলিক গল্প সন্নিবেশ করেছেন কিন্তু মূল মহাভারতের কাহিনীরস ক্ষুণ্ণ হয় নি।

১০) কাশীরাম বীররস ও কারুণরসের পাশে হাস্যরসের আয়োজনও করেছেন। একটানা যুদ্ধের ভয়ংকর দৃশ্যের মধ্যে তিনি হাস্যরসের অপুর্বধারা বাহিত করেছেন। ফলে পাঠকরাও কোথাও এই মহাভারত পড়তে ক্লান্তিবোধ করেননা। কীচকের মৃতদেহ দেখে জনতার অভিব্যক্তি নিঃসন্দেহে হাসির খোরাক জোগায়।

১১) কাশীরাম তার কাব্যে কৃত্রিম কাব্যকলার অনুসরণ করেছেন।সেই জন্য তিনি তার কাব্যে ঝংকার মুখর শব্দশৃঙ্খলাকে অনুসরণ করেছেন।

কাহিনীর বিপুল বিস্তারে, বিষয়বস্তু ও রসের বৈচিত্র্যে, চরিত্র চিত্রণের আন্তরিকতায়, জীবনের সর্ববিধ আবেগের প্রকাশে, ভাবপ্রকাশের গাম্ভীর্যে, বাঙ্গালী সমাজ-সংস্কৃতির যথাযথ রূপায়ণে কাশীরাম দাসের ভারত পাঁচালী অন্যতম শ্রেষ্ঠ অনুবাদের মর্যাদা পেয়েছে।

১) কাশীরাম দাস ভক্ত বংশের সন্তান। বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি তার প্রগাঢ় নিষ্ঠা ছিল। চৈতন্য প্রবর্তিত ভক্তিবাদ তার কাব্যে প্রভাব ফেলেছে। সমগ্র কাব্যে বীররসকে অতিক্রম করে গেছে করুণরস ও ভক্তিরস। অথচ এই কাব্য বীররসের কাব্য হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নাম ভক্তিবাদ এতটাই বঙ্গদেশে প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছিল যে এই কাব্যও হয়ে উঠেছে কৃষ্ণভক্তির অন্যতম প্রামাণিক নিদর্শন।

২) কাশীরাম দাসের মহাভারত লোকশিক্ষা প্রদানে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। কবি তত্ত্বকথা সযত্নে পরিহার করে নীতিকথার গল্প শুনিয়েছেন। ফলে এই কাব্যটি মূল সংস্কৃত মহাভারতের আক্ষরিক অনুবাদ না হয়ে কবির নিজস্ব জীবন দর্শনের অন্যতম পরিচায়ক হয়ে উঠেছে। কবি এখানে লোকশিক্ষকের ভূমিকা নিয়েছেন।

৩) কাশীরাম দাস তার অনুবাদকে এমন ভাবে উপস্থাপন করেছেন যে বাঙ্গালী ঘরের মন মেজাজ, অনুভব-অনুভূতি যথাযথ ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। স্বামী ভীমকে নিয়ে যেভাবে সভাপর্বে দ্রৌপদী ও হিড়িম্বা ঝগড়া করেছেন, তাতে সতীন কোন্দলকে প্রমাণ করেছে।কৃত্তিবাসের মতন কাশীরাম দাস বাঙ্গালী মনের উপযোগী কাব্য রচনা করেছেন। ফলে তার পাঠক সংখ্যা যথেষ্ট। এখনও প্রতি ঘরে ঘরে কাশীদাসী মহাভারত সুর সংযোজনে উচ্চারিত হয়।

৪) চরিত্র পরিকল্পনায় আমরা দেখেছি কাশীরাম দাস একান্নবর্তী সংসারে আর পাঁচটি মানুষ সেভাবেই চরিত্রকে তুলে ধরেছেন। তাই ভীম হয়েছেন পেটুক, যুধিষ্ঠির ধর্মভিরু, দ্রৌপদী আক্ষেপ সর্বস্বা বাঙ্গালী গৃহবধূ। শৌর্যশালী ভীম, গান্ডীবধারী অর্জুন, আদর্শবাদী যুধিষ্ঠির এখানে আমাদের পাড়াগাঁ-এর সাধারণ মানুষে পরিণত হয়েছেন। মুল মহাভারতের আর্যসংস্কৃতির দ্বারা কাশীরাম পরিচালিত হননি।

৫) মহাভারতের বিষয়-বৈচিত্র্য ও রসের বিভিন্নতা রামায়ণ অপেক্ষা অনেক বেশী। রামায়ণের আখ্যান একমুখী। কিন্তু মহাভারতের আখ্যান বহুমুখী। এই আখ্যানে রাষ্ট্রের উথ্বান-পতন, রাজনীতি, ধর্মনীতি, জীবনদর্শন এবং সর্বোপরি অখন্ড ভারতের গঠনের পরিকল্পনা সুচিত্রিত হয়েছে।

বাঙ্গালী সুদীর্ঘকাল ধরে পান করে আসছে কাশীদাসী কাব্যামৃত। কাশীদাসী মহাভারতে এমন একটা বিশুদ্ধতা ও স্নিগ্ধতা আছে যা ভক্তিমিশ্রিত সহজ ধর্মবোধ সংযোগে আমাদের জাতীয় মনটিকে তৈরী করেছে। জাতীয় মনের সঙ্গে সঙ্গে আবার এ মহাভারত গড়ে উঠেছে। তাই এ কাব্যকে লোককাব্য বলা চলে।

ঋণ স্বীকার :
১) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস দ্বিতীয় খন্ড – ডঃ সুকুমার সেন
২) বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা প্রথম পর্যায় – শ্রী ভূদেব চৌধুরি
৩) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আদি ও মধ্য যুগ – ডঃ দেবেশ কুমার আচার্য
৪) বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক ইতিহাস – ডঃ দীপঙ্কর মল্লিক
লেখক পরিচিতি
শৈবাল বসু

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পদার্থ বিদ্যা নিয়ে স্নাতক। পেশাগত ভাবে গত ৩৪ বছর ধরে ব্যাঙ্কার। নেশাগত ভাবে শরদিন্দু ও ইতিহাস প্রেমী। বর্তমানে কলকাতা ও বাংলার ইতিহাস নিয়ে চর্চারত।

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!