অলোক মুখোপাধ্যায়
আজ সেই দিন ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। জনসংখ্যার নিরীখে অর্ধেক আকাশ জুড়ে যারা তাদের বাদ দিয়ে সমাজ চলে না। চলা সম্ভবও নয়। নারী দিবস কেন আন্তর্জাতিক অথবা ৮ মার্চ তারিখটাই বা কেন সেই বিষয়েই আমার নাতিদীর্ঘ নিবেদন। বলা বাহুল্য মানব সভ্যতার ইতিহাসের পাতা থেকে জানা বোঝার ভিত্তিতেই এই প্রতিবেদন।
পৃথিবীর বুকে বিপ্লবের চিরকালীন চিহ্ন বহনকারী ১৮৭১ এর প্যারি কমিউন। পুরুষের সাথে কাঁধ মিলিয়েছিলেন মেয়েরা। প্যারি কমিউনে মহিলাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইকে স্বীকৃতি দিলেন মহান দার্শনিক কার্ল মার্কস। তিনি লিখলেন –পৃথিবীর যে কোন সংগ্রামেই পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মেলাতে হবে মেয়েদের। অন্যথায় সেই লড়াই কখনোই সাফল্যের মুখ দেখবে না।
১৮৫৭ সাল। ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহ। মাতৃভূমি রক্ষার লড়াইয়ে উল্লেখযোগ্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাই। ঠিক সেই একই সময়ে অর্থাৎ ১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কে দরজি শ্রমিক মেয়েরা কাজের সময় এবং মজুরি বাড়ানোর দাবীতে গড়ে তুললেন দূর্বার আন্দোলন। শুধুমাত্র জীবন জীবিকার জন্য নয়, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে মেয়েদের সুদীর্ঘ লড়াই ইতিহাস হয়ে আছে বিশ্বের সর্বত্র। মার্কসের বন্ধু এঙ্গেলস তাঁর কলমে লিখলেন –মাতৃ অধিকারের উচ্ছেদ হচ্ছে স্ত্রী জাতির এক বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়। সম্ভবত এঙ্গেলস এর এই বার্তায় উৎসাহিত হয়েই নারীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করার সাহস পান। সেই সব সংগ্রামী নারীরা মা হয়েছেন। তাদের গর্ভে জন্ম নিয়েছে যে মেয়ে সেই মেয়েও একদিন নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে প্রতি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়েছে। সেই লড়াই আজও থেমে নেই।
ক্লারা জেটকিন নামটা আমাদের সবার জানা এবং না জানা দুটোই হতে পারে। তিনি সাম্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৮৮৯ সালে প্যারি শহরে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সন্মেলনে ক্লারা জ়েটকিন প্রাঞ্জল ভাষায় সর্ব প্রথম নারী পুরুষ সমানাধিকারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। সারা বিশ্ব আশ্চর্য হয়ে শুনল এবং বুঝতে চেষ্টা করলো তাঁর দাবীর যৌক্তিকতা। বহু যুগ ধরে বিশ্বের সর্বত্র বঞ্চিত নিপীড়িত মায়েরা বিশ্বাস করতে থাকলো যে ক্লারা জেটকিন তাদেরই মনের কথা বলছেন। শুধু পিছিয়ে থাকা মহিলারা নন, অন্য মহিলা এবং মেয়েরা সমাজে যারা কিছুটা এগিয়ে আছেন আগ্রহ জাগল তাদের মধ্যেও। শিল্পোন্নত দেশের শ্রমজীবি নারীরাও উৎসাহিত হতে থাকলেন। ক্রমশ জনপ্রিয় এবং মুখরিত হতে থাকলো নারী পুরুষ সমানাধিকারের দাবী।
১৯০৭ এ জার্মানীর স্টুটগার্টে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সন্মেলনে সম্পাদক হলেন ক্লারা জেটকিন। নারী আন্দোলন ক্রমশ বিকশিত হতে থাকলো বিশ্বের উন্নত দেশ গুলোতে। ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কে দরজি শ্রমিক মেয়েরা ভোটাধিকার প্রদানের দাবী নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। একদিকে ক্লারা জেটকিন অন্যদিকে কার্ল মার্কসের ফিলোসফি –পৃথিবীর যে কোন সংগ্রামেই পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মেলাতে হবে মেয়েদের। এই দুয়ের মেলবন্ধন তুফান তোলে সেই আন্দোলনে।
১৯১০ সালে ডেনমার্কে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সন্মেলনে ক্লারা জেটকিন এবং আলেকজান্দ্রা কোলনতাই এর যৌথভাবে উত্থাপিত দাবী প্রস্তাব গৃহীত হয় -যে প্রতি বছর একটি দিন পূর্ণ বয়স্কা নারীদের ভোটাধিকার প্রদানের দাবী দিবস হিসাবে পালন করা হবে। এই দাবীও ছিল ঐতিহাসিক, কেন না তখনও বেশির ভাগ দেশে মেয়েদের ভোট দানের অধিকার ছিল না।
১৯১১ সালে মার্চ মাসের বিভিন্ন দিনে শুরু হয়ে গেল নারী দিবস উদযাপন। তারপর ঠিক হয় ১৯০৮ সালের ৮মার্চ যেদিন নিউইয়র্কে দরজি শ্রমিক মেয়েরা ভোটাধিকার প্রদানের দাবীতে আন্দোলন শুরু করেছিল সেই ৮ মার্চই সর্বত্র নারী দিবস হিসাবে পালিত হবে। ১৯৪৫ এ রাষ্ট্রসংঘ গঠিত হয় এবং তার পরেই নারীর সমানাধিকারের দাবী ঘোষিত হয়। ১৯৭৫ সাল থেকে রাষ্ট্রসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে ঘোষণা করে।
@অলোক মুখোপাধ্যায়