Home বিবিধ, গল্প আমার কলকাতা শহরকে দেখার অভিজ্ঞতা
বিবিধগল্প

আমার কলকাতা শহরকে দেখার অভিজ্ঞতা

সঞ্চারী গোস্বামী মজুমদার


আমার জন্ম উত্তর ২৪ পরগনা জেলার এক ছোট্ট শহরে।  তাই আমি আর পাঁচ জন সাধারণ বাচ্চাদের থেকে বেশি সময় মফস্বলের আশপাশ ঘুরেই  কাটিয়েছি।  ছোটবেলা থেকেই কলকাতাকে দেখার অভিজ্ঞতা ছিল খুবই কম। কলকাতা দেখা মানে আমার কাছে ছিল হাতেগোনা কয়েকটা জায়গা। তার মধ্যে অবশ্যই পড়ে চিড়িয়াখানা, নিকো পার্ক, সাইন্সসিটি ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। আর মাঝেমধ্যে মেলা দেখতে যেতাম সিঁথির মোড় অবধি। আর না হলে বাবার দুই বন্ধুর বাড়ি যা মানিকতলা ও দমদম পার্কে ছিল। আমার কাছে এই প্রত্যেকটি জায়গাতে যাওয়া খুব আনন্দের বিষয় ছিল। তার প্রধান কারণ হলো কলকাতা দেখার আনন্দ যেটা সচরাচর হতো না। তাই প্রত্যেকবারই  এই জায়গা গুলোতে যাওয়া হবে  শুনলেই আমার আনন্দের কোন সীমাই  থাকত না। এই রকম ভাবেই দেখতে দেখতে আমার স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে যায়।  আর্ ঠিক এখান থেকেই শুরু হয় এক নতুন জীবন এবং সেই জীবনের সাথে জড়িয়ে কলকাতা দেখার কিছু কথা।

আমার কলেজে যাওয়ার গল্পটা  একটু অন্যরকম। ক্লাস 12 পরে আমি একটি ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউট এ ট্রেনিং নেওয়ার চান্স পাই এবং তার সাথে সাথে কলেজেও ভর্তি হই। সপ্তাহে ৫ দিন ট্রেনিংয়ের জন্য যেতাম আর শনি ও রবিবার  কলেজ করতাম। ট্রেনিংয়ের জন্য আমাকে আসতে হতো কলকাতার ময়দান চত্বরে আর কলেজ করতাম শ্যামবাজাররে। আমি বরাবরই যেখানে যেতাম সেখানে মা-বাবার সঙ্গে যেতাম। ফলে যখন ট্রেনিং ও কলেজের জন্য আমায় একা যাতায়াত করা শুরু করতে হয়েছিল তখনই এক অন্য ধরনের অভিজ্ঞতার ও শুরু হয়। কিভাবে আমি আমার স্বাধীনতার সাথে সাথে কলকাতা  শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরেছি এবং অনেক কিছু দেখেছি-  সেটা সত্যিই আমার কাছে এক অন্য ধরনের অনুভুতি। আর এই অনুভূতি নিয়েই আমার আজকের এই ছোট্ট গল্প।

আমার স্পষ্ট করে মনে পড়ে আজ থেকে ১১ বছর আগের কথা  যখন আমি ট্রেনিংয়ের জন্য প্রথমবার ময়দানের সেই জায়গাতে যাই যেখানে  আমি কোনদিনও যাইনি। জায়গাটা ছিল ঠিক আমেরিকান কনস্যুলেটের বিপরীতে,একটি ১০০ বছর পুরনো বাড়ি।  সেই বাড়িটির নাম “হ‍্যারিংটন  ম্যানশন”। এই বাড়ির দোতলায় আমাদের ট্রেনিং হত।  ঢুকতেই জায়গাটার মধ্যে একটা অন্যরকম ব্যাপার। রাস্তায় মিলিটারি ক্যাম্প করা আছে ইউএস কনস্যুলেটে জন্য তাই খুব একটা  বেশি লোক বাড়ি কনটাই যাতায়াত করে না।  বিল্ডিং এর পাশেই আরেকটি বিল্ডিং আছে সেখানে ছিল জাবেদ হাবিবকে বিশাল বড় পার্লার। সব মিলিয়ে জায়গাটা একটু অন্যরকম। প্রথম দিন আমি আমার মা-বাবার সঙ্গে ট্যাক্সিতে করে সেখানে যাই,যদিও ট্যাক্সি রাস্তায় ঢোকেনা অনেক আগেই আমাদের নামিয়ে দেয়। তারপরে এক মাস ওই ডিউটিতে আমি বাসে করে যাতায়াত করেছি এবং আমার মা ও আমার সাথে যেত।  ফলে খুব একটা বেশি কিছু দেখা হয়নি শুধু টুকটাক আসা যাওয়ার পথে একটি শপিং মল দেখেছি এবং ভেবেছি যে কোনদিনও ওখানে যেতে পারলে খুব ভালো হয়।  এইভাবে যখন একমাস কেটে যায় তারপরে আমার একা যাতায়াত করা শুরু হয়। আমার কিছু নতুন বন্ধু হয়েছিল ইনস্টিটিউটে তাই ওদের সাথে দেখা করতাম এবং যেতাম আর ফিরতাম রোজ। তারপরই শুরু হলো ধীরে ধীরে বন্ধুদের সাথে মিলে ময়দান ও তার আশেপাশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে দেখা।  প্রথম প্রথম বেশি ঘুরতাম না, শুধু মেট্রো স্টেশনে  ফেরার সময় অন্য পথ ধরে ফিরতাম যেটা একটু ঘুরতে হতো।  তবে বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে বেশিদূর বলে মনে হতো না সেই পথও।  ইনস্টিটিউটে যাওয়ার সময় অবশ্যই ওই পথে ধরতাম না কারন তাতে অনেকটা সময় নষ্ট হতো তবে ছুটির পর তো আর কোনো কাজ থাকত না তাই বেশ আরাম করে পাকৌড়া খেতে খেতে  এবং গল্প করতে ই ফিরতাম।

এরপর দেখতে দেখতে বেশ আরো কটা দিন কেটে যায়। একদিন আমাদের কিছু বন্ধুরা মিলে ঠিক করলো যে তারা ‘মেট্রো প্লাজা’ শপিংমলে যাবে। আমাকেও বলল ওদের সাথে যেতে। আমি প্রথমটা আপত্তি জানালেও পরে রাজি হয়ে যাই তার কারণ আমারও যাওয়ার ইচ্ছা ছিল অনেকদিন ধরেই। এভাবে আমি আমার জীবনে প্রথমবার কোন শপিংমলে গিয়ে, সেটা ঘুরে দেখলাম। এরপর থেকে প্রায়ই আমরা মেট্রো প্লাজাতে যেতাম আর তার সাথে শুরু হল অন্যান্য জায়গাগুলোকে ঘুরে দেখার পর্ব।  যেমন মাঝে  মধ্যেই আমরা এলিয়েট পার্কে যেতাম এবং ওখানে বসে আড্ডা দিতাম।  কখনো আবার ক্যামাক স্ট্রীটের  প্যান্টালুনস,  কখনো বরদান মার্কেট আবার কখনো কোনো এসি মার্কেট ইত্যাদি জায়গাগুলোতে  প্রায়ই আমরা ছুটির পরে যেতাম।

কখনো আবার আমরা কোন বন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে কাছাকাছি কোন হোটেলে গিয়ে লাঞ্চ করতাম। তারপর যখন চার মাস কেটে গেছে সেই সময়ে আমরা একদিন ঠিক করি যে হেঁটে হেঁটে এসপ্ল্যানেড যাব এবং ওখান থেকে কিছু কেনাকাটা করব। এইভাবে আমি  কখনো কোনো বন্ধুর শপিং করার প্রয়োজন পড়লে তার সাথে যেতাম আবার কখনো নিজেও কিছু কিনতাম। একবার আমরা ঠিক করি পার্ক স্ট্রিটের ম্যাকডোনাল্ডস-এ  লাঞ্চ করব এবং আশপাশে একটু ঘুরবো। এইভাবে ময়দান আর্ তার সঙ্গে আমি আস্তে আস্তে পার্কস্ট্রিট এবং এসপ্ল্যানেড –  এই দুই জায়গায় চিনলাম।

খুব ভালো মনে পড়ে আইলার  ঝড় যেদিন  কলকাতায় হয় সেদিনকার  কথা। আমাদের ঠিক দুপুর বারোটা নাগাদ ছুটি দিয়ে দেয় আর আমরা মেট্রো ধরে শুধু গিরিশ পার্ক অব্দি পৌঁছাতে পারি। তারপর ওখান থেকে রাস্তা চিনে  আমি আমার বাবার সঙ্গে  দেখা করি এবং দুজনে মিলে গলির পথ ধরে  শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে যাই। সেদিনের সেই কলকাতাকে দেখার অভিজ্ঞতা আমার কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এরপর ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন কাজে আমাদের অনেক জায়গাতে যেতে হয়েছে। বেশিরভাগ জায়গাগুলোই কোন জনবহুল জায়গায় যেমন কলেজ বা ইউনিভার্সিটি, যেখানে আমরা বহু সংখ্যক ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথোপকথন করার সুযোগ পাবো। তাই কখনো শিয়ালদা অঞ্চলে এবং কলেজে গেছি রাস্তা দিয়ে যায় তো আগে কোনদিন দেখিনি বা আছে বলে জানতামও না। তখনই আমার প্রথমবার কলেজস্ট্রিট ও কফি হাউজ দেখা।  আবার সল্টলেকে ও কয়েকবার গিয়েছিলাম। রাস্তাঘাট সেখানে আমার সবকিছুই খুব জটিল মনে হতো। তাই খুব বেশি জায়গা ঘোরা হয়নি সেখানে। আসা যাওয়ার পথে কিছু অফিস দেখি আর সিটি সেন্টারই খালি ঘুরে দেখেছিলাম।

কলেজে যখন শনিবার রোববার করে যেতাম তখন আলাদা অভিজ্ঞতা  হয়েছিল। ক্লাস শেষ করার পরে আমরা সবাই মাঝেমধ্যে হাতিবাগান চলে যেতাম কারণ আগেই বলেছি আমার কলেজ ছিল শ্যামবাজারে।  ফলে মাঝেমধ্যে  টুকটাক কেনাকাটা করার জন্য চলে যেতাম সেখানে আবার কখনো রাস্তায় এদিক ওদিক ঘুরে বিভিন্ন দোকান দেখতাম আর কিছু টুকটাক পেলে কিনেও খেতাম। অনেক সময় আবার ক্লাস শেষের পরে যদি টিউশন না থাকতো তাহলে  হাতিবাগানের স্টার থিয়েটারে গিয়ে বেশ কয়েকবার সিনেমা দেখেছি। টিউশন পড়ার জন্য আবার অন্য জায়গায় যেতাম।

ভবানীপুরে যদুবাবুর বাজার এর উল্টোদিকে এক   গলিতে  যেতাম। সেখানে প্রথমবার আমি যদুবাবুর বাজার দেখি এবং কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টির দোকান বলরাম মল্লিক ও রাধারমণ মল্লিক দেখি। এইভাবে কলেজ ও টিউশন পড়ার জন্য আমি কলকাতার আরো দুটো নামকরা জায়গা চিনতে পারি। যদিও এখান থেকে খুব একটা বেশি দূরে যাওয়ার সুযোগ আমি পাইনি তবুও যেইটুকু আশপাশে ঘুরে দেখেছি তাতেও আমার বেশ অনেকটা জায়গায় চেনার সুযোগ  হয়েছিল যা পরবর্তীকালে আমার অনেক ক্ষেত্রে কাজে লেগেছে। একবার মনে পড়ে আমাদের এক বন্ধু অসুস্থ থাকার কারণে আমরা তার  বাড়িতে গিয়ে টিউশন পড়তাম একসাথে ভবানীপুরে। একমাস মতন আমরা ঢাকুরিয়া  গেছিলাম আর দু-একবার ফেরার পথে গড়িয়াহাট নামে এবং একটু ঘুরে ফিরে আসি।

এরপর হয়তো অনেক জায়গাতেই গিয়েছিলাম এছাড়াও মা-বাবার সাথে ঘোরার অভিজ্ঞতা কখনো আমার কাছে খারাপ ছিল না। তবে সব সময় মনের মধ্যে আনন্দ ছিল যে বড় হওয়ার পরে একা আমি বা কখনো বন্ধুদের সাথে মিলে কলকাতাকে পুরোপুরি দেখেছি ও চিনেছি নিজের মনের মত করে।

এই ছিল আমার কলকাতাকে নিজের মতন করে দেখার অভিজ্ঞতা।  এখন হয়তো আমার কাছে কলকাতা মানে আর একেবারেই অজানা জায়গা নয় কারণ এখন আমি দক্ষিণ কলকাতাতেই থাকি।  তবে সেই সময়ে কলকাতাকে দেখার আনন্দটা যে কতখানি  ছিলো তা বলে বোঝাতে পারলাম কিনা জানিনা।  আমার মতন আরও হয়তো এমন অনেক মানুষই আছে যারা কলকাতাকে আমার মতন বয়সে প্রথমবার দেখে। কিন্তু খুব কম লোকই আছে যারা সেই অভিজ্ঞতাকে তাদের  স্মৃতিতে সযত্নে আজও রেখে দিয়েছে। এই অপ্রত্যাশিত ভাবে কলকাতাকে দেখার সুযোগটা  আমার জীবনের  ঘটা একটি প্রিয়  অধ্যায়।

Credit: By Unstable.atom – Own work, CC BY-SA 4.0, https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=78183814



লেখিকা পরিচিতি

Sanchari Goswami Majumdar

Loves to teach and practice dance. Likes to read books.

 

 

 


Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. ভারি সুন্দর। লেখিকার সঙ্গে আমিও কলকাতা নতুন ভাবে দেখলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!