লেখিকা : গোপা মিত্র
মানালী
।। দ্বিতীয় পর্ব ।।
১৯৮১-র সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি আমি ভীষণভাবে উত্তেজিত। সঙ্গে খুব খুশিও বটে। উত্তেজনার কারণ দুটি – প্রথমতঃ, আমি আবার রোটাং পাস যাবো, আবার বরফের ওপর দিয়ে হাঁটবো। আর দ্বিতীয়তঃ, আমি আবার প্লেনে চাপবো – হোক্ না তা যতোই কম দূরত্বের! তখন তো এতো সস্তার ফ্লাইট ছিলো না – তাই এতো উত্তেজনা। খুশি আর আনন্দের কারণ হলো – এই প্রথম আমরা তিন বোনে সপরিবারে একসঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছি। যাচ্ছি – আমি, কল্যাণ, সোনাই (আমাদের মেয়ে শ্রীজাতা), বোনটি (মেজো বোন নীলা), তার স্বামী সঞ্জয় ভট্টাচার্য, তাদের ছোট্ট মেয়ে নিন্নি (সৌম্যা), ছোট বোন আনু (অঞ্জনা) ও তার স্বামী সুনীত দত্ত – মোট আটজন।
বিবাহসূত্রে আনু তখন দিল্লীর বাসিন্দা – ওই আমাদের দুই বোনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে – দিল্লী বেড়িয়ে যাওয়ার জন্যে। আমরা রাজি তো বটেই, সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেললাম, শুধু দিল্লী কেন, আমরা কুলু মানালীটাও বেড়িয়ে আসবো। ওরা তো আগে যায়নি। আমি যদিও গেছি, কিন্তু মানালীর সেই পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা মনে করে, এক পায়ে খাড়া হয়ে গেলাম।
ঠিক হলো, আমরা এবার দিল্লী থেকে সুপার ফাস্ট বাসে একেবারে সোজা গিয়ে মানালীতেই উপস্থিত হবো। হোল নাইট ষোল ঘন্টার বাস জার্নি। সকলেই ভাবলাম কোনোওরকমে বাসে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেবো, তার পরের দিন বেলাতেই তো পৌঁছে যাবো মানালীতে। সেখানে যেহেতু আমাদের হোটেল বুকিং রয়েছে, তাই কোনোও অসুবিধেই হবে না। হায় রে! তখনোও তো জানি না, আমাদের কপালে কি রয়েছে।
যাই হোক্; সকলে তৈরি হয়ে, সন্ধ্যা সাড়ে ছটার মধ্যে দিল্লীর ইন্টার স্টেট বাস টার্মিনাসে পৌঁছে গেলাম। সুনীতের বমির Tendency রয়েছে বলে সে একটা বমির ওষধ খেয়ে নিলো। মালপত্র সব বাসের ছাদে তুলে দিয়ে যে যার নিজের জায়গায় গুছিয়ে বসলাম। সকলের কাছেই একটা করে হাতব্যাগ রয়েছে – যার মধ্যে সামান্য কিছু গরম জামা, চাদর বা বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় কিছু টুকিটাকি রয়েছে। যা হয়তঃ মানালীতে নেমেই আমাদের কাজে লাগবে। খাওয়ার জলও অবশ্য সঙ্গে ছিলো।
৭টা/৭-৩০টায় বাস ছেড়ে দিলো। আমরা সকলেই খুব উত্তেজিত। পিছুটানহীন হয়ে, প্রিয়জনদের সঙ্গে এভাবে বেড়াবার মজাই আলাদা।
বাস চলছে দুরন্ত গতিতে – আমরা সবাই ঝঁকুনিতে এদিক ওদিক করছি – কিন্তু তাহলেও তন্দ্রা এসে গেছে। আর সুনীত তো বমির ওষুধের প্রভাবে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছে – ডাকলে শুধু উঁ আঁ করছে।
কিছুক্ষন পরেই ‘ঠকাস্’! মাথা ঠুকেছে সামনের সীটে। নিজেদের সামলাবার আগেই আবার ‘ঠকাস্’ – এবার মাথা ঠুকেছে পেছনদিকে। ডানদিক, বাঁদিক, সামনে, পেছন – কিছুতেই নিজেদের বাঁচানো যাচ্ছে না। ঘুমের তো দফারফাই, এখন নিজেদের কপাল, ঘাড়, মাথা কিভাবে বাঁচানো যায় – সেই চিন্তাতেই অস্থির সবাই। আসলে বাস এখন উঁচু-নিচু পাহাড়ি প্যাঁচালো রাস্তায় এসে পড়েছে – কাজেই এমনই চলবে। আমরা যে যার ব্যাগ খুলে, চাদর, গামছা, তোয়ালে, সোয়েটার – যার কাছে যা ছিলো – সব বার করে সেগুলো দিয়ে কপাল মাথা বেড় দিয়ে (যার যেমন দরকার) জড়িয়ে নিলাম – যদি এভাবে নিজেদের কোনোওমতে বাঁচানো যায়।
সব দুঃখেরই শেষ থাকে। তাই সেই দুর্বিষহ বাসজার্নির সমাপ্তির সময়টাও এগিয়ে আসতে লাগলো। সকাল হয়ে গেছে। কুলু পৌঁছে গেছি। আর মাত্র ৪০ মাইলের মতো বাকি মানালী পৌঁছতে। দূরের পাহাড়, পাশের বিপাশা নদী আর সারি সারি গাছের নয়নাভিরাম দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে বাস আমাদের পৌঁছে দিলো মানালী – আমাদের গন্তব্যে। পথের সব কষ্ট তখন ভুলে গেলাম। কারণ পৌঁছে গেছি মানালী। আমার স্বপ্নের রোটাং পাস থেকে সামান্য দূরে।
এসে উঠলাম আমাদের নির্দিষ্ট হোটেল HPTDC – এর হোটেল বিয়াস-এ। হোটেল ভালো, তবে খাওয়ার কোনোও ব্যবস্থা নেই। পাশেই রয়েছে বড় রেস্টুরেন্ট ‘চন্দ্রতাল’। আমরা আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা সেখানেই করলাম।
পরদিন থেকেই শুরু হলো আমাদের পায়ে হেঁটে মানালী সফর। সকালে Breakfast সেরেই সবাই বেরিয়ে পড়তাম, ইতি-উতি ঘুরতাম, পথেই কোথাও বসে বিশ্রাম নিতাম – ক্ষিধে পেলে খেয়ে নিতাম আর বিকেল হলেই ফিরে আসতাম – নিজেদের আস্তানায়। রাতের খাবার হোটেল ‘চন্দ্রতাল’-এ।
সেই বিপাশার ধার দিয়ে হাঁটা, হিড়িম্বা মন্দিরে যাওয়া, সেই লগ-হাট্স্, সেই কাঁচের ঘরের রেস্টুরেন্ট – সবই দেখা হয়ে গেলো। বশিষ্ঠ কুণ্ডে একদিন সবাই স্নানও করে এলাম। তবে এবার পুরুষ ও মহিলাদের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা – আলাদা স্নানঘর।
তবে এবার মনে হলো, বিপাশার স্বচ্ছ্ব জলধারা কিছুটা যেন মলিন হয়েছে। দুপাশে আবর্জনার পরিমাণ বেড়েছে। পাহাড়ের চূড়ায় বরফ কমেছে, রাস্তায় হিপি-হিপিনীদেরও দেখা যাচ্ছে না। পরিবর্তে পর্যটকদের ভিড় বেড়েছে, বাজার এলাকা গম্গম্ করছে। আমরা অবশ্য বাজারের দিকে যেতাম না – খুঁজে খুঁজে যেদিকে ভিড়ভাট্টা কম, সেদিকেই বেড়াতে যেতাম।
আগেরবার এসে চেরীগাছ থেকে চেরী ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছিলাম। এবার আপেল গাছ থেকে আপেল পেড়ে খেতে লাগলাম। চারদিকে আপেলবাগানে আপেল ফলে আছে, মাটিতেও কতো আপেল পড়ে আছে। সেই আপেলবাগানেই জীবনে প্রথমবার দেখলাম – গিরগিটি। প্রথমে বুঝিনি, সুনীত আমাকে বলে দিলো বলে জানতে পারলাম সবুজ রঙের বড় টিকটিকির মতো দেখতে এই সরীসৃপটিই হলো গিরগিটি। আমি হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলাম কারণ ছোটবেলা থেকে একমাত্র অষ্টপদী মাকড়সা ছাড়া কোনোও জীবকেই আমি ভয় পাই না। যেই ধরতে গেলাম, সেটা আমার চোখের সামনে রং বদলে খয়েরী হয়ে পালিয়ে গেলো। শুনলাম, এই রং বদলাবার ক্ষমতার জন্যেই এই প্রাণীটিকে বলা হয় ‘বহুরূপী’।
এবার যাবো রোটাং পাস – আমি উত্তেজিত – পুরনো জায়গা ফিরে দেখবো। আবার বরফের ওপর দিয়ে হাঁটবো।
পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে গাড়ি এলো। আমরা সবাই তৈরি। তবে এবার আর শাড়ি নয়। পায়ে কেড্স্ জুতো হলেও আমরা তিন বোনেই এবার শার্ট-প্যান্ট নিয়ে এসেছি। তাই পরেই আমরা আটজন রওনা দিলাম – রোটাং-এর দিকে।
মানালী-লেহ্ হাইওয়ে (World’s Highest Motorable Road) দিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চললো। মাঢ়ী ছাড়িয়ে এবার ওপরে উঠতে লাগলো। একেবারে রোটাং-এ এসে গাড়ি থামলো।
চারিদিকে চেয়ে দেখলাম – এটাই না কি রোটাং পাস! আগের রোটাং আর এই রোটাং-এর মধ্যে কতো তফাৎ। পায়ের তলায় বরফ নেই – দু এক জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে সামান্য কিছু বরফ পড়ে আছে। দুপাশের পাহাড়-চূড়াতেও যৎসামান্য বরফ। আমি হতাশ। এতোডুড় এলাম কী শুধু এই দেখবার জন্যে? তারপর বুঝলাম ভুল সময়ে এসেছি – এখন বরফ সব গলে গেছে। সেদিনই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম এবার থেকে পাহাড়ে যাবো শীতের সময়ে, ঠাণ্ডায়, যখন পাহাড় থাকবে বরফে ঢাকা। তখনই হবে চোখের তৃপ্তি – মনেরও তৃপ্তি।
রোটাং ছাড়িয়ে একটু এগোলেই রয়েছে ঋষি ব্যাসদেবের নামে ব্যাসকুণ্ড। বরফগলা জলের লেক, ষেটা না কি বিয়াস নদীর উৎস।
আমাদের মানালী ভ্রমণ এখানেই শেষ। কাল যাবো কুলুতে। নতুন সকালে, নতুন জায়গায়।
দারুন পিসি …খুব ভাল লাগছে। দুটো পর্ব ই খুব interesting…লিখতে থাক পিসি…।.
দিদি, খুব ভালো হয়েছে
পড়লাম। আরেকটু লিখলে সম্পূর্ণ হতো ।
Darun hoeche mami. Waiting for more parts..
চলুক!
ধন্যবাদ ।
চালিয়ে যাও । খুউউউউব ভাল লাগছে।