লেখিকা: গোপা মিত্র
মানালী
।। প্রথম পর্ব ।।
নাম শুনেই হয়ত মনে হবে এটা কোনোও ভ্রমণ কাহিনী। না, এটা কোনোও ভ্রমণ কাহিনী নয়। এটা আমার ভালোবাসার কাহিনী। না, কোনোও মানুষী প্রেমের কাহিনী নয় – পাহাড় প্রেমের কাহিনী। সেই কবে আমার মনে এই পাহাড় প্রেম ঢুকে গেছে, তা আজ পর্যন্ত বার করতেই পারলাম না। পাহাড় বলতে আমি বরফে ঢাকা পাহাড় অর্থাৎ পর্বতকেই বোঝাতে চাইছি, বরফ ছাড়া পাহাড়, একেবারেই না। কবে থেকে আমি এই বরফাবৃত পাহাড়ের প্রেমে পড়লাম, আজ আমি সেই কাহিনীই বলতে চলেছি।
সালটা ছিলো ১৯৭১, আমার তখন বিয়ের একবছরও পূর্ণ হয়নি। ঠিক হলো, আমরা চারজন – আমি, আমার স্বামী কল্যাণ, আর কল্যাণের দুই বন্ধু শঙ্কর ও অসিতদা আমরা যাবো মানালী বেড়াতে। তার সঙ্গে অবশ্য সিমলা, চণ্ডীগড়, হরিদ্বার, মুসৌরীতেও কয়েকদিন করে থাকবো। তবে আমাদের প্রধাণ গন্তব্য মানালী – এবং সেখানে আমরা বেশ কিছুদিন থাকবো।
মানালী তখন পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে খুব পরিচিত ছিলো না। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কে কর্মরত শঙ্কর, সেই কোথা থেকে খবর পেয়ে, আমাদের থাকার সমস্ত ব্যবস্থা করে একটা গেস্ট হাউসে। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি আমরা কালকা মেলে কালকা, সেখান থেকে ছোট ট্রেনে সিমলা, আর তারপর গাড়িতে পৌঁছে গেলাম মানালী।
পাল গেস্ট হাউস – কাঠের তৈরি দোতলা বাড়ি। দোতলা সামনে বারান্দা, নিচেও বেশ অনেকটা জায়গা। আমরা দুজনে দোতলায় আর বন্ধু দুজনের একতলায় থাকার ব্যবস্থা হলো। রোজ সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে চারজন বেরিয়ে পড়তাম মানালী আবিষ্কারে। আমাদের পাশ দিয়ে বয়ে চলতো উচ্ছ্বল, স্বচ্ছ বিপাশা নদী। আর তার ওপাশে দেখা যেতো বরফে ঢাকা পর্বতশৃঙ্গ। পর্যটক শূন্য রাস্তা, মাঝে মাঝে শুধু হিপি-হিপিনীদের আনাগোনা।
এইভাবেই আমরা একদিন পৌঁছে গেলাম হিড়িম্বা দেবীর মন্দিরে। ভীমের স্ত্রী, ঘটোৎকচের মা, হিড়িম্বাদেবীর এই মন্দিরটি ১৫শ শতাব্দীতে তৈরি। দেওদার গাছ দিয়ে ঘেরা নিরিবিলি নির্জন স্থানে চারতলা, প্যাগোডা সদৃশ সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি এই মন্দিরটি সত্যিই দর্শনীয়।
একদিন চলে গেলাম পাইন গাছে ঘেরা বশিষ্ঠ কুন্ডে। গরম জলের ধারা, পাইপ দিয়ে নিয়ে এসে নির্মাণ করা হয়েছে স্নানঘর। সবে এটি সম্পূর্ণ হয়েছে। তখনোও পুরুষ, মহিলাদের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা হয়নি। দেখলাম, একই ঘরে পাশাপাশি হিপি হিপিনী স্নান করছে মনের আনন্দে। সেখানেই জামাকাপড় ছাড়া আর পরার ব্যবস্থা। আমাদের ভারতীয় চোখ সহ্য করতে পারলো না। বেরিয়ে এলাম। ওদের হয়ে গেলে, আমরাও আমাদের মতো স্নান সেরে বেরিয়ে এলাম। পাশেই বশিষ্ঠ মন্দির দর্শন করে ফিরে এলাম নিজেদের আস্তানায় বিপাশার ধার দিয়ে।
এখানেই একদিন আলাপ হয়ে গেলো এক বাঙালী আর্মি অফিসারের সঙ্গে। আমরা রাস্তায় হাঁটছি, লগ হাউসের দিকে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে ফলন্ত চেরী গাছ থেকে চেরী ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছি, এমন সময় দেখি একজন স্যুটেড বুটেড বাঙালী ভদ্রলোক, সঙ্গে বিদেশিনী স্ত্রী এবং দুটি ফুটফুটে ৮/১০ বছরের ছেলে। তাঁরাও হাঁটছেন। আমাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে যেচে আলাপ করলেন। বাঙালী ভদ্রলোকটি একজন আর্মি অফিসার। তাঁর স্ত্রী এস্তোনিয়ার মেয়ে। সঙ্গের দুটি তাঁদের ছেলে আলোক আর ইন্দ্রেক। ভদ্রলোক আর তাঁর স্ত্রীর নাম আজ আর আমার মনে নেই।
এবার আসি আমার জীবনের সেই বিশেষ এবং বিরল দিনের কথায়। সেদিনের বিস্ময়, সেদিনের উপলব্ধি এখন আমার মনে অটুট রয়ে গেছে। মানালী এসেছি রোটাং পাস যাবো না, এমন কি করে হয় ? যদিও রোটাং তখনোও বরফে ঢাকা – তাই সকলেই বললো যে আপনারা রোটাং পাসে পৌঁছতেই পারবেন না। কিন্তু তখন আমাদের সবারই বয়স কম ছিলো, তাই ট্রেকিং চালু না হলেও রিস্কটা নিয়েই নিলাম।
একটা গাড়ি ঠিক করা হল। সে বললো যতটা সম্ভব নিয়ে যাবে। তৈরি হয়ে আমরা যাত্রা করলাম। মাঢ়ী পর্যন্ত এসে ড্রাইভার বললো আর যাওয়া সম্ভব নয় – কারণ বরফে ঢাকা রাস্তায় আর গাড়ি এগোবে না। আমরা চারজন নেমে পড়লাম। এসেছি যখন, তখন চেষ্টা তো একবার করতেই হবে। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। আমার পরনে শাড়ি, গায়ে ডাবল নিটিং উলের সোয়েটার, পায়ে বাটা কোম্পানীর সাদা কাপড়ের কেডস্। বাকিদের পরনে শার্ট প্যান্ট, ফুলস্লীভ সোয়েটার, পায়ে বাটা কোম্পানীর স্যূ। ‘উইণ্ডচীটার’, ‘স্নীকার্স’ কথাগুলো সে সময়ে আমাদের কাছে অজানা।
যাই হোক, আস্তে আস্তে আমরা ওপরে উঠছি – এমন সময়ে পাশে এসে দাঁড়ালো একটা মিলিটারী ল্যাণ্ডরোভার। গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়াও আছেন সেই বাঙালী আর্মি অফিসার, সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলে। আমাদের দেখে বললেন আমরা যদি রোটাং পাস যেতে চাই তাহলে তিনি আমাদের যতোটা সম্ভব লিফট দিতে পারেন। তবে তাঁর গাড়িতে মাত্র দুজনই যেতে পারবে – চারজন নয়। যাই হোক, আমি আর কল্যাণ সেই গাড়িতে উঠে বসলাম – দেখা যাক, কতোদূর যাওয়া যায়। বেশ কিছুটা গিয়ে সেই গাড়িও গেলো থেমে, আর যাবে না – কারণ, রাস্তা বন্ধ – আমাদের আবার হেঁটেই উঠতে হবে।
আর্মি অফিসারের স্ত্রী বললেন তিনি আর যাবেন না, সেখানেই একটা পাথরের ওপর বসে আমাদের ফেরার অপেক্ষা করবেন। সুতরাং, আমরা দুজন আর ওনারা তিনজন ওঠা শুরু করলাম। মাঝে মাঝে দাঁড়াচ্ছি, আবার উঠছি – কিন্তু বাচ্চাদুটির কোনোও কষ্ট নেই – তারা মনের আনন্দে তরতর করে ওপরে উঠে যাচ্ছে।
অবশেষে পৌঁছলাম – বিস্ময়ে স্তব্ধ। হতবাক। এ কি দেখছি আমি ? আমার পায়ের তলায় বরফ, আমার দুপাশে বরফের পাহাড়, আমি দাঁড়িয়ে আছি বরফে ঢাকা পৃথিবীর ছাদের ওপরে। সামনে যতোদূর চোখ যায় – বরফের ছাদ ঢালু হয়ে নেমে গেছে – অনেক, অনেক নিচে; কেলং-এর দিকে (লাহুল স্পিতি উপত্যকা)। আর পেছনে তাকালে, সরু ফিতের মতো নিচে পড়ে আছে আমাদের ফেলে আসা রাস্তা।
প্রকৃতির এই শান্ত সমাহিত শুভ্র সুন্দর ধ্যানগম্ভীর রূপ আমাকে বাকরহিত করে দিলো। আমি শুধু অনুভব করতে চাইলাম – কোথায় রয়েছি আমি ? এই অপরূপ সুন্দর পৃথিবী তো এতোদিন আমার চোখে ধরা দেয়নি। এ যেন এক সম্পূর্ণ অন্য জগৎ, এক অন্য পৃথিবী। এটাই কি তবে স্বর্গ – দেবতাদের বাসস্থান ? এমন বরফাবৃত পাহাড়েই তো আমরা চিরকাল দেবতাদের বাসস্থান কল্পণা করে এসেছি।
মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেলো। মনে হতে লাগলো, নিচের পৃথিবীতে আমরা সংসারী মানুষ, হাজার মোহমায়ায় আবদ্ধ। কতো তুচ্ছ কারণে আমরা পরস্পরের প্রতি স্বার্থপরের মতো ব্যবহার করি, মারামারি করি – কেন ? সেই কারণেই কি যুগে যুগে সাধক মহাপুরুষেরা এখানে চলে এসেছেন সাধনা করতে ? হবেও বা।
মনের সেই অপার্থিব অনুভূতিতে আমি বাহ্যজ্ঞানহারা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পায়ের ভিজে অনুভূতি, ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা আর বাচ্চাদুটোর আনন্দ চিৎকার আমার জ্ঞান ফিরিয়ে আনলো।
এবার ফিরতে হবে, ফিরতে হবে নিচের সেই চেনা পৃথিবীতে। উপলব্ধি করলাম জীবনে কোনোও কিছুই চিরস্থায়ী নয় – বিস্ময়, আনন্দও যেমন নয়, দুঃখ বেদনাও তেমনই নয়। এই পৃথিবীতেই আমাদের থাকতে হবে, বাঁচতে হবে – যতোটা ভালোভাবে থাকা যায় সেই চেষ্টা করে।
এর প্রায় দশ বছর পরে আরোও একবার আমার মানালী, রোটাং পাস যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো। তবে সেটা অন্য সময়ে, অন্য সঙ্গীদের সঙ্গে। সে কথা আবার পরে একসময়ে যদি সুযোগ হয়, নিশ্চয়ই বলবো।
(প্রথম পর্ব সমাপ্ত)
খুব ভালো লাগল
খুব সুন্দর। আর ও লেখা দেখতে চাই
খুব ভালো লাগলো। তোমাদের এই প্রয়াস স্বার্থক হোক। আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল। চরৈবেতি….
পড়েছি । আরো লেখা পড়ি । ভাল লেগেছে বলেই পড়বো ।
Kyaa baat.
সহজিয়া ভাষায় লেখা ভ্রমণ-বৃত্তান্ত মনের পটে নতুন নতুন ছবি এঁকে নিতে পাঠক-শিল্পীকে প্রেরণা যোগায়! অনবদ্য!
ধন্যবাদ সবাইকে ।
দারুণ লিখেছ। আরো চাই। আমরা 2011 য় গেছিলাম মানালি।