Home সামাজিক, গল্প তবু বেঁচে থাকা
সামাজিকগল্প

তবু বেঁচে থাকা

বিশ্বজিৎ সেনগুপ্ত


সাতগাছি বাসস্ট্যান্ড।বাসস্ট্যান্ডের ঠিক পেছনে চিত্তর চায়ের দোকান।ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই চা পিপাসু মানুষেরা সেখানে ভিড় জমাতে শুরু করে।সকালের প্রথম চায়ের নেশা,আমাকেও প্রতিদিন নিয়ে যায় চায়ের আড্ডায়।

চায়ের আড্ডায় মশগুল থাকলেও,কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি- ঐ বাসস্ট্যান্ডে এক বৃদ্ধার আবির্ভাব ঘটেছে।বয়স মোটামুটি সত্তর ছুঁইছুঁই। বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীরা আসেন আবার চলেও যান।এটাই স্বাভাবিক।কিন্তু,বৃদ্ধা এসে,ওখানেই ঘাঁটি গেড়ে বসলেন।সঙ্গে একটা পুটুলি আর একটা জলের বোতল।ঐ পুটুলিতে হয়ত বেঁচে থাকার জন্য,ক’দিনের রসদ মজুত করা ছিল।

সেগুলো শেষ হতেই,বৃদ্ধার শরীর ধীরেধীরে ভাঙতে শুরু করে।অথচ,মানুষের কাছে হাত পাতার স্বভাব তাঁর নেই।শুধু মাঝেমাঝে জলশূন্য বোতলটা নিয়ে, অশক্ত দেহে,চিত্তর দোকানে এসে জল চায়।শুধু জল কেন,চিত্তকে দেখেছি,কখনও নিজের হাতে গড়া চায়ের সাথে কিছু খাবারও ওকে দিয়েছে।কিন্তু,তাতে করে তো একটা মানুষ সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে না।আমাদের চোখের সামনে উঁনি ক্রমশ শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হয়ে পড়ছেন।হাঁটার ক্ষমতাও তাঁর নেই বললেই চলে।

এলাকার উদ্যোগে তাঁকে নিয়ে যাবার জন্য,কোন এক সামাজিক সংস্থার সাথে যোগাযোগ যে করা হয়নি, তা নয়।কিন্তু,কোনমতেই তাঁকে সেখান থেকে সরানো যায়নি।উঁনি কিছুতেই অন্য কোথাও আর যাবেন না।জোর করে হয়ত তাঁকে নিয়ে যাওয়া যেত।কিন্তু সেটা করা হয়নি।
হতে পারে,কারও ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়াটা,সংস্থার নিয়ম-বিরুদ্ধ।

যাই হোক,গড়িয়ে যায় আরও কিছু সময়।বাসস্ট্যান্ডের এককোনে, চেয়ারে বসা মানুষটিকে দেখলে মনে হয়,বিধাতার দেওয়া প্রাণটুকু বিধাতাকেই ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য,ধ্যানমগ্ন হয়ে উঁনি বসে আছেন।নাহলে, একটানা ওভাবে ক’জন বসে থাকতে পারে!

ওভাবে বসে থাকতে দেখে,একদিন এগিয়ে গেলাম ওঁর কাছে।কিছু টাকা ওঁর হাতে গুঁজে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম-আপনার কেউ নেই?ক্ষীণ-কন্ঠে উত্তর ভেসে এল ওঁর কন্ঠ থেকে-আমার মা আছেন।আপনার মা-বিস্ময় ঝরে পড়ল আমার গলায়।এই মা কী ওঁর নিজের মা।নাকি উঁনি ঈশ্বররের কথা বলছেন।আবার ভাবলাম,উঁনি কী অবিবাহিতা।নাকি ওঁর কোন ছেলেপুলে নেই।নাহলে শুধু মায়ের কথা বললেন কেন।নাকি,ছেলেপুলে থাকলেও,আজ ওঁর এই অবস্থার জন্য,তারাই দায়ী। এর উত্তর পেতে,আরও দু’একটা প্রশ্ন ওঁকে করেছিলাম।যদিও,সেসব প্রশ্নের উত্তর উঁনি দেননি।প্রশ্ন করা থেকে বিরত হয়ে,গুটিগুটি পায়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনে হল- সব কেনর হয়ত উত্তর দেওয়া যায় না।

গড়িয়ে যাওয়া সময়ের সাথে,তাঁর এই আস্তানাটুকুও একদিন পাল্টে গেল।বলা ভাল-পাল্টে দিতে হল।বাসস্ট্যান্ড তো আরও দশ জনের সুবিধার্থেই করা হয়ে থাকে।তা যদি কারও জন্য নোংরা,অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে,সেটাও তো হতে পারে না।তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল একটা ‘সেফ’ জায়গায়।

সময় পেরিয়ে মাস,মাস পেরিয়ে বছর এসে গেল।তাঁকে দেওয়া খাবারগুলোর বেশিরভাগ আজ পড়ে থাকে পাশে।দরদি রমেন এসে মাঝেমাঝে তাঁকে খাইয়ে যায়।পরনের নাইটিটাও এক-আধদিন পাল্টে দেয়।পাশে পড়ে থাকা খাবারে পচন ধরে।উঁনি চাইলেও,সে পোকারা এখনও আসেনি তাঁর কাছে।

@শ্রীসেন

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!