Home বিবিধ, গল্প সপ্তর্ষির ছায়া – অষ্টমের গল্প
বিবিধগল্প

সপ্তর্ষির ছায়া – অষ্টমের গল্প

ডঃ দীপ্র ভট্টাচার্য

রাতটা ছিল আলাদা। শহরের প্রান্তে ছোট একটা পাহাড়ি গ্রামে আকাশটা যেন কাঁচের মতো পরিষ্কার ছিল। তাঁবুর ঠিক ওপরে ভেসে থাকা সপ্তর্ষি মণ্ডলকে দেখে মনে হচ্ছিল, তারা যেন ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাচ্ছে পৃথিবীর বুকে।

ঋতজ তাকিয়ে ছিল ওপরে। বছর তিনেক ধরে সে এই নক্ষত্রমণ্ডলের পেছনে গবেষণা করে চলেছে—জ্যোতির্বিজ্ঞান, পুরাণ, কিংবদন্তি—সব কিছু মিলিয়ে একটা ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতে চাইছিল। কিন্তু আজ রাতে প্রথমবারের মতো তার মনে হলো, এই নক্ষত্রেরা শুধু তথ্য বা দ্যুতি নয়… এরা জাগ্রত। ঋতজ একজন ব্যতিক্রমী মানুষ—পেশায় গবেষক, কিন্তু চিন্তায় এক প্রাচীন আত্মার মতো। তার জীবনটা গতানুগতিক ছিল না কখনো। ছোটবেলা থেকেই পুরাতত্ত্ব, মহাকাশ, প্রাচীন ভারতের শাস্ত্র আর একধরনের অলৌকিক স্পন্দনের প্রতি ছিল গভীর আগ্রহ।

আজ সে এখানে এসেছে একা, একটা তাপমাত্রা সেন্সর, একজোড়া দূরবীন, আর একটা পাণ্ডুলিপির নকল নিয়ে। আসল পাণ্ডুলিপিটার নাম ছিল—“ঋষিমণ্ডলী”, যা একটা অপ্রকাশিত প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের অংশ বলে কেউ কেউ দাবি করেন। তারই সূত্র ধরে এসেছে আজ সে সপ্তর্ষির এই নির্জন পর্যবেক্ষণে।

তবে সবকিছু বদলে গেল যখন সে অরুন্ধতীর দিকে তাকাল। বশিষ্ঠের পাশেই রয়েছে এক ক্ষীণ আলো, যা মাঝেমাঝেই যেন সহসা অদৃশ্য হয়ে যায়। লোকেরা জানে, সে হল অরুন্ধতী—বশিষ্ঠের পত্নী। তারা একসঙ্গে ঘোরে, একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না কখনও। এই যুগলের মহাজাগতিক অবস্থানকে অনেক আধ্যাত্মিক শিক্ষক বলেছেন “দাম্পত্যের প্রতীক”, যুগ যুগ ধরে হিন্দু বিবাহের সময় বর-কনেকে এই তারার দিক দেখিয়ে বলা হয়—”তাদের মতো হও।”

কিন্তু ঋতজের চোখে আজ সেই দ্বৈত নক্ষত্রজোড়ার মাঝখানে একটা অস্পষ্ট আঁধার দেখা দিল। একটা ছায়া, যেটা চোখের পলকে ধরা পড়ে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। তাকে হঠাৎ মনে হলো, অরুন্ধতী যেন কাঁপছে। কিন্তু তার হাত যথেষ্ট স্ট্রং, দূরবীন ধরে ধরে সে অভ্যস্ত, সে তো সহজে কাঁপে না। তবে? সেই রাতে, ঘুমের গহ্বরে সে একটা স্বপ্ন দেখে। অথবা বলা ভালো, এক দৃশ্য। তীব্র আলোয় ভরা এক গুহা, যেখানে সাতজন ঋষি বসে আছেন ধ্যানমগ্ন। তাদের মাঝে এক অষ্টম পুরুষ—গম্ভীর চোখ, ক্ষতবিক্ষত কণ্ঠ। সে চিৎকার করে বলছে— “আমি কি কম ঋষি ছিলাম? আমার চেতনা কি কম ছিল? আমি কেন তুচ্ছ হলাম? কেন আমাকে বাদ দেওয়া?” তার চোখ জ্বলছে অভিমানে। সে যেন ঋতজের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে— “তুই আমাকে ডেকেছিস। আমি ফিরে এসেছি তোর মধ্যে।”

ঋতজ তড়াক করে উঠে পড়ে। তার কপাল ভেজা। চারদিকে নিঃস্তব্ধতা, কিন্তু ভেতরের হৃৎস্পন্দন ধকধক করছে। সে জানে, কিছু একটা বদলাতে চলেছে। শুধু গবেষণার গভীরতা নয়, এ যেন এক যাত্রা — প্রাচীন আধ্যাত্মিক স্তরে, সপ্ত ঋষির চেতনাজগতে, অরুন্ধতীর নিঃশব্দ দুঃখে, আর… কোন এক অবহেলিত ঋষির অভিমানে।

আলো নেভানোই ছিল। ঘড়ির কাঁটা রাত তিনটে ছুঁই ছুঁই করছিল, কিন্তু প্রকৃতি যেন অন্য কিছুর সময় ধরে চলছিল। ঋতজের কনুইয়ে ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে গেল। তাঁবুর বাইরে বের হতেই সে দেখতে পেল, চারপাশে অন্ধকার, তবে ঠিক সামনে একটা অদ্ভুত জ্যোতিষ্মান পথ তৈরি হয়েছে। পাথরের গায়ে গায়ে আগুনের রেখা। আকাশের তারা গলে যেন নেমে এসেছে মাটিতে। ঋতজ জানে, সে এখন বাস্তবে নেই। এ এক স্তর — চেতনার একান্ত পথ, যেখানে শরীর নেই, আছে শুধু মন আর আত্মার অনুবর্তী স্পন্দন।

প্রথম যে মুখটি সামনে এল, সে এক আলোকিত ঋষির অবয়ব — চুলে ধূসরতা, চোখে বিশালতা। ঋষি বশিষ্ঠ, জ্ঞানের নদী যেন তার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। “তুমি এসেছ?” “তুমি কি প্রস্তুত, ঋতজ?”

ঋতজ কিছু বলার আগেই, চারপাশের পরিবেশ বদলে যায়। সে নিজেকে দেখে একটা বিশাল গ্রন্থাগারের মত কোন জায়গায়, পুঁথি ঠাসা। প্রাচীন যজ্ঞস্থলের পাশে দাঁড়িয়ে। হাজারো পাতার রচনায় লেখা শ্লোক ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে।

“বুঝতে পারছো তো?” বশিষ্ঠ জিজ্ঞেস করলেন।

ঋতজ বলল, “এই… এগুলো তো… বেদের স্তব?”

“না,” বশিষ্ঠ হেসে বললেন, “এগুলো তোমার চেতনার ছায়া। তুমি যা জানো না, অথচ জানার আকাঙ্ক্ষায় ভেতরে রেখে দাও— সেই সমস্ত প্রশ্নের শিকড় এখানে।”

ঋতজ চুপ করে যায়। তার ভেতরে একটি অজানা ব্যথা যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এমন সময় বাতাসে ভেসে আসে এক কণ্ঠস্বর— এক মহিলা কণ্ঠ, মৃদু, অথচ স্থির— “সব জ্ঞান তোমার নিজের ভেতরে, ঋতজ। তুমি শুধু শুধু ভয় পাও।”

বশিষ্ঠ থেমে তাকান। ঋতজ প্রথমবার বোঝে—এই কণ্ঠস্বর অরুন্ধতীর। তবে বশিষ্ঠ তাকে থামিয়ে দেন। ঋতজকে বলেন— “তোমার গন্তব্য এখনো বহু দূরে। এই স্তরে তুমি পাবে জ্ঞান, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে আসবে দ্বিধা।” তারপর চারপাশে পুঁথিগুলোর পাতা খসে পড়তে থাকে। প্রতিটা পাতায় ঋতজ দেখতে পায় তার মুখ, নিজের পূর্বজন্মের ছবি— কোনো জন্মে সে ঋষি, রাজকুমার, কোনো জন্মে বৈরাগী, কোনো জন্মে বিশ্বাসঘাতক।

“তুমি শুধু গবেষক নও,” বশিষ্ঠ বললেন। “তুমি সেই আত্মা, যে যুগে যুগে ফিরে এসেছে সত্যের সন্ধানে। এবার তুমি জানতে চাও — কেন অরুন্ধতী কাঁপে? কেন সপ্তর্ষির মাঝে বিরতি তৈরি হয়? তবে একথা জেনে রাখো — কেউ ফিরে এসেছে। একজন, যাকে আমরা ভুলে যেতে চেয়েছিলাম।”

চোখের সামনে বশিষ্ঠ ধীরে ধীরে মিশে যান। প্রাচীন যজ্ঞস্থল অদৃশ্য হয়। আকাশ ফেটে আলোর রেখা নেমে আসে, আবার ঋতজ ফিরে আসে তার তাঁবুর ভেতরে। শরীর ঘেমে গেছে। তবু তার মন ঠান্ডা। সেদিন রাতে সে লিখে রাখে তার গবেষণার খাতায় একটি লাইন— “জ্ঞান যদি প্রশ্ন না তোলে, তবে সে নিছক তথ্য। আর প্রশ্ন যদি হৃদয়ে ব্যথা না জাগায়, তবে তা আত্মার নয়।”

পরের রাত ছিল অদ্ভুত রকম শান্ত। চাঁদের আলো পাহাড়ের কাঁধ ছুঁয়ে নামছিল, যেন কোনো গল্পের ভিতর ঢুকে গেছে ঋতজ। গাছের পাতায় পাতায় কুয়াশা, তার নিচে বসে থাকা তার ছায়া যেন ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে গেছে শরীর থেকে।

“এই স্তরটা ভিন্ন,” সে নিজে নিজেই ফিসফিস করে বলে। কোনো যজ্ঞস্থল নেই, কোনো আলো নেই। শুধু তার নিজের স্মৃতি। কিন্তু এই স্মৃতি যেন তার নয় — বরং কেউ তাকে সেইসব স্মৃতিতে টেনে নিয়ে চলেছে। চোখের সামনে হঠাৎ দৃশ্যপট খুলে গেল। সে এখন একটি প্রাচীন গুহার ভেতর — মাটিতে ছাই ছড়ানো, দেয়ালে আঁকা প্রাচীন লিপি, এবং কেন্দ্রে বসে আছেন মরীচি। চোখদুটো আধা বন্ধ, কিন্তু তার ভ্রু কুঁচকে আছে। তিনি যেন এমন কিছু দেখছেন যা ভবিষ্যতের স্মৃতি।

ঋতজ সামনে এগিয়ে যায়। “তুমি কি জানো না স্মৃতির ভেতর কি থাকে?,” মরীচি চোখ না খুলেই বলেন— “তুমি ভাবো স্মৃতি মানে কেবল ছবি। কিন্তু প্রতিটি স্মৃতির ভেতর থাকে এক টুকরো পাপ,
এক বিন্দু আফসোস, আর… অপ্রাপ্তি।”

ঋতজ জবাব দিতে গিয়েও থেমে যায়। হঠাৎ, দেয়ালের একদিক স্পিলবারগের সিনেমার মত ছিঁড়ে পড়ে। তার পেছনে খুলে যায় আরেকটা দৃশ্য। সে দেখতে পায় একটা ল্যাব— আধুনিক। ঋতজের নিজের গবেষণা কেন্দ্র, বিস্ফোরণের ঠিক আগে। সে সেদিন সবকিছু হারিয়েছিল — তার ডেটা, তার গবেষণা।

“কিন্তু এই বিস্ফোরণ তো দুর্ঘটনা ছিল!” সে চিৎকার করে ওঠে।

“না,” মরীচির কণ্ঠ এবার গুরুগম্ভীর, “তুমি তখনো বোঝোনি — কেউ তোমাকে লক্ষ্য করছিল।
কারণ তুমি ভুল জায়গায় খোঁজ করছিলে।”

ঋতজের গলা শুকিয়ে যায়। তার মনে পড়ে যায়— বিস্ফোরণের আগের রাতে সে প্রথম ‘অরুন্ধতী-বশিষ্ঠ’-এর কক্ষপথে অদ্ভুত কম্পন শনাক্ত করেছিল। আর ঠিক পরের দিন তার কেন্দ্রটি উড়ে যায়।“তবে কি সেই বিস্ফোরণ…?”

“হ্যাঁ,” মরীচি এবার চোখ মেলে তাকান, “ঋতব্রত তখনই তোমাকে দেখে। তার অভিমান তখনই নাড়া খায়। কারণ তুমি দেখেছ সেই ছায়া, যেটা যুগ যুগ ধরে গোপন রাখা হয়েছে।”

ঋতজ কাঁপতে থাকে। ঋতব্রত কে আবার? ঋষি কি তার নাম ভুল করলেন? তবে ভেতরে কোথাও, একটা নতুন শক্তি জন্ম নিচ্ছে। একটা পুরনো ক্ষত, যা এতদিন সে দুঃস্বপ্ন ভেবেছিল, আজ প্রকৃত ঘটনা হয়ে ওঠে।

মরীচি এবার উঠে দাঁড়ান। মুহূর্তে পুরো দৃশ্য যেন গলে যায়। বাতাসে গন্ধ আসে — পুরনো ছাই, পুড়ে যাওয়া কাগজের। ঋতজ আবার ফিরে আসে তার তাঁবুর মধ্যে, কিন্তু এবার সে আর আগের মতো নরম নয়। “স্মৃতি শুধু ইতিহাস নয়,” সে নিজের খাতায় লিখে রাখে, “স্মৃতি হলো সত্যের মিথ্যা চেহারা।”

ঋতজ জানে, বুঝতে পারে, এই অসীম রহস্যে জড়িয়ে আছে সাত ঋষিরা আর তাদের মুখোমুখি তাকে হতেই হবে। সে ভাবে, তবে কি পরের রাতে, আগামী স্তরে তাকে পড়তে হবে শক্তির মুখোমুখি। যেখানে অপেক্ষা করছেন পুলস্ত্য — ক্ষমতার পুরুষ।

পরের পাহাড়ি রাতের বাতাসে একটা ভার। আকাশে মেঘ নেই, তবু দম বন্ধ হয়ে আসে।তাঁবুর বাইরে পাহাড়ের খাঁজে যেন জ্বলে উঠেছে অদ্ভুত নীলাভ অগ্নিশিখা। ঋতজ বুঝল — সে আবার স্তরে প্রবেশ করছে। তবে এবার প্রবেশ নয়, যেন টেনে নেওয়া হচ্ছে তাকে। এবার সে পৌঁছল এক শূন্য ভূমিতে। কোনো গাছ নেই, জল নেই, কেবল আগুনে দগ্ধ মাটি আর বাতাসে লোহা গন্ধ। মাঝখানে বিশাল এক অগ্নিকুণ্ড। আর ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন — ঋষি পুলস্ত্য।

একাধারে ঋষি, আবার যুদ্ধপ্রিয় যোদ্ধা। গাত্রচর্মে দাগ, চোখে স্থির হিংস্রতা। তার চেহারায় ভীতি নয় — ভয় থেকে মুক্ত এক আত্মবিশ্বাস, যেখানে “ক্ষমা” এক বিলাসিতা মাত্র।

“তুমি জানো কাকে খুঁজছো, ঋতজ?”

“জানি।”

“তবে কেন আমার স্তরে এসেছো?”

“কারণ আমি বুঝতে চাই, ঋতব্রত কে আর তিনি কেন আমাকে নিয়ে ফিরে এসেছেন। তার জন্যই কি আকাশ কেঁপে ওঠে? অভিমান বা রাগ না হলে তো কেউ এভাবে কেঁপে ওঠেন না!”

পুলস্ত্য হেসে ওঠেন। হাসি নয়, যেন বিস্ময়ময় গর্জন।“অভিমান? ওটা দুর্বলদের অস্ত্র। আমি তাকে দেখেছি। ঋতব্রত চেয়েছিল ক্ষমতা, কিন্তু সে আমাদের প্রতি বিশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল।”

ঋতজ এবার প্রশ্ন তোলে, “তবে কি তাকে অযোগ্য বলেই বাদ দেওয়া হয়েছিল?”

পুলস্ত্য অগ্নিকুণ্ডের দিকে তাকিয়ে বলেন— “সে যোগ্য ছিল। কিন্তু ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, নিয়ন্ত্রণ তার ছিল না।”

অগ্নিকুণ্ড এবার আলোড়িত হয়। তার মধ্যে ফুটে ওঠে এক দৃশ্য — প্রাচীন এক ঋষিমণ্ডলীর সভা, যেখানে সাতজন ঋষির মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন ঋতব্রত। চোখে বিদ্রোহ, ঠোঁটে অভিমান।

“আমার প্রজ্ঞা তোমাদের চেয়ে কম নয়। তবে কেন আমি অষ্টম?”

“কারণ তুমি নিজেকে প্রমাণ করতে চাও—অন্যকে পরাজিত করে, সেটা নিজেকে উজাড় করে নয়।”

সেই সভা ভেঙে যায়। ঋতব্রত একা দাঁড়িয়ে থাকে। তার চারপাশের ভূমি জ্বলে ওঠে। অগ্নিকুণ্ড থেকে ছিটকে আসে অগ্নিশলাকা, ঋতজ কেঁপে ওঠে। সে শুনতে পায়— “তুমি যদি সত্যিই তার সন্ধানে যাও, তবে মনে রেখো— প্রতিটা স্তরে তার জ্বালা, তার ছায়া আরও গভীর হবে। সে শুধু অভিমানী নয়, সে এখন স্বীকৃতির খিদেয় ক্লান্ত এক আত্মা।” ঋতজ এবার উঠে দাঁড়ায়। সে জানে সামনে যা আসবে, তা হয়তো কেবল আধ্যাত্মিক স্তর নয়— তা হবে আত্মার সংঘর্ষ।

আবার সে ফিরে আসে বাস্তব জগতে। তাঁবুর বাইরে পাহাড়ি বাতাসটা এবার একটু উষ্ণ, যেন পুলস্ত্যের আগুন এখনও তার চামড়ায় লেগে আছে। সে খাতায় লিখে রাখে— “ক্ষমতা পেতে চাইলে, নিজেকে পুড়িয়ে ফেলতে হয়। কিন্তু সেই আগুনে নিজেকে হারানোই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।” সে জানে এবার তার সামনে অপেক্ষা করছেন পুলহ, যার স্তরে রয়েছে প্রেম, সম্পর্ক আর ছিন্ন ভালোবাসার ঘূর্ণাবর্ত।

পরের রাতে পুলস্ত্যের আগুন পেরিয়ে এসে এবার ঋতজ যেন একটা শান্ত, নরম, সবুজ স্বপ্নে ঢুকে পড়ল। আকাশ এখানে মেঘমুক্ত, বাতাসে হালকা গন্ধ — কাঁচাপাকা আমের মত আর ভেজা মাটির মিশ্র ধ্বনি। বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে আলো আসছে—ছায়া-আলো-ছায়া, যেমনটা থাকে হারানো দিনের স্মৃতির ভেতর।

এই স্তরটা ঠিক ধ্যানের মতো নয়— বরং যেন ঋতজ ফিরে এসেছে নিজের শৈশবে। সে দেখে, একটি ছোট ছেলে একটি মেয়ের পাশে বসে আছে। তারা দুজনেই চুপচাপ, কিন্তু মাঝে মাঝে চোখাচোখি হলে হেসে ফেলে। ঋতজ চিনতে পারে না সেই ছেলেটিকে… প্রথমে। তারপর বুঝতে পারে— ছেলেটা সে নিজেই। আর মেয়েটি? তার নাম মনে নেই, কিন্তু চোখদুটি… অদ্ভুতরকম পরিচিত।

“তুমি জানো, ও হারিয়ে গেছে,” কান্নার মতো স্বরে পেছন থেকে কেউ বলে। ঋতজ ঘুরে দাঁড়ায়।

পুলহ আসেন এক বাউল মেজাজে। নিঃশব্দ, অনুচ্চ কণ্ঠে তিনি বলেন— “তুমি জ্ঞান চাও, শক্তি চাও, কিন্তু যে হৃদয় খালি, সে কিছু পায় না।”

“আমি কী হারিয়েছি?” ঋতজ ফিসফিস করে।

পুলহ হেঁটে চলেন গাছের গা ঘেঁষে।“সেই সম্পর্ক— যা একদিন তোমার অন্তরের ভেতরে শান্তির মতো বাস করত। তুমি তাকে সময় দাওনি। কারণ তুমি ভেবেছিলে, সত্য খোঁজা প্রেমের চেয়ে বড়।”

গাছের নিচে তারা বসে, পুলহ আর ঋতজ। পাখিরা নীড়ে ফিরছে, আর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে এক অদ্ভুত বিষণ্নতা। পুলহ বলেন, “ঋতব্রতের অভিমান শুধু বিদ্বেষ নয়। ওর ভেতরেও ছিল একটা সম্পর্ক — অরুন্ধতীর সঙ্গে এক অতল গোপন সংযোগ। যেটা ভেঙে যাওয়ার পরই সে ছিটকে পড়েছিল সপ্তর্ষির গণ্ডি থেকে।”

ঋতজ থমকে যায়। “অরুন্ধতী…? তার সঙ্গে ঋতব্রতের সম্পর্ক ছিল?”

“একসময় ছিল। সেটা প্রেম ছিল না, বরং এক অব্যক্ত সমর্থন, একসঙ্গে ধ্যান করার নিঃশব্দতা। বশিষ্ঠের আসার আগে থেকেই। কিন্তু বশিষ্ঠের বুদ্ধি আর ভারসাম্যের সামনে… ঋতব্রত হার মানে।”

ঋতজ সেই মুহূর্তে নিজেকে এক ভাঙা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে। নিজের হারানো বন্ধুত্ব, সেই ভালোবাসা যার জন্য সে কখনো থামেনি, কিন্তু আজও বুকের মধ্যে খালি একটা জায়গা হয়ে রয়ে গেছে।

পুলহ তখন বলে ওঠেন— “যে আত্মা ভালোবাসতে জানে না, সে কখনো সত্য উপলব্ধি করতে পারে না। ঋতব্রতের দুঃখ ছিল— তার হৃদয় শুনেছিল অরুন্ধতীর নিঃশব্দতা, কিন্তু পৃথিবী শুনেছিল বশিষ্ঠের শব্দ।”

আলো ফিকে হয়। আবার ছায়া ঘনিয়ে আসে। পুলহ ধীরে চলে যান বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে। ঋতজের চারপাশ থেকে ভেসে আসে সেই হারিয়ে যাওয়া হাসি— তার ছোটবেলার সেই মেয়েটির। সে আবার ফিরে আসে বাস্তবে। তাঁবুর বাইরে এখন বৃষ্টি পড়ছে, হালকা সুরে, যেন পুরনো গান। ঋতজ খাতায় লেখে— “প্রেম হারানো মানুষই প্রকৃত বিদ্রোহী হয়। তার প্রশ্ন সত্যের নয়, প্রতিশোধের।” তবে সে জানে, এবারে তার সামনে অপেক্ষা করছেন — অত্রি, যার স্তর — আত্মজিজ্ঞাসার।

এই স্তরে পৌঁছতেই চারপাশটা গাঢ় ধূসর। না আলো, না আঁধার। শব্দও যেন কিছুটা স্তব্ধ। এখানে কোনোকিছু চলে না সময়ের নিয়মে। সব স্থির। সব ওজনদার। ঋতজ টের পায়—এখানে কোনো দৃশ্য নয়, এখানে সে নিজের মুখোমুখি। আর তার সামনে এক জন, যে দাঁড়িয়ে—তাকে ঠিক দেখায় না, তবু চেনা চেনা লাগে।

একটা দৃষ্টির স্পর্শেই তার সামনে খুলে যায় একটা কালো জলের পুকুর, যার মধ্যে এক আয়নার মতো প্রতিফলন। তবে আয়নায় সে নিজেকে দেখে না। দেখে একটা কিশোর— চোখে অদ্ভুত আঘাতের ছাপ, যে স্পষ্টভাবে বলে ওঠে— “তুই জানিস না, তোর সমস্ত সত্য লুকানো ভয়ের মধ্যে।” ঋতজ জবাব দিতে পারে না।

সেই মুহূর্তে, নীরবতা ভেঙে এক কণ্ঠ আসে। “প্রত্যেক জ্ঞানীর দরকার আত্মাকে স্পর্শ করা, নাহলে তার প্রশ্নগুলো অন্যের মুখে মুখে ঘোরে।” অন্ধকার থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসেন ঋষি অত্রি — শান্ত, কিন্তু ভেতরে যেন মহাকাশ। তার চোখদুটো যেন সময় ছুঁয়ে এসেছে।

“আমি কী খুঁজছি, ঋষিবর?” ঋতজের গলা যেন ভেঙে পড়ে।

“তুই নিজের মধ্যেই খুঁজিস বহির্জগত। কিন্তু তুই কি জানিস, তুই কে?”

এক বিশাল গুহার ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকে ঋতজ। প্রাচীন দেওয়ালে খোদাই করা প্রতিটি চিত্র — তার জীবনের এক একটা কাহিনি। শৈশবের সংকট, মায়ের মুখ, বাবার আত্মবিশ্বাস, তার একরোখা জেদ — আর সবকিছুর পেছনে একটা শব্দ— “যোগ্যতা”।

অত্রি বললেন, “তুই ঋতব্রতকে বোঝার চেষ্টা করছিস, কারণ তার ভেতরে তুই নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিস। তিনিও তোর মতোই প্রশ্ন করতেন — ‘আমি কি যোগ্য?’ আর উত্তর না পেয়ে অশান্ত, ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন।” এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পড়ে যায় ঋতজ। সে দাঁড়িয়ে থাকে একটা প্রাচীন দরজার সামনে— যেখানে ভেতরে তার সেই সব ভুল, ব্যর্থতা আর অস্বীকার বন্দি।

ঋষি অত্রি বলেন— “তুই যদি নিজের গভীরতায় নেমে না যাস, তাহলে ঋতব্রতের সত্য তুই ধরতে পারবি না। আত্মার গভীরে আছে সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র— আত্মস্বীকৃতি।”

ঋতজ চোখ বন্ধ করে। আর সে দেখে— তার মধ্যে এক অন্ধকার পুরুষ, যে চিৎকার করছে, যে ভেঙে পড়ছে, যে কখনও বলতে পারেনি— “আমি ব্যর্থ হয়েছি।”

ঋতজ ঋষি অত্রির সামনে চুপ করে বসে পড়ে। তার চোখে জল, কিন্তু তা কাঁদা নয়— তা যেন নিজেকে ভাঙার আর হালকা হয়ে ওঠার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো সত্য।

ঋষি অত্রি চলে যেতে-যেতে, ধীরে ধীরে বলেন— “তুই এবার প্রস্তুত, তোর জিজ্ঞাসা এবার আত্মায় পৌঁছেছে। সামনে যা আসবে, তা শুধু মহাকাশের রহস্য নয়— তা এক আত্মঘাতী আত্মার চিহ্ন।”

ফিরে এলেও ঋতজের ভিতরটা নিঃশব্দ, যেন অনেক শব্দের পর একটা ক্লান্ত বিরতি। আকাশে তারারা জ্বলছে, কিন্তু তার চোখে ভেসে উঠছে শুধু এক নাম— ঋতব্রত। আরেকটা নাম—অরুন্ধতী। তার খাতায় লেখা হয়— “সব ‘অযোগ্য’ মানুষই একদিন প্রশ্ন হয়ে ফিরে আসে।”

পরের রাতে, প্রথমেই যা ধরা দিল, তা শব্দ নয় — বরং ধ্বনি। একটানা গুঞ্জন, যেন সমুদ্রের অনেক গভীরে থাকা হুমহুম আওয়াজ। আলো নেই, অন্ধকারও না। এই স্তর যেন তৈরি হয়েছে ধ্বনির রূপে। ঋতজ হাঁটছিল না, সে যেন ভাসছে। চারদিকে তারার মতো ভাসছে স্ফুলিঙ্গ। বাক্য নয় — শব্দের অনুভব। আর ঠিক তখনই সে শুনল— “ঋতজ।” একটি শব্দ। কিন্তু সেই শব্দ যেন তার শরীরের কোষে কোষে কেঁপে উঠল।

আকাশ-চরের মতো এক ঋষি। ঋষি অঙ্গিরার মুখে না আছে ভ্রুকুটি, না আছে হাসি। তাঁর চেহারায় আলোক নেই, কিন্তু দীপ্তি আছে। তিনি যেন কোনো ভাষা বোঝেন না, তবু প্রতিটি প্রশ্নের গভীরতা তাকে ছুঁয়ে যায়। ঋতজ মুখ খোলে, “আপনি ঋষি অঙ্গিরা?”

উত্তরে আসে না কোনো শব্দ। কেবল বাতাসে ভেসে আসে ছন্দ — যেন বেদ পাঠ করছে বাতাস নিজেই। একটি গম্ভীর স্পন্দন ছড়িয়ে পড়ে স্তরজুড়ে। তার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে ভেসে উঠতে থাকে তিনটি শব্দ— আকাঙ্ক্ষা, অস্বীকার আর আত্মঘাত। ঋতজ যেন কোনও গূঢ় আকাশবাণীর মধ্যে প্রবেশ করেছে।

অঙ্গিরা এবার ধীরে বলেন— “সব সৃষ্টি শব্দে শুরু হয়। আর প্রতিটি পতনও শব্দেই ঘোষিত হয়। তুমি শুনেছ, কিন্তু বোঝোনি। আর ঋতব্রত? সে বুঝেছিল, কিন্তু কাউকে শোনাতে পারেনি।”

চারপাশে যেন তৈরি হলো এক অনুরণন-মণ্ডপ। ঋতজ দেখতে পায় — ঋতব্রত অরুন্ধতীর সঙ্গে বসে ধ্যান করছেন। তারা দুজনেই নীরব। বশিষ্ঠ এলেন। কিন্তু অরুন্ধতীর নীরবতা, বশিষ্ঠের আগমনের পরে, অপরিচিত হয়ে ওঠে।

অঙ্গিরা বলে চলেন— “ ঋতব্রত একদিন একটি শ্লোক বলেছিল, যা মহাজ্ঞান নির্দেশ করে, কিন্তু সে তখন বুঝতে পারেনি — সেই শ্লোক বশিষ্ঠ বহু আগেই লিখে ফেলেছিলেন। তখন থেকেই তার ভিতর জন্মায় প্রশ্ন— “আমি কি কখনো মৌলিক ছিলাম?” “আমার কি নিজস্ব কোনো ‘শব্দ’ আছে?”

অঙ্গিরা বলেন— “আসলে ঋতব্রত যে শব্দ খুঁজছিল, তা ছিল না মুখে, ছিল চেতনার স্তরে, আর সেখানে তার শব্দ কেউ শুনতে চায়নি।” অঙ্গিরা হঠাৎ থেমে যান। চোখ বন্ধ করে বলেন, “তুইও তো শব্দ খুঁজিস, ঋতজ। তোর গবেষণা শুধু বৈজ্ঞানিক নয়। তুই একটা শব্দ খুঁজিস, যা সমস্ত সন্দেহ মুছে দেয়— যা বলে দেয়, তুই যথেষ্ট।”

এই মুহূর্তে ঋতজ বোঝে— তার ভেতরের গবেষণা, সব ডেটা— সব কিছুর গভীরে সে শুধু চেয়েছিল একটিমাত্র শব্দ শুনতে— “তুমি ঠিক পথে আছো।”

অঙ্গিরা এবার পেছন ফিরে হাঁটেন, ধ্বনি মিলিয়ে যায়, তবে ঋতজের ভেতরে একটা শব্দ থেকে যায়— “প্রতিধ্বনি, কখনো কখনো আসল কথার থেকেও সত্য হয়।”

সে আবার ফিরে আসে তাঁর তাঁবুতে। আকাশে তারার বিন্যাসে সে যেন দেখতে পায় অরুন্ধতী, আর একটু দূরে, সেই অষ্টম—ঋতব্রত। খাতায় লেখা হয়— “ঋতব্রতের অভিমান এক অজানা ভাষা, যাকে কেউ বুঝতে পারেনি, আর সে নিজেও তার ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।” এবার তার গন্তব্য, পরের ঋষির স্তরে — যেখানে সময় থেমে যায় না, বরং নিজেই হয়ে ওঠে বিচারক।

এই স্তরে প্রবেশ করতেই ঋতজ টের পেল, এখানে আলো সাদা নয়, কালো নয়— এখানে আলো ধূসর। সময় এখানে এগোয় না। বরং গড়িয়ে পড়ে — ঘড়ির কাঁটার মতো নয়, বরং প্রবাহিত পাথরের মতো। এখানে বাতাসে বোঝা ভাসে। সে দেখে, দূরে, এক বিশাল পাথরের সিংহাসনে বসে আছেন এক ঋষি, ক্রতু। তার চোখে অদ্ভুত শান্তি, কিন্তু তার গায়ে বসে আছে সময়ের ধুলো, যেন তিনি হাজার বছরের বিচার শুনে শুনে শিলায় পরিণত হয়েছেন। ঋতজ এগিয়ে যায়। কোনো অভ্যর্থনা নেই, কোনো স্বাগত নেই। কেবল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক অদৃশ্য শক্তি।

“তুমি আমাকে চেনো?” ঋষি ক্রতু প্রশ্ন করেন, কণ্ঠ একেবারে নিরাসক্ত।

“আপনি সিদ্ধান্তের ঋষি। আপনি বলেছিলেন— যার আত্মা ভারসাম্য হারায়, তার স্থান সপ্তর্ষিমণ্ডলে হয় না।”

“তাহলে তুমি বুঝেছো কেন ঋতব্রতকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল?”

“বুঝেছি… কিন্তু আজ আমি জানতে চাই, আপনারা কী ভেবেছিলেন, ঋতব্রত তা কীভাবে নিয়েছিল, সেটা কী কখনো ভেবেছিলেন?”

ক্রতু হালকা হাসেন—একটা দুঃখের মুচকি হাসি।

হঠাৎ সামনে ফুটে ওঠে সেই দিন। সপ্তর্ষিরা এক চক্রে বসে। ঋতব্রত তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে। তার কণ্ঠ আবেগে কাঁপছে— “আমার শক্তি কম নয়। আমার বোধ, আমার জ্ঞান, আমার তপস্যা— আমি তোমাদের থেকে পিছিয়ে নেই। তবু কেন আমি অষ্টম? কেন নয় সপ্তম?”

বশিষ্ঠ এগিয়ে আসেন, নরম কণ্ঠে বলেন— “কারণ, তুমি এখনও নিজের ব্যর্থতা মেনে নিতে পারো না। তোমার প্রত্যাশা তোমার আত্মজ্ঞানকে ঢেকে দিচ্ছে।”

তখনই, ক্রতু উচ্চারণ করেছিলেন সেই সিদ্ধান্ত— “তুমি যোগ্য, কিন্তু এখনও পূর্ণ নও। তোমার পথ অন্য। সপ্তর্ষির স্তরে তুমি নয়— তুমি হবে তাদের ছায়া, পথপ্রদর্শক নও— বরং পরীক্ষক।”

সেদিন থেকেই ঋতব্রতের ভিতর ফাটল ধরেছিল। সে পরিত্যক্ত বোধ করেছিল, কিন্তু সত্যি হলো— সপ্তর্ষিরা তাকে এক উচ্চতর দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন। তবু, সেই ব্যাখ্যা পৌঁছয়নি তার হৃদয়ে। অরুন্ধতী তখন চোখ নামিয়ে নিয়েছিল।আর সেই নীরবতা ছিল চূড়ান্ত বিচ্ছেদ।

ক্রতু এবার ঋতজের দিকে তাকান। “তুমি কি প্রস্তুত, যখন সেই ঋতব্রত আবার ফিরছে— একা নয়, এক নব্য জ্ঞানের আগুন নিয়ে?” “তবে কি সে বুঝতে পেরেছে?”

“না। সে চাইছে নতুন বিচার, সপ্তর্ষির স্থান নয়, বরং পুরনো সিদ্ধান্তের আবার মূল্যায়ন।”

পাথরের মেঝেতে শব্দ করে পড়ে একটি বীজ। তাতে অঙ্কুর গজায়— এক সেকেন্ডেই। ঋতজ বুঝে যায়— সময় এখানে সিদ্ধান্তের মতোই— অতিলঘু কিন্তু চূড়ান্ত।

সে ফিরে আসে তাঁবুতে, অবসন্ন নয়, কিন্তু ভারাক্রান্ত। তার খাতায় লেখে— “সত্য কেবল ক্ষমতায় থাকে না, তার একটা মানবিকতাও থাকে। সেটাই ভুলেছিল সাত ঋষিরা— আর সেই ফাঁকেই জন্ম নিয়েছিল এক অবিচারের ছায়া।”

সাতজন ঋষির মধ্যে তার স্থান ছিল সবচেয়ে আলাদা। অরুন্ধতী নক্ষত্রের মত দীপ্তি যত্ন করে নিজের মতো নিভৃত একক। শব্দ নেই, নেই আলো, নেই ছায়া। শুধু এক গভীর নীরবতা— যা কথা বলে না। ঋতজ যখন ওই স্তরে প্রবেশ করল, তার চারপাশে যেন অদৃশ্যতা ঘিরে এল, মধুর গোপন এক বাতাসে ভাসল সে— আর সামনে, এক ধূসর কল্পনায় দাঁড়িয়ে ছিলেন অরুন্ধতী। তাঁর চোখ ছিল শূন্য, অথচ সেগুলো যেন সত্যের জোয়ার।

“তুমি অনেক কিছু জানো, ঋতজ,” তার গলায় যেন কোনো সুর নেই, “কিন্তু আমি সেই কথা বলিনি, যা তুমি জানতে চেয়েছ। ঋতব্রতর কথা। যে কখনো সপ্তর্ষির অংশ হতে পারল না, আমার মতই। আসলে, সে ছিল আমাদের মধ্যে এক অশ্রুত শব্দ। আমি তাকে থামাইনি, আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি— আমার নীরবতাই ছিল তার সবচেয়ে বড় দুঃখ।”

ঋতজ কিছু বলতে পারল না। তার হৃদয়ে ঢেউ খেলছিল, বেদনার সাগরে সে ডুবে গিয়েছিল।

“তুমি কি জানো,” অরুন্ধতী ধীরে বললেন, “আমি কি চেয়েছিলাম? সে যেন বুঝতে পারে— আমার নীরবতায় কোনো অপমান নেই, তা নয়— যে আমি তাকে অস্বীকার করেছি, বরং সেই নীরবতা ছিল আমার দ্বিধা, আমার অন্তর্দ্বন্দ্ব। সে যখন আমার সামনে অশ্রু চোখে প্রশ্ন করত, আমি আকশের নিচে গড়িয়ে যাওয়া সূর্যের মতো তাকে দেখতাম, ভাবতাম, যদি একটু বুঝতে পারতাম, একটু ছুঁতে পারতাম, কিন্তু কথা বলতে পারতাম না। আসলে, আমি ভয় পেতাম— আমার কথা তার প্রত্যাশাকে ভেঙে দিতে পারে।”

ঋতজ চুপ করে শুনল, প্রতিটি শব্দ যেন তার আত্মার গহীনে গর্ত খুঁড়ছিল।

“ঋতব্রতের না বোঝার ব্যর্থতা ছিল আমাদের ভুল— আমাদের সিদ্ধান্তের ছায়া, আমার নীরবতার গ্লানি।” অরুন্ধতীর চোখ ভিজে এলো, কেউ দেখলো না— কেউ শুনলো না, তবু আকাশের গভীরে যেন ঝরনাধারা বেয়ে নেমে গেল তার অদৃশ্য কষ্ট।

ঋতজ জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আজ কী করবেন আপনি?”

অরুন্ধতী ধীরে বললেন, “আমি শুধু অপেক্ষা করছি, যে দিন সে ফিরে আসবে— শুদ্ধ করে নেবে ভুল বোঝার গ্লানি, সেইদিন আসবে, তখনই সত্য জানাবে, আমাদের ভুল কী ছিল।”

নীরবতা আবার ঘিরে ধরল ঋতজকে। তবে এইবার সে বুঝেছিল, নীরবতাও কথা বলে— কিন্তু শুধু তারা যারা শুনতে জানে তাদের জন্য। ঋতজ ফিরে এসে লিখে রাখল, “নীরবতা কখনো নিষ্ঠুর নয়, বরং সে আমাদের প্রতিবিম্ব, যা আমাদের গোপন ব্যথাগুলো ফাঁস করে দেয়, যখন আমরা সাহস পাই কথা বলতে না পারার।”

মন শক্ত করে, এবার ঋতজ যখন প্রবেশ করল সপ্তম স্তর পার করে, সে বুঝল, যে রহস্য তাকে এতদিন ঘিরে রেখেছিল— সেই রহস্যের নাম ছিল ঋতব্রত। সেই ঋতব্রত— যার নাম কেবল একবার হলেও কেউ উচ্চারণ করতে ভয় পেত, যার গল্পকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাকে বাদ দিয়ে সপ্তর্ষির সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে আজ সে ফিরে এসেছে তার মধ্যে। কেন? কী নিয়ে?

ঠান্ডা মেঘের গায়ে যেন আগুনের মতো শিখা দেখা গেল, আকাশের নক্ষত্রগুলো যেন দুলে উঠল আরেকবার, ঋতজের সামনে ধীরে ধীরে আবির্ভূত হল এক চেহারা— ছায়াময়, কিন্তু নির্ভীক। ঋতব্রত। তার চোখে আগুন, তার কণ্ঠে বর্জিত ইতিহাসের আঘাত, আর তার হাতে সেই অদৃশ্য অষ্টম নক্ষত্রের মহাশক্তি।

ভেসে উঠলেন সপ্তর্ষিরা একত্রিত, স্থির। ঋতব্রত তাঁদের বিরুদ্ধে নয়, বরং সবার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন— “আমি ফিরে এসেছি, তোমাদের ভুল সংশোধনের জন্য। তোমরা আমাকে করে রেখেছিলে অষ্টম, আর আমি তোমাদের বিচারকে নিয়েছিলাম অন্য মাত্রায়। সেটা ছিল আমার ভুল”

“তোমাদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে পৃথিবী আজ অন্ধকারে ডুবে আছে। আমাকে অষ্টম করার জন্য নয়, আমাকে ঠিক মত বোঝাতে না পারার ভুল, সঠিক দিশা না দেখানোর ভুল। তোমরা বিচার করেছিলে ‘অহংকার’ আর ‘ক্ষমতা দিয়ে’, কিন্তু তোমরা দেখোনি, বিচারের প্রতিফলন, বিচারের সঠিক অর্থ, প্রকৃত ব্যবহার কেমন হওয়া উচিত।”

সেই সময়, বশিষ্ঠ, মরীচি, পুলস্ত্য, পুলহ, অত্রি, অঙ্গিরা ও ক্রতু—সবার মুখে অপ্রকাশিত হতাশা আর নীরবতার ছায়া। নীরব ভাষা কিন্তু ক্ষমার আকুতি।

ছোটবেলার স্কুলের মত, ঋতজ হাত তুলে বলে উঠল— “এখন আমাদের সামনে শুধু পুরনো ভুল সংশোধনের সুযোগই নেই, বরং আমাদের সামনে রয়েছে এক নতুন সূচনা। এক নতুন সপ্তর্ষি নয়, বরং এক নতুন যুগের শুরু, যেখানে পুরানো গ্লানি, পুরানো ভুল আর পুরানো গর্বকে বিসর্জন দিয়ে, সত্যিকার অর্থে সমতা, জ্ঞান ও সংহতি বজায় থাকবে।”

ঋতব্রত চোখের কোণে জল রাখতে পারেন না, তার কথা শোনা যায় শুধু হৃদয়ের গভীর থেকে—“আমরা নক্ষত্র, আমরা ঋষি, আমরা প্রাচীন মিথ, কিন্তু আমাদের বেঁচে থাকার কারণ হলো— আমরা নিজেরাই যখন ভুল করি, তখন তা মেনে নিতে পারি, আরও উন্নতির পথে হাঁটতে পারি।”

ঋষিরা সবাই হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন ঋতজকে। কোথাও শাঁখ বেজে উঠল। সব ঋষিরা মিলে বললেন— “আজ ঋতজ একটি নতুন সত্যের জন্ম দিল, যা সারা বিশ্বের জন্য আলো হয়ে উঠল।”

ঋতজ যখন ফিরে এল বর্তমান পৃথিবীতে, তার হাতের খাতায় লেখা গুলো যেন আবার জীবন্ত হয়ে উঠল। ঋতজ খাতা খুলে লিখল— “সপ্তর্ষি আর নয় শুধু অতীতের রূপক, তাদের ভুল থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন প্রজ্ঞা, আর অষ্টম ঋষি ঋতব্রত শুধু বাদ পড়া নয়, সে এক নতুন পৃথিবীর প্রতীক— যেখানে বিচার নয়, ক্ষমাশীলতা ও সংহতি থাকবে। বিচার হবে হৃদয় দিয়ে।” সে জানে, এই গল্প এখানেই শেষ নয়, এর গহীনে লুকোনো আলো, প্রতি সময়েই পথ দেখাবে, নতুন কেউ এসে সত্যের খোঁজ করবে,আর আবার নতুন করে লিখে দেবে ইতিহাস।

তুমি যদি কখনো কান পাতো নিঃশব্দতার গভীরে, তবে বুঝতে পারবে— নীরবতারও ভাষা আছে। সেই ভাষা উচ্চারিত হয় না শব্দে, তা ঢেউ তোলে হৃদয়ের গভীরে— যেখানে একেকটি থেমে যাওয়া নিঃশ্বাস একেকটি অসমাপ্ত কথার প্রতিধ্বনি হয়ে বাজে। তুমি যদি সাহস করো আকাশের অতল গহ্বরে তাকাতে, তবে দেখতে পাবে— সেই নক্ষত্রদের পেছনে লুকিয়ে আছে এক জ্বালাময়ী, বিদ্রোহী আগুন। সেই আগুন শুধু আলো দেয় না— সে পোড়ায় প্রশ্ন, দগ্ধ করে পুরনো অহংকার, জন্ম দেয় নতুন উপলব্ধির। আর যদি তুমি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারো— তবে একদিন তুমি উপলব্ধি করবে, সপ্তর্ষি কেবল সাতজন নয়, তারা এক চেতনা। এক ধারা। এক প্রজ্ঞা। তারা রয়ে গেছেন আমাদেরই মধ্যে— প্রত্যেক চিন্তায়, প্রতিটি দ্বন্দ্বে, প্রতিটি ক্ষমাশীল সিদ্ধান্তে।

আজকের পৃথিবীতে, যেখানে মানুষ প্রযুক্তির ভেতরে ঢুকে নিজের আত্মাকেই খুঁজে ফেরে, যেখানে যুক্তি আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শাসন করে মন, তবুও কখনো কখনো, একটি নিঃশব্দ অশ্রু বা একটি অপ্রকাশিত প্রশ্ন তোমায় মনে করিয়ে দেবে— প্রজ্ঞা কখনো শুধু তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে থাকে না, সে দাঁড়িয়ে থাকে সত্য উপলব্ধির সাহসে। সেই সাহসই আমাদের মধ্যে অষ্টম ঋষিকে জাগিয়ে তোলে।

লেখক পরিচিতি

Dr. Dipra Bhattacharya

Management Consultant & AI Strategist

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. অনবদ্য ছাড়া আর কোনও ভাষা আসছে না। বেশ কিছু কথা মনে রেখে দেওয়ার মতো। বিশেষ করে ঋতব্রত ও সপ্তর্ষিদের কথোপকথন। এমন লেখা আরও পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।

  2. অসম্ভব ভালো লেখা। অত্যন্ত মননশীল। মূল‍্যায়ণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। এমন লেখা আরোও চাই।

  3. Exquisitely beautiful. এ লেখা আকাশের মতই ব্যাপ্ত এবং বর্ণণাময়। আমরা, আমরা আর আমরা শুধুই চলছি কিন্তু যিনি সত্যিই অষ্টম ঋষি হতে চান? তাকে তো শুধু চললে হবে না, ওই কথা মনে রাখতে হবে – বিচারে শুধু বাণী নয়, থাক হৃদয়ের হাতছানি। অজস্র ধন্যবাদ এ লেখাটির নতুন আলোকছটাকে।

  4. Exquisitely beautiful. এক নতুন আলোকের ঝর্ণাধারায় আলোকিত এ লেখা। আকাশের মত ব্যাপ্ত এ লেখার দীপ্তি।

  5. “সব কিছুর পিছনে একটা শব্দ -যোগ্যতা “ 👏

    এবং

    “সত্য উপলব্ধির সাহস !!” 🫡

    দারুন ছিল রে !
    ব্যাখ্যার উর্ধে !!
    Speed ছিল , ছিল “হোয়াট next” এর তাড়না!

    আজকাল সচরাচর এতটা text go থ্রু করা হয়ে ওঠেনা – সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে পুরোটা পরে জেনে বেশ অন্যরকম লাগছে!
    একটা journey ধরা পড়েছে , আছে adoptation on transformation etc.
    আবার স্মৃতিচারণ ও হয়ে গেলো সপ্তঋষিদের নাম চয়নের মধ্য দিয়ে! 😊

    সব মিলিয়ে খুব ঋদ্ধ এক অভিজ্ঞতা হলো রে!

    1. মনন কে নাড়া দিয়ে গেল। খুব সুন্দর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!