গোপা মিত্র
অন্ধ বিচার
রহস্য ধারাবাহিক (পর্ব-৬)
আজ অনুপমার সাক্ষ্যগ্রহণ। অন্ধ মেয়ের সাক্ষ্য দেখতে কোর্ট চত্বরে কেবলমাত্র জুনিয়ার উকিলরাই নয়, জনতাও ভীড় জমিয়েছে। এমন সময় সকলে আশ্চর্য হয়ে গেল কালো কোট চাপিয়ে অজেয় রায়কে আসতে দেখে। এতদিন পরে অজেয় রায় কোর্টে! তবে কি উনি অন্ধ মেয়েটির হয়ে কেস লড়ছেন? একটু পরেই বেদবাবুকে দেখা গেলো স্ত্রী কন্যার সঙ্গে আসতে। অনুপমা এসেছে, ওড়নায় মাথা মুখ ঢেকে।
কোর্টেই শরণ্যার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো সুমেধার। সেও একজন জুনিয়ার উকিল, আর সুমেধার বন্ধু। অজেয় রায় এতদিন পরে কেস লড়ছে শুনে সেও চলে এল সুমেধার সঙ্গে। আজকের প্রথম সাক্ষী অনুপমার বাবা, বেদ ব্যানার্জী। কোর্টে শপথ গ্রহণের পর অজেয় রায় তার জিজ্ঞাস্য শুরু করলেন।
– আপনি অনুপমার বাবা? হ্যাঁ, তবে আমি ওর Biological father নই। ও রুমার মেয়ে। প্রায় দু আড়াই বছর থেকে ও আমার কাছে রয়েছে। আমি ওকে নিজের মেয়ে বলেই মনে করি, ও-ও আমাকে বাবা বলেই জানে।
– আচ্ছা আপনি কি করেন, মানে আপনার পেশা কি?
-আমার একটা কিউরিও শপের দোকান আছে। সেখানে , দেশ বিদেশের নানারকম শো পিসের সঙ্গে আমার আর অনুপমার হাতে তৈরী মূর্তিও বিক্রী হয়। –
– অনুপমা চোখে না দেখে মূর্তি তৈরী করে কিভাবে?
– ছেলেবেলা থেকেই ওকে আমি হাতে ধরে মূর্তি গড়া শিখিয়েছি। ও তো জন্মান্ধ নয়। ক্লাস নাইনে পড়বার সময় ওর একবার কঠিন অসুখ করে। অসুখ সেরে গেলো ঠিকই কিন্তু ওর চোখের দৃষ্টি চলে গেলো। চোখ চলে যাবার পরও ওকে যে কোনো জিনিষ হাতে ধরিয়ে দিলেই, ও অনুভবে বুঝে নিয়ে ঠিক সে রকম গড়ে দিতে পারে।
-আচ্ছা ঘটনার সময় আপনি কোথায় ছিলেন?
– সেদিন আমার বোনের নাতনীর অন্নপ্রাশন ছিলো, শান্তিনিকেতনে। আমার বোন সেখানেই থাকে। অনু যেতে চাইলো না, তাই আমি আর রুমাই চলে গেলাম।
– কখন আপনি খবর পেলেন, আর আপনাকে খবরটা জানালোই বা কে?
– সুহাসী আমাকে খবরটা দিল, তখন প্রায় সাড়ে বারোটা, একটা। খবর শুনে আমরা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেখান থেকে রওনা দিই। বাড়ী পৌঁছলাম প্রায় সন্ধ্যের মুখে। এসেই অনুপমার কাছে গেলাম, তার অবস্থা দেখলাম। তারপর অনুর কাছ থেকে সমস্ত ঘটনাটা জানলাম। ইতিমধ্যে অবশ্য দুপুরে সুহাসীর সঙ্গে ওপরে ষ্টুডিওতে গিয়ে সে তার ধর্ষণকারীর এক মূর্তি বানিয়ে ফেলেছে, সেটা সে দেখালো। দেখেই আমি ছেলেটিকে চিনতে পারলাম, এই ছেলেটিই আগের দিন অত্যাধুনিক মডেলের গোল্ডেন ইয়েলো বি এম ডব্লিউ গাড়িতে এসে অজয়ের বাড়ির ঠিকানা জানতে চেয়েছিলো। পরদিন আমি থানায় গিয়ে ছেলেটির বিরুদ্ধে একটা এফ আই আর করলাম।
– এবার সাক্ষীকে আপনার জেরা কে.কে.। অজেয় রায় বললেন।
কে.কে. উঠলেন জেরা করতে।
– আচ্ছা… সুহাসীর কথামত, দরজা বাইরে থেকে তালাবন্ধ ছিলো। তাহলে ছেলেটি ভিতরে ঢুকলো কিভাবে?
– আমাদের বাড়ীর গেট টপকে ঢুকে একটু চেষ্টা করলেই পিছন দিকের রান্না খাবার ঘরের কার্নিশে উঠে দোতলার খোলা গ্রিলের জানলা দিয়ে উপরের ষ্টুডিওতে আসা যায়, তারপর সিঁড়ির দরজা খোলা থাকলে অনায়াসেই একতলায় নেমে আসা যাবে। –
– তার মানে সেদিন আপনি সিঁড়ির দরজা বা গ্রিলের জানলা বন্ধ করে যাননি। তাহলে এটা কি আমি বলতে পারি যে আপনি সেদিন ইচ্ছে করেই সব দরজা জানলা খুলে রেখে চলে গিয়েছিলেন যাতে ঐ অভিযুক্ত ছেলেটি বা অন্য যে কোনো ছেলে ভিতরে এসে আপনার সৎ মেয়েকে ধর্ষণ করতে পারে! আপনি মুখে বলছেন আপনি ওকে নিজের মেয়ের মতই ভালোবাসেন, কিন্তু সত্যিই কি তাই? এই যে সবকিছু খুলে রেখে চলে যাওয়া, এটা কি আপনার ইচ্ছাকৃত ছিল না?
– কি বলছেন আপনি? এটা আমি করতেই পারি না। হয়ত তাড়াহুড়োতে সব কিছু খুলে রেখেই ভুল করে চলে গিয়েছি।
বেদ বাবু নেমে এলে সাক্ষ্য দিতে উঠলেন, রুমা দেবী। অজেয় রায়ের জিজ্ঞাসা শেষ হলে কে.কে. উঠলেন তাকে জেরা করতে।
– আপনি রুমা দেবী, অনুপমার মা।
– হ্যাঁ।
-বেদবাবু তাহলে অনুপমার বাবা। তাই তো?
– না, আমার পূর্ব স্বামী মারা গেলে, আমি ওনাকে বিয়ে করি।
– আপনার স্বামী কি করতেন?
– আমার স্বামীর ব্যবসা ছিলো।
-তা বেশ, আপনার স্বামী মারা যেতেই, যেই দেখলেন বেদবাবু পয়সাওলা লোক, অমনি তিন মাসের মধ্যেই তাকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করে ফেললেন।
অজেয় রায় বলে উঠলেন, “Objection My Lord, উনি মহিলাদের সম্মান হানিকর প্রশ্ন করছেন”।
– Objection Sustained! আপনি এমন প্রশ্ন করবেন না।
– তাহলে আমি প্রশ্নটা অন্যভাবে করছি। বেশ আপনি এবার বলুন বিয়ের সিদ্ধান্তটা আপনি অত তাড়াতাড়ি নিলেন কেন?
– আমার স্বামী যখন মারণ রোগে মারা গেলেন, অনু তখন খুবই ছোট। ব্যবসার আমি কিছুই বুঝি না। আমি পড়লাম অথৈ জলে। আশেপাশের অনেকেরই দেখলাম নজর আমাদের টাকার দিকে। আমি তখন কি করবো? বেদবাবু ছিলেন আমার স্বামীর বন্ধু। আমাদের বাড়িতে আসতেন, অনুকেও খুব ভালোবাসতেন। তিনি যখন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন, আমি রাজী হয়ে গেলাম। তাছাড়া আমার স্বামীও আমাকে বলে গিয়েছিলেন, প্রয়োজনে তুমি শুধুমাত্র বেদবাবুর সাহায্যই নিও, আর কারও নয়। তাই তাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত।