ডঃ দীপ্র ভট্টাচার্য
(৫ই জুন – বিশ্ব পরিবেশ দিবস-এর আলোকে)
পদক্ষেপ
সেদিন হঠাৎ করেই কারেন্ট চলে গেল অফিসে। সচরাচর আজকাল যায় না। জেনারেটর চালু হতে হতে, সিট থেকে উঠে তাকিয়ে দেখি জানালার বাইরে কলকাতার গ্রীষ্ম দুপুর। অফিসের নিচে রাস্তায় গরমে চটচট করছে পিচ, ট্র্যাফিকের হর্ন ছিন্নভিন্ন করছে রুমের ভিতরকার নৈঃশব্দ্য। আমার ডেস্কে রাখা কম্পিউটারে হাত রাখতেই মনে হল – আমি বুঝি বাঁচছি না, শুধু ঠেকনা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা একটা যন্ত্র।
একা মানুষ। চাকরির বয়স বিশ পেরিয়ে গেছে। কর্পোরেট হিসাবরক্ষণ, টার্গেট, ডেডলাইন… এক অদৃশ্য খাঁচার ভিতর আমি বন্দি। আমার সহকর্মীরা যাকে “সাফল্য” বলে, আমি তাকে বলি বালুকাবেলা। ছুঁতে গেলেই ফসকে যায়।
অতএব, সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আমি সিদ্ধান্ত নিই – এই কলকাতা আমি ছাড়ব। গন্তব্য? উত্তরের একটা নাম না জানা বনাঞ্চল – বাইরের দুনিয়ার সাথে যার যোগাযোগ প্রায় নেই। এক জায়গার নাম শুনেছিলাম অনেক আগে, আসামের ভেতরের দিকে, মূর্তি নদীর তীরে এক অরণ্যগ্রাম – নামটা মনে পড়ল হঠাৎ – চিলোনি।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, পাতার ফাঁকে ফাঁকে তার শব্দ থেমে গিয়ে আবার ফিরছে – ঠিক যেমন করে শহরের শোরগোল আমার ভিতর থেকে মুছে যেতে চায়, অথচ অভ্যাসবশত বারবার ফিরে আসে। চিলোনি পোঁছাতে দেড়দিন লেগে গেল। প্রথমে ট্রেন, তারপর বাস, তারপর একটা জিপ। চালক পেছনে তাকিয়ে বলল, — “আরও ভিতর দিকে যাবেন? আলো পড়ে গেলে বাঘ বেরোয়, সাবধান থাকবেন দাদা।”
আমি হেসে বললাম, “আলোয় তো মানুষও বেরোয়। ওদের ভয় লাগে না?”
এই বন আমাকে গ্রহণ করেছে, তার নীরব চোখে। এখানে কেউ প্রশ্ন করে না আপনি কে, আপনি কি করেন, আপনার সিটিসি কত। এখানে সন্ধ্যে নামে এক প্রাচীন গন্ধ নিয়ে – গাছের, ভিজে মাটির, আর কিছু অনুচ্চারিত বিষণ্নতার। এখানে, আমি একটা কাঠের ঘরে থাকি। দিন কেটে যায় পাখির ডাক শুনে, গাছের পাতা গুনে। পাশের নদীটা রাতে সুর তোলে – গম্ভীর, অথচ শান্ত।
আমি লিখতে শুরু করেছি — দিনের পর দিন প্রকৃতির মাঝে কাটিয়ে, যে সব কথা কখনও কাগজে উঠত না, এখন তারা পাখির মতন এসে বসে লেখার পাতায়। আমি নিজেই বুঝতে পারিনি এতদিন যে, প্রকৃতি আমাকে নিজের করে নিতে চাইছিল।
আজ আমি ঠিক করেছি — শহরের জীবনের সমস্ত হিসেব ভুলে, আমি এই অরণ্যের একজন হয়ে উঠব। না, আমি পরিবেশবিদ নই, আমি কোনো আন্দোলনের মুখও নই। আমি শুধু প্রকৃতিকে ভালোবেসে ফিরে এসেছি তার কোলে। যেমন ছোটবেলায় মায়ের কাছে ফিরে আসতাম। এই ডায়েরি, হয়তো কেউ কখনও পড়বে না। কিন্তু আমি লিখে যাব। যদি একদিন কেউ জানতে চায় – “মানুষ একা হলে কোথায় যায়? তখন আমার লেখা হয়তো একটা ঠিকানা হয়ে উঠবে।”
গাছেরা যাদের চেনে
ভোরে ঘুম ভাঙল বাঁশবনের হালকা শিসে। জানালার বাইরে দেখি, ঘন কুয়াশার মাঝে ছায়ার মতো হেঁটে যাচ্ছে একটা সম্বর হরিণ — মাথা নিচু, পায়ের শব্দ নেই, যেন মাটি না ছুঁয়েই চলেছে। এই বনের প্রাণীরা মানুষকে সন্দেহের চোখে দেখে না, যদি না সে নিজে অপরাধী হয়।
চিলোনির লোকেরা বনকে ভয় পায় না, বরং ওরা বাঁচে বনকে আঁকড়ে ধরে। এই বন তাদের পোষ্য নয় — বন্ধু, অভিভাবক। গতকাল বিকেলে তামাং নামে এক যুবকের সঙ্গে দেখা হল। গাঢ় বাদামি মুখ, চোখে পাহাড়ি মায়া। সে নিয়ে গেল আমাকে এক জায়গায় — যেখানে গাছগুলো কাটা হয়েছে কিছু দিন আগে। গোটা পাঁচেক শালগাছের গুঁড়ি পড়ে আছে — রক্তাক্ত মৃতদেহের মতো, পাশেই মাটিতে ছড়িয়ে পাতা, শাখা, আর ছোট গাছের ভগ্নাংশ।
তামাং বলল, — “বাবু, যারা কেটেছে, তারা বাইরের লোক। রাতের অন্ধকারে আসে, বন অফিস তখন ঘুমোয়।” তার গলায় রাগ নেই, আছে একধরনের ক্লান্তি। লড়াই সে করেছিল, কিন্তু এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে গাছগুলোর পাশে বসে ছিলাম। আশেপাশে অসংখ্য পাখি, কিন্তু কেউ ডাকছে না। বন যেন শোক করছে।
তামাং-এর সঙ্গে ভাব হয়ে গেছে। সন্ধ্যাবেলায় আমি তামাংয়ের সঙ্গে হাঁটতে বের হলাম। পথ ধরে সে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘরের সামনে দাঁড়াল। ভেতর থেকে বের হলেন এক বৃদ্ধা — মেইনু দিদিমা। তার বয়স আশি ছুঁইছুঁই, কিন্তু চোখে জ্বলে আগুন।
তিনি বললেন, — “এই গাছগুলো আমি ছোট থেকে দেখছি। আমার বাবাও এখান থেকে ছায়া পেয়েছিল, ফল পেয়েছিল। এখনকার লোকেরা ভাবে, গাছ শুধু কাঠ।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা কিছু করেন না কেন?”
তিনি মৃদু হেসে বললেন, — “আমরা তো করি। একেকটা গাছের জন্য আমরা আমাদের একেকটা সন্তানকে সেই গাছের নাম দিই। আর ওদের বলি, তুমি বাঁচলে গাছ বাঁচবে।”
ভাবতেই পারিনি, এ যে পরিবেশ সংরক্ষণের এক অনাড়ম্বর, নির্ভরযোগ্য পথ — যেখানে প্ল্যাকার্ড নেই, ক্যাম্পেইন নেই, কিন্তু আছে ভালোবাসা, আছে আত্মীয়তা।
সেই রাতেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম — এই অঞ্চলের গাছ কাটার তথ্য সংগ্রহ করব, নথিভুক্ত করব, ছবি তুলব। আমি কোনো NGO কর্মী নই, আমি সাংবাদিকও না। তবু এই কাজটা করতে হবে। কারণ আমি এখন এই বনের লোক।
পরদিন সকালে একটা খাতা কিনলাম — তার নাম দিলাম, “সবুজের খাতা”। প্রথম পাতায় লিখলাম— “যে গাছ কাটা হল, তার বয়স জানলাম ৪৮ বছর। কত লোক তার ছায়ায় দাঁড়িয়েছিল — সে সবাইকে শীতল করেছিল, বিনা প্রশ্নে। আজ তার ছায়া আর নেই, আর মাথায় রোদ পড়ে। এই আমি লিখে রাখলাম।”
এইভাবেই শুরু হল আমার নতুন লড়াই। নিশব্দ, নিরালম্ব, অথচ আন্তরিক — এই অরণ্যের পক্ষ থেকে লেখা এক মানুষের কণ্ঠস্বর।
গাছবন্ধুদের জন্ম
তামাংয়ের বোনের ছেলে, নাম রিংকু। বয়স বারো। চোখে বুনো হরিণের সতর্কতা, আর মুখে সারাদিন পাহাড়ি ঝর্নার মতো শব্দের ধারা। সে-ই আমাকে প্রথম বলল, — “দাদা, আমরা কয়েকজন মিলে একটা ক্লাব বানাতে চাই। নাম ভেবেছি ‘গাছবন্ধু’। আপনি লিখে দিতে পারবেন নামটা?”
সেই দিন সন্ধ্যায় আমি ঘরের বারান্দায় বসে বড় বড় করে লিখে দিলাম – “গা-ছ-ব-ন্-ধু”।
দেয়ালের গায়ে পেরেক দিয়ে টাঙানো হল। বাতাসে তখন গন্ধ – বৃষ্টির, মাটির, আর অদ্ভুত এক আশার।
রিংকু, তার দুই বন্ধু সোমা আর ন্যামগিয়াল – তিনজন মিলে শুরু করল বনের পাহারা। প্রতি বিকেলে ঘুরে ঘুরে দেখে, নতুন কেউ এসেছে কিনা, গাছ কাটা হয়েছে কিনা। আমি তাদের দিয়েছিলাম তিনটে ছোট খাতা। ওরা তাতে লিখে রাখে প্রতিদিনের দিনপঞ্জি—
“আজ দুপুরে নদীর ধারে দুটো অপরিচিত লোক এসেছিল। দেখে আমাদের লুকিয়ে পড়তে হয়েছিল। ন্যামগিয়াল বলেছে ওরা কিছু গাছ দেখতে এসেছিল। আমরা চুপ করে গাছের আড়ালে বসে ছিলাম।”
“আজ বৃষ্টি পড়েছে। শালগাছের ডালে ঘুঘু পাখি বসেছিল। আমরা কিছু বলিনি। পাখিটার ডাক শুনে মনে হল, ও আমাদের চিনে ফেলেছে।”
এই ছোট ডায়েরিগুলো যেন জঙ্গল-জীবনের শ্বাসপ্রশ্বাস। শহরের চোখে ওরা হয়তো শিশু, কিন্তু গাছেদের চোখে ওরা প্রহরী।
চতুর্থ সপ্তাহে শহর থেকে এল এক পরিচিত — দীপ্তা, পরিবেশবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করে। আমি তাকে বলেছিলাম আসতে, এই বনের শিশুদের কাজ দেখে যেতে।
দীপ্তা সন্ধ্যায় এসে শিশুদের খাতা পড়ল। তার চোখে জল। সে বলল, — “আমরা শহরে হাজারটা পোস্টার ছাপাই, সামাজিক মাধ্যমে ক্যাম্পেইন করি — কিন্তু এই বাচ্চাগুলোর এই খাতাগুলো হয়তো তার চেয়েও বড় কাজ।”
সে শিশুদের শেখালো কীভাবে বনের প্রাণী দেখলে তার চিহ্ন রাখতে হয়, কেমন করে জলাধারের চারপাশে গাছ বসালে ক্ষয় আটকানো যায়। ছোট একটা পাণ্ডুলিপি দিল — “প্রকৃতি কেমন কথা বলে”, যাতে বনের ভাষা শেখানো হয়।
সেই রাতেই আমি খেয়াল করলাম — আমার চারপাশে যে বন, সে এখন শুধু নিসর্গ নয়, সে যেন জীবন্ত চরিত্র। আমরা একে রক্ষা করছি না কেবল, একে ফিরিয়ে দিচ্ছি তার মর্যাদা।
রিংকুদের ক্লাব এখন দশজনে দাঁড়িয়েছে। তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়, কোন এলাকায় নজরদারি বেশি দরকার, কোথায় গাছ লাগানো হবে বর্ষায়। আমি লিখলাম “সবুজের খাতা”-র দ্বিতীয় পাতায়— “যে সমাজ তার গাছেদের ভালোবাসে, সে সমাজ এখনও বেঁচে আছে। এবং যতদিন শিশুরা গাছকে বন্ধু ভাববে, ততদিন এই পৃথিবী হারিয়ে যাবে না।”
এই অরণ্য, এই শিশুদের মুখ, আর দীপ্তার দেওয়া বইয়ের পাতায় আমি দেখতে পাই — এক নতুন পরিবেশ আন্দোলনের বীজ। নিঃশব্দে, নিঃশব্দেই শুরু হয় সব বড় জিনিস।
নীরব বন, শব্দহীন প্রতিবাদ
বিকেল থেকে আকাশ ভার হয়ে আছে। ছায়া নেমেছে অরণ্যে, পাখিরা নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। এই নিস্তব্ধতা, আমি বুঝি, ভালো কিছু আনার পূর্বাভাস নয়।
তামাং হঠাৎ এসে বলল, — “আজ বিকেলে বন দপ্তরের লোক এসেছে। বলেছে, রাস্তা বানানোর কাজ শুরু হবে পরশু থেকে।”
আমি চমকে উঠলাম। — “রাস্তা? এই ঘন জঙ্গল পেরিয়ে?”
— “হ্যাঁ, মূর্তি নদীর ধার দিয়ে চলে যাবে এক এক্সপ্রেস রোড, নাকি ট্যুরিজম বাড়বে।”
প্রশাসনের ভাষায় ‘উন্নয়ন’। প্রকৃতির ভাষায় — ক্ষরণ।
রিংকুরা খবর পেয়েই ছুটে এল। ওদের চোখে ভয় নয় — ছিল অভিমান।
সে বলল, — “আমরা কি তাহলে এতদিন এমনি পাহারা দিলাম?”
আমি তাদের সঙ্গে বসে লিখে দিলাম এক খোলা চিঠি — জেলাশাসক, বন বিভাগ, এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্দেশ্যে।
চিঠিতে লেখা হল:
“আপনারা হয়তো জানেন না, এই অরণ্যে একদল শিশু নিজের হাতে গাছ চেনে, প্রকৃতিকে নিজের আত্মীয়র মত ভাবে। ওই গাছের পাখিদের ডাকও তারা আলাদা আলাদা করে চেনে। তাদের গাছবন্ধুর খাতায় লেখা আছে প্রকৃতির বাঁচার গল্প। যদি এই রাস্তা হয়, শুধু গাছ নয়, হারিয়ে যাবে সেই গল্পগুলোও।”
চিঠি কোনো জবাব আনল না। বরং ঠিক সময় মতো রীতিমতো সরকারী গাড়ি এসে দাঁড়াল। দু-একজন কর্মী, কিছু কনট্রাক্টর, আর মাটি কাটার বড় যন্ত্র।
কিন্তু যন্ত্র চলে না। কারণ গাছবন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছে — হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড—
“এই গাছগুলোই আমাদের নাম। কেটে দিলে আমরা নামহীন হয়ে যাব। এতে থাকা পাখিরা আমাদের বন্ধু। আমরা খেলি ওই পাখিদের ডাক শুনে, আমাদের খেলা নষ্ট কোরো না।”
একজন ছোট মেয়ে — সোমা — মাটি জড়িয়ে ধরে বসে পড়েছে। দীপ্তা এসে দাঁড়াল পাশে। সে জানায় মিডিয়াকে। সাংবাদিক কেউ আসে না, কিন্তু একজন ব্লগার আসে। সে ছবি তোলে, পোস্ট করে দেয়, সোশাল মিডিয়ায়। তারপর যে জিনিসটা ঘটল, তা মানুষ অনেক সময় বোঝে না — প্রকৃতি ঠিক সময়মতো তার প্রতিক্রিয়া জানায়।
সেদিন বিকেলে হঠাৎ করে এমন এক বৃষ্টি শুরু হল, যেটা ওই সময় সাধারণত হয় না। বজ্রপাত, নদীর জল হু-হু করে বাড়ল। যন্ত্রপাতি সরাতে বাধ্য হয় শ্রমিকেরা। স্থানীয় পঞ্চায়েত একদিনের জন্য কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়, “পরিবেশ মূল্যায়নের” অজুহাতে। কিন্তু আমরা জানি — গাছেরা বুঝেছে, ওদের পাশে কেউ দাঁড়িয়েছে।
সেই রাতেই দীপ্তার ব্লগের লেখা ভাইরাল হয়। হেডলাইন ছিল— “যেখানে গাছেদের পাহারা দেয় শিশুরা — এক অরণ্যের লড়াই”।
পরের দিনই সরকারী পর্যবেক্ষক আসে। কাজ স্থগিত হয়, অন্তত কয়েক মাসের জন্য।
আমার “সবুজের খাতা”-র চতুর্থ পাতায় লিখলাম— “এই বন একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে কি না জানি না। কিন্তু আজ একদল শিশু, এক বৃদ্ধা, এক মা, এক তরুণ — আর একটা একাকী লোক মিলে বলেছে, এই বনের গন্ধ আমরা ভুলতে দিই না। আর তাতেই হয়তো গাছেরা বেঁচে গেল আরেকদিন।”
প্রকৃতির ডানা গজায়
প্রকৃতি কখনও খুব জোরে চিৎকার করে না, সে নিঃশব্দেই তার কথাগুলো বলে। যেমন করেছিল চিলোনির শিশুদের মুখ দিয়ে। বনের গভীরে রচিত হওয়া সেই ছোট্ট প্রতিবাদ — রিংকুদের গাছবন্ধু” ক্লাব — এখন নীরবে ছড়িয়ে পড়ছে বাইরের জগতে।
দীপ্তার ব্লগ পোস্টটি এক পত্রিকার ‘সানডে স্পেশাল’-এ ছাপা হয়। শিরোনাম ছিল— “বন বাঁচানোর পাঠশালা — শিশুরা যেখানে শিক্ষক”।
কিছু দিন পর ফোন এল কলকাতা থেকে — এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে। তারা জানতে চায় — “আমরা কিছু শিক্ষার্থী নিয়ে চিলোনি আসতে চাই, এই ‘গাছবন্ধু’ ক্লাবের সঙ্গে দেখা করতে। সম্ভব?” আমি বললাম, “নিশ্চয়ই, মানুষ তো অতিথি।”
পরের সপ্তাহেই সাতজন শিক্ষার্থী আর দুজন অধ্যাপক এলেন। সোজা ঢুকে গেলেন অরণ্যের ভিতর — গাইড না নিয়ে, গাছবন্ধুদের হাত ধরে। রিংকু, সোমা, ন্যামগিয়াল — ওরা ওদের নিয়ে গেল সেই শালবন যেখানে রাস্তা কাটার কথা ছিল। সেখানে এখন একটা ছোট ফলক লাগানো হয়েছে— “এই বনের প্রত্যেক গাছ আমাদের এক একজন আত্মীয়”।
শিক্ষার্থীরা অবাক। শহরে পরিবেশ শিক্ষার পাঠ্যবই আছে, কিন্তু এখানে তাদের পাঠশালা মাটি ছুঁয়ে, পাতার নিচে, পাখির ডাকের ভেতরে। একজন বলল, — “আমরা যেন বইয়ের বাইরের এক অধ্যায়ে ঢুকে পড়েছি।”
এরপর রাজ্য পরিবেশ দপ্তরের তরফে এক প্রতিনিধিদল আসে। তারা দেখে শিশুদের খাতা, ডায়েরি, গাছের রেজিস্টার — কে কোথায় জন্মেছে, কত বয়স, কোন পাখি তাতে বাসা বানায়।
প্রতিনিধি বলেন, — “এই মডেলটা আমরা স্কুল পর্যায়ে চালু করতে চাই। গাছবন্ধু একটা আন্দোলনের নাম হয়ে উঠুক।” আমরা অবাক হইনি। কারণ জানি — প্রকৃত ভালোবাসা যদি সৎ হয়, সে কখনও চুপ করে থাকে না। সে ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে, পত্রে, মানুষের মুখে।
পরিবেশ দিবস, ৫ই জুন। সেদিন গাছবন্ধু ক্লাব প্রথমবার একটি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি করে — শহর থেকে আসা শিক্ষার্থী ও স্থানীয় শিশুদের মিলিয়ে মোট ৫০টি নতুন চারা বসানো হয়। প্রতিটি গাছের নিচে পাথরে লেখা হয় রোপনকারীর নাম। বিকেলে ছোট্ট অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে আমাকে কিছু বলতে বলল রিংকু।
আমি দাঁড়িয়ে শুধু বললাম— “যে শিশুরা গাছের নাম জানে, তারা চিরকালই এই সবুজ পৃথিবীকে চিনবে। কারণ প্রকৃতির সঙ্গে যার বন্ধুত্ব, সে প্রকৃত মানুষ হতে ভোলে না।”
সবুজের খাতা থেকে— “আজ চিলোনি জঙ্গল কেবল একটা বন নয়, এক পাঠশালা। রিংকু আর ওদের মত শিশুরা এখন শুধু গাছ পাহারা দেয় না — তারা পৃথিবী পাহারা দেয়। গাছেরা আজ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, তবে আর একা নয়। তাদের পাশে এখন কিছু নাম আছে, কিছু খুদে হৃদয়। এই হল আমাদের ছোট, সবুজ বিপ্লব।”
ফিরে দেখা, এক সবুজ জীবন
পাঁচ বছর কেটে গেছে। চিলোনির আকাশ এখনও কুয়াশায় ভরে উঠে শীতে। মূর্তি নদী এখনও বয়ে যায় নরম গর্জনে। আমি এখন শহরে — তবে মাঝে মাঝেই ফিরে যাই পুরনো পাতার নিচে, সেই কাঠের ঘরে। এই ফেরা শুধু ভ্রমণ নয় — যেন আমি ফিরে যাই আমার আসল ঠিকানায়।
আজ সকালে ডাক এল রিংকুর কাছ থেকে। — “দাদা, একটা অনুষ্ঠানে আপনাকে আসতেই হবে। এবার আমাদের ক্লাব রাজ্যের ‘গ্রীন এডুকেশন মডেল’ হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে!”
রিংকু এখন কলেজে পড়ে — পরিবেশবিজ্ঞান নিয়ে। তার চুল বড় হয়েছে, গলায় গামছা জড়িয়ে রাখে আগের মতোই। তবে কথা বলায় এক আত্মবিশ্বাস এসেছে। সে এখন বক্তৃতা দেয়, সরকারী মিটিংয়ে যায়, অথচ এখনও প্রতিদিন সকালবেলা নিজের হাতে অন্তত একটি গাছকে জলে দেয়।
চিলোনির গাছবন্ধু ক্লাব এখন ৮টি গ্রামের ১২৩ জন শিশুর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রত্যেকটি গ্রামে এখন একটি ‘গাছরেজিস্টার’, এক ‘সবুজ খাতা’ আর প্রতি বছর ৫ই জুন একটি বৃক্ষ মেলার আয়োজন করা হয়।
গাছগুলো আর নামহীন নয় — তারা এখন কারও ‘বুবু দাদা’, কারও ‘পাখি মাসি’, কারও ‘ছায়া মা’। রাজ্যের বইয়ে এই উদ্যোগ এখন অন্তর্ভুক্ত। শিক্ষকেরা শেখান, “প্রকৃতি পাঠ্যবইতে নয়, প্রথম শেখা উচিত গাছের ছায়ায় বসে।” রবিঠাকুরকে মনে পড়ে যায়।
কলকাতা ফেরার পরও আমি চাকরিতে আর ফিরে যাইনি। আমি এখন লেখালেখি করি, এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই, আর কখনও কখনও বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে এই অরণ্যের কথা বলি।
একটি কথা আমি সবসময় বলে থাকি— “বাঁচতে গেলে শুধু শ্বাস নেওয়া যথেষ্ট নয় — বাঁচতে গেলে শেকড়ের খোঁজ পেতে হয়। আমার শেকড় আমি পেয়েছি চিলোনির গাছেদের মাঝে।”
আজ বহুদিন পর সেই পুরনো ‘সবুজের খাতা’ খুললাম। শেষ পাতায়, সাদা কাগজের ওপরে একটুখানি ফ্যাকাসে হয়ে আসা লেখা— “গাছেরা দাঁড়িয়ে থাকে। তারা হাঁটে না, দৌড়য় না, তবু তারা আমাদের আগলে রাখে। আমরা একদিন হয়তো হারিয়ে যাব, কিন্তু যদি কোনও শিশুর মনে একটা গাছের নাম থেকে যায় — তাহলেই পৃথিবীটা কিছুটা বেঁচে যাবে।”
জানালার বাইরে এখন সন্ধ্যে। একঝাঁক চিল ঘরে ফেরে, গাছেরা একে একে নুয়ে পড়ে ক্লান্ত ছায়ায়।
আমি জানি — সেই অরণ্য এখন শুধু চিলোনিতে নয়, আমার ভেতরেও বাসা বেঁধেছে।
চিত্রঋণ : META
লেখকের দু- কলম
পৃথিবীর বুকে যত গল্প লেখা হয়, তার অনেকগুলোই মানুষকে নিয়ে — মানুষের ভালোবাসা, ক্ষোভ, সংগ্রাম, লোভ, সাহস। কিন্তু খুব কম গল্প থাকে, যেখানে মানুষ শুধু কেন্দ্র নয় — প্রকৃতির পাশে দাঁড়ানো এক বন্ধু হয়ে ওঠে। এটা ঠিক তেমন একটা লেখা — যেখানে গাছেরা চরিত্র, নদী কথা বলে, আর শিশুরা হয়ে ওঠে পৃথিবীর রক্ষাকর্তা। এই লেখার পটভূমি ভারতের উত্তরবঙ্গের চিলোনি নামে এক অরণ্যগ্রাম, যার অস্তিত্ব বাস্তব থেকে দূরে নয় — এমন গ্রাম যা, আজও ছড়িয়ে আছে দেশের আনাচেকানাচে। লেখার মূল চরিত্র শহরের একজন কর্পোরেট কর্মী, যে নিজেকে হারিয়ে পায় গাছের ছায়ায়, শিশুর চোখে, প্রকৃতির গভীরে। প্রেক্ষাপটটি যদিও কাল্পনিক, তবু ঘটনাগুলো বাস্তবতাকে ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা — যেখানে শিশুদের হাতে গড়ে ওঠে ‘গাছবন্ধু’ নামের এক পরিবেশ আন্দোলন, যা নীরবে, শব্দহীন বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়। এই লেখা মূলত ৫ই জুন – বিশ্ব পরিবেশ দিবস-এর আলোকেই, কিন্তু এর বার্তা শুধু একদিনের জন্য নয়। মনে রাখতে হবে—“প্রকৃতি আমাদের অভিভাবক নয়, সে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ভবিষ্যৎ।” একটা সময় ছিল, যখন আমরা বড়দের মুখে শুনতাম — “গাছের ছায়া বাঁচিয়ে রেখো। ওরা তোমাকে চিনে রাখে।” আজ আমরা বিজ্ঞান দিয়ে বুঝি কার্বন নিঃসরণ, জলবায়ু পরিবর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি। কিন্তু সেই সঙ্গে দরকার ভালোবাসা দিয়ে বোঝা — গাছ কাটা মানে শুধু পরিবেশ নষ্ট নয়, মানে নিজের একটা অংশ ছিঁড়ে ফেলা।
এই লেখার শেষে এসে আমরা যদি শুধু এই উপলব্ধিটুকু নিতে পারি — “প্রকৃতি সংরক্ষণ কোনও দায়িত্ব নয়, এটা ভালোবাসার এক আকার,” তাহলে এই লেখা সার্থক। সবুজের খাতা হয়তো একদিন হলুদ হয়ে যাবে, পাতার ডায়েরি পুরনো হয়ে পড়বে। তবু যদি কোথাও, কোনও শিশুর হাতে একটুখানি মাটি লেগে থাকে — তবে প্রকৃতির শেষ পাতা এখনও লেখা হয়নি।
সুন্দর লেখনী ও বিষয় ভাবনা।
দুরন্ত হয়েছে। বর্তমান কালের নিরীখে অতিশয় প্রাসঙ্গিক এবং এক অত্যন্ত জরুরী বার্তা পেশ করা হয়েছে এই গল্পের মধ্যে দিয়ে।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লেখা। লক্ষ্যনীয় হলো তথ্য ভিত্তিক আলোচনায় না গিয়ে জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি এমন ভাবেও করা সম্ভব, এই গল্পটি না পড়লে সেটা বোঝা যেত না। আলাদা করে ভালো লাগল প্রতিটি ভাগের অপুর্ব নামকরণ। অসংখ্য ধন্যবাদ এমন এক লেখায় আমাদের ব্লগকে সমৃদ্ধ করে তোলার জন্যে।
খুব ভালো লাগল। গাছ বাঁচানোর আন্তরিক প্রচেষ্টা কিসের থেকে প্রকৃতভাবে জাগবে সেটা এই গল্পে সুন্দর ফুটে উঠেছে। আসামে National Highway বানানোর সময় গাছ কাটার পর কোনো একজন একক প্রচেষ্টায় বৃক্ষ রোপনের কাজ করেন – নামটা ভূলে গেছি – কাগজে পড়েছিলাম – সেই ঘটনার একটা ছায়া দেখলাম তোর গল্পে।
চেনা ছকের বাইরে অসাধারণ লেখা, কাল্পনিক হলেও মন ছুঁয়ে যায়।বাস্তবের সাথে সাহিত্য রসের সুন্দর মেলবন্ধন লেখার মানকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। নতুন লেখা পাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
গাছেরও যে প্রাণ আছে। সে তো প্রাণের সাথে মিলবেই। পরাণে পরাণে এ সখ্যতার বিবরণ যেন পরতে পরতে রসালো আর বাঙময়।
সম্পর্ক প্রেমেই সার্থক। পরিবেশের সাথে এক প্রাঞ্জল প্রেমের কাহিনী এ লেখা। দেয়া নেয়ার এ আলেখ্য যেন মনে করায় সেই অমর অনুভূতি “তুমি আছ, তাই আছি”। সবুজ পাতা ঘেরা বনানীর মতই এ লেখা সহজ এবং প্রাণবন্ত। নিঃশ্বাসে বিশ্বাসের জন্ম দেয় যে লেখা।
দারুন লেখা। আজকের পৃথিবীতে খুবই প্রাসঙ্গিক।
অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়ে সুন্দর লেখা। কাল্পনিক চরিত্রের উপস্থাপনা ও তাদের মধ্যে দিয়ে একটা ইতিবাচক বার্তা দেওয়া সত্যিই প্রশংসনীয়।
সহজ, সাবলীল এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক লেখা।
অপূর্ব লেখা। পড়তে পড়তে আমিও যেনো সেই চিলোনিতে চলে গিয়েছিলাম। সেই সব ছোট্ট ছোট্ট গাছ বন্ধুরা যারা আজকে বড় হয়ে গেছে, ভালোবেসে গাছেদের রক্ষা করে চলেছে। এইরকম লেখা আরো আরো দরকার সবাইকে উজ্জীবিত করার জন্যে।
খুব ভালো লাগলো গল্পটা পড়ে । সহজ ,সরল ভাষায় যেভাবে পরিবেশের উপর আন্দোলনটা গড়ে উঠলো তা খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সবার কাছে ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে গল্পটার মাধ্যমে, যা আজকের সমাজে ভীষণ প্রাসঙ্গিক।
অপূর্ব লেখা। পড়তে পড়তে আমিও যেনো সেই চিলোনিতে চলে গিয়েছিলাম। সেই সব ছোট্ট ছোট্ট গাছ বন্ধুরা যারা আজকে বড় হয়ে গেছে, ভালোবেসে গাছেদের রক্ষা করে চলেছে। এইরকম লেখা আরো আরো দরকার সবাইকে উজ্জীবিত করার জন্যে।
কি সুন্দর রে!
কর্মসূত্রে এইরকমের প্রকৃতির কোলে বহুদিন বসবাস করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার_ তাই দ্রুত connet করতে পেরেছি !
মনে পরে গেলো সেই অভিজ্ঞতা ,
খুব ভালো লাগলো!
খুউব ভাল আর সাবলীল লেখা। আহা এমন যদি সত্যি হতো।
খুউব ভাল আর সাবলীল লেখা। আহা এমন যদি সত্যি হতো।