Home বিবিধ, গল্প রাখে হরি মারে কে ! (পর্ব – ২)
বিবিধগল্প

রাখে হরি মারে কে ! (পর্ব – ২)

অঞ্জন বসু চৌধুরী

প্রথম পর্বে আমি আপনাদের ১৯৭৬ সালের ২২শে জানুয়ারীতে ঘটে যাওয়া আমার জীবনের প্রথম ভয়ঙ্কর ঘটনাটির (যেখানে আমি মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরে এসেছিলাম) কথা বলেছিলাম। আজ থাকছে দ্বিতীয় ঘটনাটি। সেবারেও আমি মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছিলাম।

১১ই ডিসেম্বর, ১৯৮৮ সাল। ঠিক দু-মাস আগে শাশুড়ি মা প্রয়াত হয়েছেন শ্বশুরমশাইয়ের মনের অবস্থা একদমই ভালো নয়, খুবই ভেঙে পড়েছেন। তাঁর মনটা যদি কিছুটা ভালো করা যায় সেই আশায় আমার মেজো শ্যালক বললো যে, কারুর মন মেজাজ ভালো নেই। চলু্‌ আমরা কয়েকদিনের জন্যে দীঘা ঘুরে আসি।

আমার দীঘা গাড়ী করে যেতে আপত্তি ছিল। কেননা রাস্তার হাল খুব খারাপ। তার ওপর আমি সাধারণত ছুটি মঞ্জুর না করিয়ে কোথাও যাই না। তখন আমার অডিট চলছে তার ফলে ছুটি পাওয়া মুশকিল। শ্যালক কে বললাম তোমরা এখন মহাগুরু নিপাতের বছরের মধ্যে আছো, নাই বা বেরোলে কোথাও। কিন্তু সে বললো কিছু হবে না চলো।

অডিটের কাজ শেষ হয়ে গেলো ঠিকই; কিন্তু তাও অফিস থেকে ছুটি না নিয়েই দীঘার উদ্দেশে রওনা হলাম আমরা। সব মিলিয়ে আমরা ছ’জন বড়ো আর দুজন বাচ্চা – একজন তিন বছরের আর একজনের বয়েস দেড় বছর। অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। আমি ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলাম কারণ আমার দুই শ্যালক যারা দুজনে মিলে ভাগ করে গাড়ি চালাবে বললো, তাদের কারুরই লং-ডিসটেন্স চালানোর অভিজ্ঞতা নেই।

আমরা সকাল দশটা নাগাদ নন্দকুমার বলে একটা জায়গায় পৌঁছলাম। সেখানে খাওয়া দাওয়া করলাম। আমাদের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আসছিলো একটা মোটরবাইক কয়েকজন মিলে তাতে দীঘা যাচ্ছে। তারাও আমাদের সাথেই খাওয়া-দাওয়া করলো। তারপর আমরা যে যার মতো বেরিয়ে পড়লাম দীঘার উদেশ্যে।

আমি সামনের সীটে জানলার ধারে, মেজো শ্যালক আর ছোট শ্যালক গাড়ী চালাচ্ছিল। পেছনের সীটে আমার স্ত্রী, শ্বশুরমশাই, মেজো শ্যালকের স্ত্রী আর দুটো ছোট বাচ্চা। বাড়ী থেকে বেরনোর সময়ে জানতে পেরেছিলাম যে, সাতদিন আগে যেহেতু গাড়ি সাভিসিং হয়েছে তাই ব্রেক তত ভালোকরে কাজ করছে না। আমি সে কথার উল্লেখ করতে সবাই বললো ওটা কোনো সমস্যা হবে না। দীঘায় পৌঁছেই একবার মেকানিক কে দেখিয়ে দিলেই হবে।

নন্দকুমার ছাড়বার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা শ্রীকৃষ্ণপুর বলে একটা জায়গার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, ঠিক সেসময় আমাদের গাড়ি সামনের একটা ট্রাককে ওভারটেক করতে গেলো। আমাদের গাড়ীর স্পীড তখন ঘন্টায় প্রায় ৪০ কিলোমিটার। যে রাস্তা দিয়ে গাড়ী যাচ্ছে সেই রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। বেশ এবড়োখেবড়ো। একপাশে পুকুর আর অন্য পাশে ধানী জমি। আমি সতর্ক করলাম গাড়ীর চালক আমার ছোট শ্যালককে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ লরিটাকে ওভারটেক করার সময় গাড়ীর পেছনের চাকা পীচরাস্তাতে ওঠবার সময় হঠাৎ বার্স্ট করে গেলো। গাড়ীটা টলতে টলতে সামনের দিকে এগোতে থাকে। ব্রেক করবার চেষ্টা করেও কোনোও লাভ হয় না কারণ ব্রেকটা গন্ডগোল করছিলো আগে থেকেই।

গাড়ির টালমাটাল অবস্থা, আমি চিৎকার করছি ব্রেক কষার জন্য, কিন্তু হাজার চেষ্টা করা সত্ত্বেও ব্রেক ধরলো না। আমি দেখছি গাড়িটা পাগলের মতো টলতে টলতে ডানদিকে সরে যাচ্ছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়িটা ডানদিকে উল্টে গড়াতে গড়াতে পাশের জল ভর্ত্তি পুকুরটাতে গিয়ে পড়ল। আমি চিৎকার করে বাচ্চা দুটোকে বার করার কথা বললাম। কিন্তু আমার কথা অন্ধকারে পাঁকের মধ্যে দেবে গেল। আমার মুহূর্তের মধ্যে সকলের কথা, অফিসের কথা মনে পড়ল। তারপর জানি না। চোখ নিকষকালো অন্ধকারে ডুবে গেল। কিছুক্ষণ জ্ঞান ছিল না। জ্ঞান ফিরতে দেখি আলো দেখা যাচ্ছে। পুকুরে পাঁক থাকার জন্য আমরা ডুবে যাইনি। পরে দেখেছিলাম বাঁ দিকেও একটা পুকুর ছিলো, সেটায় পড়লে আর দেখতে হতো না। প্রায় ছ-সাত মানুষ সমান জল। একেবারে ডুবে যেতাম, কারুর বাঁচার আশা থাকতো না।

যাই হোক, পাশের মাঠে কয়েকজন কাজ করছিলেন আর একটা ক্লাব ছিল সেখানের কিছু ছেলে দৌড়ে এসে গাড়ির উইন্ড স্কীন ভেঙে আমাদের বার করলো। আমি যেহেতু বাঁদিকে জানালার ধারে ছিলাম আর গাড়িটা ডানদিকে কাৎ হওয়ার ফলে আমি ছিটকে গিয়ে স্টিয়ারিং য়ের নীচে গিয়ে পড়লাম, আমার একটা হাত স্টিয়ারিঙের চাকার রডের মধ্যে আটকে গেল।
ভাগ্য ভালো কারুর কিছু হয় নি। শুধু শ্বশুর মশায়ের বুকে চাপ লেগেছে আর বৌঠানের বাঁ হাতটা একটু কেটে রক্ত পড়ছিল। আমি গাড়ির ভিতর থেকে বেড়িয়ে আগে গাড়িটাকে পুকুর থেকে তুলিয়ে দুই শ্যালককে গাড়ির সঙ্গে পাঠালাম তমলুক আর লালদিঘিতে যেখানে গাড়ি সারানো আর গাড়ির বডি রিপেয়ারিং হয়।

আমার মুখ থেকে শুধু পাঁক বের হচ্ছে। অন্য একটা পুকুরে নেমে নিজেকে পরিষ্কার করে ওদের সকলকে নিয়ে ওই ক্লাবটাতে উঠলাম। জামাকাপড় সব ভিজে গেছে। কোনো রকমে শ্রীকৃষ্ণপুর বাজার থেকে মেয়েদের জামাকাপড় কিনে আনলাম। খাবার কিছু নেই। সকাল ১১-২৪মিঃ দুর্ঘটনা ঘটেছে সেই থেকে সন্ধ্যে ৬-৩০মিঃ পর্যন্ত না খাওয়া বাচ্চা দুটো খুব কাঁদছে। ৭টার সময় দেখি আমার ছোটভাই দুই শ্যালককে একটা জীপ গাড়ি করে নিয়ে হাজির। কি … না, দীঘা যাবে। সেই অবস্থায় দীঘা যাওয়া হল। দু’দিন পরে বাসে কলকাতায় ফিরে এলাম।

বড় বাঁচা বেঁচে গেছি সেদিন ইশ্বরের কৃপায়।

লেখক পরিচিতি

 

 

অঞ্জন বসু চৌধুরী

কর্মাসে স্মাতক ও এম বি এ পাস করে চাকুরি জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও গান এবং গল্পের বই পড়া অঞ্জন বসু চৌধুরীর অন‍্যতম নেশা। এক সময়ে অসম্ভব সুন্দর মাউথ অরগ‍্যান বাজাতেন।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. এই এক গাড়ি ছিলো – অ্যাম্বাসাডর ! নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা হয়তঃ ছিলো না, কিন্তু আজকের দিনের যে কোনোও ‘অত্যাধুনিক’ গাড়ির থেকে সহস্রগুণ বেশী আরামদায়ক, মজবুত ও সর্বোপরি নিরাপদ ছিলো। কে বলতে পারে, সেদিন অ্যাম্বাসাডরের জন্যেই লেখকের প্রাণরক্ষা হয়নি ?

Leave a Reply to Anjan Bose Chowdhury Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!