Home সামাজিক, গল্প মনের হিসেব
সামাজিকগল্প

মনের হিসেব

লেখিকা : জয়শ্রী বোস


 

মানুষ ভাবে এক আর ঘটে একদম অন্য কিছু। তাওআশায় বাঁচে চাষা”- মতো নীলাও ভেবেছিলো, আজ থেকে বাহান্ন বছর আগে নতুন বউ হয়ে, এই সংসারের হাল ধরার সময় থেকে কিছু মাস আগে অবধি যেমন ভাবে কায়িক পরিশ্রমে ঘর বাইরের সব কাজ সামলে এসেছে এখনও তেমনভাবেই সব কিছু সামলে নিতে পারবে। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিলো। ছেলেবৌমা, মেয়েজামাই, নাতিনাতনি সবাইকে নিয়ে তার জীবন কেটে যাচ্ছিলো নানা ওঠাপড়া, ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে দিয়ে

সময়ের সাথে সাথে বয়স ধীরে ধীরে ডালপালা মেলছিলো ‍‌স্বাভাবিক নিয়মে। উনিশ বছরে বিয়ে হয়ে আসা নীলা এখন সত্তর ছুঁই ছুঁই নীলা দেবী। বাহান্ন বছরের বিবাহিত জীবন নানা ঘাত প্রতিঘাত, দুঃখ সুখের মেলবন্ধনে গতানুগিতক ভাবে কেটে গেছে। পেছনে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা যখন অবসর সময়ে বসে বসে ভাবেন তখন নিজেরই অবাক লাগে কেমন ভাবে ঘরের বাইরের সমস্ত কাজ শ্বাশুড়ির সাথে হাত মিলিয়ে তিনি নিজেও সামলেছেন; আবার প্রয়োজনে স্বামী কে বাইরের কাজে সাহায্য করতেও পেছপা হননি। আজকাল কেন জানিনা, নিজের শরীর নিয়ে একটু বেশীই চিন্তিত থাকেন। বোধহয় বয়সের সাথে সাথে মনের জোরও কমতির দিকে। নীলার সবথেকে বেশী মনের জোরের জায়গা ছিলো তার স্বামী সুশোভন। নীলার নিস্তরঙ্গ জীবনে প্রথম ধাক্কা এক আকস্মিক পথ দূ্ঘটনায় সুশোভনের হঠাৎ চলে যাওয়া। নিজেও তিনি সাত মাস অসুস্থতার পর বাড়ি ফেরে সারা শরীরে শুধু ডানপা ছাড়া সবটা প্লেট বসানো। এরকম দুঃসময়েও নীলা তার ছেলের কথা ভেবে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে সংসারের হাল ধরেন। মনের কষ্ট ভুলে দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতার মাঝে নিজেকে মানিয়ে নিলেন। কখনো কোনো কিছু নিয়ে অভিযোগ করেননি। এহেন মানুষটি যখন পঁয়ষট্টির পর নিজের শরীর নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন হঠাৎ করে, তখন সবাই তাঁকে মনের জোর দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। 

বিগত দুতিন মাস ধরে তিনি পায়ের সমস্যায় ভুগছেন। যদিও খুব গুরুতর সমস্যা নয়, তাহলেও নীলা দেবী কাবু হয়ে পড়লেন। সব রকম চিকিৎসার পর ফিজিওথেরাপী শুরু হলো। নীলা দেবীর বৌমা নন্দিনী তাকে সব সময় মনের জোর দিলেও তিনি আস্তে আস্তে ভেবে নিচ্ছিলেন যে এবার শরীর ভাঙ্গার পালা। ছেলেবৌমা, মেয়ে-জামাই, নাতিনাতনী কেউই তাকে মনোবল ফিরিয়ে দিতে পারছিলো না। এমন সময় হঠাৎ একদিন নীলা দেবীরা যে পাড়ায় থাকতেন সেই পাড়ায় আঞ্চলিক দুই গোষ্ঠীর মধ্যে গণ্ডগোল শুরু হল। তারই জেরে দু তিনটে পাড়ায় পুলিশ থেকে কারফিউ জারি করলো। নীলা দেবীর বাড়ির দুই কাজের লোকই দুর্ভাগ্যক্রমে ওই তিনটি পাড়ার মধ্যে একটির বাসিন্দা। তাই স্বাভাবিক নিয়মেই তারা কাজে আসতে পারল না। নীলা দেবীর বাড়িতে সবাই একটু চিন্তার মধ্যে পড়লো। নন্দিনী স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষিকা। সে এগারোটা নাগাদ স্কুলের জন্যে বেরিয়ে পড়ে। প্রথমে ঠিক হল যে সে বাড়ীর কাজ সেরে স্কুলের জন্যে বেরিয়ে পড়বে কিন্তু পরে সে ঠিক করলনা, থাক! দুতিন দিন, না হয় ছুটিই নিয়ে নেবে। প্রথম দিন সেভাবেই কাটলো, সারাদিন নীলা দেবী অত্যন্ত অস্থিরতার মধ্যে কাটালেন। তাঁর সারাক্ষণ মনে হতে থাকল যে সব নন্দিনী কে একা সামলাতে হচ্ছে সেখানে তিনি শুয়ে বসে রয়েছেন। একটু সাহায্য যদি করতে পারতেন তাহলে হয়ত তার বউমার ওপর এতখানি চাপ সৃষ্টি হত না। কেউই নিয়ে কোনো অভিযোগ না করলেও নীলা দেবী নিজের মনেই অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। দিনের শেষে এই ভাবনা ভাবতে ভাবতে তিনি একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন

পরের দিন সকালবেলা, নীলা দেবী অনেক ভোরে উঠে চা করে ছেলেবৌমাকে ডাকেন বেশ কিছুমাস আগের মতো।  ঘুম থেকে উঠে দুজনেই অবাক হয়ে গেলো এতদিন পরে মাকে চা করতে দেখে ছেলে সোহম প্রথমে অবাক হলেও পরে খুব খুশি হলবহুদিন বাদে মা চা করে ডাকলো। নন্দিনী ব্যস্ত হয়ে বললো, “আমি তো এক্ষুনি উঠেই চা করতাম তুমি আবার কেন চা করলে!” নীলা দেবী বললেন, “তোরা কোনো চিন্তা করিস না আমি ঠিক পারবো কাজ করতে। তোরা ব্যস্ত হোস না।যেমন কথা তেমন কাজ সারাদিন বৌমাকে নানা কাজে তিনি সাহায্য করলেন। দুপুরবেলা এসে যখন নিজের ঘরে শুলেন, মনে হল পায়ের ব্যাথাটা আবার বোধহয় চাগাড় দিল। তিনি নিজেও অবাক হয়ে গেলেন এই ভেবে যে, যতক্ষণ কাজের ভেতর ছিলেন ততক্ষণ অবধি তিনি কিছু অনুভবই করতে পারেন নি! তাহলে এখন আবার কেন এমন মনে হচ্ছে, এখন তো তিনি বিশ্রাম করছেন! তাহলে কি সবটাই মনের অপর নির্ভর! কাজের মাঝে পা নিজের শরীর নিয়ে ভাবার অবকাশ পাননি তাই ব্যথা অনুভব করেননি। নিজেই নিজেকে বোঝালেন যে, শরীরের নাম মহাশয় যা সহাবে তাই সয়

রাত্তিরে নন্দিনী এসে দুবার খবর নিল ব্যথা বেড়েছে কিনা। শুধু সে নয়, বাকিরাও তার খোঁজ করলো ফোন করে। তিনি সবাইকেই আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে, তিনি একবার সেঁক নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে

নীলা দেবী এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। কাজের লোক এসেছিল আরোও দুদিন বাদে। এলাকায় গণ্ডগোল মিটে গেলেও গুণ্ডাগিরি শাসানির ভয়ে কেউ পাড়া ছেড়ে বেরোতে পারছিলো না। নীলা দেবী কিন্তু বাড়ির সবাইকে অবাক করে দিয়ে সব কাজ যে নিজেই সামলালেন তাই নয়, বউমাকেও জোর করে স্কুলে পাঠালেন। 

কারণ, আজ তিনি বুঝেছেন মনই মানুষের সব ভালো থাকার উৎস। নীলা দেবীর কাছে এখন থেকেমনের নাম মহাশয়, যা সহাবে তাই সয়

সমাপ্ত

 

 

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. Khub bhalo laglo,tomader “du-kolom”kunri theke mohiruhu hoye charidike dalpala bishtar koruk. Sobai bhalo theko.

    1. setai bolo jeno amra teen bhaibon nijeder moner moto kore blog ta sajate pari ….sob aponjon der sahajje

      1. খুব ভালো লেখা। এই মনোবলটাই আসল। লেখাটা অনেককেই অনুপ্রেরণা দেবে।👌👌

  2. Maima, tomake janai antarik kritagnata o pronam. Valo theko. Anekdin dekhi ni tomay . Anjan

    1. ma er hoye ami i uttor dilam kaku,,,,tomader kotha ma khub bole..ma ke bolechi aro likhte…pronam nio,

  3. Khub bhalo laglo mashima lekhata pore, ami Sudeshna r Bondhu….akdom thik kotha likhechhen, moner oporei sab kichhu nirbhor kore, mon i amader chalay….seijonnyo sabsamay bhalo thakun, hasi khushi thakun, ei kamona kori…amar pronam neben.

    1. khub sundor likhli re susmita… ma khub khushi sobaier kotha sune ar inspired o…..aro likhbe bolche.

Leave a Reply to sudeshna mitra Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!