Home প্রবন্ধ মহাসূর্য
প্রবন্ধ

মহাসূর্য

কলমে: অরুণিমা

(১)

কপিলাবস্তু নগর।

মহা ধুমধামে বার্ষিক হলকর্ষণ উৎসব আয়োজিত হয়েছে। ঐ দিন রাজা ও অমাত্যরা নিজের হাতে লাঙ্গল চালিয়ে সারাবছরের কৃষিকার্যের সূচনা করে থাকেন। শাক্যরাজ শুদ্ধোদন তাঁর শিশুপুত্রকে নিয়ে উৎসবে যোগ দিলেন। রাজকুমার তার পোষা খরগোশ, মৃগ শাবক, ময়ূর, মরালদের সাথে ক্রীড়ারত থাকাকালীন প্রত্যক্ষ করল, হলকর্ষণের সময় ভেজা মাটি থেকে নির্গত কীটদের ভক্ষণ করছে একটি ভেক। আবার সেই ভেকটিকে মুহূর্তে গলাধঃকরণ করল এক সাপ। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া পরপর এই ঘটনায় রাজকুমার অতীব উদ্বিগ্ন। উৎসবের কোলাহল থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিল। বেঁচে থাকার জন্য প্রাণীকুলে এমন নিষ্ঠুরতার কথা ভাবতে ভাবতে এক বিশালাকার জম্বুবৃক্ষের ছায়ায় বসে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হলো সে।এদিকে হলকর্ষণ উৎসব শেষে তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়না। সহসা রাজকুমারের খেলার সাথীরা জম্বুবৃক্ষের ছায়ায় ধ্যানমগ্ন জ্যোতির্ময় আভায় উদ্ভাসিত এক অবয়ব লক্ষ্য করে বিস্ময়ে অভিভূত হলো। রাজা শুদ্ধোদন স্মরণ করলেন সেদিন বৈশাখী পূর্ণিমায় লুম্বিনী উদ্যানে উচ্চারিত হওয়া ঋষি অসিতের ভবিষ্যদ্বাণীটি, ”এই বালকশিশু বোধির জন্য জগতের হিতকামনায় জন্মগ্রহণ করেছে। সংসারে এটিই এই বালকের অন্তিম উৎপত্তি।”

(২)

রাজগৃহ নগর। (বর্তমান রাজগীর)

রাজা বিম্বিসার মাগধী প্রজাগনের মুখে শ্রবণ করলেন বৈশালী নগর থেকে আগত সম্যক জ্ঞানী এক আশ্চর্য সন্ন্যাসীর কথা। রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ জানালেন তাঁকে। রাজা বিম্বিসার প্রত্যাখ্যাত হলেন। সন্ন্যাসী রাজাকে জানালেন, “যদি কখনও সত্যের সন্ধান পাই, তবে অবশ্যই রাজার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করব। তার পূর্বে নয়।” রাজাও থামার পাত্র নন। আয়োজন করলেন এক মহা যজ্ঞানুষ্ঠানের। এক সহস্র মেষ বলি হবে সেই যজ্ঞে। প্রজামুখে আনীত সেই সংবাদে বিচলিত সন্ন্যাসী ছুটে গেলেন রাজপ্রাসাদে। মুখোমুখি মগধরাজ বিম্বিসার ও প্রাণশক্তির মন্ত্রে সদা জাগ্রত সেই সন্ন্যাসী। শান্ত ধীর স্বরে বললেন,”দন্ডকে সবাই ভয় পায় হর্ষঙ্ক রাজ! জীবন সকলের প্রিয়। মৃত্যুভয়ে সকলেই সন্ত্রস্ত। সুতরাং নিজের সাথে তুলনা করে কাউকে প্রহার বা আঘাত করবেন না। করুনা ছাড়া কেউ আলোকিত হতে পারে না। আপনি তো ভারতসম্রাট! মানুষ, পশু, পক্ষী সকলই আপনার সন্তানসম। এদের রক্ষা করাই আপনার ধর্ম, কর্তব্য।”

রাজগৃহ নগরে মহারাজ বিম্বিসার সেই সন্ন্যাসীকে ধর্মগুরুর মান্যতা দিয়ে মেষ বলি থেকে বিরত হলেন। স্থাপিত হলো এক পরম বন্ধুত্ব। সন্ন্যাসী প্রতিশ্রুতি দিলেন সত্যান্বেষণ সম্পন্ন হলে পুনরায় রাজগৃহে ফিরে আসবেন।

(৩)

বৈশাখী পূর্ণিমা।

উরুবিল্ব গ্রাম (বুদ্ধগয়া)।

নৈরঞ্জনা নদীতীরে (ফল্গু) অশত্থ বৃক্ষের তলায় অনশনক্লিষ্ট দুর্বল দেহে শরীরকে অপরিসীম কষ্ট দিয়ে কঠোর তপস্যায় মগ্ন এক সন্ন্যাসী। নিবেদিতপ্রাণা সুজাতা পরমান্ন নিয়ে অপেক্ষায়। পুত্র সন্তান প্রসব হয়েছে তার। এই সন্ন্যাসীকে দেবতা ভেবে অনন্ত ভক্তি নিয়ে পরমান্ন প্রদান করবে আজ। তপস্বী ওর মনোবাঞ্ছা পূরণ করলেন।

পূর্ণিমা রাত্রির প্রথম যামে তাঁর পূর্বজন্মের জ্ঞান লাভ হলো। দ্বিতীয় যামে দিব্যচক্ষু বিশুদ্ধ হলো। অন্তিম যামে দ্বাদশ প্রতীত্যসমুৎপাদ।

অরুণোদয়ে বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি।

বো ধি লা ভ!!

(৪)

সারনাথে সম্পন্ন হয়েছে ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন’। আষাঢ় মাসের পূর্ণিমায় পাঁচ শিষ্যকে দীক্ষা দিলেন মহাকারুণিক সন্ন্যাসী। তারপরে অতিবাহিত হয়েছে বহু মাস, বহু বছর।সহানুভূতি, মননশীলতা, অভ্যন্তরীণ শান্তিতে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করেছেন তিনি।

(৫)

কুশীনগর।

বৈশাখী পূর্ণিমা।

হিরণ্যবতী নদীতীরে শাল বৃক্ষের নিচে শায়িত এক সন্ন্যাসী। সম্মুখে উপবিষ্ট শিষ্যদের অন্তিম বাণী প্রদান করলেন, “নিজেই নিজের দীপ হয়ে বিচরণ করো, আত্ম শরণই অনন্য শরণ, ধর্মদীপ হয়ে বিচরণ করো, ধর্মের শরণই অনন্য শরণ।’’

ধ্যানে নিমগ্ন হলেন।

নেত্রযুগল মুদিত হলো।

ম হা প রি নি র্বা ণ!!

বুদ্ধ নামের যে মহাসূর্য শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে উদিত হয়েছিলেন; জগৎকে মুক্ত জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে পুনরায় শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতেই অস্তমিত হলেন।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!