Home বিনোদন, প্রবন্ধ মহানায়কের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
বিনোদনপ্রবন্ধ

মহানায়কের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

অঞ্জন বসু চৌধুরী

মহানায়ক উত্তম কুমারকে আমি প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করব। জমিদার রাজাবাবু অতিশয় দয়ালু এক চরিত্র – “কাহারবা নয় দাদরা বাজাও” গানে মাতিয়ে রাখা এক চরিত্র। নাহলে “কা তব কান্তা কস্তে পুত্রহ”-র সন্ন্যাসী। একদিকে অসাধারন দয়ালু রাজার ভূমিকায় আর অন্যদিকে সব হারানো এক সন্ন্যাসী যে জীবনের সব সুখ দুঃখ থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। আবার এই দয়ালু রাজা ই বদলে যান জাদরেল জমিদারি মেজাজে স্ত্রী ছবিতে।

“হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা রাতটাকে যে দিন করেছে” – মান্না দে যদি গানে মাত করেন, তাহলে উত্তমকুমার তাঁর অভিনয় গুণে সত্যিই রাতকে দিন করেছিলেন। 

অন্যদিকে স্নেহশীল দাদার রোল সে বিশ্বজিতের সঙ্গে “তারে বলে দিও, সে যেন আসে না আমার দ্বারে” গানে লিপ দেয়ার ভেতরেই হোক আর অনবদ্য কমেডির ছোঁয়া লাগা মৌচাক ছবির “লক্ষ ব্লেডেও কামালে যে, উঠবে না তো গোফঁ আর দাড়ি”-র গায়কীতে রঞ্জিত মল্লিকের দাদাই হোন উত্তম শুধু উত্তম ই। 

কমেডি অভিনয়ের প্রসঙ্গে বলি ওনার অভিনয় দেখি আর মনে হয় কমেডি চরিত্র এত সাবলীল ভাবে কোনো রোমান্টিক নায়ককে এঁর আগে করতে দেখিনি। হিউমারের টাইমিং বিষয়টি খুব ভালো জানতেন। মৌচাকে মিঠুকে কোনঠাসা করা থেকে শুরু করে, বিকাশ রায়কে ‘ছদ্মবেশী’-তে, পাহাড়ী স‍্যানাল আর তনুজাকে ‘দেয়া নেয়া’-তে যেভাবে টক্বর দিয়েছেন, তা প্রশংসার দাবি রাখে।

রোমান্টিক নায়ক হয়ে প্রেমের অভিনয়ে উনি তো সবার শীর্ষে। সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী, সাবিত্রী চ্যাটার্জী, মাধবি মুখার্জী, অপর্ণা সেন, তনুজা – সবার সঙ্গেই স্বচ্ছন্দে অভিনয় করেছেন। তাঁর মুখের ভাব আর আবেগে মনে হতো না, তিনি অভিনয় করছেন।

সবারই খুব প্রিয় ছিল ‘হারানো সুর’ ছবির “তুমি যে আমার” বা ‘সপ্তপদী’-র “এই পথ যদি না শেষ হয়”, ‘ইন্দ্রাণী’-র “নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়” সব মিলিয়ে দর্শককে অন্য জগতে নিয়ে যেতেন উত্তম কুমার।

ড্রাইভার গৌরহরি এবং সিঙ্গার অভিজিৎ চৌধুরীর দুরকম আলাদা অভিনয়ে অনবদ্য উত্তমকুমার। আজও ভেবে পাইনি কতখানি চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হলে ‘অমানুষ’ ছবির “বিপিন বাবুর কারণ সুধা”-র পাশাপাশি “কি আশায় বাঁধি খেলাঘর”-এর অভিনয় সুরে বাঁধা পড়ে।

শেষের দিকে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’-র “এই তো জীবন”, যেমন অনবদ্য তেমন “আমি একজন শান্তশিষ্ঠ পত্নী নিষ্ঠ ভদ্রলোক”-তে হালকা বিদ্রূপ মনে রাখবার মতো।

তৎকালীন দিকপাল অভিনেতারা যেমন – কমল মিত্র, ছবি বিশ্বাস, জহর গাঙ্গুলী, পাহাড়ি সান‍্যাল, অসিতবরণ যদি বাংলা ছবির জগত কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁদের পাশেও উত্তম কুমার অত‍্যন্ত সাবলীল। এই স্বাভাবিক অভিনয়ই তাকে মহানায়কের শিরোপা এনে দেয়।

দানধ‍্যান প্রচুর করেছেন কিন্তু প্রচারের ঊর্ধ্বে ছিলেন। বিশেষ করে স্টুডিওর সহকর্মীদের পাশে দরকারে সবসময় দাঁড়াতেন। বন্যার ত্রাণে নিজে বেরিয়ে গরীব-দুঃখীদের জন্য টাকা তুলে দিয়েছিলেন। ‘শিল্পী সংসদ’ ওনারই তৈরী। লিভিং লেজেন্ড সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন যে, উত্তমদার অভিনয় ওনাকে অনুপ্রাণিত করেছে সব সময়। উত্তম কুমারের ভাই তরুণ কুমার বলতেন, দাদার তুলনা দাদা নিজেই। যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন সেটার মধ্যে ঢুকে যেতেন। তার রেশ বহুক্ষন থাকতো। সবসময় তাঁর অভিনীত চরিত্রের প্রতিফলন খুঁজতেন তিনি এমনই শোনা যায়। এটাই ওনাকে সকলের থেকে আলাদা করেছিল। 

তাড়াতাড়ি চলে গেলেন সেটাই খুব আক্ষেপ আমার। আরো অনেক কিছু দেওয়া বাকী রয়ে গেলো।

আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি উত্তমকুমারের স্মৃতিতে একটু অন্যভাবে।

লেখক পরিচিতি

 

 

অঞ্জন বসু চৌধুরী

কর্মাসে স্মাতক ও এম বি এ পাস করে চাকুরি জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও গান এবং গল্পের বই পড়া অঞ্জন বসু চৌধুরীর অন‍্যতম নেশা। এক সময়ে অসম্ভব সুন্দর মাউথ অরগ‍্যান বাজাতেন।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. উত্তম উত্তমই। তাই তো, মৃত্যুর ৪০ বছর পরেও তিনি সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

Leave a Reply to SRIJIT MITRA Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!