লেখিকা : সুলগ্না রায়
বছর দশেক বয়স তখন আমার। শনিবার স্কুল ছুটি কিন্তু মায়ের তো স্কুলে যেতেই হবে। অগত্যা মায়ের সাথে অশোকনগর যাওয়া আবার মায়ের সাথে ফেরা। সপ্তাহে পাঁচ দিন নিজের স্কুল আর একদিন মায়ের স্কুল। এই ভাবেই রুটিন তৈরি হয়েছিল।
শনিবার বিকেলে ডাউন বনগাঁ লোকাল ভিড়ে ঠাসা। মেয়ের হাত ধরে মা দাঁড়িয়ে আছে লেডিস কম্পার্টমেন্টে উঠবে বলে আর মুখে বুলি আউড়ে যাচ্ছে প্রতি শনিবারের মতো। “রড ধরে লাফ দিয়ে উঠে পড়বি, ভেতরে ঢুকে যাবি, আমি যদি না উঠতে পারি —- “ইত্যাদি ইত্যাদি। রোজ এক কথা বলে মা। আরে আমি তো ট্রেনে উঠতে শিখে গেছি। ট্রেন এসে দাঁড়ালো; লোক নামলো; রড ধরে লাফ দিয়ে আমি ট্রেনে উঠে পড়লাম; ভেতরেও চলে গেলাম। কিন্তু মা কই??? ট্রেন যে ছেড়ে দিলো। মা — মা — ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। বুকের ভেতরটা মুচড়ে দলা পাকিয়ে এল। জামা ভিজে যাচ্ছে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলে। আমার মা কোথায় গেলো??
তখন মোবাইল ফোন যেমন ছিল না, পৃথিবীটা এতটা ভয়ানকও ছিল না বোধহয় নাকি অদৃশ্য থেকে আমার আরেক মা মাথায় স্পর্শ দিয়েছিলেন জানিনা ।একজন মাতৃসমা মহিলা আমায় কোলে টেনে নিয়ে জানতে চাইলেন কি হয়েছে। বলে ফেললাম, “হারিয়ে গেছি আমি”। শহুরে স্কুলের সপ্রতিভতা আর মায়ের শেখানো সব নামধাম খোঁজখবর যথাযথ বলতে পারায় ইম্প্রেসড ওই মহিলা কিছুক্ষণের জন্য আমার অভিভাবক হয়ে গেলেন। পরম যত্নে নিজে এসে আমায় বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেলেন, অপেক্ষা করলেন মায়ের জন্য। পরের ট্রেনে মা ফিরলে মায়ের কাছে কন্যা সমর্পণ।
বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনেকবারই আমি হারিয়ে গেছি নানানভাবে, কিন্তু ছেলেবেলায় আক্ষরিক অর্থেই হারিয়ে যাওয়ার ভয়টা আজও মনে পড়ছে।
ভালো লাগলো