Home বিনোদন, প্রবন্ধ বর্তমান সময়ে বিনোদনের দুই মাধ্যম
বিনোদনপ্রবন্ধ

বর্তমান সময়ে বিনোদনের দুই মাধ্যম

সঞ্চারী গোস্বামী মজুমদার

ভূমিকা

আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাতে কাজের চাপ অনেকটাই বেশি। এই চাপ শুধু অর্থোপার্জনের নয়,বরং নিজেদের জীবনকে সব দিক দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লড়াইতে আজ মানব সমাজ মগ্ন। তাই খুব সহজেই একঘেয়েমি চলে আসে জীবনে। “বিনোদন” আমাদের জীবনে নিয়ে আসে একঘেয়েমি কাজের থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস। অনেকেই বিভিন্নভাবে তাদের অবসর সময় কাটান। কেউ বই পড়েন, গান শোনেন, আবার কেউ কেউ রান্না করতে ভালোবাসেন। কিন্তু এতসব কিছুর মধ্যেও বিনোদন জগতের দূরদর্শন অর্থাৎ টেলিভিশন এক নম্বর স্থানে আছে। এই মাধ্যম এর মাধ্যমে দূর-দূরান্তের খবর আমরা যে ঘরে বসে শুধু দেখতে পাই তা নয় বরং আরো কিছু অনুষ্ঠান ও উপভোগ করতে পারি। টেলিভিশন সিরিয়াল অর্থাৎ ধারাবাহিক এর মধ্যে অন্যতম। এই অনুষ্ঠান আমরা সপ্তাহে ৫ থেকে ৭ দিন দেখতে পাই এবং বিভিন্ন চ্যানেলে আমরা অনেক ধরনের গল্পের ভিত্তিতে তৈরি ধারাবাহিক দেখতে পাই।

আমাদের ভারতবর্ষে দুই দশকের বেশি এই মাধ্যম দর্শকদের আনন্দ প্রদান করে চলেছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে আমরা আর একটা নতুন বিনোদনের মাধ্যমে সঙ্গে পরিচিত হয়েছি যার নাম ওয়েব সিরিজ। এটি ইন্টারনেট যোগাযোগ ছাড়া দেখা সম্ভব নয়। এই ধরনের বিনোদনের মাধ্যম আমাদের দেশে নতুন হলেও খুব অল্পদিনের মধ্যেই দর্শকের কাছে থেকে ভাল সাড়া পাচ্ছে। দর্শক এই নতুন ভাবনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছেন এর ফলে ইদানিং একটি অলিখিত প্রতিযোগিতা হচ্ছে এই দুই মাধ্যমের মধ্যে। দেখা যাচ্ছে প্রবীনদের পছন্দ ধারাবাহিক এবং নবীনদের ঝোঁক ওয়েব সিরিজের দিকে। আর এই দুই দলই নিজেদের বিনোদনের মাধ্যম কে শ্রেষ্ঠ মনে করেন। তবে আমাদের মতো কিছু দর্শক আছেন যারা নতুন ধরনের গল্পের প্রতি আকৃষ্ট তা সে ওয়েব সিরিজ হোক বা ধারাবাহিক। বর্তমান সময়ে আমরা সবাই কম বেশি ঘর বন্দী হয়ে আছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই ঘরে বসে কাজ করছেন আবার কেউ কেউ গৃহবন্দীই হয়ে আছেন শুধু। বাইরে দরকার ছাড়া বেরোনো যাচ্ছে না। তার সাথে নানান ধরনের চিন্তায় চিন্তিত হয়ে থাকা। এই সময় মনের মত বিনোদনের দরকার সব থেকে বেশি বলে আমার মনে হয়।

সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ

টিভি সিরিয়াল আমাদের রোজকার জীবনে একটা অংশ হয়ে উঠেছে। এই পারিবারিক অনুষ্ঠান আমাদের সবার মন কেড়েছে। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে আমরা বিনোদনকে এক নতুন ভাবে দেখতে পাচ্ছি যার নাম ওয়েব সিরিজ। হ্যাঁ, যেটা ইন্টারনেটের সাহায্যে আমরা যখন তখন আমাদের সুবিধা মতন দেখতে পাই। আমি দেখতে পাচ্ছি এই ওয়েব সিরিজ বেশিরভাগ অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের বেশি পছন্দ। তার প্রধান কারণ হচ্ছে সময়। সিরিয়াল চলে অনেকদিন ধরে। নতুন নতুন চমক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এবং সময় সময় সেটা একঘেয়ে হয়ে ওঠে। কিন্তু ওয়েব সিরিজ তা নয়। খুব অল্প সময়ে নতুন ধরনের গল্প নিয়ে এবং সেই গল্পগুলিকে বাস্তবের সাথে মিল রেখে কিছু নতুন – পুরনো মুখ আমাদের সামনে আসে সিরিজে। সিরিয়ালও কিছু কম যায় না। তারাও আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে নতুন ধরনের গল্প নিয়ে দর্শকের কাছে পৌঁছাতে। তাই একটা পছন্দের তফাৎ রয়ে যাচ্ছে। আর নবীন ও প্রবীণ এই দুই বিনোদন মাধ্যমের মধ্যে একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব আমরা অনুভব করতে পারি। ভারতের সর্বত্র এই ওয়েব সিরিজ আজ জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছেছে। বাংলাও বিনোদনের দুনিয়ায় সমানভাবে এগিয়ে চলেছে তালে তাল মিলিয়ে। আমি একজন দর্শক হয়ে নিজের মতামত এই দুই বিনোদনের মাধ্যমকে নিয়ে প্রকাশ করছি একে একে।

টিভি সিরিয়াল

টিভি সিরিয়ালের গল্প তৈরি করা হয় একটা পরিবারের একতার কথা মাথায় রেখে এবং যাই হোক সেই একতা ও ভালোবাসা সবসময় বজায় করার চেষ্টা থাকে শেষ অব্দি। এই সিরিয়াল আমাদের সমাজের মেয়েদের জীবনে বিভিন্ন সংগ্রামের কথা তুলে ধরেছে। কিন্তু মাঝে মাঝে পরকীয়া, বিরোধীর কৌশল, এই রকম একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি- সিরিয়ালকে  নিরস বানিয়ে ফেলে এবং দর্শক তাদের কৌতূহল হারিয়ে ফেলে। তার উপরে এই সিরিয়াল অনেক সময় দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে এবং কখনও কখনও আমরা কয়েকটি চরিত্রের সাথে বাস্তবের মিল পাইনা। বেশি মেকআপ আবহসংগীত কিছু প্লট এবং  সাবপ্লট এত বেশি একঘেয়ে ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে যে দর্শকদের কটাক্ষের শিকার হতে হয়। অনেক সময় নায়িকাকে দেখা যায় বেশিমাত্রায় প্রতিপক্ষের হাতে হেনস্থা হতে যা বাস্তবজীবনে অসম্ভব।

আর কখনও সখনও এই প্রতিপক্ষ প্রয়োজনের থেকে বেশি খারাপ হয়ে থাকে যেটা গ্রহণযোগ্য হয় না। সিরিয়াল অনেক বেশি পারিবারিক ঘটনা দেখায়। যার দুটি দিক আছে। এতে পরিবার একসাথে বসে সময় কাটায় আর আমাদের সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন করে। বিভিন্ন দিক দিয়ে এই সিরিয়াল ও সিরিয়ালের বেশ কিছু চরিত্র অনেক মানুষকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। কিন্তু শুধুই পারিবারিক ব্যাপার গুলি প্রধান না করে অন্য কেউ যদি আরও জোর দেওয়া হতো তাহলে হয়তো মানুষ আরো বেশি আনন্দ ও শিক্ষা দুই পেত। বাংলার মানুষ আজও সিরিয়াল কে পছন্দ করে তার কারণ এখন এই সিরিয়াল গুলি অনেকটাই আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বা সে চেষ্টা করে। কিন্তু তাও নবীনদের মন পেতে এবং একঘেয়েমি প্লট গুলি বদল করলেই দর্শকদের মনে দাগ কাটতে মারবে বাংলা সিরিয়াল। আর তা না হলে দর্শক হিসেবে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে বাংলা সিরিয়াল এর ভবিষ্যৎ নিয়ে।

 

ওয়েব সিরিজ

 ইন্টারনেটের যুগে আজ কোন কিছু করাটাই খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়। এবং বিনোদনের ক্ষেত্রেও যে ইন্টারনেটের অবদান আছে সেটা অনস্বীকার্য। ওয়েব সিরিজ মানে ইন্টারনেটের বিভিন্ন চ্যানেলে হওয়া অর্থাৎ ছোট ছোট সিরিয়াল। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সময় বা ইচ্ছা কোনটাই থাকে না টিভি সিরিয়াল দেখার জন্য। আর তার উপরে সিরিজে একটু অন্য ধরনের ঘটনা দেখানো হয়। এতে অনেক সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প বানানো হয়।

অনেক নতুন মুখ কাজ করে পুরনো সিরিয়াল সিনেমার অভিনেতাদের সাথে মিলে। বেশিরভাগ গল্পের সাথে আমরা বাস্তবের মিল পাই এবং কাল্পনিক গল্পকে দেখানো হয় খুব সুন্দর করে যাতে দর্শকের মন খুব সহজেই পাওয়া যায়। এক লাইনে বলতে গেলে ওয়েব সিরিজে খুব প্রয়োজন বুঝে স্ক্রিপ্ট লেখা হয় যাতে গল্প গুলি ভালোভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।

এত সবের মধ্যেও কিছু এমন জিনিস আছে যা ওয়েব সিরিজে দেখাবার ফলে দর্শকের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে অনেক সিরিজেই এমন ভাষা ব্যবহার করে যেটার একটা খারাপ প্রভাব পড়ে দর্শকের উপর। এছাড়া আপত্তিকর কিছু দৃশ্য বা সম্পর্ক দেখানো বড়দের বা অন্য মানুষের প্রতি রুক্ষ আচরণ এইসব অনেক সময় দর্শকদের মানিয়ে নিতে একটু অসুবিধা হয়। আর একটা বিষয় হলো অসম্পূর্ণ গল্পের সমাপ্তি। অনেক সিরিজ গল্পের শেষ করেও করেনা। সেটা অনেক সময় ভালো লাগে আবার অনেক সময় দর্শকের উৎসাহ কে নষ্ট করে দেয়। আমার মনে হয় যে সব গল্পের দ্বিতীয় সিজিন  হয় না বা অনেক বেশি দেরি হয়। তার থেকে তাদের প্রথম গল্পকে শেষ করলেই দর্শক বেশি আনন্দ পাবে। আর তা না হলে দ্বিতীয় সিজন বেশি দেরি না করে দেখানো হলে গল্পের লিংক দর্শকের মনে থেকে সরে যাবে না আর তারা উপভোগ ও করবে অনেক বেশি।

নিজস্ব মতামত

বর্তমান সময়ে আমরা সিনেমা দেখলেও অনেক সময় অল্প সময় থাকার কারণে সিরিয়াল বা সিরিজ দেখে থাকি আমরা। এর প্রধান কারণ হল এই দুই মাধ্যমের গল্প গল্প প্রকাশের নিজস্ব ধরন যা মানুষকে আকৃষ্ট করে থাকে এবং আনন্দও দেয়।আমার মনে হয় বাংলার একজন মানুষ হয়ে আর পাঁচজন দর্শকের মতো আমিও সিরিয়াল ও সিরিজ দুটোই খুব ভালো করে উপভোগ করি। আমার এই দুই মাধ্যমের খারাপ দিক গুলো আমায় নিরাশ করে। বাংলায় অনেক নতুন প্রতিভা আছে যাদের চেষ্টায় সিরিয়াল অনেক বদলেছে আর ওয়েব সিরিজের মত এমন এক ডিজিটাল বিনোদনের মাধ্যমিকে আমরা পাচ্ছি। আমি এটা মনে করি যে বাংলায় প্রতিভার অভাব নেই এবং এই ভাবে কাজ করতে থাকলে বাংলা টিভি সিরিয়াল ও ওয়েব সিরিজ বাংলার গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা ভারত তথা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছাবে এবং সমস্ত দর্শকদের আনন্দ দেবে। তার জন্য এক দিকে যেমন নতুন বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে তেমনি এমন কিছু করা উচিত যেটা মানুষকে সচেতন ও শিক্ষিত করে। তবে সবার আগে যা যা কারণে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে দর্শকদের কাছে বা যেটা দেখতে দর্শক অস্বস্তি বোধ করে সেটা যদি কমে যায় তাহলে আরো ভাল হবে।

উপসংহার

লকডাউন যতদিন চলবে ততদিন মানুষ অনেক বেশি বিনোদনের দ্বারস্থ হবে নিজেদের মনকে ভালো ও কিছু সময়ের জন্য চিন্তা মুক্ত রাখার জন্য।আজ আমি একজন বাংলার মানুষ হয়ে এটা বলতে পারি যে আমাদের বাংলা বিনোদনের দুই মাধ্যমেই আমাদের আনন্দ দিতে যথেষ্ট সক্ষম। নিজেদের মতন করে তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে এবং আমি গর্বের সাথে বলতে পারি যে প্রতিযোগিতা হলো দুজনে একে অপরকে টেক্কা দিচ্ছে যাতে আমরা ভালো সিরিয়াল বা ওয়েব সিরিজ দেখতে পাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আগামী দিনেও আমরা আরো ভালো এবং নতুন ধরনের গল্প এই দুই মাধ্যমের থেকে পাব।এবং এর থেকে আমাদের বিনোদনের কোনরকম অভাব ঘটবে না বরং নবীন ও প্রবীণ  এই দুই দলই বিভেদ ভুলে উপভোগ করবে বিনোদনের এই দুই মাধ্যমকে।

লেখিকা পরিচিতি
 
 
 
 
 
 
 
Sanchari Goswami Majumdar
 
Loves to teach and practice dance. Likes to read books.

Author

Du-কলম

Join the Conversation

Leave a Reply to Srijit Mitra Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!