Home বিবিধ, প্রবন্ধ ভালো মেয়ে
বিবিধপ্রবন্ধ

ভালো মেয়ে

লেখিকা: ঊর্মি বসুন্ধরা দুহিতা


 

ভালো মেয়ে হওয়ার যে কি অসম্ভব চাপ ছোটবেলা থেকে তা বলার নয়। সারাক্ষণ বুক ধড়ফড় নিয়ে চলতে হবে, ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে, এই বুঝি পিছলে গেলাম ভালো মেয়ের মাপকাঠি থেকে। অঙ্কে শূন্য পেলে বুক ঢিপঢিপ, জ্যামিতি বাক্স, খাতা নিতে ভুলে গেলে ভয়, কান ধরে দাঁড় করালে ভয় বন্ধুদের চাপা হাসির, কম নম্বর পাওয়া খাতা হাপিস করে দিয়েও ভয় যে জানতে পারলে জুটবে উদ্দাম বকুনি, চড়চাপড়। শব্দ করে হাসবে না, দুড়দাড় করে হাঁটবে না, রাস্তায় বখাটেদের মতো আড্ডা মারবে না, মুখে মুখে তর্ক করবে না, চেঁচিয়ে কথা বলবে না ––– ‘না’ এর নামাবলী শুনতে শুনতে প্রাণ যায় যায়। বেয়াদপি নৈব নৈব চ … বাড়িতেও নয়, স্কুলেও নয়। সব জায়গায় আপ্রাণ চেষ্টা কি করে ভালো মেয়ে হবো। প্রেম প্রেম ভাব এলেও প্রকাশ কখনোই নয়, তাহলেই বাড়ির মান মর্যাদা গেল ––– প্রেম করা যে খুব খারাপ কাজ। ভালো মেয়েরা প্রেম করে না।

এই সিলেবাস মুখস্ত করতে করতে, মেনে চলতে গিয়ে কখন নিজের সিস্টেমে মিশে গেল বুঝলাম না। খালি কিছু করলেই ভয়, বুক ঢিপঢিপ থাকল নিত্যসঙ্গী। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ‘ভালো’-র মাপকাঠিটাও পাল্টাতে থাকে। নিজের কাছে, বাড়ির লোকেদের কাছে, আত্মীয়-স্বজন সবার কাছেই সেই মাপকাঠিটা আলাদা আলাদা রকমের চাহিদায় মাপা। স্কুলে থাকাকালীন ‘ভালো মেয়ে’ হওয়ার মাপকাঠি বদলে যায় ভালো রেজাল্ট, ভালো মাইনে, ভালো চাকরীতে। ভালো চাকরী না জোটাতে পারলে এতদিনের ‘ভালো মেয়ের’ তকমা নিমেষে খসে পড়ে সাধারণ হয়ে পড়ে। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকে না। সন্তানদের ভালো, স্বামীর ভালো, শ্বশুরবাড়ির ভালো সবকিছুই যে নির্ভর করে থাকবে আমার ভালোত্বর মাপকাঠির ওপর। একবার গায়ে এই ছাপ পড়লেই হল, আজীবন চলবে এই পরীক্ষা। সংসার জীবনের ভুল সিদ্ধান্তের মাসুলের ক্ষতকে কি অদ্ভুত দক্ষতায় মানিয়ে নিয়ে হাসি মুখে সাজিয়ে গুছিয়ে সবার কাছে হাজির করে এই ভালো মেয়ে হওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা।

জীবনের ওঠাপড়া, মনের খারাপ সময় কোন কিছুই গুরুত্ব পায় না সেই চাহিদার কাছে। সবাইকে খুশি করতে হবে, তুষ্ট করতে হবে, কারুর মুখভার হলেই দমবন্ধ করা ভয়। এই ভয় যে কখন মনের সাথে চিরকালের মতো গাঁটছড়া বাঁধে তা নিজের মনও জানতে পারেনা।

এই insecurity তে ভুগতে ভুগতে যখন দেখলাম কিছুই ‘ঠিকমতো’ হল না, কোন কিছুর আগে ‘ভালো’ তকমা লাগলো না, তখন নিজের ওপরেই বুমেরাং হয়ে ফিরে এল রাগ, দুঃখ। নিজেকে নিয়েই তখন চলে কাঁটাছেড়া, মন তোলপাড় করা হাবিজাবি ভাবনা। সবার আলাদা আলাদা ‘ভালো’-র মাপকাঠির চাহিদাতে, তাদের মতো করে ভালো হতে গিয়ে কখন যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলি। আসলে একটা করে ছাঁচ তৈরি হয়, নিজেকে সেই ছাঁচে ফেলে দেয়া খালি।

তাহলে “আমি” কোথায়? পুরো জীবনটাই কি অন্যের ছাঁচে বেঁচে থাকা? “আমি” বলে কি কেউ ছিল কখনো আদৌ?


ঊর্মি বসুন্ধরা দুহিতা

 

কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাতত্ত্বে স্নাতকোত্তর। শিক্ষকতা ছাড়াও সমাজসেবার কাজের সাথে যুক্ত আছেন অনেকদিন। অবসরের সঙ্গী রঙ-তুলি আর কলম। সাদা কাগজে কল্পনা কখনো রঙীন হয়ে ওঠে তাঁর তুলির আঁচড়ে কখনোও বা ইচ্ছেঘুড়ি ডানা মেলে লেখিকার কলমের কালিতে।

 


 

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. ভালো হওয়ার দায় শুধু মেয়েদের এই ভুল ধারনাটাই আমাদের সমাজের ত্রুটি। তবে সমাজ বদলাচ্ছে।

    1. Bodleche nischoi… Kintu ekhono meyeder kache expectation tai besi… R meyerao bhalo image ta dhore rakhte besi udgrib

      1. আমাদের মনের কথা তোমার লেখনী তে প্রাণ পেলো। আরো লেখ।

Leave a Reply to শ্রাবনী গাঙ্গুলী Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!