Home সম্পাদকের পছন্দ, বিবিধ, প্রবন্ধ আমার শহরতলীর ছেলেবেলা
সম্পাদকের পছন্দবিবিধপ্রবন্ধ

আমার শহরতলীর ছেলেবেলা

 

সুস্মিতা রায়

আমার ছোটবেলা কেটেছে দুটি শহরতলি অঞ্চলে যেগুলো এখন এক্সটেন্ডেড কলকাতার মধ্যে ঢুকে গেছে। প্রথম জায়গাটির নাম মধ্যমগ্রাম, যেখানে বাল্যকাল থেকে তেরো বছর বয়স অবধি কেটেছে এবং তারপর থেকে বিবাহপূর্ব পুরোটা সময় কেটেছে সোদপুরে। দুটো জায়গারই অনেক সুন্দর স্মৃতি রয়েছে। আমাদের সময় বাচ্চাদের খেলাধুলার খুব চল ছিল। পাড়ার রাস্তায় বা মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে প্রচুর খেলেছি, তখন গাড়িঘোড়ার এত উৎপাত ছিলনা। পুতুল খেলাও হত প্রচুর। ওটার একটা আলাদা জগৎ ছিল, যাকে বলে ইমাজিনারি ওয়ার্ল্ড। আমাদের ছোটবেলায় টিভি ইন্টারনেট ছিল না, সেই জন্য কল্পনার জগৎগুলো ছিল পুতুল এবং খেলাধুলার মাধ্যমে এবং অবশ্যই গল্পের বই পড়ে।

মধ্যমগ্রামে পাড়ার মধ্যে অনেক ছোট ছোট খেলার মাঠ ছিল, আমাদের বাড়ির পিছনেই একটি বাড়ির খালি জমি ছিল যেখানে আমরা প্রচুর ব্যাডমিন্টন, কাবাডি, লেম্-ম্যান, খোখো এইসব খেলতাম। আমাদের বাড়িটি ছিল একতলার কর্নার ফ্ল্যাট; কিন্তু সামনে পিছনে প্রচুর জমি এবং বাগান। চওড়া উঠান। বারান্দা থেকে নেমেই উঠোনে চক দিয়ে মার্কিং করে কত যে এক্কাদোক্কা খেলেছি তার সীমাসংখ্যা নেই। আমাদের পাশের পাড়ায় ছিল একটি বড় মাঠ যেখানে বড় বড় টুর্নামেন্ট হত হত । আমাদের বাড়ি থেকে স্কুলে যেতাম হেঁটে হেঁটে সেই বড় মাঠ পেরিয়ে। যখন লোডশেডিং হতো তখন কত গরমকালে হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশোনা শেষ করে আমরা একটি মাদুর বালিশ নিয়ে পুরো ফ্যামিলি শুদ্ধ এবং তার বন্ধু (আমাদের মা বাবার বন্ধুরা থাকত তার সঙ্গে ) শুদ্ধ আমরা চলে যেতাম বড় মাঠে। সেখানে বাবা মায়েরা মাদুর বিছিয়ে গল্প করতো আর আমরা “হো-ও-ও-ও …” চিৎকার করতে করতে শুধু ছুটে বেড়াতাম আর ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতাম। যদিও ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকতো। রাত্রের আলোয় যতটুকু দেখা যেত, ওতেই খেলা হতো যথেষ্ট। কোন টেনশন ছিল না, না আমাদের, না আমাদের বাবা-মায়ের। কি সহজ-সরল দিনগুলো ছিল তখন! আর আমাদের পাড়ার প্রাইমারি স্কুল, যেখানে ক্লাস ফোর অব্দি পড়েছি, সেখানে হাইস্কুলে যাওয়ার পরও প্রায়ই দৌড়তে যেতাম। পরীক্ষার সময় যখন আগে ছুটি হয়ে যেত, তখন বাড়িতে না এসে আমরা বন্ধুরা মিলে চলে যেতাম প্রাইমারি স্কুলের দোলনা চড়তে। সেই দোলনা চড়ার কথা খুব মনে পড়ে। পরে শুনেছি সেই প্রাইমারি স্কুল উঠে গিয়ে সেটিকে ভেঙে একটি পুজোর মণ্ডপ তৈরি হয়েছে।

আমাদের ছোটবেলার দুর্গা পুজোর স্মৃতি হল যখন থেকে মন্ডপের বাঁশ টানানো শুরু হতো, সেই বাঁশ ধরে ঝুলে ঝুলে দোল খাওয়া আর পুজোর পাড়ায় প্রোগ্রাম করা, সব লাইভ। গান, নাচ, বাদ্যযন্ত্র, ভাষ্য পাঠ সব। রেকর্ডিং-এর কোন কনসেপ্টই ছিলনা। পুজোর আগের একমাস ধরে চলত রিহার্সাল, সে এক আলাদাই মজা।

এরপর আমার বাবা বাড়ী করে চলে আসে সোদপুরে। জানিনা কেন আমার মন কিন্তু মধ্যমগ্রামের সেই সহজ সরল জীবনটাকে বহুদিন অব্দি ভুলতে পারে না। দুটো জায়গাই কলকাতার শহরতলী তবু সোদপুর মধ্যমগ্রামের তুলনায় অনেক বেশি শহুরে ছিলো।

সোদপুরে যখন আসি আমি তখন আমার কৈশোর বেলা। এখনকার ভাষায় যাকে বলে টিনেজার। এখনকার সোদপুরের থেকে তখনকার সোদপুরের অনেক পার্থক্য ছিল। অনেক ফাঁকা আর দূষণমুক্ত আবহাওয়া ছিল তখন। কিন্তু তবুও ছোটবেলায় স্কুল, বন্ধুদের ছেড়ে আসার কষ্ট, তার সাথে নতুন স্কুল এবং পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া, খুবই দ্বন্দ্ব যুদ্ধ হয়েছিল নিজের মনের সঙ্গে।

সোদপুরে এসে খেলা বন্ধ হয়ে গেল। অনেক বেশি আড়ষ্টতা ছেলে মেয়েদের মেশার মধ্যে, অনেক কৌতুহল পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে অনেক জিজ্ঞাসা অনেক সন্দেহ ইত্যাদির সম্মুখীন হতে হয়েছে।

এই সবের মাঝে নিজেকে খুঁজে পেতাম বাড়ীর ভেতর ও বাইরের আমার প্রিয় দু একটি জায়গার মধ্যে। সব থেকে বেশি কৌতূহলের জায়গা ছিল কুয়োর পাড় আর তার সঙ্গে ফিট করা টিউবওয়েল। যা আগেকার কলকাতার বৈশিষ্ট্য। এখন এই কলতলা আর দেখতে পাওয়া যায় না।

আমাদের বাড়ীর সামনেই ছিল একটা মস্ত বড় খেলার মাঠ। আর পাশেই ছিল রেলওয়ে ট্র্যাক। 

কাজেই প্রথম প্রথম সোদপুরে যাওয়ার পর নতুন অভিজ্ঞতা হলো সারাদিন বাড়ির জানলা দিয়ে লোক্যাল ট্রেন দেখা। ওই আওয়াজটাতে অভ্যস্ত হতেও বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। বাড়ির কাছেই ছিল স্টেশন। এরপর শুরু হল ট্রেনে করে স্কুল যাওয়া। একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা। স্কুল লাইফের বাকি চার বছর এই ভাবে কাটলো।

বাড়ীর সামনের খোলা মাঠ আর রেলওয়ে ট্র্যাক থেকে প্রচুর হাওয়া আসতো আর তাতে জানলার পর্দা ঘরের মেঝের সাথে সমান্তরাল হয়ে পতপত করে সারাক্ষণ উড়তে থাকতো। আমার খুব ভাল লাগতো বিশেষ করে গরমের সন্ধ্যেবেলা যখন লোডশেডিং হয়ে যেতো তখন। আমরা গরম তো বুঝতেই পারতাম না এই খোলা হাওয়ায়। তার চেয়েও বড় কথা মোমবাতি তো জ্বালানোই যেত না এমনকি হ্যারিকেনের সলতেও দপদপ করে নিভে যেতো। সে এক আলাদা রোমাঞ্চ।

এখানে খেলাধুলা হতো না, তবে গান বাজনা চর্চা যথেষ্ট হত। পাড়ার একটি ছোট্ট ক্লাব এবং মাঠ ছিল, সেখানে পুজোর অনুষ্ঠানে হত বই কি। 

কলেজ লাইফ স্বভাবতই পাড়ার চেয়ে বাইরেই কেটেছে বেশি। বয়সটাই বন্ধুদের সাথে কাটানোর বয়স, আড্ডা দেওয়ার বয়স। বাবা-মার শত শাসন সত্ত্বেও পড়াশোনা ফাঁকি দিয়ে বাকি সবই করা হতো। আমি গান শুনতে ভালবাসতাম খুব। রেডিও, টেপ রেকর্ডারে নিজের পছন্দ মতন ক্যাসেট চালিয়ে কত ঘন্টা যে কেটে যেত তার হিসেব নেই। বাড়ীর বারান্দা আর ছাত আমার প্রিয় জায়গা ছিল। আঁকতে ভালোবাসতাম তাই বারান্দার থাম টা খুব সুন্দর করে আলপনা দিয়ে সাজিয়েছিলাম। ছাত জুড়ে ছিল মায়ের হাতের তৈরী বাগান।

দুঃখের কথা হল কলকাতা শহরতলীতেও একদিন কলকাতা্র ছোঁয়া লাগলো। সেই খোলা মাঠে তৈরী হয়ে গেলো বিরাট বড় এক পাড়া আয়তনে যা হয়ত আমাদের পাড়ার থেকেও বড়। আজ রেললাইন দেখতে হলে তিনতলার ছাতে উঠে এক চিলতে দেখতে পাওয়া যায়। মুক্ত পরিবেশের আমার ছোটবেলার সোদপুর আজ দূষণ আর হাইরাইজের সোদপুরে পরিণত হয়ে গেছে।

লেখিকা পরিচিতি

 

সুস্মিতা রায়

Kathak dance teacher and choreographer at Chittaranjan Park Bangiya Samaj for the last 10 years. Botany Honours graduate and B.Ed from Calcutta University. Lives in C. R. Park, New Delhi. Loves to travel, read, sing, music editing, painting and cook special dishes. Loves to hang out with friends, watch movies. Loves to drive and obviously teach dance. Crazy about dance costume designing and shopping.

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. খুব সুন্দর সহজ সরল লেখা হয়েছে। স্মৃতি সততই সুখের।

  2. একই বক্তব্য আমারও! একই ছোটোবেলা শেয়ার করেছি দুজনে, বয়সটাই যা তফাত! মধ্যমগ্রামকে কোনোদিন ভুলতে পারবো না, সোদপুরের পরিবেশও ফিরে আসবে না আগের মত! খুব ভালো লাগলো, মনের মত লেখা!

Leave a Reply to Mousumi Poddar Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!