Home প্রবন্ধ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি আমার রবীন্দ্রনাথ
প্রবন্ধসাহিত্য ও সংস্কৃতি

আমার রবীন্দ্রনাথ

সুস্মিতা রায়

“যিনি সকল কাজের কাজী,
মোরা তারই কাজের সঙ্গী
যার নানা রঙের রঙ্গ,
মোরা তারই রসের রঙ্গী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের দিয়ে গেছেন অসংখ‍্য‍ গান পূজা পর্যায়ের, যা ভগবানের উদ্দেশ্যে রচিত। কিন্তু ওনার লেখা গানগুলিই যে ওনাকে আমাদের কাছে ভগবানের স্বরূপ করে তুলবে তা বোধহয় কবি নিজেও কল্পনা করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের রক্তে মজ্জায় মিশে যাওয়া একটি নাম। ছোটোবেলায় ওনার লেখার গভীরতা বোঝার আগেই থেকেই ওনাকে আমরা ভালোবাসতে শুরু করেছি। প্রথমে সহজ পাঠ, তারপর গানের মাধ্যমে, নাচের মাধ্যমে, কবিতা, গল্প, নাটক আরো কত কী! কোথায় নেই উনি!! স্কুলের প্রার্থনা সঙ্গীত, জাতীয় সঙ্গীত, নাচ গানের প্রতিযোগিতা সবেতেই উনি।

আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে, তখন কে তুমি তা কে জানত“!!

ছেলেবেলা কিশোরবেলা যৌবনবেলা সবেতেই কবিগুরুর দৃঢ় প্রভাব। প্রথম শেখা রবীন্দ্রসংগীত “আমরা সবাই রাজা” বা স্কুলের প্রথম সঙ্গীত প্রতিযোগীতায় গাওয়া “দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার” গানের স্মৃতি এ জীবনে কি কখনো ভোলা সম্ভব!! আমাদের ছোটবেলায় রবীন্দ্র নৃত্যের খুবই প্রচলন ছিল। এতটাই একাত্ম হয়ে যেতাম আমরা তার সঙ্গে যে শুধু নাচ বা গানই নয় পুরো গীতিনাট্য আমরা পুরোটা মূখস্ত গেয়ে দিতে পারতাম। আমাদের বাড়ী ছিল গান বাজনায় সমৃদ্ধ। তাই কান তৈরী হয়ে গেছিল ছোট থেকেই যদিও সেই অর্থে গান কখনো শেখা আমার হয়ে ওঠেনি। গান শুনতাম বেশী, গাইতাম কম। রবীন্দ্রনৃত‍্যের প্রতি অসম্ভব টান ছিলো। সেইসময়, তা প্রায় পচিঁশ বছর আগের কথা, তখন দু ধরনের মানুষ আমার চারপাশের জগতে দেখতে পেতাম। একদল রবীন্দ্র অনুরাগী আর অন‍্যরা তাঁর গুনগ্ৰাহী হলেও কোথাও কড়া সমালোচকও। তাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে কোথাও ওনার রচনার প্রতি নিজস্ব ভালোলাগার অনুভূতি তৈরি হয়ে গেছিলো। যা সব যুক্তির উর্ধ্বে। শুধু শ্রদ্ধা আর ভালোলাগাই সেখানে মুখ‍্য।

পরবর্তী কালে বিয়ের পর স্বামীর চাকরীসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হয়েছে। নাগপুর, ভোপাল, রাঁচি বা রৌরকেল্লা তে বেশীদিন না থাকার জন্যে সেখানের সংস্কৃতির সাথে খুব বেশী জড়িত থাকতে পারিনি। একসময় এলাম দিল্লী। স্থিতি পেলাম সেখানেই। সাংস্কৃতিক আবহাওয়া দিল্লীতে যথেষ্ট বেশী এবং প্রবাসী বাঙালীরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে রবীন্দ্রজয়ন্তী বা নানারকম শিল্প সংষ্কৃতির সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে রাখেন। যেহেতু সবাই নানা জায়গার থেকে দিল্লীতে এসে বসবাস করছেন তাই হয়তো রবীন্দ্রনাথকে জানার কিছূ খামতি থাকতে পারে সুযোগের অভাবে কিন্তু কখনো সমালোচনা করতে দেখিনি বরং যারা কলকাতা থেকে এসেছে তাদের রবীন্দ্রচেতনাকে শ্রদ্ধা করতেই দেখেছি। নিজে একটি ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হই আর যেহেতু বাঙ্গালী অধ‍্যুষিত চিত্তরঞ্জন পার্ক এলাকায় থাকি তাই হয়তো নাচ গান কবিতা এইসবের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগও বেশী পেয়ে থাকি। নানা রবীন্দ্রভাবনার অনুষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে রাখার আনন্দ আলাদা। কবিগুরু ছাড়া যে কোনোকিছুই সম্পূর্ণ হয় না।

এভাবেই চলছিল সবকিছু। ২০১৫ সালে হঠাৎ সুযোগ আসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত “হাজার কণ্ঠে সম্মেলক রবীন্দ্রসংগীতে” যোগদান করবার। দিল্লীর একটি দল তৈরী হয়। শুরু হয় অনুশীলন। রবীন্দ্রসংগীত কে আরো নতুনভাবে গাওয়া, শেখা, অনুশীলন করা সর্বোপরি নতুনভাবে অনুভব করার সেই শুরু। বুঝতে পারলাম বয়েসের সাথে সাথে রবীন্দ্রনাথকে আরো গভীরভাবে অনুভব করতে পারছি। ২০১৫ র অনুষ্ঠানটি কলকাতার নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলেও আমাদের দলটি আজও আছে এবং আমরা নানা অনুষ্ঠান করে থাকি‌ নিয়মিতভাবে।

“সুরের গুরু দাও গো সুরের দীক্ষা/মোরা সুরের কাঙাল এই আমাদের ভিক্ষা”—গুরু বিনা কোনো শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় বলে আমি মনে করিনা। তাই এক গুরুর আবশ‍্যিকতা ছিল রবীন্দ্রসংগীত শেখার জন্য, যে ইচ্ছাটিও আমার পূর্ণ হলো ২০১৭ সাল থেকে। আমি গুরুর কাছে ২০১৭ থেকে গান শিখতে শুরু করলাম। সে ইচ্ছাটিও আমার পূর্ণ হলো অবশেষে। আমার মতে যদি সত্যি সত্যি মনের ইচ্ছে থাকে তবে শেখার কোনো শেষ নেই। বয়েস সেখানে কোনো বাধা হতে পারে না। রবীন্দ্রসংগীত এমন এক অনুভূতি যা ঘরের কোণে একলা বসে নিজের মতো গাইলেও মনে আনন্দ আসে, মন শান্ত থাকে। অনেকটা ধ‍্যান বা ঠাকুরের আরাধনা করার মতো ব‍্যাপার। তিনি ও আমাদের ভগবানই।

"সংসার যবে মন কেড়ে লয়, জাগেনা যখন প্রাণ,
তখনো হে নাথ, প্রণমি তোমায়, গাহি বসে তব গান"

যত পথ চলছি ততো যেন বেশী করে নিজের মর্মে ওনাকে অনুভব করছি আরো বেশী একাত্ম হয়ে যাচ্ছি ওনার সঙ্গে। নিজেকে উপলব্ধি করিও যেন ওনারই গানের কথায়। তাই ধার করি ওনারই কথা। “আপনাকে এই জানা আমার, ফুরাবে না”।

অথবা

"আমার মুখের কথা তোমার নাম দিয়ে দাও ধুয়ে
আমার নীরবতায় তোমার নামটি রাখো থুয়ে"

কবিগুরুর সম্বন্ধে বলতে গেলে তার উদ্ধৃতি প্রতি পদক্ষেপে ধার নিতে হয়। তাঁর মতো সুন্দর করে সহজ করে কজনই বা পেরেছেন মনের ভাব বোঝাতে! এ লেখা শেষ করার আগে ওনাকেই স্মরণ করে বলি যা মনে প্রানে আমার বিশ্বাস–

"ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু
পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু"

অথবা –

"যা পেয়েছি প্রথম দিনে সেই যেন পাই শেষে
দু হাত দিয়ে বিশ্বেরে ছুঁই শিশুর মতো হেসে"।

লেখিকা পরিচিতি

Susmita Roy

Kathak dance teacher and choreographer at Chittaranjan Park Bangiya Samaj, for the last 10 years. Botany honors graduate and B.Ed from Calcutta Univeristy. Lives in CR Park, New Delhi. Loves to travel, read, sing, edit music, paint, and cook special dishes. Loves to hang out with friends, watch movies. Loves to drive and obviously teach dance. Crazy about dance costume designing and shopping.

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. This is so true! Without realizing consciously Rabindra Nath Tagore is present in every sphere of our lives and his literary work enriches the our spirit in it’s every reference 🙏

Leave a Reply to Sonali Mitra Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!