Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ২৮
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ২৮

গোপা মিত্র

বারাণসী
পর্ব ২

সকালে গিয়েছিলাম বিশ্বনাথ মন্দির দর্শনে, বিকেলে চলেছি তিলভান্ডেশ্বর – মহাদেব দর্শনে। পর্যটন মানচিত্রে অবশ্য এর কোনো অস্তিত্ব নেই, তবে আমাকে তো খুঁজেপেতে সেখানে যেতেই হবে। এ নাম আমি প্রথম শুনেছিলাম আমার স্বর্গীয়া ঠাকুমা, কাকিমার কাছে। এখন আমি তাদেরই উত্তরসূরী, চলেছি সেই মহাদেবের খোঁজে। আমার দুই বোনও তাদের কথামত দেখে এসেছে তিলভান্ডেশ্বর মহাদেব।

কোথায় তাঁর সঠিক অবস্থান আমাদের জানা নেই – সেই খোঁজে আমরা প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলাম লজের কর্মচারীদের। কিন্তু তারা এমন নাম শোনেইনি। আমরা এবার, বিশ্বনাথ মন্দির থেকে ফেরার পথে, স্থানীয় দোকানীদের শরণাপন্ন হলাম। বেশীর ভাগ দোকানী আমাদের হতাশ করলেও একজন আমাদের সন্ধান দিয়ে বললেন যে, আপনারা একবার বাঙালী টোলায় খুঁজে দেখুন – সম্ভবতঃ সেখানেই আছে।

বিকেলে এক রিক্সায় চলেছি সেই মন্দিরে। রিক্সাওয়ালাও মন্দির চেনে না, কিন্তু বাঙালীটোলা চেনে। সেখানে নিয়ে গেলে আমরা মন্দির খুঁজে নেব।

কাশীর বিখ্যাত বাঙালীটোলার কথা আমরা প্রায় সকলেই জানি। প্রাচীনকাল থেকেই পরিবার পরিজন পরিত্যাক্তা বাঙালি বিধবাদের আশ্রয়স্থল এই বাঙালীটোলা। গলির মধ্যে আলো বাতাসহীন ছোট ছোট ঘুপ্‌চি ঘরে এদের বাস। সামান্য সাহায্যের টাকায় এদের জীবননির্বাহ, বেঁচে থাকা। অশক্ত শরীরেও এদের নিজেদের কাজ নিজেদেরই করতে হয়। এদের দেখার কেউ নেই। একদিন এভাবেই এদের জীবন শেষ হয়ে যায়। রিক্সায় যেতে যেতে দেখছি এমন অনেককে। এই প্রসঙ্গে অনেকদিন আগে দেখা বৃন্দাবনের একটা দৃশ্য মনে পড়ে গেল। মা বাবা বোনেদের সঙ্গে বৃন্দাবন গিয়ে দেখেছিলাম, একটা ছোট ঘরে অনেকজন পরিবার পরিত্যক্তা মহিলা বসে রাধাকৃষ্ণের নামগান করছে। এটাই তাদের জীবিকা। সারাদিন নামগান করলে মালিক যে মুষ্টিভিক্ষা দেবে তাই দিয়েই তাদের বেঁচে থাকা। আমাদের সমাজের এই অবক্ষয় দেখে কষ্ট হয়। আমরা কি এদের একটু সুস্থ জীবন দিতে পারি না?

এদের জিজ্ঞেস করেই রিক্সাওয়ালা আমাদের নিয়ে এল এক সরু গলির মুখে। এবার পায়ে হেঁটেই আমাদের যেতে হবে। কয়েকটা বাড়ী পরে আমরা এসে পৌঁছলাম কয়েকতল বিশিষ্ট ছোট এক বাড়ীর সামনে – যেটা কোনোভাবেই মন্দির বলে মনে হয় না। সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে সামনেই এক খাড়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম দোতলায়। আশেপাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন কয়েকজন মহিলা। তাদের বিস্মিত দৃষ্টি দেখেই বুঝলাম যে এখানে কেউ আসে না। সম্ভবতঃ এটা মহিলাদের এক আশ্রম এবং এখানেই রয়েছে তিলোভান্ডেশ্বর মহাদেব।

আমাদের জিজ্ঞাসায়, তারা সেই মহাদেবের ঘর দেখিয়ে দিলেন। মাত্র একটা জানলা বিশিষ্ট সেই ঘরের, একমাত্র ছোট্ট এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করলাম প্রায় ১০/১২ ফুট এক ঘরে। সূর্যের আলোতে নয়, বাল্বের আলোয় দেখলাম, ঘরজোড়া বিশালবপু কালো পাথরের প্রায় গোলাকার এক শিবলিঙ্গ। উচ্চতায় বেশী নয়, পরিধিতে বিরাট। তাঁকে চারিপাশ দিয়ে প্রদক্ষিণ করতে হলে তাঁকে স্পর্শ করতেই হবে – চারিপাশে এতটাই কম জায়গা। ভাবা যায় না, এতটাই বিশালায়তন সেই শিবলিঙ্গ। বুঝলাম, আমার বোনেরা কেন বারবার এখানে আসতে বলেছিল। তবে কি আমার স্বর্গীয় ঠাকুমা বা কাকিমা যা বলেছিলেন সেটাই সত্যি? এই শিবলিঙ্গ কি এত বছর ধরে তিল তিল করে বৃদ্ধি পেয়েই আজ এমন বিশাল রূপ ধারণ করেছেন? এখনও কি তিনি তিলার্ধ পরিমাণ করে বেড়েই চলেছেন? এইজন্যই কি এই শিবলিঙ্গকে তিলভান্ডেশ্বর মহাদেব বলা হয়?

ফেরার পথে দেখলাম বেনারসী শাড়ী বোনার জন্য বিখ্যাত মুসলিম মহল্লা। অপরিষ্কার, অপরিসর, ও অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঘরে ঘরে মুসলমান কারিগররা বুনে চলেছে তাঁত – তাদের হাতের দক্ষতায়, রঙীন সুতোয়, রেশম জরিতে, কাপড়ের ওপর ফুটে উঠছে ফুল লতা পাতার মোটিফ। আজ এখানে না এলে হয়ত কাশীর সম্পূর্ণ চিত্রটাই দেখা হত না।

পরদিন সকালে চলেছি মানমন্দির দর্শনে – এও অবশ্য আমার বোনেদের পরামর্শে। এখন আর এসব জায়গায় কেউ আসে না। আগেরদিনই দোকানদারদের কাছ থেকে এর অবস্থান জেনে নিয়েছি। দশাশ্বমেধ ঘাট থেকে একটু এগোলেই রাজেন্দ্রপ্রসাদ ঘাট এর কাছেই মানমন্দির ঘাট। এর সংলগ্ন প্রাসাদেই রয়েছে ১৬৯৩ সালে জ্যোর্তিবিজ্ঞানী রাজা সওয়াই জয়সিংহ নির্মিত গ্রহনক্ষত্রের গতিবিধি পরিমাপের যন্ত্রগণকগুলি। বামদিকের গলি দিয়ে একটু এগোলেই রাস্তা থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে মানমন্দিরে।

জনমানবহীন ভিতরে প্রবেশ করে চিৎকার করে ডাকাডাকি করতেই এসে উপস্থিত হলেন একজন কেয়ারটেকার, নাকি, নিরাপত্তারক্ষী জানি না। নিচের ঘরগুলি প্রায় সবই বন্ধ। সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলার এক ঘরের চাবি খুলে দিল সে। গঙ্গার ধারের বিশাল এই ঘরের সিলিং নানান উজ্জ্বল ফ্রেসকোয় শোভিত। জানলা এবং সেগুলির পাশের দেওয়ালগুলি সমৃদ্ধ নানাবিধ ভাস্কর্য ও চিত্রকলায়। খোলা জানলা দিয়ে দেখলাম সূদুরপ্রসারী গঙ্গার এক অবারিত অপরূপ রূপ, আর তারই বুকে ইতঃস্তত ভেসে থাকা নৌকোর মেলা – এখানে না এলে হয়ত এমন দৃশ্য অধরাই থেকে যেত।

এবার উঠলাম মানমন্দিরের ছাদে – সেখানেই রয়েছে নানারকম যন্ত্রপাতি, সূর্য চন্দ্র বা গ্রহনক্ষত্রের গতিবিধি পরিমাপের জন্য। এর আগে আমি জয়পুর বা দিল্লীতে মহারাজ জয়সিংহ নির্মিত যে মানমন্দির বা যন্তরমন্তর দেখেছি তার সবই ছিল এক বিশাল চত্বরে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায়। কিন্তু এক প্রাসাদের ছাদে, এত ছোট জায়গায়, সূর্যঘড়ি থেকে শুরু করে, পাথর বা ধাতু নির্মিত জ্যোর্তিবিজ্ঞানের হরেকরকম যন্ত্রপাতিগুলো দেখলে সত্যই আবাক হতে হয়। কত যুগ আগে ভারতবর্ষ যে গণিত বিদ্যায় কত দক্ষ ছিল তার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে। চারিপাশের মাথা উঁচু বাড়ীগুলোর মধ্যে এমন এক মানমন্দিরের অবস্থান যে হতে পারে ভাবাই যায় না। শুনলাম এই মানমন্দিরের ছাদেই নাকি ফেলুদারূপী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও বিকাশ সিংহরূপী বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ ছবির একটি বিশেষ দৃশ্যের শ্যুটিং হয়েছিল। তবে ছাদে বাঁদরের উৎপাত আর বাঁদরামি থেকে সাবধান!

দুপুর শেষ হতেই এক অটোয় চলেছি বারাণসীর অন্যতম আকর্ষণ বিখ্যাত বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় দর্শনে। স্বয়ংসম্পূর্ণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল প্রবেশতোরণ পার হয়ে অটো আমাদের নিয়ে চলল, এক সবুজে ঘেরা প্রায় ২০০০ একর জমির উপর নির্মিত ১০০ র অধিক বিভাগে সমৃদ্ধ বিশাল এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোন্‌ বিষয় পড়ানো হয় না এখানে? হিন্দুধর্মের সঙ্গেই এখানে চলে শিল্প, বিজ্ঞান, সাহিত্য, এলোপ্যাথি, আয়ুর্বেদ, পূর্তবিদ্যা, কৃষিবিদ্যা, সঙ্গীত, শরীরচর্চা সমস্ত কিছুরই পঠনপাঠন। পন্ডিত মদনমোহন মালব্য প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় বেনারস তথা সারা ভারতের গর্ব বলা চলে।

বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রবেশের পর প্রথমেই চোখে পড়ে নবীন কাশী বিশ্বনাথ মন্দির। এই মন্দিরও পন্ডিত মদনমোহন মালব্যর প্রেরণায় বিড়লা পরিবার নির্মাণ করেছিলেন। আদি বিশ্বনাথ মন্দিরের আদলে নির্মিত মর্মর পাথরের এই মন্দিরে সর্ব ধর্মের ভক্তদেরই প্রবেশাধিকার রয়েছে। এর দেওয়ালে খোদিত প্রাচীন ধর্মের নানা উদ্ধৃতি। নতুন এই বিশ্বনাথ মন্দিরটি সম্ভবতঃ কাশীর সবচেয়ে সুন্দর মন্দির।

ফেরার পথে দেখে নিলাম কৃত্রিম এক উপবনের মধ্যে অবস্থিত সঙ্কটমোচন মন্দির। মন্দিরের দেবতা হনুমানজী। চারিদিকের গাছপালার মধ্যে শুধুমাত্র পবননন্দনদের লম্ফঝম্প – অথচ ভক্তদের কোন বিরক্তি নেই। আমরা অবশ্য ভিতরে গিয়ে কোনমতে দর্শন সেরেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। শুনলাম এখানে গোস্বামী তুলসীদাসজী তাঁর রামচরিতমানসের অনেকাংশই রচনা করেছিলেন।

এখান থেকে চললাম দুর্গা মন্দিরে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত দুর্গার নামে এই মন্দিরটি, উত্তর ভারতীয় নাগর শৈলী শিল্পকলার এক উৎকৃষ্ট নির্দশন। এই রীতিতে উঁচু নীচু অনেকগুলি শিখর মিলে মন্দিরের গঠন হয় খুবই আকর্ষণীয়। সংলগ্ন দুর্গাকুন্ড সরোবর খুবই পবিত্র বলে মানা হয়। 

পরদিন চলেছি বারাণসী থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে বৌদ্ধতীর্থ সারনাথে। বোধিলাভের পরে বুদ্ধদেব প্রথম এখানেই এসে পাঁচজন প্রিয় শিষ্যকে তাঁর জ্ঞানলব্ধ বাণী শুনিয়েছিলেন। অতীতের ঋষিপত্তনই আজকের সারনাথ। আগে এখানেই ছিল ঋষিদের আশ্রম, আর তা ঘিরে মৃগদের আবাস বা মৃগদাব। মৃগ বা সারঙ্গ থেকেই এই স্থানের নাম হয়েছে সারনাথ। এখানেই প্রথম অষ্টমমার্গের শিক্ষাদান করেন ভগবান বুদ্ধদেব। প্রথম বৌদ্ধধর্মমহাচক্র হয় এখানেই। বিশাল এক বৃক্ষতলে, যা বোধিবৃক্ষ নামেও পরিচিত, দেখা যাচ্ছে ভগবান বুদ্ধ তাঁর পাঁচজন প্রিয় শিষ্যকে প্রথম ধর্ম উপদেশ দিচ্ছেন। এখান থেকেই তিনি ধর্মচক্র প্রবর্তন করেন।

এখানেই মূলগন্ধকূটী বিহারে রয়েছে বুদ্ধদেবের অনিন্দ্যসুন্দর সোনালী মুর্তি – যে ভঙ্গিমায় তিনি প্রথম ধর্মবাণী শুনিয়েছিলেন। মঞ্চের নিচে আধারে রয়েছে বুদ্ধদেবের Relics বা দেহভষ্ম। বছরে একমাত্র বুদ্ধপূর্ণিমার দিনেই তা বার করা হয়। দেওয়ালগাত্র সজ্জিত জাপানী শিল্পী কোসেৎসু নসুর আঁকা বুদ্ধের জীবনের নানা সুন্দর চিত্র দিয়ে।

নিকটের এক প্রত্নতাত্বিক সংগ্রহশালায় রয়েছে সারনাথের ধ্বংসস্তূপথেকে উদ্ধার দ্রব্যসামগ্রীগুলি। মনে করা হয় এসবই মৌর্য ও কুষাণ যুগের। এদের মধ্যে রয়েছে বুদ্ধদেবের নানা ভঙ্গীমার অপরূপ সব মূর্তি, এমনকি ভগবান বুদ্ধের ধর্ম প্রচারের মুর্তিও। এছাড়াও হিন্দু দেবদেবী – সরস্বতী, গণেশ, বিষ্ণুর মূর্তিও রয়েছে। আমাদের জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভের ছোট বড় নানারূপ প্রস্তরমূর্তিও রয়েছে এখানে। এর কাছেই রয়েছে বিদেশী কয়েকটি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী রাষ্ট্র – থাইল্যান্ড, মায়নামার, শ্রীলঙ্কা এসব দেশের মনাষ্ট্রি ।

ফেরার সময় দেখলাম ধামেক স্তুপ। পাথর ও ইঁটের তৈরী ৪৩ মিটার উঁচু ও ২৮ মিটার ব্যাসবিশিষ্ট এই গম্বুজাকৃতি গোলাকার স্তুপটির নিচের অংশ পাথরের ও উপরের অংশ ইঁটের। পাথরের উপর নক্সা ও কারুকার্য করা। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা এর ভিতরে প্রবেশ করতে পারলাম না – স্তুপের গায়ে বাঁশ বেঁধে এর রক্ষণাবেক্ষনের কাজ চলছে। প্রবেশ দরজা তালাবন্ধ। তাই বাইরে থেকে দেখেই আমাদের ফিরতে হল।

ফেরার পথে আমাদের অটোওলা তার চেনা দোকান থেকে আমাদের বেনারসী কেনাবেই। আমরা কিছুতেই রাজী না হওয়াতে সে বাধ্য হল আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসতে।

পরদিন সকালে আমরা চললাম রামনগর দুর্গে। সতেরশো শতাব্দীতে নির্মিত এই দুর্গ কাশীর রাজাদের বাসস্থান। স্থলপথেও যেমন এখানে পৌঁছনো যায় তেমন গঙ্গার ঘাট থেকে নৌকো করেও এখানে আসা যায়। আমরা অবশ্য জলপথেই এলাম। এর এক অংশের সংগ্রহশালাতে রয়েছে প্রাচীন আসবাবপত্র, রাজকীয় অস্ত্রশস্ত্র, পালকী, হাতীর দাঁতের কারুকার্যময় নানা দ্রব্যসামগ্রী, পুরাতন গাড়ী ও অ্যান্টিক ঘড়ী। এখানের দুর্গা মন্দিরে আজও পুজা হয়।

বিকেলে শেষবারের মত এসেছি দশাশ্বমেধ ঘাটে। কারণ পরদিনই আমরা ফিরে যাব কলকাতায়। এবার রাস্তা চেনা। গোধুলিয়া মোড়ে রিক্সা থেকে নেমে এগিয়ে চললাম ঘাটের দিকে। তার আগে অবশ্য একটা খরিদারী বাকী আছে। মানমন্দির আসার সময়ই দেখেছিলাম একটু এগিয়েই রয়েছে এক কাঁচাবাজার – বিক্রী হচ্ছে নানারকম ফল আর সব্জী। আজ প্রথমেই আমরা সেখান থেকে কিনে নিলাম, কাশীর বিখ্যাত বড় বড় পাকা পেয়ারা আর গোল গোলবড় বড় বেগুন – কলকাতায় নিয়ে যাব বলে। ইচ্ছে থাকলেও বেশী কেনা গেল না, নিয়ে যাওয়ার অসুবিধা হেতু।

আজ দশাশ্বমেধ ঘাটের সিঁড়িতে বসে দেখলাম ঢেউয়ের ধাক্কায় ছোট বড় নৌকোর দোল খাওয়া, কোন্‌ সে অজানার উদ্দেশ্যগঙ্গার জলে প্রদীপ ভাসানো আর সেই আলোজ্বলা প্রদীপ বুকে নিয়ে গঙ্গার বয়ে চলা। তারপর ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যায় গঙ্গারতির রঙীন আলোগুলো জ্বলে উঠলে আলোছায়াময় গঙ্গার জলে গঙ্গারতির প্রদীপের ছায়ার দোলাচল। আরতি শেষ হলে আমরা ফিরে চললাম আমাদের লজে।

কাশীর আর এক আকর্ষণ তার জিভে জল ঝরানো নানারকম সুখাদ্যের সম্ভার – অবশ্য সবই দিশী , একেবারেই ভারতীয়। বেনারস আসার আগেই আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম আমরা সেখানে কি কি খাব! সেইমতই আমাদের প্রতিদিনের প্রাতঃরাশের মেনু ছিল, গরম গরম কচুরি সঙ্গে তরকারী বা ডাল আর উপরে দই দিয়ে জিলিপি। লজের কাছেই ছিল শ্রীকৃষ্ণ সুইটস, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, ভালো ঘিয়ে তৈরী খাবারও অতি সুস্বাদু। বেরোবার আগে আমাদের প্রতিদিনের প্রাতঃরাশের ব্যাবস্থা সেখানেই। বেলায় প্রতিদিনই আমরা  একবার যেতাম গোধুলিয়া বাজারে, কোনো এক সুস্বাদু সরবতের রসাস্বাদনের জন্যে। যেমন চাইতাম তেমন সরবতই ওরা আমাদের সামনে তৈরী করে দিত। একদিন দেখলাম  – লস্যিতে নানারঙের সরবত মিশিয়ে তার মধ্যে দুটো সন্দেশ ভেঙে মিশিয়ে দিল। এমন যে হতে পারে, আমি তো ভাবতেই পারি না। সন্দেশ মেশানো সরবত্‌ – অথচ কি অপূর্ব তার স্বাদ! আবার রোজ বিকেলে যেখানেই যাই না কেন, একবার আসতাম গোধুলিয়ায়। চা এর সঙ্গে থাকত গরম গরম সিঙ্গাড়া, পকোড়া, ও কোনো মিষ্টি বা পেঁড়া। একদিন চাটের দোকানে চাট খেতে গিয়ে তো ভেবেই পাচ্ছিলাম না এত রকমের মধ্যে কোন্‌টা খাবো! এরমধ্যে অবশ্য দুদিন কাশীর বিখ্যাত মিষ্টি পানও আমাদের খাওয়া হয়ে গেছে। তবে এ পান যে কেন এত মূল্যবান তা অবশ্য বুঝলাম না। সবশেষে এখানের রাবড়ির কথা ত বলতেই হবে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, গোধুলিয়া বাজারে মাত্র দুটি দোকানে সন্ধ্যা ছটায় রাবড়ি তৈরী হয় – আর কোথাও নয়। একদিন পৌঁছে গেলাম সেখানে। আমাদের সামনেই তৈরী হল রাবড়ী, তারপর কটোরা করে দিয়েও দিল। দেখলাম দুধ ফুটিয়ে ফুটিয়ে একেবারে জমিয়ে প্রায় ঘন করে ফেলেছে – সেটাই হল কাশীর রাবড়ি।

ফেরার আগের দিনই শ্রীকৃষ্ণ সুইটসে অর্ডার দিয়েছিলাম পেঁড়ার, কলকাতায় নিয়ে যাব বলে। সেই পেঁড়া কলকাতায় যারাই খেয়েছিল, তারাই তার অপূর্ব স্বাদে মুগ্ধ হয়েছিল।

ফিরে চলেছি কলকাতার পথে, বেনারসের রূপ রস গন্ধ সঙ্গে নিয়ে। অন্য কোথাও বেড়াতে গেলে ভীড় আমার অসহ্য লাগে, অথচ বেনারসের প্রাণই হল এর জন অরণ্য। এই জনতার ভীড়ে হারিয়ে যাওয়ার যে এত আনন্দ, বেনারসে না এলে হয়ত কোনদিন জানতেই পারতাম না। এখন মনে হয় এখানে এসে আমি একেবারেই ভুল করিনি। এর অন্ধকার গলিঘুঁজি, মলিন রাস্তা, গঙ্গার ঘাট, চীৎকার চেঁচামেচি, সবকিছু নিয়েও, বেনারস আজও অমলিন এক ঐতিহ্যে ঝলমলে শহর। আফশোস অবশ্য একটা রয়েই গেল, এই গলিঘুঁজি রাস্তাঘাটের গোলকধাঁধাঁয় হারিয়ে গিয়ে এমন কোনো গলিতে পৌঁছতে পারলাম না যেখান থেকে ভেসে আসে কোনো মিঠা সুরের সানাই বা মধুর সুরেলা কন্ঠে গাওয়া কোনো গজল বা ঠুম্‌রী।

—  বারাণসী ভ্রমণ পর্ব সমাপ্ত —

 

লেখিকা পরিচিতি
 
 
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

      1. খুব ভালো লাগলো। সরবতে সন্দেশের ব্যাপারটা বেশ ইনটারেস্টিং।

        1. আমার ও লেগেছে । তাই ত লিখেছি । তবে সত্যি অপূর্ব স্বাদ ছিল সেই সরবতের ।

  1. ক্ষীরের সন্দেশ দেওয়া আমের সরবৎ কলকাতার ধর্মতলা ও শ‍্যামবাজারে পাওয়া যায়।

    1. কোনো দিন খাওয়ালে স্বাদ বুঝতে পারবো ।

  2. তোমার এই লেখা টা travel guide এর বইতে ছাপানো যায়।এতো details আর দারুণ সব description s ভাবা যায় না।খুব ভালো লাগলো।কি করে যে মনে রাখ।

    1. ধন্যবাদ ।চেষ্টা করি সেই জায়গায় ভালো মন্দ সব দিকগুলো ই তুলে ধরতে।

Leave a Reply to Anjana datta Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!