Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ২৭
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ২৭

গোপা মিত্র

বারাণসী
পর্ব ১

ছলাৎ ছল্‌, ছলাৎ ছল্‌, ছলকে আসা জল এসে সিড়িঁর পাশের ছোট বড় পাথরের শিবলিঙ্গগুলোকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। দিনমণি প্রায় অস্তে যেতে বসেছে। সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে অমৃতপ্রবাহিনী গঙ্গা। আমি বসে আছি বারাণসীর, কেদার ঘাটের সিঁড়িতে, নৌকোর অপেক্ষায়। এরপরই ভেসে পড়ব আমরা দুজনে – আমি আর কল্যাণ, বহমান গঙ্গার বুকে প্রবহমান জীবনের চলচ্চিত্র দর্শনে।

আমার বারাণসী বা বেনারস ভ্রমণ আমার দুই বোনের আগ্রহাতিশয্যে। ওরা বেশ ভালো করেই জানে যে ভীড়ে ভারাক্রান্ত শহর আমার একেবারেই পছন্দ নয়, তবুও বারবার তারা আমায় বেনারস বেড়াতে যেতে বলেছে। তারা অবশ্য এর মধ্যেই একাধিকবার ঘুরে এসেছে, তবুও আমি বেনারস আসার কথা ভাবিইনি। অবশেষে তাদের উৎসাহেই আমি একবার বেনারস বেড়ানো মনস্থির করলাম। সেইমতই একদিন ভোরে আমরা দুজনে – আমি আর কল্যাণ, বেনারস জংশন ষ্টেশনে এসে নামলাম। সময়টা ছিল ডিসেম্বরের একেবারে শেষ, সালটা ছিল ২০১৩।

বার্ধক্যের বারাণসী, বাবা বিশ্বনাথের বারাণসী, গলির গলি তস্য গলির বারাণসী, ধর্মের ষাঁড়ের বারাণসী, কত না নামে লোকে ডাকে এই বারাণসীকে। ভারতের অন্যতম জ্ঞানপীঠ, বিশ্বের প্রাচীনতম নগরীর অন্যতম এই বারাণসী, অবস্থিত পুণ্যতোয়া গঙ্গার অর্ধচন্দ্রাকৃতি বামতীরে।

বারাণসী বা লোকমুখে বেনারস – পুরাকালে বিখ্যাত ছিল কাশী নামে। পৌরাণিক কাহিনী মতে, কয়েক হাজার বছর আগে এই নগরীর প্রতিষ্ঠাতা কাশ্যের নামেই এই নামকরণ। বরুণা এবং অসি নামের দুই নদী যা আজও এই নগরীর উত্তর ও দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে এসে গঙ্গায় মিলিত হয়েছে এদের নাম একত্র করেই বারাণসী নামের উৎপত্তি। বারাণসীর মন্দিরগুলি মুঘল আমলে বারবার ধ্বংস করা হয়েছে – আবার গড়ে তোলাও হয়েছে। সবশেষে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের হাতে বাবা বিশ্বনাথের মন্দির ধ্বংস হবার পর ইন্দোরের রাণী অহল্যাবাঈ ১৭৭৭ সালে পুরনো মন্দিরের কাছেই নির্মাণ করেন এই বর্তমান মন্দিরটি। স্বর্গের নদী গঙ্গা আর দেবাদিদেব মহাদেবের অবস্থান, কাশীকে করে তুলেছে হিন্দুদের এক পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। তবে কাশী শুধুমাত্র তীর্থক্ষেত্রই নয়, হিন্দুধর্মের প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারকও বটে। অনন্তকাল ধরেই তাই কত না সাধক, জ্ঞানীগুণী, বিদগ্ধ পন্ডিতজনের আনাগোনা এই কাশীতে আত্মদর্শন ও আত্মোপলব্ধির আশায়।

কলকাতা থেকেই বুকিং করে আসা ইউ পি ট্যুরিজমের লজটি ষ্টেশনের একেবারেই কাছে, কাশীর ব্যস্ততম অঞ্চল গোধুলিয়া থেকে সামান্য দূরে। ষ্টেশন থেকেই আমরা একটা অটো নিয়ে একটু ঘুরপথে এসে পৌঁছলাম লজে। কারণ অটো সব রাস্তায় যেতে পারে না।

দুপুরের রোদ পড়ে এলে আমরা স্থির করলাম আজ আমরা দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়ে গঙ্গারতি দেখে আসব। রাস্তা না জানায়, কত রাত হবে ফিরতে, তাও না জানায়, আমরা এক অটো ঠিক করলাম লজের সাহায্যে – সে আমাদের নিয়ে যাবে, আবার আরতির পর ফিরিয়েও নিয়ে আসবে। সেই মতো অটো আমাদের নিয়ে কোন্‌ সব গলিঘুঁজির মধ্যে দিয়ে এসে উপস্থিত হল কেদার ঘাটের পিছনের এক রাস্তায়। এখানেই সে আমাদের নামিয়ে দিয়ে একটা সিঁড়ি দেখিয়ে দিয়ে বললো যে, উপরে উঠলেই কেদার ঘাট। সেখান থেকে বাঁদিকে গেলেই দশাশ্বমেধ ঘাট। দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে অটোর প্রবেশ নিষেধ, তাই সে আমাদের নিয়ে এসেছে এখানে। এখানেই সে অপেক্ষা করবে, আরতি দেখে আমরা এখানেই আসব, সে আমাদের নিয়ে ফিরে যাবে।

এবার বুঝলাম কাশীর গলি কাকে বলে – দুপাশে শুধুমাত্র ঘুলঘুলির ফোকরযুক্ত, প্রায় দরজা-জানলাবিহীন, একহারা বাড়ীগুলির অবস্থান এমন, যেন গলিটিকে দুদিক থেকে চেপে ধরেছে। মনে হয় সূর্যের আলোর প্রবেশ এখানে নিষিদ্ধ। টিম্‌টিমে রাস্তার আলোয় দেখলাম, কোনক্রমে একটা অটো যাওয়ার মতই রাস্তা। জনমানবশূন্য নিরিবিলি নিঃঝুম এই গলিতে সত্যি গা ছম্‌ছম্‌ করে। মনে পড়লো, এই সেই বিখ্যাত গলি যেখানে সত্যজিৎ রায় তার ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ সিনেমার শ্যুটিং করেছিলেন।

অনেকটা উঁচুতে কেদার ঘাটে রয়েছে কেদারেশ্বরের মন্দির। সেই চাতাল থেকে খাড়া সিঁড়ি নেমে গেছে গঙ্গায়। সেখানেই সার দিয়ে দাঁড়িয়ে অসংখ্য ছোট বড় নৌকো আর দু’একটা বজরা – জানি না, এর মধ্যে কোন্‌টা মগনলালের বজরা।

দরদস্তুর করে ছোট একটা নৌকো ঠিক হল – সে আমাদের বিখ্যাত সব ঘাটগুলো দেখিয়ে এসে দাঁড়াবে দশাশ্বমেধ ঘাটের সামনে। সেখানে, নৌকোয় বসেই আমরা গঙ্গারতি দেখবার পরে সে আমাদের আবার নামিয়ে দেবে কেদারঘাটে।

বেনারসের ঘাটগুলি একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত বা বলা যায় একই ঘাটের যেন একাধিক Extension – শুধু নামগুলো বদলে বদলে গেছে। অনায়াসেই পায়ে হেঁটে এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে চলে যাওয়া যায়। গঙ্গা তীরের ছোট বড় অসংখ্য এই ঘাটগুলির মধ্যে কয়েকটি অন্যতম বলা যায়। অসি ঘাট – যেখানে অসি নদী এসে মিলেছে গঙ্গায়, তাকে যদি সূচনা ঘাট বলে ধরা হয়, তবে আদি কেশব ঘাট – যেখানে বরুণা এসে মিলেছে গঙ্গায়, তাকে শেষ বলে ধরা যাবে। অবশ্য বিপরীতক্রমও হতে পারে। এদের মধ্যে দশাশ্বমেধ ও মণিকর্ণিকা ঘাট ব্যস্ততম বলা যায়।

আমরা দুজনে ভেসে চলেছি গঙ্গার বুকে। মাঝি তখন শুনিয়ে চলেছে লাগাতার ঘাটগুলির ধারাবিবরণী। আমার কান সেই বিবরণীর দিকে হলেও চোখ কিন্তু তখন ব্যস্ত ঘাটগুলির পর্যবেক্ষণে। সেগুলি যেন ভারতীয়দের চলমান জীবনের প্রতিচ্ছবি।

কোনো ঘাটে চলছে শরীরচর্চা, তো কোথাও ধুনি জ্বালিয়ে সাধুমহারাজদের পুজার্চনা, কোথাও কথক ঠাকুরের কথকতা, তো কোথাও দেহাতী রমণীর উনুন জ্বালিয়ে গরম চা পকোড়া বিক্রী, তো কোথাও ছোটখাট জিনিষের বিকিকিনি। কোথাও চলেছে নির্ভেজাল আড্ডা বা তর্কবিতর্ক, তো কেউ একলা বসে উদাস নয়নে চেয়ে রয়েছে বহমান গঙ্গার দিকে। পুণ্যলোভে কেউ সেই শীতল গঙ্গায় তখনও ডুব দিচ্ছে, তো কেউ আবার পূর্বপুরুষের অস্থি বিসর্জন দিতে এসেছে। একদিকে চলমান জীবনের অবিরাম ধারা, অন্যদিকে নশ্বর জীবনের সমাপ্তি অনুষ্ঠান – জীবনের নিত্য অনিত্যকে পাশাপাশি পাওয়া, এটাই বোধহয় বারাণসীর চরম উপলব্ধি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, তবুও ঘাটের চিত্র বদলায় না। রাতে হয়ত কিছুক্ষণের বিরতি, আবার ভোর থেকেই শুরু হয়ে যায় সাধুমহারাজ ও পূণ্যার্থীদের মন্ত্রোচ্চারণ ও পূণ্যস্নান।

প্রতিটি ঘাটেরই আলাদা নাম। প্রতিটি ঘাটেরই আছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বা ঐতিহ্য। প্রতিটি ঘাটেই রয়েছে কোনো না কোনো দেবদেবীর মন্দির। ঘাটের লাগোয়া সিঁড়ি উঠে গেছে কোন্‌ কালের সব প্রাসাদ, সৌধ বা ইমারতের দোড়গোড়ায়। সবই কোন না কোন রাজপুরুষ বা ভূস্বামীদের কীর্তির সাক্ষী। এখন অবশ্য এই সব প্রাসাদ বা ইমারতের অনেকগুলিরই কিয়দংশ বা সম্পুর্ণ পরিবর্তিত হয়েছে কোন বিলাসবহুল স্টার হোটেলে।

দশাশ্বমেধ ঘাট থেকে যাত্রা শুরুর আগেই রাজেন্দ্রপ্রসাদ ঘাট। এখানে রয়েছে এক ঝুলন্ত অলিন্দ – গঙ্গার দৃশ্য দেখার বা হাওয়া খাওয়ার উপযুক্ত।

ঠিক পরেই রয়েছে মানমন্দির ঘাট। ঘাটের উপরের প্রাসাদে রয়েছে কয়েকশো বছরের প্রাচীন মানমন্দির বা যন্তরমন্তর। ললিতা ঘাটের ঠিক উপরেই রয়েছে বৌদ্ধ মনাষ্ট্রির আদলে তৈরী এক নেপালি মন্দির। দশাশ্বমেধ ঘাটের দক্ষিণের ঠিক পরের ঘাটটাই মুনসি ঘাট, লাগোয়া পেশোয়াদের তৈরী রাজঘাট। মুনসি ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁয়ের বাড়ীটাই দ্বারভাঙ্গার রাজবাড়ী, সত্যজিৎ রায়ের ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ সিনেমায় যা ছিল মছ্‌লিবাবার আড্ডা। চওষটঘাটের নবদুর্গা মন্দির দর্শন সেরে এগিয়ে গেলে, দিগপতিয়া ঘাটে রয়েছে সীতারামদাস ওঙ্কারনাথজীর আশ্রম।

গঙ্গার দক্ষিণ দিকে অসী ঘাটে রয়েছে জগন্নাথদেবের পবিত্র মন্দির। তুলসী ঘাটে তুলসীদাসজী শ্রীরামচরিতমানসের অনেকগুলি অধ্যায় রচনা করেছিলেন। হরিশচন্দ্রঘাট, সত্যবাদী রাজা হরিশ্চন্দ্রের নামাঙ্কিত। পঞ্চগঙ্গা ঘাটে রয়েছে প্রাচীন বিন্দুমাধবের মন্দির। সিন্ধিয়া মহারাজের দেওয়ান নির্মিত আদি কেশব ঘাটে রয়েছে সঙ্গমেশ্বর ও ব্রহ্মেশ্বর মন্দির।

উত্তরবাহিনী গঙ্গার প্রায় মধ্যবিন্দুতে রয়েছে মণিকর্ণিকা ঘাটের মহাশ্মশান। কখনও নেভে না এর চিতার আগুন। মাঝি শোনায় এই ঘাটের উপাখ্যান। শিব পার্বতী একদিন বেড়াচ্ছিলেন। সেইসময় অসাবধানে পার্বতীর কানের মণি পড়ে যায়। বহু সন্ধানেও সেই মণি খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যথিতা পার্বতীকে শিব সান্ত্বনা দেন এই বলে যে, মণি পড়েছে বলেই এই স্থান অতি পবিত্র হয়ে থাকবে এবং এখানে যাদের মৃতদেহ দাহ হবে তাঁরা সশরীরে স্বর্গধামে যাবে। মাঝির গলা কানে আসে, ঐ যে আগুন দেখছেন, দেবী দুর্গার ক্রোধ থেকেই ঐ আগুনের সৃষ্টি। ঐ আগুন কখনও নেভে না, ওখান থেকে আগুন নিয়েই কাঠের চিতায় আগুন দেওয়া হয়। এখানে রয়েছে তারকেশ্বর শিবের মন্দির। বিশ্বাস এই যে, স্বয়ং শিব, মৃত্যুপথযাত্রীর কানে তারকব্রহ্ম নাম জপেন।

বিন্দুমাধব মন্দিরের আগেই ত্রৈলঙ্গস্বামী আশ্রমে বিরাজিত বিশালায়তন শিবলিঙ্গ, পাশেই মারাঠা বৈষ্ণবসাধক, তুকারাম প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ। ইনিই বলেছিলেন, ঈশ্বরের নামটাই আসল, জাত নয়।

বেনারসের ঘাটে মাঝেমাঝেই রয়েছে একরকম আটকানো বুরুজ, যার উপরে ভোরবেলায় পায়রারা দল বেঁধে দানা খায়, রয়েছে ইতস্ততঃ ছড়ানো বড় বড় ছাতা, যার আড়ালে সাধু সন্ন্যাসী পুণ্যার্থী থেকে নিছক পর্যটকও রোদের থেকে মাথা বাঁচায়। ঘাটে ঘাটে রয়েছে কতনা বিজ্ঞাপন, কত না ঠাকুর দেবতার ছবি।

নৌকাবিহার শেষে ফিরে এলাম দশাশ্বমেধ ঘাটের সামনে। সূর্য তখন নেমে গেছে অবগাহন স্নানে। গঙ্গার বুকে তখন প্রদীপ বা তালপাতার ডোঙার আলোকবিন্দুগুলি ভেসে চলেছে কোন অজানার উদ্দেশ্যে। ঘাটের দশাশ্বমেধেশ্বর শিব মন্দিরের সঙ্গে দূরের ঘাটগুলির মন্দির থেকেও ভেসে আসছে সন্ধ্যারতির ঘন্টাধ্বনি। দশাশ্বমেধ ঘাটের সাজানো মঞ্চে তখন জ্বলে উঠেছে আলোকমালা। শুরু হয়ে গেছে গঙ্গারতির প্রস্তুতি। কিছু লোক তখনও ডুব দিয়ে যাচ্ছে গঙ্গায়, বিশ্বাস এই যে এই ঘাটে স্নান করলে দশ অশ্বমেধ যজ্ঞের পূণ্য হয়।

আমাদের নৌকো এসে দাঁড়াল সুসজ্জিত সেই মঞ্চের সামনে। আমরা নৌকো থেকেই দেখব আরতি। রঙীন আলোকমালায় সজ্জিত পাঁচটি মঞ্চের উপর হলুদ রঙের পতাকা উড়ছে। কাঠের বেঞ্চিপাতা গ্যালারিগুলি আর ঘাটের সিঁড়িগুলি তখন জনসমাগমে পুর্ণ। মঞ্চ আর ঘাটের আলো মিলে গঙ্গার জলে এক রহস্যময় আলোছায়ার খেলা।

শুরু হল আরতি। প্রথমে মঞ্চে উপস্থিত গায়কদের সুরেলা স্তোত্রপাঠ ও শঙ্খধ্বনি বেজে উঠলো মাইকে। তারপর পাঁচটি মঞ্চে উপস্থিত পাঁচজন, একই রকম সাদা ও গেরুয়া পোষাকে সজ্জিত পুরোহিত, সার দিয়ে দাঁড়িয়ে গঙ্গার দিকে মুখ করে শুরু করলেন আরতি। এক হাতে তাদের তিন-চার থাকের জ্বলন্ত প্রদীপ অন্য হাতে ঘন্টা। মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে নাচের ভঙ্গীতে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চারিদিকে প্রদীপ ও বাকী অনুষঙ্গ ঘুরিয়ে চলল আরতি। গঙ্গার বুক থেকে অবশ্য দেখতে ভালোই লাগল। তবে পুরো ব্যাপারটাই আমার বড় বেশী কৃত্রিম বলে মনে হল – স্রেফ পর্যটক আকর্ষণের একটা প্রচেষ্টা মাত্র। সেই কত বছর আগে ১৯৭১ সালে প্রথমবার হরিদ্বার গিয়ে দেখেছিলাম গঙ্গারতি। মনঃশ্চক্ষে ভেসে উঠল সেই দৃশ্য – হর কি পৌড়ীর ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, শুধুমাত্র ঘাটের আলোতে, একজন মাত্র পুরোহিত জ্বলন্ত প্রদীপ হাতে ঘন্টা বাজিয়ে গঙ্গারতি করছে আর তার পিছনে ভীড় করে দাঁড়ানো উদ্বেল জনতা জয়ধ্বনি দিচ্ছে গঙ্গার, সেই ভক্তি, সেই আবেগ, সেই আকুলতা এখানে কোথায়? অবশ্য আমি জানি না, এখন সেখানেও আলো লাগিয়ে মঞ্চ সাজানো হয়েছে কি না!

ভীড় ছাড়িয়ে কেদারঘাটের পিছনে এসে আবারও সেই, আমাদের জন্য অপেক্ষারত অটোতেই ফিরে এলাম লজে।

পরদিন সকালে প্রস্তুত হয়ে চললাম বেনারসের অন্যতম আকর্ষণ বাবা বিশ্বনাথ মন্দির দর্শনে। রিক্সা করে দুজনে এসে উপস্থিত হলাম বেনারসের প্রাণকেন্দ্র গোধুলিয়া মোড়ে। রিক্সা আর এগোবে না, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ চলছে। এবার আমাদের পায়ে হেঁটেই যেতে হবে।

দ্বাদশ জ্যোর্তিলিঙ্গের অন্যতম বাবা বিশ্বনাথ এখানেই নাকি প্রথম আর্বিভূত হয়েছিলেন। আদি বিশ্বনাথ মন্দিরের কাছেই ইন্দোরের রাণী অহল্যাবাঈ নির্মিত বর্তমান এই মন্দিরের চূড়াটি পরে সোনায় মুড়ে দিয়েছিলেন পাঞ্জাবকেশরী মহারাজ রণজিৎসিংজী। সেইজন্যই এই মন্দিরটি কাশীর স্বর্ণমন্দির নামেও বিখ্যাত।

এগিয়ে চলেছি রাস্তা ধরে জন অরণ্যের মাঝ দিয়ে – এ যেন এক মিনি ভারতবর্ষ। ধনী দরিদ্র বৃদ্ধ বৃদ্ধা যুবক যুবতী নির্বিশেষে সব প্রদেশের লোকেরাই রয়েছে এদের মধ্যে – একাকী বা দলবেঁধে। দুপাশের দোকানীদের হাঁকাহাঁকি বিকিকিনি, নির্বিকার কোন ষাঁড় বা গরুর পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম দর্শনার্থীদের লাইনের পিছনে। দর্শন শেষে ফিরতি লোকেরাও আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। শম্বুক গতিতে এগোলেও কারো বিরক্তি নেই, সকলেই বাবা বিশ্বনাথের দর্শনে উন্মুখ।

অবশেষে এসে পৌঁছলাম বিশ্বনাথের গলির মুখে। এবার নিরাপত্তা দরজা পার হয়ে পাশের এক দোকানে নিজেদের জুতো গচ্ছিত রেখে, এগিয়ে চললাম ভীড়ের পিছু পিছু। সেই সরু গলির দুপাশে অসংখ্য দোকানে সাজানো রয়েছে ঝক্‌মকে শাড়ী, কাচের চুড়ি, টিপ, পাথর ও ধাতু মূর্তি, পিতল কাঁসার বাসন, রকমারী কাঠের খেলনা, এমনকি পানমশলা জর্দাও। সারা কাশীতে যা পাওয়া যাবে, তার সবই বোধহয় পাওয়া যায় এখানে। আবার Security Checkup, তবে এবার Body Checkup – পুরুষ ও মহিলাদের আলাদাভাবে। এখানেই সঙ্গের সবকিছু জমা দিতে হল পাশের এক দোকানে – পার্স মোবাইল ক্যামেরা সব। সঙ্গে রইলো শুধু পূজার সামগ্রী।

দেবস্থানের পাথরের বাঁধানো চত্বর পার হয়ে এসে উপস্থিত হলাম মন্দিরের গর্ভগৃহে। কালো পাথরের শিবলিঙ্গ যেন মাটি থেকেই উত্থিত হয়েছে। সামনেই বসে থাকা পুজারী হাত থেকে পূজার ডালি নিয়ে নিচ্ছে, কারো কপালে টিপ দিচ্ছে, কারো হাতে তুলে দিচ্ছে ফুল বা মালা। লাইন ধরেই এগিয়ে যেতে হচ্ছে, দাঁড়াবার প্রশ্নই নেই। তার মধ্যেই দেবতা স্পর্শ করে প্রণাম করে নিতে হচ্ছে। সামনে রাখা বাক্স বা থালায় জমে উঠছে প্রণামী। যেমন লাইন দিয়ে প্রবেশ করে ছিলাম, তেমনই লাইন ধরে অন্য এক দরজা দিয়ে বেরিয়েও এলাম। যেপথ ধরে মন্দিরে প্রবেশ করেছিলাম আবার সেপথ দিয়েই ফিরে এলাম প্রধান সড়কে, দোকান থেকে ফেরৎ নিয়ে গচ্ছিত রাখা জিনিষপত্রগুলি।

একমাত্র হিন্দুদের প্রবেশাধিকার এই মন্দিরে আরতি হয় বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন রকমে। একেবারে ভোরবেলায় মঙ্গলারতি, দুপুরে ভোগারতি, সন্ধ্যায় সপ্তর্ষি আরতি, রাতে শৃঙ্গার ও ভোগারতি, সবশেষে শয়নারতি। এই সব আরতি দেখার জন্য আগে থেকেই নাম লিখিয়ে, টাকা দিয়ে সময় বুক করতে হয়।

বিশ্বনাথ মন্দিরের পিছনেই জ্ঞানবাপী কূপ। কথিত আছে কালাপাহাড় বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করতে এলে স্বয়ং বিশ্বনাথ ত্রিশূল দিয়ে এই কূপ খনন করেন ও এতে আশ্রয় নেন।

কাশী মন্দিরময় শহর – রয়েছে একাধিক মন্দির। তবে সব মন্দির দেখা একেবারেই অসম্ভব। বিশ্বনাথ মন্দিরের কাছেই অন্নপূর্ণা মন্দির – ১৭৮৫ সালে পেশোয়া বাজীরাও দ্বারা নির্মিত। রূপোর সিংহাসনের ওপর দেবী অন্নপূর্নার পিতলের মুর্তি। দেওয়ালীর পরে এখানে বিশাল আয়োজনে অন্নকূট উৎসব হয়। এর চত্বরেই রয়েছে কুবের আর সূর্য মন্দির।

মন্দির দর্শন সেরে তৃপ্ত আমরা ফিরে চললাম লজের দিকে। যদিও শীতকাল, তবুও রোদের তাপ আর ভালো লাগছিল না। তাছাড়া দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়ানো – এতক্ষণ এসব কষ্ট বলেই মনে হচ্ছিল না। এখন মনে হচ্ছে লজে ফিরে অবশ্যই একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার।

সেই কত বছর আগে কেদারনাথ দর্শনে গিয়ে (আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৭) যে সত্য উপলব্ধি করেছিলাম আজও যেন আর একবার চোখের সামনে সেই সত্য প্রত্যক্ষ করলাম। তখন যেমন দেখেছিলাম, ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে একই দেবতার উদ্দেশ্যে, একসঙ্গে পথচলা, এখনও যেন দেখলাম তেমনই এক মিলেমিশে ভারতবর্ষের চিত্র। অনুভব করলাম, মানুষ তার নিজের স্বার্থেই বিভেদের সৃষ্টি করে, ঈশ্বরের কাছে সব মানুষই সমান।

— প্রথম পর্ব সমাপ্ত —

লেখিকা পরিচিতি
 
 
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

    1. এই জন্যই তুই আমাদের রাজা– সঙ্গে সঙ্গেই comment. ধন্যবাদ ।

  1. খুব ভালো লাগল পড়তে।তুমি খুব ই observant,প্রচুর details দিয়েছো।সুন্দর লেখা।

    1. একদম ঠিক ।আমি যেখানে ই যাই , সেই জায়গা আবিস্কারের চেষ্টা করি ।ধন্যবাদ ।

Leave a Reply to Runa Ray Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!