Home প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১২
প্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ১২

গোপা মিত্র

যোধপুর থেকে জয়সলমীর

।। দ্বিতীয় পর্ব ।।

আমার জয়সলমীর ভ্রমণ অবিস্মরনীয় হয়ে আছে, আমাদের সেই সান্ধ্যভ্রমণের জন্য। রাতের অন্ধকারে নিস্তব্ধ প্রকৃতির মাঝে আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া কোনোওদিনও কি সম্ভব আমাদের মতো শহুরে বাসিন্দাদের কাছে?

সোনার কেল্লা দেখে এসে বৈকালিক জলযোগের পরে আমরা ভাবতে বসলাম, এখন আমরা কি করবো? মাত্র দু’দিন কাটতে চলেছে – এখনোও আমাদের হাতে রয়েছে ছ’দিন। বেড়াতে এসে যদি সন্ধ্যেবেলা ঘরে বসে কাটাতে হয়, তবে তো আমাদের বেড়ানোর মজাটাই অর্ধেক হয়ে যাবে। স্থির হলো সন্ধ্যেবেলা আমরা নিজেদের মতো খানিকটা বেড়িয়ে আসবো। কিন্তু তার আগে দেখতে হবে, সেক্ষত্রে কোনোও বিপদের সম্ভাবনা আছে কি না।

হোটেলেরই এক কর্মচারী – এখানকারই অধিবাসী, তাকে জিজ্ঞেস করাতে সে খুব গর্বভরে বললো যে, “আপনারা নিশ্চিন্ত হয়ে রাত পর্যন্ত বেড়াতে পারেন। আপনারা যদি মূল্যবান গয়না পরেও বেরোন, তা হলেও কেউ আপনাদের দিকে ফিরে চাইবে না।” ব্যাস্‌! আর কোনোও বাধা রইলো না। সেই সন্ধ্যা থেকেই আমরা হাঁটতে বেরোতাম।

মুমল ট্যুরিস্ট বাংলো – সোনার কেল্লা, বাজার বা জনবসতি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। মাঝে অনেকখানি জনহীন ফাঁকা জায়গা। সেই দিন থেকে গরম জামায় নিজেদের মুড়ে রোজ সন্ধ্যায় আমরা বেরিয়ে পড়তাম হাঁটতে। নির্জন প্রকৃতির মাঝে, মাঠঘাটের মধ্যে দিয়ে, নির্ভীক আমরা – কখনোও হেঁটে যেতাম এদিকে, তো কখনোও ওদিকে। ‘উজ্জ্বল’ অন্ধকারে, কালচে নীল আকাশের ঝিকমিক তারাদের সঙ্গী করে আমরা এগিয়ে যেতাম দিকচক্রবালের দিকে, যেখানে আকাশ এসে মিশেছে পৃথিবীতে। আকাশের দিকে চেয়ে আমরা খুঁজে ফিরতাম কালপুরুষ ও লুব্ধক, সপ্তর্ষিমণ্ডল, ধ্রুবতারা ইত্যাদি। একজন কেউ খুঁজে পেলে অন্যজনকেও চিনিয়ে দিতো। আকাশের তারা যে এতো উজ্জ্বল হয়, এটাও তো আমাদের জানা ছিলো না। দূষণমুক্ত প্রকৃতি, আকাশের সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারকেও তখন আমাদের চোখে উজ্জ্বল করে তুলেছে। আমরাই যেন সেই জনহীন পথের একচ্ছত্র অধিকারী। আমার সমস্ত ভ্রমণের মধ্যে জয়সলমীর স্মরনীয় হয়ে আছে – শুধুমাত্র এই সান্ধ্যভ্রমণের জন্যে। রাতের মোহময়ী রূপ আমরা একমাত্র এখানে এসেই প্রত্যক্ষ করেছিলাম। ফিরে আসতাম দেড়/দুঘন্টা পরে। তারপর চলতো পরের দিনের প্রস্তুতি।

পরদিন চলেছি – হাভেলি দর্শনে। যাদের হাতে সময় অল্প, তারা অবশ্য একই দিনে সোনার কেল্লা ও হাভেলি দর্শন করে থাকে। আমাদের হাতে সময় রয়েছে, তাই রোজই আমরা সকালে জয়সলমীরের কোনোও না কোনোও দ্রষ্টব্য স্থানে ঘুরে বেড়াতাম পায়ে হেঁটে। সেই সময়কার বণিক বা উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জায়গীরদারদের কারুকার্যময় প্রচুর কক্ষবিশিষ্ট ও একাধিক তলবিশিষ্ট বাসগৃহগুলিকেই বলা হয় হাভেলি। এদের মধ্যে বিখ্যাত ‘পাটোয়া কি হাভেলি’, ‘নাথমলজী কি হাভেলি’, ‘সেলিম ‘সিংজী কি হাভেলি’ ইত্যাদি।

হলুদ পাথরের তৈরী এই হাভেলিগুলির মধ্যে বৃহত্তম ‘পাটোয়া কি হাভেলি’। ৫টি ছোট হাভেলি নিয়ে তৈরী বিশাল এই হাভেলি। তৈরী হতে সময় লেগেছিলো প্রায় ৬০ বছর। রাজ্য সরকার অধিগৃহীত এটি এক গলির মধ্যে অবস্থিত।

রাজকীয় প্রবেশ তোরণ পার হলেই সামনে এক বিশাল প্রাঙ্গন বা ‘চক্‌’ বেষ্টন করে রয়েছে একাধিক তলবিশিষ্ট একই সঙ্গে সন্নিহিত কারুকার্যময় মহলগুলি। এই চক্‌ বা প্রাঙ্গন ব্যবহৃত হতো, গৃহের কোনোও অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে। প্রথমেই চোখে পড়ে বায়ুসঞ্চালণের পথ হিসাবে নির্মিত সূক্ষ্ম কারুকার্যময় জালিকাজ ও সন্নিহিত ঝরোখাগুলি। এগুলি সজ্জিত নানারূপ ভাস্কর্য, ফুল, লতাপাতা ইত্যাদি দ্বারা। সঙ্গে রয়েছে বহির্মুখী ৬০টি ঝুলবারান্দা ও তদুপরি ছত্রী। প্রতিটি ঝরোখা ও প্রতিটি জালিকাজই আলাদা – অর্থাৎ একে অপরের Copy/Paste নয়। এর থেকেই বোঝা যায় তখনকার শিল্পীদের শিল্পভাবনা কতো সমৃদ্ধ ছিলো।

বাইরের স্থাপত্যে রয়েছে মুঘল ও রাজস্থানী নির্মানশৈলীর ছাপ। কিন্তু অন্দরের চারিদিকে ছড়ানো শুধুমাত্র রাজস্থানী শৈলী ও কলাকৃতি। তখনকার ধনিক সমাজের ঐশ্বর্যই শুধু নয়, তাদের রুচিবোধেরও পরিচয় এর অন্দরসজ্জায়। অন্দরের অসংখ্য কক্ষের সিলিং, দেওয়াল, স্তম্ভ বা খিলানগুলি সজ্জিত – দর্পন, জালিকাজ, ভাস্কর্য, রঙীন ফ্রেসকো, ম্যুরাল ও রাজস্থানী চিত্রকলায়। এখানেও রয়েছে দর্পন সমৃদ্ধ এক শিশমহল। কক্ষগুলি ব্যবহার হতো দৈনন্দিন জীবনের নানান প্রয়োজনে। বিভিন্ন কক্ষের সজ্জাও বিভিন্ন। ভাস্কর্যের মধ্যে পড়ে ফুল, লতাপাতা, পূর্ণাবয়ব ও প্রসাধণরতা নারীমূর্তি। উপর, নিচ বা চারিদিকের সোনা, রূপা ও অন্যান্য মূল্যবান পাথরের কারুকার্য চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। একটি কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে যাওয়ার প্রবেশপথ রূপে ব্যবহার হয়েছে বিভিন্ন আকৃতির খিলানগুলি। এগুলিতে যেমন রয়েছে নানারূপ ভাস্কর্য, তেমনই রয়েছে নানারূপ রঙ্গীন চিত্র। রয়েছে পেখম মেলা অপূর্ব ময়ূর। এর ছাদ থেকে দেখা যায় কেল্লা ও সমগ্র জয়সলমীর।

অনতিদূরেই রয়েছে দুই স্থপতি ভাই দ্বারা নির্মিত অপূর্ব সূক্ষ্ম কারুকার্যময় ও মূর্তি শোভিত, রাজার দেওয়ান নাথমলজীর হাভেলি। এর দুই অংশ দুই ভাই দ্বারা নির্মিত হলেও, কোন অংশটি যে শ্রেষ্ঠ নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। তফাৎ অবশ্য আছে – কিন্তু সাধারণ চোখে তা ধরা পড়ে না। একদিকে রয়েছে এক পাল্লা বিশিষ্ট ঝরোখা, অন্যদিকে রয়েছে দুই বা তিনপাল্লা বিশিষ্ট ঝরোখা। একদিকে রয়েছে ফুল-লতা-পাতার কারুকার্য, অন্যদিকে রয়েছে চমৎকার ময়ূরের কারুকার্য। এর অন্দরের দেওয়ালে রয়েছে অসংখ্য মিনিয়েচার ছবি। হাভেলিগুলির সামনে রয়েছে নানারূপ রাজস্থানী সামগ্রীর অসংখ্য দোকান।

এইসব হাভেলিগুলি ও কেল্লার সামনে কোনোও এক অনামী লোকশিল্পী মধুরস্বরে গেয়ে চলেছে রাজস্থানী লোকসঙ্গীত। হাতে রয়েছে তারের এক বাদ্যযন্ত্র। শ্রোতা সেখানে আছে কি নেই, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না – তারা গেয়ে চলেছে নিজের মনে, নিজের আনন্দে।

আজ ৩১শে ডিসেম্বর, ১৯৮৪ – বছরের শেষ দিন। আজ আমরা চলেছি মরুভূমিতে – বছরের শেষ সূর্যাস্ত দেখতে। জয়সলমীরের অন্যতম আকর্ষণ শহর থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে স্যাম স্যাণ্ড ডিউনস্‌ (Sam Sand Dunes)। ট্যুরিস্ট লজই আমাদের জীপের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দুপুর নাগাদ রওনা হয়েছি, ফিরবো সন্ধ্যায়।

অবশেষে পৌঁছে গেলাম অপরূপ সেই মরুভূমিতে। এখানেও আমাদের স্বাগত জানালো রাজস্থানী এক লোকসঙ্গীত শিল্পীদল – সঙ্গে রয়েছে একজন নৃত্যশিল্পীও। সামনেই দিগন্তবিস্তৃত হলুদ বালির প্রান্তর। মরভূমির ভিতর যেতে এখান থেকেই আমরা উটের ব্যবস্থা করলাম। প্রতিটি উটের পিঠে দু’জন বসার ব্যবস্থা। সঙ্গে থাকবে একজন চালক। উট কিভাবে ওঠে বা বসে আমরা সবাই প্রায় দেখেছি ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমায়। উট ওঠে বা বসে দু’ভাগে। বসার সময়ে সামনের ভাগ আগে বসে, ওঠার সময়ে উল্টো। পেছনের ভাগ আগে ওঠে। দু’বারেই হুমড়ি খাওয়ার সম্ভাবনা। যা হোক্‌, আমরা সবাই উঠে বসলাম। এবার শুরু হলো আমাদের যাত্রা। সূর্যালোকে চক্‌চকে হলুদ রুক্ষ, শুষ্ক বালুভূমির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছি সামনে। মাঝে মাঝে সামান্য সবুজের ছোঁয়া, উটের খাদ্য দু-একটা কাঁটাঝোপ মাত্র। লালমোহনবাবুর সেই বিখ্যাত প্রশ্ন মনে পড়ে গেলো – “কাঁটা কি এরা (উট) বেছে খায়?”

উঁচু-নিচু, ঢেউ তোলা বালিয়াড়িগুলি হাওয়ার ঝাপটায় প্রায় প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তন করছে নিজেদের গঠনাকৃতি। অবশেষে উট আমাদের জনশূন্য নির্জন এক জায়গায় নামিয়ে দিলো। আমরা সেখানেই পশ্চিমাভিমুখী বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম সূর্যাস্তের। আমাদের দুই মেয়ে বালি নিয়ে খেলতে লাগলো। আমরাও তাদের সঙ্গ দিলাম। মজা এই – বালিগুলি হাতে একেবারেই লেগে থাকে না, হাত নোংরাও করে না – ঝরে পড়ে যায় নিচে।

দিগন্তবিস্তৃত বালুভূমির মধ্যে বসে আছি আমরা ক’জন, সূর্যাস্তের অপেক্ষায়। মনে ভাবছি, কি বিচিত্র এই প্রকৃতি। কোথাও শুভ্র বরফে আবৃত, আবার কোথাও সে হলুদ বালুকাময়। কোথাও উত্তুঙ্গ পর্বতশিখর আবার কোথাও অতল গভীর খাদ। কোথাও নূপুরের ধ্বনি তুলে বয়ে চলা কলস্বনা নদী তো কোথাও ঢেউয়ের গর্জন তোলা উত্তাল সমুদ্র। কোথাও অরণ্য তো কোথাও সমতল প্রান্তর। কে এমন করে বিচিত্র রূপে প্রকৃতিকে সাজিয়ে তুলেছে, কে জানে! কিছুক্ষণের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। সচেতন হয়ে দেখি সূর্য প্রায় দিকচক্রবালে পৌঁছে গেছে। অস্তসূর্যের রক্তিমাভায় তখন হলুদ বালুভূমিও রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।

হঠাৎই যেন সূর্য কোথায় টুপ করে ডুবে গেলো – না কি হারিয়ে গেলো। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তপ্ত বালুও শীতল হয়ে গেলো। শীতকালের বাতাসের শীতলতাও যেন আবার ফিরে এলো। এবার আমরা ফিরে চললাম – আবার সেই উটের পিঠে চড়েই – আমাদের গাড়ির কাছে। আমাদের রোমাঞ্চকর উট-সওয়ারী বা মরুভূমি ভ্রমণ এখানেই শেষ হলো।

পরদিন চললাম গদ্দীসর লেক দেখতে। বেশী বড় নয় – তবে পরিষ্কার জল। সিঁড়ি দিয়ে একটু নেমে রয়েছে মাথা ঢাকা পাথরের এক বসার জায়গা। রোদ্দুর আড়াল করতেই এই ব্যবস্থা। বেশ কিছুক্ষণ এখানে বসে, ঠাণ্ডা হাওয়ার আরাম নিয়ে, আমরা ফিরে চললাম লজে।

পরদিন চললাম ব্যাসছত্রী – কোনোও এক রাজার স্মৃতিস্তম্ভ। রাজার সমাধিস্থানের উপর নির্মিত এই স্মারকে রয়েছে একটি উচ্চ মঞ্চ। মঞ্চের চারিদিকে কারুকার্যময় স্তম্ভের উপরে ছাতার আকারে ছত্রী। সবই হলুদ পাথরের। শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে বাদাবাগে রয়েছে রাজাদের এমনই একাধিক স্মৃতিস্তম্ভ। সেখান থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য অসাধারণ।

লেক বা ছত্রী দেখতে তো বেশী সময় লাগে না। বাকি সময় কাটাতে আমরা ফিরে চললাম আবার সেই কেল্লার কাছে দোকান-বাজারের মধ্যে দিয়ে।

পরদিন বিকেলে আবার চলেছি সোনার কেল্লার পথে – সূর্যাস্তে সোনার কেল্লার রং পরিবর্তন দেখতে। ভোরের সোনালী চক্‌চকে সোনার কেল্লা সূর্যাস্তে পরিবর্তিত হলো সোনালী মধুবর্ণে।

আজ শেষদিন। সারাদিন বেড়ালাম পুরনো দোকান, বাজার, গলি-ঘুঁজির মধ্যে দিয়ে। দুপুরে লজে ফিরে খেয়েদেয়ে তৈরী হলাম – রাতের ট্রেনের জন্য।

পরদিন যোধপুর পৌঁছে, রিটায়ারিং রুমে জিনিসপত্র রেখে তৈরী হয়ে আমরা চললাম উমেদভবন প্যালেসে। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে মহারাজা উমেদ সিংহ কর্তৃক নির্মিত এই ভবন এখনোও পৃথিবীর বৃহত্তম ব্যক্তিগত আবাস। পূর্বতন যোধপুরের রাজাদের এই বাসভবনে রয়েছে ৩৪৭টি কক্ষ। ২৬ একর জমির উপর এই বাসভবনে রয়েছে ১৫ একরের চমৎকার উদ্যান। ভবনটি তিনটি পর্বে বিভক্ত। একপর্ব রাজপরিবারের বাসগৃহরূপে, একপর্ব তাজ গ্রুপের পাঁচতারা হোটেল ও শেষপর্বে রয়েছে বিংশ শতাব্দীর যোধপুরের রাজ পরিবারের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি দ্বারা সজ্জিত এক মিউজিয়াম। প্রাসাদে রয়েছে নিজস্ব দরবার হল, ব্যাঙ্কোয়েট হল, লাইব্রেরী, সুইমিং পুল, বিলিয়ার্ড রুম ইত্যাদি। ভবনের অন্দর নির্মিত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য স্থাপত্যকলার সংমিশ্রণে। মিউজিয়ামে রয়েছে রাজা মহারজের ব্যবহৃত নানান দ্রব্যাদি – নানারকম ঘড়ি, অস্ত্রশস্ত্র, চমৎকার রাজস্থানী মিনিয়েচার পেন্টিং ও চিত্রকলা, যার অধিকাংশই অ্যান্টিক। এছাড়াও স্টাফড্‌ চিতাবাঘ ও রাজাদের ব্যবহৃত পুরনো গাড়িগুলিও রয়েছে প্রদর্শনীর জন্য।

আজ রাতের ট্রেনেই ফিরে যাবো দিল্লী। মন ভারাক্রান্ত। স্মৃতিতে রয়ে যাবে যোধপুর কেল্লা, সোনার কেল্লা এবং হাভেলির স্থাপত্য, ভাস্কর্য, অন্দরের নান্দনিক সজ্জা ও রাজা মহারাজাদের ঐশ্বর্য বিলাস। সর্বোপরি মনে রয়ে যাবে জয়সলমীরে আমাদের বিশেষ সান্ধ্যভ্রমণ – যার আনন্দ একমাত্র এখানেই লাভ করেছিলাম। মনে রয়ে গেছে সেই কুলীর বলা “শুক্রিয়া” বা হোটেল কর্মচারীর গর্বভরে বলা “এখানে কেউ আপনাদের গয়নার দিকে ফিরেও দেখবে না।” আর সব জায়গায় নিজের মনে নিজের আনন্দে গাওয়া তাদের ঐতিহ্যশালী রাজস্থানী লোকসঙ্গীত।

অতি সম্প্রতি আমার একজন পরিচিত গিয়েছিলো এইসব জায়গায়। ফিরে বলেছে যে, এখন জয়সলমীর কেল্লার ও পাটোয়া কি হাভেলির অনেকগুলি কক্ষ পরিবর্তিত হয়েছে রাজা মহারাজাদের দ্রব্যাদির প্রদর্শনী কক্ষরূপে। দর্শক এখন কেল্লা বা হাভেলির গঠনশৈলী বা সৌন্দর্য নয়, রাজা মহারাজাদের ব্যবহৃত মূল্যবান দ্রব্যাদি দেখতেই বেশী আগ্রহী। কিন্তু আমার মনে হয়, এগুলো তো যে কোনোও মিউজিয়ামে তুলে নিয়ে এসে রাখা যায় – সম্পূর্ণ কেল্লা বা হাভেলি কি তুলে এনে প্রদর্শনী কক্ষে সাজানো যাবে? এছাড়াও সোনার কেল্লার দোকান, বাজার বা হোটেল-রেস্তোরাঁর সংখ্যাও প্রচুর বৃদ্ধি পাওয়ায় ভিড়ও প্রচণ্ড বেড়ে গেছে। এখন আর সান্ধ্যভ্রমণে তেমন নির্জন পথও পাওয়া যায় না। মরুভূমিতেও তাঁবু খাটিয়ে এখন রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে পানাহারের সঙ্গে চলে চিৎকৃত নাচগানের আসর। আর তারই ফলশ্রুতি মরুভূমি ভরে উঠেছে নিক্ষিপ্ত বর্জ্যে – কাঁচের, প্লাস্টিকের বোতল বা প্যাকেটে। উটের গাড়ি ও জীপ দর্শকদের নিয়ে যাচ্ছে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে। মরুভূমির বালিও মলিন হয়ে কাদাময় হয়ে যাচ্ছে। আগে যে জয়সলমীর আমাদের মুগ্ধ করেছিলো – এখন হয়তঃ তার অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে।

~ যোধপুর – জয়সলমীর ভ্রমণ সমাপ্ত ~

লেখিকা পরিচিতি
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. দারুণ লাগলো। কুড়ি বছর আগে গেছিলাম। তুমি সব স্মৃতিগুলো তাজা করে দিলে।

  2. বাহ্!! সব মিলিয়ে খুব ভালো লেখা হয়েছে।
    💐💐💐💐💐💐💐💐💐💐💐💐💐

  3. আমার তো ভারত ভ্রমণ হয়ে যাচ্ছে। আর কোন কোন যায়গা লুকিয়ে আছে তোমার ঝুলিতে।অপেক্ষায় রইলাম।খুব সুন্দর লেখা।👌👌💐💐

    1. এখনো অনেক বাকী আছে । সব জায়গাতেই মানস ভ্রমণ করিয়ে দেবো ।

  4. বর্ণনা খুব নিখুঁত ও অনেক তথ্য সমৃদ্ধ । খুব অবাক হয়েছি ।
    কিন্তু পথের বর্ণনা পেলাম না । সঙ্গে কারা ছিল ?
    ভাল লেখা হয়েছে ।

  5. প্রথম পর্ব পড়লাম। খুব ভালো লাগলো। আমার বিস্ময় লাগছে এত তথ্য সমাবেশ পড়ে।

  6. এখনও স্মৃতি শক্তি ঠিক ঠাক আছে মনে হয় ।

Leave a Reply to Anjan Bose Chowdhury Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!