Home ভ্রমণ, প্রবন্ধ আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৭
ভ্রমণপ্রবন্ধ

আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ৭

গোপা মিত্র

কেদার বদ্রী

।। প্রথম পর্ব ।।

“দেবতা না চাইলে মন্দিরের দরজা থেকে দেবদর্শন না করেই ফিরে আসতে হয়।” ছোটবেলায় মা বলতেন। মা আরোও বলতেন যে, “এমনও হয়েছে যে, পুরীর জগন্নাথদেব দর্শনে গিয়ে হয়তঃ বিশেষ কোনোও কারণে মন্দির বন্ধ দেখে জগন্নাথদেব দর্শন না করেই ফিরে আসতে হয়েছে।”

অনেকদিন থেকেই মনের গোপনে একটা ইচ্ছে লালন করছিলাম যে, একবার চারধাম – কেদার, বদ্রী, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী যাবো। কিন্তু কিছুতেই সুযোগ পাচ্ছিলাম না। মেয়ের পড়াশুনা, পরীক্ষা – এসব থেকে কিছুতেই আর ছুটি মিলছিলো না।

১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে মেয়ের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলে, বেশ কিছুদিন ছুটি। মনে হলো, এটাই সুযোগ, অক্ষয় তৃতীয়ায় কেদারের মন্দির খুললে, একবার ঘুরে আসি – কেদারের সঙ্গে বাকি ধামগুলিও।

কিন্তু ভাবা আর কাজে করার মধ্যে তফাৎ অনেক। সামনেই অক্ষয় তৃতীয়া। এতো অল্প সময়ের মধ্যে এরকম একটা Hectic Tedious Tour-এর ব্যবস্থা করা আমাদের পক্ষে একেবা্রেই অসম্ভব। তাই আমরা এক নামী নির্ভরযোগ্য পর্যটক সংস্থার দ্বারস্থ হলাম। কিন্তু হায়! আমাদের পছন্দমতো দিনের বুকিং আগেই পূর্ণ হয়ে গেছে। ওরা আমাদের সেপ্টেম্বর মাসে যাওয়ার জন্য বললো। মার সেই কথাটা আবার একবার মনে পড়ে গেলো। মনে মনে স্থির করলাম, আমি গেলে আমার পছন্দমতো দিনেই যাবো, না হলে যাবোই না। তা ছাড়া আরোও একটা কারণও অবশ্য ছিলো। মে মাসের গরমে চারিদিকের বরফ গলতে শুরু করবে ঠিকই, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে গলে যাবে না। কেদার পাহাড়ও তখন থাকবে বরফে ঢাকা। দর্শনের সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের এমন সুযোগটাই বা ছাড়বো কেন? কদিন পরেই আবার বুদ্ধ পূর্ণিমা। পূর্ণিমা রাতে পাহাড়, নদী, মন্দির মিলিয়ে প্রকৃতির যে অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের দেখা মিলবে। সেটাই বা কম কিসে?

আমাদের আগ্রহ দেখে সংস্থা আমাদের Provisional Booking-এর একটা সুযোগ দিলো। আমরা সামান্য কিছু অগ্রিম দিয়ে ফিরে এলাম। ফিরে এসে দিন গুনতে লাগলাম। মনে সংশয়, কেদার দর্শন হবে কি হবে না! দেখা যাক্‌।

যাত্রার ঠিক দুদিন আগে সংস্থা ফোনে জানালো যে, কজন যাত্রা বাতিল করেছে – আমরা যেতে পারি। তবে তখনই এসে পুরো টাকা জমা দিতে যেতে হবে। কল্যাণ সঙ্গে সঙ্গেই চললো টাকা জমা দিতে আর আমি ব্যাগ গুছোতে বসলাম। অবশ্য ততোদিনে ব্যাগ গুছোনো আমার অভ্যেস হয়ে গেছে, কি যাবে আর কি যাবে না, এ সবই আমার মুখস্থ। কিন্তু সঙ্গে বেশ কিছু গরম জামা নিতে হবে – আগে সেগুলো সব বার করলাম। ট্রলি ব্যাগ তখনোও আসেনি। আমার একটা স্যুটকেশ ছিলোই, বোনের কাছ থেকে আর একটা স্যুটকেশ চেয়ে নিলাম। একটায় গরম জামা, একটায় সাধারণ জামাকাপড় ভর্তি করলাম আর কাছে রাখার জন্যে একটা হাতব্যাগ নিলাম। এর বেশী আর নেওয়া যাবে না – এটাই ছিলো সংস্থার নির্দেশ।

হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে দু রাত পর এসে পৌঁছলাম হরিদ্বার। হোটেলে যে ঘরে আমরা জায়গা পেলাম, সেটা একটা বদ্ধ ঘর। একটাই জানলা, সেটাও আবার ভেতর দিকে, পাশেই করিডোর – কাজেই জানলা খোলা অসম্ভব। ওদের বলাতে ওরা একটা এয়ার কুলার এনে বসিয়ে দিলো। সন্ধ্যায় একবার ‘হর কি পৌড়ী’-তে গেলাম, গঙ্গা দর্শন করলাম, একটু পাশের বাজারে ঘোরাঘুরি করে ফিরে এলাম।

পরদিন যাত্রা কেদারের পথে। দেবতাত্মা হিমালয়ের ১১,৭৫৫ ফুট উচ্চতায় এক নয়নাভিরাম নৈসর্গিক উপত্যকায় বিরাজ করছেন দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম ভগবান কেদারনাথ। যুগ যুগ ধরে হিমালয়ের এই শৈবতীর্থের পূণ্য লোভাতুর ভক্তদের আনাগোনা। কেদারক্ষেত্রে পৌঁছবার প্রচলিত পথটি হলো হরিদ্বার থেকে গাড়ি বা বাসে গৌরীকুন্ডে এসে, সেখান থেকে হেঁটে, ঘোড়ায়, ডান্ডিতে বা কান্ডিতে ১৪ কিলোমিটার (২০১৩ সালের হড়পা বানের ধ্বংসের পর পথের দূরত্ব বেড়ে হয়েছে ১৭ কিলোমিটার।) চড়াই উঠে কেদার মন্দিরে।

প্রতি বছর অক্ষয় তৃতীয়ার পূণ্য লগ্নে কেদারনাথের প্রতিভূ রৌপ্যনির্মিত পঞ্চমুখী শিবলিঙ্গ ডুলিতে করে নিয়ে আসা হয় উখিমঠ থেকে কেদারখণ্ডে। আবার কালীপূজার পর কেদারনাথ চলে যান উখীমঠে, তাঁর শীতকালীন আবাসে। সেখানেই তখন তাঁর পূজা হয়।

হরিদ্বার থেকে প্রায় ২৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গৌরীকুন্ড। পথ গিয়েছে হৃষীকেশ, দেবপ্রয়াগ, শ্রীনগর, রুদ্রপ্রয়াগ, অগস্ত্যমুনি, শোনপ্রয়াগ হয়ে।

হরিদ্বার থেকে কেদারনাথের জয়ধ্বনি দিয়ে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ। পথে হেয়ার পিনের বাঁক, পাহাড় ও খাদের মাঝখানে সরু পথ। দীর্ঘ চড়াই ভেঙে এক পর্বতের গা ঘেঁষে আর এক পর্বতের কাছাকাছি আসা। বলা যায় শিখর থেকে শিখর ছাড়িয়ে চলেছি আমরা। পাশে আমাদের সঙ্গী অমৃতবাহিনী গঙ্গা।

দেবপ্রয়াগে অলকাপুরী হিমবাহ থেকে উৎসারিত নীল জলের অলকানন্দা এসে মিলিত হয়েছে গঙ্গোত্রীর গোমুখ থেকে উৎসারিত গঙ্গার আপাত বর্ণহীন জলধারার সঙ্গে। দেবপ্রয়াগে এসে অলকানন্দা হারিয়েছে তার পৃথক স্বত্ত্বা। অলকানন্দার গর্জন এসে মিলে গিয়েছে ভাগীরথীর কলতানের সঙ্গে।

গাড়োয়ালের প্রাচীন রাজধানী শ্রীনগরে এসে আমাদের দ্বিপ্রাহরিক আহারের বিরতি। এখানে বলে নেওয়া ভালো, দেবভূমি হিমালয়ে আমিষ আহার নিষিদ্ধ। তবে আমাদের কোনোও অসুবিধা হয়নি। কারণ, প্রতিদিনই আমাদের পরিবেশন করা হয়েছিলো হরেক রকম উৎকৃষ্ট নিরামিষ পদ – শুক্তো, পোস্ত, ধোঁকার ডালনা, ছানার ডালনা, চাটনি, নানারকম মিষ্টি, পায়েস ইত্যাদি।

এরপরের দর্শনীয় রুদ্রপ্রয়াগ। এখানে সবুজ মন্দাকিনীর আলিঙ্গন নীল অলকানন্দাকে। সূর্যের আলোকে তখন মাঝেমাঝেই ঝলসে উঠছে বহুদূর পাহাড়ের শীর্ষদেশে জমে থাকা তুষারের শিরস্ত্রাণ। আশেপাশের গাছগাছালিতে পড়া সূর্যের মোহিনী কিরণ, পাশ দিয়ে বয়ে চলা মন্দাকিনী, সৃষ্টি করেছে এক অপার্থিব দৃশ্যের। বাতাস এখানে কনকনে ঠাণ্ডা, রোদ উজ্জ্বল কিন্তু তাপবিহীন। অসংখ্য পাহাড়ী ঝর্ণা কলকলিয়ে নেমে এসে মন্দাকিনীতে বিলীন হয়েছে। চারদিকে রংবেরঙের পাখী উড়ছে। মাঝেমাঝেই গাছপালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে পাহাড়ের কোলে কোনোও এক নাম না জানা গ্রাম।

শোনপ্রয়াগে আবার দুটি নদীর মিলন। বাসুকীতাল থেকে উৎসারিত শোনগঙ্গা এখানে এসে মিলে গিয়েছে উচ্ছ্বল মন্দাকিনীর সঙ্গে।

আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি গৌরীকুন্ডে। রাস্তা খুব সরু। আস্তে আস্তে সন্ধ্যার অন্ধকারও নেমে আসছে। সঙ্গে শুরু হয়েছে টিপ টিপ বৃষ্টি।

গৌরীকুন্ডের আগে পরে ত্রিযুগী নারায়নের মন্দির। এইখানে শিব-পার্বতীর বিয়েতে পুরোহিত ছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা এবং সাক্ষী ছিলেন নারায়ণ। তবে এখানে আমরা কেউই নামিনি।

কনকনে ঠাণ্ডায়, বৃষ্টি ভেজা হাওয়ায়, পথশ্রমের ক্লান্তিতে আমরা সকলেই তখন বিধ্বস্ত। এখনই আমাদের একটা আশ্রয় দরকার।

পর্যটক সংস্থা আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলো উষ্ণ কুন্ডের কাছে মন্দাকিনীর ধারে অবস্থিত ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে। সরু খাড়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে আমাদের থাকার ব্যবস্থা তিনতলার এক ঘরে। ঘর খুব বড় না হলেও আরামদায়ক। ঘরের ঐশ্বর্য লাগোয়া ছোট এক ব্যালকনি। ঠিক নিচ দিয়েই বয়ে চলেছে গর্জনরতা মন্দাকিনী, মেঘে ঢাকা অন্ধকার রাতে নদীর সৌন্দর্য কিছুই বুঝলাম না। শুধু তার গর্জনই শুনলাম।

পরদিন প্রাতঃরাশের পর আমরা রওনা দিলাম কেদারনাথের পথে। সঙ্গে একরাত্রি থাকার মতো কিছু প্রয়োজনীয় জামাকাপড় ও জিনিসপত্র একটা ছোট হাতব্যাগে ভরে দিয়ে দিলাম পর্যটক সংস্থার হাতে। ওরা ওগুলো কেদারনাথে আমাদের কাছে পৌঁছে দেবে।

১৪ কিলোমিটার (১৯৯৪-এর হিসেবে) চড়াই যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী উঠতে চেষ্টা করছে। নিজেদের ওপর ভরসা করে আমরা তিনজন – আমি, কল্যাণ ও আমাদের মেয়ে সোনাই – আমরা পায়ে হেঁটেই উঠবো ঠিক করলাম। সংস্থার পরামর্শে স্থানীয় দোকান থেকে আগেই তিনটি লাঠি কিনে নিলাম। তারপর শুরু হলো আমাদের ওপরে ওঠা।

রাস্তা পাথুরে কিন্তু ভালো – বেশ প্রশস্ত। তবে, ওই একই রাস্তা ধরে মানুষজন উঠছে, নামছে, ঘোড়া, ডান্ডি, কান্ডিও ওঠানামা করছে। আশ্চর্য এই – কোথাও কেউ কারো পথে বাধার সৃষ্টি করছে না। কেদারের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে চলেছে তীর্থযাত্রীরা। শুধু চড়াই আর চড়াই। লাঠির ভরে চড়াই ভেঙে এগিয়ে চলেছি। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মন্দাকিনী। কখনোও একেবারে কাছে, কখনোও অনেক নিচে – সবুজ সিল্কের শাড়ীর মতো। চারিধারে সবুজ বনানী, বুনো ফুলের সমারোহ আর শৈলশিখরের মনোরম শোভা।

চারিদিকে তাকাই আর মনে হয় প্রকৃতির এই অপরূপ সৃষ্টি কার হাতে গড়া? কে এমন ভাবে পর্বতের পর পর্বত সাজিয়ে গড়ে তুলেছে এমন অনিন্দ্যসুন্দর সুবিশাল হিমালয় পর্বতমালা? ঘর ছেড়ে বেরিয়েছি দেবতাত্মা হিমালয় দেখবো বলে। তবে, স্বর্গের পথে চলেছি এ বিষয়ে কোনোও সন্দেহ নেই।

অনেকদিন আগে মানসচক্ষে যে চিত্র প্রত্যক্ষ করেছিলাম কুলুতে, আজ আবার সেই একই চিত্র প্রত্যক্ষ করছি – কিন্তু স্বচক্ষে। উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই একাত্ম হয়ে একই দেবতার উদ্দেশ্যে জয়ধ্বনি দিতে দিতে চলেছে কেদারের পথে। এটাই তো ভেদাভেদহীন ভারতবর্ষের প্রকৃত চিত্র।

প্রথমেই পড়ে ভৈরব চটি। কথিত আছে ভৈরব রূপ নিয়ে ভৈরবনাথ যুগ যুগ ধরে কেদারক্ষেত্রকে রক্ষা করে আসছেন। গৌরীকুন্ড থেকে ৭ কিলোমিটার ওপরে (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯০০০ ফুট উচ্চতায়) এ পথের বৃহত্তম চটি রামওয়াড়া। আমি তখন খুবই ক্লান্ত, আরোও ৭ কিলোমিটার চড়াই উঠতে হবে। দেরীও হয়ে যাচ্ছে। তাই এখান থেকেই আমরা ৩ জন ৩ টি ঘোড়া নিলাম।

মন ভরে আছে অপার আনন্দে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবো আমার সেই দেবতার কাছে, যাকে দেখার জন্য এতো দূর থেকে, এত কষ্ট করে এখানে এসেছি।

হঠাৎই চোখে পড়লো আকাশ জুড়ে বিস্তৃত তুষারশুভ্র ২২,৭৭০ ফুট উঁচু কেদার গিরিশ্রেণীর কোলে কেদারনাথের মন্দির। পড়ন্ত সূর্যের লালচে সোনালী কিরণে সেই পর্বতমালা, এক অনির্বচনীয় মহিমাময় রূপ ধারণ করেছে।

নেমে পড়লাম ঘোড়া থেকে। এগিয়ে চললাম পায়ে হেঁটে। আর কিছুদূর, তার পর ছোট ছোট স্থানীয় দোকান পার হয়ে মন্দিরের সামনে এসে পৌঁছলাম। মনে মনে প্রণাম জানালাম সেই দেবতাকে, যাঁর বাসস্থান এই নির্জন হিমানীতে। তাঁর অপার করুণায় আজ তাঁরই দোরগোড়ায় এসে পৌঁছতে পেরেছি। কিন্তু এখন তাঁকে দর্শন করা যাবে না। আমাদের আগে যেতে হবে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে – সেখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা।

অ্যাটাচড বাথ সহ বেশ প্রশস্ত ঘর। আমরা এসে সবে হাত-পা ছড়িয়ে বসেছি, একজন পান্ডা এসে উপস্থত হলো। সে আমাদের প্রস্তাব দিলো যে, আমরা যদি তাকে তখনই টাকা দিই, তাহলে সে আমাদের কেদারনাথ দর্শনের ব্যবস্থা করে দেবে। তবে সেক্ষেত্রে সে যে কোনোও সময়ে আমাদের ডেকে নিয়ে যাবে। এমন কি, মধ্যরাতও হতে পারে। যখনই ডাকবে, তখনই আমাদের যেতে হবে।

আমাদের সঙ্গে আসা একটিমাত্র পরিবারই শুধু রাজি হলো টাকা দিতে। কল্যাণ রাজি থাকলেও, আমি রাজি নই। ঘুষ দিয়ে দেবদর্শন করবো না। মায়ের সেই বলা কথাটা, আবার মনে পড়ে গেলো। “দেবতা না চাইলে, দেবদর্শন কিছুতেই হবে না।” দেখা যাক্‌, দেবতা কি চান! আমি অপেক্ষা করবো।

কনকনে ঠাণ্ডা রাতে একবার বাইরে বেরিয়ে আর উজ্জ্বলশুভ্র পর্বতচূড়া দেখে এসে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। পরদিন ভোরের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে – সম্ভবতঃ ৫টা/সোয়া ৫টা হবে, এমন সময়ে দরজার বাইরে মহিলা কণ্ঠের চিৎকার, “তোমরা কেউ যদি কেদারনাথ দর্শন করতে চাও, তাহলে এক্ষুনি যাও। মন্দির ৬টায় খুলবে। লাইন প্রায় নেই বললেই চলে।” – আমাদের দলেরই একজন মহিলা সবাইকে চিৎকার করে বলছেন।

আমি তো শুনেই লেপকম্বল ফেলে দিয়ে তড়াক্‌ করে লাফিয়ে উঠলাম। কল্যাণকেও ঠেলে তুলে দিলাম। ওকে বললাম যে, “আমি তৈরী হয়ে মন্দিরে গিয়ে লাইন রাখছি, তুমি মেয়েকে তৈরী করে নিয়ে এক্ষুনি চলে এসো।” কোনোওরকমে হাত মুখ ধুয়ে, মোজা, টুপি, গ্লাভস্‌ চাপিয়ে দৌড়লাম মন্দিরের দিকে।

এবার ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের অবস্থানের সুবিধেটা বলতেই হয়। কেদারনাথের মন্দির আর ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ একই দেওয়ালের দুদিকে অবস্থিত। আমি সঙ্ঘের ছাদের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে পৌঁছে গেলাম কেদারনাথ মন্দিরের চাতালে। সামনেই মন্দিরের প্রবেশ দরজা – বন্ধ। সামান্য ২/৪ জন ভক্ত লাইন দিয়ে আছেন। আর আশ্চর্য, আমার সামনেই দর্শনের অপেক্ষায় বসে রয়েছে সেই  পরিবার, যারা গতকাল পান্ডাকে টাকা দিয়েছে।

ইতিমধ্যে কল্যাণ মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছে। আজ বুদ্ধ পূর্ণিমা – মেঘ মুক্ত নীল আকাশ, প্রভাত সূর্যের কিরণে ঝলমলে কেদার পর্বতের পটভূমিকায়, কেদার মন্দিরের দরজার সামনে উপবিষ্ট আমরা অপেক্ষা করছি দেবদর্শনের।

পিছন দিকে লাইন তখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন সময়ে দরজা খুলে গেলো। দ্বারের সম্মুখেই মহাদেবের বাহন নন্দীর প্রস্তরময় মূর্তি। প্রথমে তাঁকে পুজো দিয়ে, তারপর কেদারেশ্বরের পুজো দেওয়ার রীতি। কল্যাণের নিয়ে আসা ফুল-বেলপাতা নিয়ে আমরা এবার প্রবেশ করলাম মন্দির অভ্যন্তরে। ধূপ, ধুনো, চন্দন, ঘৃত ও ফুলের সৌরভে মন্দির গর্ভে এক স্বর্গীয় পরিবেশ।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর জ্ঞাতিহত্যার পাপ থেকে মুক্তি পেতে পাণ্ডবরা তখন শিবকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। শিব তখন মহিষ রূপ ধারণ করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ভীম তাঁকে চিনতে পেরে, মহিষের পিছনের পা দুটি চেপে ধরে তাঁর দুরন্ত গতি রুদ্ধ করেন। অতঃপর শিব তাঁদের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে তাঁদের পাপমুক্ত করেন।

এখানে কেদারনাথের যে শিলামূর্তি রয়েছে, তা মহিশরূপী দেবাদিদেবের পিছনের অংশ। একরাশ ফুলের আবরণে ঢাকা বাবার প্রতিভূ কৃষ্ণবর্ণ প্রস্তরখণ্ড স্পর্শ করে ফুল-বেলপাতা সহকারে তাঁর পুজো দিয়ে যে তৃপ্তিলাভ করলাম, সেই অনুভব প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই। পুরোহিত মশাইও ছিলেন অত্যন্ত সদাশয়। আমার আকুতি হয়তঃ তাঁকেও স্পর্শ করেছিলো। আমি দেবতাকে প্রদক্ষিণ করলাম, তাঁকে স্পর্শ করলাম, তিনি বাধা দিলেন না। বরং আমাকে সাহায্য করলেন, যতোক্ষণ না আমি তৃপ্ত হই। মায়ের কথা ফলে গেলো। “দেবতা চাইলে তবেই তাঁর দর্শন সম্ভব হয়।”

বাইরে এসে মন্দির প্রদক্ষিণ করে ফিরে চললাম। মন্দিরের চারধারে পঞ্চকুন্ড ও একদিকে আদি শঙ্করের সমাধি মন্দির রয়েছে। আমরা অবশ্য সেখানে আর গেলাম না।

পথের ধারে পড়ে থাকা বরফের পাশ দিয়ে, কোথাও আবার বরফ পেরিয়ে সামান্য ঘুরপথে আমরা এসে পৌঁছলাম আমাদের আস্তানায়। এবার ফিরতে ফবে গৌরীকুন্ডে। তাড়াতাড়ি দ্বিপ্রাহরিক আহারান্তে আমরা সেই আগের পথেই নিচে নামতে লাগলাম – এবার উৎরাই, তাই পায়ে হেঁটে। অগণিত ভক্তের সামিল হয়ে মুখে “জয় কেদার” ধ্বনি দিতে দিতে পরিতৃপ্ত আমি লাঠি ঠুকতে ঠুকতে মন্দাকিনীকে সঙ্গে নিয়ে নেমে চললাম, নিচে – আরোও নিচে।

সাড়ে ৩টে নাগাদ এসে পৌঁছলাম গৌরীকুন্ডে। নেমেই আগে চললাম ‘তপ্তকুন্ড’ নামে খ্যাত উষ্ণ জলের কুণ্ডে স্নান করতে। জল বেশ গরম। কিন্তু ধীরে ধীরে সইয়ে নিইয়ে অনায়াসেই স্নান করা যায়। প্রবাদ আছে, ধ্যানমগ্ন শিবের দেহমিশ্রিত স্বেদ থেকেই এই তপ্ত কুন্ডের সৃষ্টি। স্নান করে পথের ক্লান্তি, দেহের ব্যথা-বেদনা সব যেন একেবারেই দূর হয়ে গেলো।

তপ্তকুন্ডের ঠিক পাশেই আমাদের আস্তানা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে, আমাদের পুরনো সেই তিনতলার ঘরে আবার ফিরে এলাম। আজ রাত্রিবাস এখানেই। কাল যাত্রা বদ্রীনাথের পথে।

রাতে খাওয়াদাওয়ার পর এসে দাঁড়ালাম সংলগ্ন ঝুলন্ত ব্যালকনিতে। “আহা, কি হেরিলাম!” জ্যোৎস্নালোক বিধৌত রাতের প্রকৃতি, মায়াবী আলোয় ধারণ করেছে মোহিনীরূপ। আর তারই নিচ দিয়ে নুপুর-নিক্কন তুলে বয়ে যাওয়া মন্দাকিনীর সঙ্গে চলেছে ভেঙে যাওয়া, গলে যাওয়া চাঁদের লুকোচুরি খেলা।

এই অপার্থিব রমনীয় রূপ দর্শনের সৌভাগ্য ক’জনেরই বা হয়? মাত্র একটা নির্ঘুম রাতের বিনিময়ে যদি এমন একটা নৈসর্গিক দৃশ্যের সাক্ষী থাকা যায়, তাহলে না হয় একটা রাত না ঘুমিয়েই কেটে যাক্‌।

পরিশেষ আমার একটাই জিজ্ঞাস্য – শুনেছি এখন হেলিকপ্টার চালু হয়েছে, কেদারনাথ দর্শনের জন্য। এতে মাত্র কয়েকঘন্টার মধ্যেই কেদার দর্শন করে পূজা দিয়ে ফিরে আসা যায়। খুব ভালো কথা, সময় সংক্ষেপ ব্যস্ত মানুষের অনেক সুবিধে করে দেবে। তবে আমার প্রশ্ন – হেলিকপটার থেকে ক্ষনিকের জন্য হিমালয়ের চূড়াগুলি দেখা গেলেও, তার অন্তরাত্মা – যার কারণে হিমালয়কে ‘দেবতাত্মা’ বলা হয় – সেটা কি অনুভব করা যায়?

(শেষাংশ পরবর্তী পর্বে)
লেখিকা পরিচিতি
 
গোপা মিত্র

ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

    1. চমৎকার বর্ণনা। ভাল লাগল।

  1. “চারধাম” ভ্রমণের “কেদার” অধ‍্যায় পড়তে পড়তে ২৬ বছর আগেকার সেই রোমাঞ্চকর দিনগুলো যেন আমার চোখের সামনে স্লাইড-শো হয়ে ভেসে উঠল। লেখার মান প্রশংসনীয়।।💐💐💐💐💐💐💐💐💐💐💐💐💐

  2. তোমার memory কে 🙏এতো details,just wow.দারুণ লেখা ।খুব সুন্দর descriptions ,মনে হচ্ছে যেন আমিও ওখানে গিয়েছিলাম।

  3. শ্রীমতি গোপা মিত্রের দু~কলমে লেখা প্রবন্ধটি খুব মন দিয়ে পড়লাম। আমার তা দূর্দান্ত লাগলো। অতি অনায়াস সাবলীল লেখা। আগামী দিনে ওনার আরো অনেক লেখা পড়ার অপেক্ষায় থাকবো।

    অনুপচৌধুরী।

    1. আপনার মন্তব্য আমায় সম্মানিত করলো ।

  4. গোপা বৌদি,আপনার স্মরণশক্তি আমাকে মুগ্ধ করলো। এতো সুন্দর লেখনী আমি অনেকদিন পড়িনি। কি সুন্দরভাবে আপনি সমস্ত দেখাটা আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরলে, তা আপনার মতো ভাষায় প্রকাশ করতে পারলাম না।ভালো থাকবেন, আর এইভাবেই লিখে আমাদের ঋদ্ধ করবেন। পরবর্তী লেখার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।

  5. ভ্রমন কাহিনী পড়ে খুব ভালো লাগলো, আপনার এই কাহিনী খুবই আকর্ষণীও, এত সবিস্তারে কখনো পড়িনি। খুব ভালো হয়েছে। আশা করি আগামী দিনে এই রকম ভ্রমণ কাহিনী পড়তে পাবো। ধন্যবাদ।

    1. সময় করে পড়েছো বলে খুব খুশী হলাম ।

  6. দারুণ। Will wait for the next part. তোমার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। Remembering things in such detail after 25 plus years is a great achievement.

  7. আমার যা ভালো লাগে বা যা পছন্দ করি তা সহজে ভুলি না ।

  8. খুব ভালো লাগলো আপনার এই ভ্রমণকাহিনী।
    আশা করি ভ্রমণের আরো অনেক কাহিনী আপনার কাছে পাবো।

  9. আপনি পড়েছেন দেখে। খুশী হলাম। আমার নামের tag এ click করলে বাকীগুলো এসে যাবে ।

  10. অপুর্ব বর্ণনা। নতুন লেখার অপেক্ষায় থাকলুম

  11. অপুর্ব বর্ণনা। নতুন লেখার অপেক্ষায় থাকলুম

  12. অলকা ভট্টাচার্য ও লক্ষ্মীকান্ত ভট্টাচার্য says:

    দু~কলমের পাতায় গোপা মিত্রের লেখা ভ্রমণবৃত্তান্ত পড়লাম। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও স্মৃতির মণিকোঠা থেকে আহরণ করে সর্বসমক্ষে প্রকাশ করার এমন নিরলস উদ্যোগকে বাহবা না দিয়ে পারা যায় না।

    দেবতাত্মা হিমালয়ের কোলে যে সমস্ত দেবভূমি বিরাজিত, খুব কম লোকেরই সেই পূণ্যভুমি দর্শণের সুযোগ হয়। লেখিকা বহু দুর্গম পথ অতিক্রম করে সেই সৌভাগ্যের অধিকারিনী হয়েছেন এবং তাঁর সেই দর্শনানুভূতি এবং আনন্দোপলব্ধির স্বাদ পাঠক পাঠিকাকে দিতে চেয়েছেন নিঃসন্দেহে এটি প্রশংসনীয় উদ্যম।

    তবে, আমাদের যাদের এই পূণ্যদর্শনের সৌভাগ্য হয়নি, তাদের অবস্থা ‘অন্ধের কিবা রাত্রি, কিবা দিন’-এর মতো। সবচেয়ে বড় কথা দেবদর্শন এবং প্রকৃতির রূপমাধুরী ও ক্ষণে ক্ষণে তার সৌন্দর্যের পালাবদল অপরের চোখ দিয়ে দেখা যায় না এবং অনুভব করাও যায় না। কারণ – দর্শন ও মনন এই দুটি ইন্দ্রিয় ঈশ্বর আমাদের দিয়েছেন স্বচক্ষে দেখার আনন্দ এবং তার পূর্ণ স্বাদ অন্তর দিয়ে অনুভব করার জন্যে। সেজন্য অপরের চোখে দেখা ভ্রমণের বিবরণ – আমরা যারা ওই দৃশ্য অবলোকন করিনি, তাদের কাছে কয়েকটি অক্ষরের সমষ্টি ছাড়া কিছু নয়। তবে লেখিকার লিখনশৈলীর বলিষ্ঠতা এবং সুচারু বর্ণনা যথেষ্ট প্রশংসার দাবী রাখে।

    1. ধন্যবাদ ।একেবারেই সঠিক মূল্যায়ন ।তবে আমার মতো এমন অনেক ভ্রমণ পিপাসু রয়েছে, যাদের পক্ষে সব জায়গায় পৌঁছোনো হয়তো সম্ভব নয়—তাদের আমার মতোই ভ্রমণ কাহিনীর মাধ্যমে মানসভ্রমণ করে সন্তুষ্ট থাকতে হয় । আমি জানি , দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে না।তবুও আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা যদি কারো মানসভ্রমণে সাহায্য করে —–

Leave a Reply to গোপা মিত্র Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!