Home সাহিত্য ও সংস্কৃতি টুকরো স্মৃতির ঝাঁপি
সাহিত্য ও সংস্কৃতি

টুকরো স্মৃতির ঝাঁপি

লেখিকা : সুমনা চৌধুরী


ছোটবেলার কথা মানেই যেন টুকরো স্মৃতির ঝাঁপি খুলে যাওয়া। আর, সেই ঝাঁপিতে কত হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনেরা। মা, বাবা, কত্তা (আমরা ঠাকুমাকে “কত্তা” ডাকতাম)। এঁদের বাদ দিয়ে ছোটবেলা হয় না কি!!

কত্তা ছিল আমার একান্ত আপন, বড় আশ্রয়। দুষ্টুমি করলে বাবার কাছে বকুনি খাওয়ার সময় যা যা শুনতাম,কারনে অকারনে কত্তার ওপর রাগ দেখিয়ে ঠিক সেই সেই ডায়লগগুলোই উগরে দিতাম। যেমন “খুব বাড় বেড়েছে তোমার, আমি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি” ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমার কত্তার সাথে প্রথম দুরে বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতি আগরতলা। সাথে আরও অনেক কিছুর প্রথমবারের অভিজ্ঞতা ঐ আগরতলা ভ্রমণ। যেমন, প্লেনে প্রথমবার ওঠা, অটো বস্তুটি তখনও কলকাতায় অজানা থাকলেও আগরতলার রাস্তায় দিব্যি চলতো।প্রথম দেখেই ছোটখাটো খেলনা খেলনা দেখতে এই যানটি আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল।আরেকটি কথাও মনে পড়ে আগরতলা এয়ারপোর্ট থেকে অটো করে আমরা যখন সার্কিট হাউসের দিকে যাচ্ছি দুরে উত্তর-পূর্ব ভারতের ছোট ছোট পাহাড়ের মাথা দেখে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম “পাহাড়, পাহাড়” বলে। বাবা বুঝিয়ে বলেছিলেন এগুলো সেই বিরাট পাহাড় না। সহজ ভাষায় বলেছিলেন, এগুলোকে টিলা বলা যায়।

সালটা বোধহয় উনিশশো ছিয়াত্তর / সাতাত্তর হবে। অনেকটাই ছোট তখন তাই যা দেখি তাতেই বিস্মিত হওয়ার সহজ ক্ষমতা ছিল।

একদিন বেরোলাম সবাই মিলে আগরতলার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখতে। সিপাইজোলা লেকে নিজেরাই প্যাডলিং করে বোট চালিয়ে ঘুরে তারপর দেখতে গেলাম সিপাইজোলা স্যাংচুয়ারি বা সোজা কথায় চিড়িয়াখানা। সেখানেই দেখলাম দুই আশ্চর্য রকম বাঁদর। মানুষ দেখে লজ্জা পেয়ে মুখ ঢাকে লজ্জাবতী বাঁদর আর চোখের পাশ দিয়ে গোল গোল দাগ ঠিক যেন চশমা পরে আছে তাই তারা চশমা পরা বাঁদর। বাড়ি ফিরেও কত দিন অবদি আমার ভাই কতজনকে যে এই আশ্চর্য প্রাণীদের গল্প শুনিয়েছে তার বোধহয় হিসেব নেই।

আগরতলার বিখ্যাত মানিক্য রাজপরিবারের একটি প্রাসাদ শহরের মধ্যে, আবার শহর থেকে একটু দূরে আরেকটি প্রাসাদ আছে যেটা “নীরমহল” নামে খ্যাত। রূদ্রসাগর হ্রদের (স্থানীয় ভাষায় টুইজিলিকমা লেক) মধ্যে এই প্রাসাদটি তাই নাম “নীরমহল”। তখন বেশ ভগ্নদশা। পরে শুনেছি সংস্কার করা হয়েছে। এখানে আমার কত্তা হঠাৎ দলছুট হয়ে হারিয়ে গেলেন। এখনও কানে বাজে ঐ ভগ্নপ্রায় প্রাসাদে বাবা এক ঘর থেকে আরেক ঘরে আকুল হয়ে “মা মা” করে কত্তাকে ডেকে ডেকে খুঁজে যাচ্ছে। হঠাৎ যেন প্রাসাদের কোনো এক বাঁকের মুখে কত্তাকে পাওয়া গেলো। তিনিও দলছুট হয়ে গেছেন বুঝে এদিক ওদিক খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন আমাদের।

ত্রিপুরা তথা আগরতলার আরও একটি দর্শনীয় স্থান হচ্ছে সতীর ৫২ পীঠের অন্যতম ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির।ত্রিপুরার মানিক্য রাজবংশের পূজিতা জাগ্রত দেবী মা ত্রিপুরেশ্বরী। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত “বিসর্জন” নাটক রচিত হয়েছিল এই মন্দিরেরই পটভূমিতে। অনেক গল্পকথা, অলৌকিক কাহিনী জড়িয়ে আছে এই মন্দিরের সাথে। গর্ভগৃহের আলো-আঁধারি ভাবগম্ভীর পরিবেশ ছোট্ট বালিকা আমাকেও যেন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু সেই ভাবটা আবার কেটে যায় মন্দির সংলগ্ন জলাশয়ের কচ্ছপ দেখে। বিশাল বিশাল কচ্ছপ ও মাছ জলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা ভ্রমণার্থীদের হাত থেকে মুড়ি খাচ্ছে। আমিও খাইয়েছিলাম। তখনই জানতে পেরেছিলাম, কচ্ছপগুলি নাকি তাদের মৃত্যুর সময় বুঝতে পেরে জল থেকে উঠে আসে। ঐ ছোট বয়সে খুবই অবাক হয়েছিলাম কচ্ছপের সমাধি দেখে। পাশাপাশি পরপর সমাধি দেওয়া হয়েছে মৃত কচ্ছপদের।

আগরতলা ভ্রমন আমার মনের মণিকোঠায় থেকে যাবে যতদিন আমি থাকবো এই পৃথিবীতে।

সার্কিট হাউসের সেই উপাদেয় খাবারের স্বাদ আজও মনে আছে। তারপর ত্রিপুরার সেই বিখ্যাত বাঁশের কাজের হস্তশিল্প। মা বেশ কিছু কিনেছিলেন শখ করে। নিজেদের জন্য, উপহারের জন্য। বাঁশের কাজে দুর্গার মুখ ওয়াল হ্যাঙ্গিং কত বছর অবধি আমাদের দেওয়ালের শোভা বাড়িয়েছে।

কত্তাকে সাথে নিয়ে সেইই আমাদের সবার শেষ বেড়াতে যাওয়া। এর দুবছরের মধ্যে বয়সজনিত শারীরিক অসুস্থতায় কত্তা আমাদের ছেড়ে চলে যান চিরকালের মতো। কত্তার সাথে গায়ে গা লাগিয়ে শোয়া, গল্প শোনা আজও আমার প্রিয়তম স্মৃতি।

ছোটবেলা হারিয়ে যায় কিন্তু আমাদের ছেড়ে যায় না। যতদিন আমরা এই সব প্রিয় মানুষদের সাথে কাটানো পুরোনো কথা মনে করে হাসবো, কাঁদবো, আনন্দিত হবো ততদিন ছোটবেলা আমাদের ছেড়ে যাবে না।

 

Author

Du-কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!