ডঃ দীপ্র ভট্টাচার্য
খেলাধুলা মানে শুধু শরীরের যুদ্ধ নয়, এটি একটি মানবিক নাটক—আবেগ, চেষ্টা, ভরসা আর প্রতিজ্ঞার গল্প। আধুনিক বিশ্বে যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) খেলার মাঠে প্রবেশ করেছে, তখন এক বড় প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে — প্রযুক্তি কি আমাদের খেলার আনন্দ ও মনুষ্যত্বকে ছিনিয়ে নিতে পারে? নাকি এটা ক্রীড়াবিদদের সক্ষমতা আরও উজ্জ্বল করার হাতিয়ার?
এই ‘দ্য ফাইনাল হাডল – AI-এর যুগে খেলা’ নাটকে আমরা দেখতে পাই, কিভাবে বিশ্বজুড়ে খ্যাতনামা ক্রিকেট ও ফুটবল তারকারা, তাদের কোচ এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা এই প্রশ্নের উত্তরে এক সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করেন। তারা চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেন, ভয় ভাগাভাগি করেন, এবং একসাথে নতুন দিশা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। খেলার মাঠে প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষের চিরকালীন খেলা, যেখানে প্রযুক্তি সহায়ক, কিন্তু নেতৃত্ব সব সময় মানুষের হাতে থাকে। এটি একটি আহ্বান—খেলা যেমন হৃদয়ের, তেমনি প্রযুক্তিরও, যদি আমরা সঠিকভাবে ব্যবহারের শিক্ষা নিতে পারি।
অঙ্ক ১, দৃশ্য ১ : সম্মেলনের সূচনা
পরিবেশ: একটি ঝকঝকে, আধুনিক কনফারেন্স হল। মাঝখানে একটি বড়, আধুনিক গোল টেবিল। চারপাশে বড় এলইডি স্ক্রিন—যেখানে ভেসে উঠছে লাইভ স্পোর্টস ডেটা, ইনজুরি প্রেডিকশন গ্রাফ, হিটম্যাপ, পারফরম্যান্স অ্যানালিটিক্স। আলো নীলচে-সাদা। প্রতিটি চেয়ারে বসে রয়েছেন বিশ্বের খ্যাতনামা ক্রিকেট ও ফুটবল ব্যক্তিত্বেরা।
নাটকের চরিত্রাবলী:
- বিরাজ কৌল — আগুনে মেজাজের ক্রিকেট অধিনায়ক
- রোহন সিনহা — অভিজ্ঞ, হিসেবি ক্রিকেট সেনাপতি
- রাহুল দেব — চিন্তাশীল ও স্থির ক্রিকেট কোচ
- ক্রিস্তো রুয়াল — বিশ্বখ্যাত ফুটবল জাদুকর
- এমবোজে — বিখ্যাত ফুটবল সেনসেশন
- জেদানো — অভিজ্ঞ ও কৌশলী ফুটবল কোচ
- কোচ পেপেরো — নতুন প্রজন্মের ফুটবল ট্রেনার
- নেহা তানেজা — স্পোর্টস AI গবেষক
- সিদ্ধার্থ মালেকার — ফেসিলিটেটর, আলোচনার সঞ্চালক
(সিদ্ধার্থ মালেকার উঠে দাঁড়ান। চারপাশ হঠাৎ নিঃশব্দ। সবার দৃষ্টি তাঁর দিকে।)
সিদ্ধার্থ মালেকার : স্বাগতম সবাইকে। আজকের এই সম্মেলন শুধুমাত্র ভবিষ্যতের কথা বলবে না— এটি খেলার আত্মা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। AI এখন আর শুধুই প্রযুক্তি নয়। এটি ম্যাচের সিদ্ধান্ত বদলাচ্ছে, ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে, ইতিহাস লেখার আগে গাণিতিক অনুমান বসিয়ে দিচ্ছে। আমাদের চারপাশে আজ যারা বসে আছেন, তাঁরা মাঠের ভেতর থেকে এই পরিবর্তন দেখেছেন। তাঁরা রক্ত, ঘাম, বিশ্বাস দিয়ে তৈরি মানুষ। বিরাজ, শুরু করুন আপনি।
বিরাজ কৌল : (সোজা হয়ে বসে, ঘাড় নাড়ে, তারপরে বলতে শুরু করে) আমার খেলাকে AI নতুন চোখ দিয়েছে। প্রতিপক্ষের দুর্বলতা হোক বা নিজের রিফ্লেক্স—সবই দ্রুত শিখেছি। কিন্তু একটা কথা বলি— মাঝে মাঝে মনে হয়, খেলাটা আর আমার হাতে নেই। আমি খেলছি, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করছে কেউ… অদৃশ্য কেউ। প্রযুক্তির ভেতরে কোথাও আমার আত্মা চাপা পড়ে যাচ্ছে না তো?
রোহন সিনহা : আমার পক্ষে AI একটা আশীর্বাদ ছিল। চোটের ঝুঁকি কমেছে, কেরিয়ার লম্বা হয়েছে।কিন্তু— শেষ মুহূর্তে যখন একটা শট মারব কি মারব না, সেটা তো AI বলবে না। ওখানে শুধু আমি আর আমার বিশ্বাস।
ক্রিস্তো রুয়াল : ফুটবলে AI আমাদের বলে—এই পজিশনে থাকো, ওই রুটে দৌড়াও। কিন্তু গোল? গোল তখনই হয়, যখন তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নাও—কিন্তু সেটা তোমার হৃদয় থেকে আসে।
এমবোজে : ডেটা বিশ্লেষণ আমাকে ‘উন্নত’ করেছে ঠিকই। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়—আমার ওপর বিশ্বাস নেই। কোচ আমার গেম টাইম ঠিক করেন, একটা মডেলের ওপর ভরসা করে। আমি খেলোয়াড়।
আমি তথ্য না।
রাহুল দেব : আমি AI ব্যবহার করি, হ্যাঁ। প্লেয়ারদের ডেটা দেখি, প্যাটার্ন দেখি। কিন্তু খেলোয়াড় তৈরি হয় ডেটা দিয়ে না। তারা তৈরি হয়—বিশ্বাস, সাহস আর সংকট কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা দিয়ে।
জেদানো : খেলোয়াড়কে তুমি পুতুল বানিয়ে ফেললে… তাহলে সেরা ফুটবল কোথা থেকে আসবে?
কোচ পেপেরো : আমরা তো চাই খেলোয়াড় সুস্থ থাকুক। AI আমাদের আগাম জানিয়ে দেয়—কে ক্লান্ত, কে ঝুঁকিতে। কিন্তু ও বলে না—কে খেলতে চায়, কার চোখে আগুন আছে।
নেহা তানেজা : AI হচ্ছে একটা হাতিয়ার। আমরা বানিয়েছি—তাহলে এটাকে মানবিক করাও তো আমাদের দায়িত্ব। খেলোয়াড়দের ব্যাকআপ হিসেবে নয়, তাদের পাশে দাঁড়াতে পারলে… তবেই AI সত্যিকারের টিমমেট হবে।
সিদ্ধার্থ মালেকার : ধন্যবাদ সবাইকে। আজকের আলোচনায় আমরা ডেটার সীমা, মানুষের সম্ভাবনা—সবই ঘেঁটে দেখব। একসঙ্গে, খোলাখুলি। এই আলোচনা—শুধু প্রযুক্তি নিয়ে নয়। এটি খেলার আত্মা নিয়ে।
(আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়।)
অঙ্ক ১, দৃশ্য ২ : কফি, কোড আর কিছু ব্যক্তিগত কথা
পরিবেশ: সেমিনারের ভেতরের একটি আরামদায়ক লাউঞ্জ কর্নার। কাফে ল্যাটে, গ্লাস টেবিল, বই-পত্র, আইপ্যাড ছড়ানো। ব্যাকগ্রাউন্ডে শান্ত জ্যাজ মিউজিক। আলো মৃদু, স্বচ্ছন্দ। খেলোয়াড় ও কোচরা এখন মূল সেশনের বাইরে, একে একে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। এখানে আলোচনা আরও খোলামেলা, অন্তরঙ্গ।
(বিরাজ কৌল এবং ক্রিস্তো রুয়াল এক পাশে কফির কাপ হাতে বসে আছেন।)
বিরাজ কৌল : (হালকা হাসি) তুই জানিস, ক্রিস্তো, আমি একদিন AI ডেটা দেখে ঠিক করেছিলাম—শট নেব না। কিন্তু সেই বলটা ছিল আমার কেরিয়ারের মোড় ঘোরানোর সুযোগ। ডেটা আমাকে বাঁচিয়েছিল… কিন্তু জেতায়নি।
ক্রিস্তো রুয়াল : (ঘাড় নাড়ে) একজ্যাক্টলি! আমার মনে হয়—আমরা সেই প্রজন্ম যারা এখনও গাট ফিলিং-এ বিশ্বাস করি। আমাদের অভিজ্ঞতা, ভয়, আত্মবিশ্বাস—এসব কিছুই তো AI ধরতে পারে না।
(ওদিকে রোহন সিনহা ও এমবোজে একটি সোফায় বসে খোলামেলা আলাপ করছেন।)
রোহন সিনহা : তুই জানিস, আমরা তো এখনো শরীরের ফর্ম ম্যানুয়ালি বিশ্লেষণ করি। কিন্তু তোদের ট্রেনিং তো একদম টেক-স্মার্ট, তাই না?
এমবোজে : হ্যাঁ ভাই। প্রতিটি স্টেপ, প্রতিটি মুভমেন্ট সেন্সর ট্র্যাক করে। ডেটা বলে—কোন জুতো পরলে ACL-এর ঝুঁকি কম। কিন্তু একটা ভুল অ্যালগরিদম আমাকে বেঞ্চে পাঠিয়ে দেয়।
রোহন : (চোখ ছোট করে) মানে তুই ফিট, তাও AI তোকে খেলতে দেয় না?
এমবোজে : (নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকায়) হ্যাঁ। ডেটা বলেছে ৬৭% ইনজুরি রিস্ক। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল খেলব। আমি তো মেশিন না—আমার ইচ্ছেও একটা ফ্যাক্টর হওয়া উচিত, তাই না?
(এবার দৃশ্য ঘোরে রাহুল দেব এবং জেদানো’র দিকে। তারা দুজনই প্রায় ফিসফিসিয়ে কথা বলছেন, গুরুজনদের মতো গম্ভীর গলায়।)
রাহুল দেব : আমাদের খেলোয়াড়রা এখন টেকনোলজির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। সিদ্ধান্ত না নিয়ে তারা অনুমতির অপেক্ষা করে।
জেদানো : যখন প্লেয়ার মাঠে যায়, ওর হাতে থাকা সাহসই একমাত্র অস্ত্র। AI তো সাহস দেয় না, রাহুল। শুধু প্রেডিকশন দেয়।
(অন্য পাশে কোচ পেপেরো ও নেহা তানেজা বার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। তাদের মধ্যে আলোচনা কিছুটা টেকনিক্যাল, কিছুটা মানবিক।)
নেহা তানেজা : আমরা এখন এমন মডেল বানাচ্ছি—যেখানে খেলোয়াড়দের আবেগও কিছুটা বোঝা যাবে। সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস, মুখের অভিব্যক্তি… এসব নিয়েও কাজ চলছে।
পেপেরো : (হালকা হেসে) সেন্টিমেন্ট পড়তে গেলে তো আগে খেলোয়াড়দের সম্মান করতে হয়। AI ডেটা দেয় ঠিকই, কিন্তু খেলোয়াড় কে খেলবে—সিদ্ধান্তটা শেষমেশ একটা মানুষকেই নিতে হবে।
(আলো ধীরে ধীরে কিছুটা হালকা হয়, যেন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সবার মুখে চিন্তার ছায়া, কিন্তু চোখে স্পষ্ট আলো—যেন কিছু একটা পরিবর্তন শুরু হচ্ছে।)
অঙ্ক ২, দৃশ্য ১ : অ্যালগরিদম বনাম আত্মা
পরিবেশ: কনফারেন্স হলের মূল মঞ্চে সকলে আবার জড়ো হয়েছে। বড় স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে – একটি ফুটবল ম্যাচের রেকর্ড করা দৃশ্য, তার নিচে AI-র বিশ্লেষণ। টেবিলের ওপর “AI Ethics in Selection” নামে একটি ডকুমেন্ট রাখা। সবাই কিছুটা থমথমে। আলো মাঝারি, পরিবেশ চাপা।
(স্ক্রিনে ফুটে ওঠে: “BREAKING: Mboze benched by AI recommendation. Coach Peppero defends decision. Global media reacts.”)
সিদ্ধার্থ মালেকার : (গম্ভীর গলায়) বন্ধুরা, আমাদের আলোচনার ঠিক মাঝখানে একটা বড় প্রশ্ন উঠে এসেছে। একটা পুরোনো ঘটনা মনে করিয়ে দিই। AI এক ফুটবলারের পারফরম্যান্স, ক্লান্তি, এবং মাইক্রো ইনজুরি রিস্ক বিশ্লেষণ করে তাকে বেঞ্চে বসানোর সুপারিশ করেছে। কোচ সেই সুপারিশ অনুসরণ করেছেন। ফলাফল?
একটি টিম হেরেছে। একটি প্রতিভা হারিয়েছে আত্মবিশ্বাস। আর বিশ্ব — প্রশ্ন তুলেছে।
(সবচেয়ে বড় স্ক্রিনে ভেসে ওঠে এমবোজের মুখ। কিছুটা বিষণ্ণ, কিছুটা রাগী।)
এমবোজে : (চোখে চোখ রাখে সবার দিকে) আমি খেলতে চেয়েছিলাম। আমি প্রস্তুত ছিলাম। AI বলেছিল, “৬৫% ক্লান্ত”। কিন্তু আমার মন বলেছিল, “এই ম্যাচটা জীবনের মোড় ঘোরাবে।” আমার আত্মা খেলতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার জায়গা চলে গেল আর একটা সংখ্যার কাছে।
ক্রিস্তো রুয়াল : (মাথা নিচু করে) একটা খেলোয়াড়ের সবচেয়ে বড় শক্তি তার মনের জোর। AI যদি মনের ভাষা না বোঝে, তবে ওর হাত দিয়ে সিদ্ধান্ত মেনে নেবার মানে কী?
কোচ পেপেরো : (কণ্ঠ শক্ত) আমি শুধুমাত্র তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি চাইনি এমবোজের কেরিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হোক। আমরা যদি খেলোয়াড়দের ওপরই ভরসা করি, তখন কখনও কখনও আবেগ আমাদের হারায়।
রোহন সিনহা : কিন্তু আমরা তো খেলি হারার ঝুঁকি নিয়েই! ঝুঁকি না নিলে, খেলা তো খেলা নয়—ব্যবসা। আমি বারবার চোট পেয়েছি, তবু ফিরেছি। কারণ আমি একজন মানুষ। মেশিন না।
বিরাজ কৌল : আমি AI-এর ওপর ভরসা করি… কিন্তু শুধুই সহকারী হিসেবে। কখন খেলব, কখন থামব—এই সিদ্ধান্ত কেবল আমার হতে পারে। কারণ আমি জানি আমার সীমানা কোথায়, AI সেটা জানে না।
রাহুল দেব : শুধু AI-এর কথা শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া একটা বড়ো ভুল। তথ্য ব্যবহার করতে হয়—মানুষের বিচারবুদ্ধি দিয়ে। না হলে, আমরা খেলোয়াড় তৈরি করব না, রোবট বানাব।
নেহা তানেজা : আমি একমত। আমরা গবেষকরা দায়ী—AI যেন সহায়ক থাকে, নিয়ন্ত্রণকারী না হয়ে ওঠে। AI যেন খেলোয়াড়ের পাশে থাকে, তার ওপর চেপে না বসে।
জেদানো : (ধীরে, ভারি কণ্ঠে) মাঠে শেষ কথা বলে হৃদয়। AI সেই শব্দের উচ্চারণ জানে না। ওর অভিধানে “ভালোবাসা” নেই।
(চারপাশ নিস্তব্ধ। সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কনফারেন্স রুম যেন নিঃশ্বাস ফেলে। আলো কিছুটা নিভে আসে। শুধু একটিমাত্র আলো পড়ে থাকে এমবোজের মুখে।)
এমবোজে : (নিচু গলায়) আমরা কি আস্তে আস্তে মানুষের বদলে ডেটা-নির্ভর ইউনিটে পরিণত হচ্ছি? তাহলে খেলা কার?
অঙ্ক ২, দৃশ্য ২ : নীতির রূপরেখা
পরিবেশ: একই কনফারেন্স হল, কিন্তু এবার আলো আরও গম্ভীর। টেবিলের মাঝখানে রাখা “ETHICS PROTOCOL DRAFT” নামে একটি নথি। প্রোজেক্টরের স্ক্রিনে ভেসে আছে – “Discussion in Progress: Defining AI’s Role in Sport”.
চারদিকে চাপা গুঞ্জন। সবার মুখেই এখন একটা প্রশ্ন—AI আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
(নেহা তানেজা উঠে দাঁড়ান। তাঁর পাশে সিদ্ধার্থ মালেকার। তাদের সামনে টেবিলে একটি ডকুমেন্ট এবং একটি টাচ-স্ক্রিন ল্যাপটপ। বাকিরা চারপাশে বসে আছেন।)
নেহা তানেজা : আমরা সবাই যা বললাম, তার ভিত্তিতে আজকে আমরা একটা প্রস্তাবনা তৈরি করছি।
এই ড্রাফট কোনও আইনের খসড়া নয়— এটি একটি নৈতিক চুক্তি, যা খেলোয়াড়, কোচ এবং প্রযুক্তি—এই তিনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।
সিদ্ধার্থ মালেকার : (আস্তে আস্তে পড়ে শোনান) “AI shall inform, not decide. It shall serve the sports-person, not replace them.”
(নিমগ্ন নীরবতা চারপাশে। কেউ মাথা নাড়ছেন, কেউ চোখ বন্ধ করছেন।)
রোহন সিনহা : সঠিক কথা। AI জানাতে পারে আমি ক্লান্ত কিনা— কিন্তু খেলব কি না, সেটা আমারই রায়।
জেদানো : আমিও চাই, আমার প্লেয়ার সিদ্ধান্ত নিক। আমি কোচ হিসেবে, এবং AI—উভয়ই সহকারী হবো।
ক্রিস্তো রুয়াল : যদি একদিন আমাদের পুরো কেরিয়ার কেবল স্কোর বোর্ড আর অ্যালগরিদমে ঠেকে যায়— তাহলে ফুটবল আর “দিল সে” খেলা হবে না।
নেহা তানেজা : এই ড্রাফটে আরও একটা লাইন আমরা যুক্ত করছি: “A player’s voice is a data point, too.” খেলোয়াড়ের ইচ্ছা, মতামত, অনুভব—সবই তথ্য। আমরা এখন পর্যন্ত ওটা বাদ দিয়েছি। এখন সময় ওটাতাই কেন্দ্রে আনার।
বিরাজ কৌল : আমার মনে হচ্ছে… এইটা এক নতুন কিক-অফ। নতুন ম্যাচের, নতুন চিন্তার।
এমবোজে : আর এই ম্যাচে আমি খেলব। আমার মত থাকবে। আমার হৃদয় থাকবে।
(সকলের মুখে একটুখানি হাসি। আলো ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে “Ethical Protocol for AI in Sport – Draft Accepted”)
সিদ্ধার্থ মালেকার : আমরা আজ শুরু করলাম। একটা খেলা যেখানে মানুষ এবং মেশিন একসাথে খেলবে। কিন্তু হৃদয়—সবসময় ক্যাপ্টেনই থাকবে।
অঙ্ক ৩, দৃশ্য ১ : শেষ দিনে আলো
পরিবেশ: সেমিনার রুম এখন অনেক ফাঁকা। আলো নরম, সোনালি। স্ক্রিনে চলছে একটি স্লো মোশন ভিডিও—খেলার মাঠ, গোলের মুহূর্ত, স্লাইড ট্যাকল, ক্রিকেটে চার-ছয়, জয়ধ্বনি। তার পাশে লাইন ভেসে উঠছে: “AI + Human = Future of Fair Play”
টেবিলে আর কোলাহল নেই, কিন্তু চারপাশে এক ধরনের শান্ত প্রত্যয় ছড়িয়ে পড়েছে।
(রাহুল দেব একটি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, বাইরের আলোয় মুখ দেখিয়ে নিচু গলায় বলেন)
রাহুল দেব : খেলোয়াড় তৈরির জন্য শুধু তথ্য নয়—ভালোবাসা, ধৈর্য, ব্যর্থতাকে গ্রহণ করার সাহস লাগে। AI সেই সাহস শেখাতে পারবে না। কিন্তু সাহসী মানুষকে সহায়তা করতে পারবে।
বিরাজ কৌল ধীরে হেঁটে আসে, রাহুলের পাশে দাঁড়ায়)
বিরাজ কৌল : আমার মনে হয়… এই সম্মেলনে আমি নতুন কিছু শিখিনি। আমার বরং পুরোনো কিছু মনে পড়ে গেল। কেন খেলতে শুরু করেছিলাম—সেটা।
রোহন সিনহা : (পেছন থেকে এসে যোগ দেয়) আমরা AI-কে শত্রু ভাবছিলাম। কিন্তু ও তো একটি টুল। যেমন ব্যাট—তুমি কীভাবে চালাও, সেটাই আসল।
(ক্রিস্তো রুয়াল হেঁটে এসে টেবিলের পাশে দাঁড়ায়, স্ক্রিনে খেলার মুহূর্ত দেখে, চোখে জল জমে)
ক্রিস্তো রুয়াল : খেলা আমাকে মানুষ করেছে। AI হয়তো আমাকে আরও ভালো খেলোয়াড় করত— কিন্তু আমার চোখের জল… ও ধরতে পারত না।
(এমবোজে এসে পাশে দাঁড়ায়, মাথা নিচু করে)
এমবোজে : আজ বুঝলাম—আমি শুধু খেলে যাচ্ছি না। আমি নিজেকেও তৈরি করছি, প্রতিদিন। AI যদি আমার পাশে থাকে, তাহলে আমি আরও এগোতে পারি। কিন্তু আমাকেই চালাতে হবে—নিজের পথ।
(নেহা তানেজা ও কোচ পেপেরো এক কোণ থেকে আসেন।)
নেহা তানেজা : আমরা প্রযুক্তি বানাই—কিন্তু দায়িত্বও আমাদের। খেলোয়াড়কে বুঝে, সম্মান দিয়ে, পাশে দাঁড়াতে শেখাতে হবে প্রযুক্তিকেও।
কোচ পেপেরো : আমি প্লেয়ারদের চোখে আবার আগুন দেখতে চাই। AI থাক, কিন্তু আগুনটা যেন নিভে না যায়।
(জেদানো ধীরে সামনে এগিয়ে আসেন। তাঁর গলা ভারী, কিন্তু দৃঢ়)
জেদানো : আমার প্রজন্ম খেলা শিখেছে লাথি খেয়ে, ব্যথা পেয়ে। আজকের প্রজন্ম শেখে ডেটা দেখে। যদি দুই প্রজন্ম একসাথে হাঁটে—তবেই সত্যিকারের খেলা জন্ম নেবে।
(শেষে, সিদ্ধার্থ মালেকার এগিয়ে আসেন। সবার দিকে তাকিয়ে বলেন)
সিদ্ধার্থ মালেকার : আজ আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম না। আমরা প্রশ্ন করলাম। আর সেটাই বড়ো জয়— কারণ খেলাধুলা মানেই তো প্রশ্ন করে এগিয়ে যাওয়া, নয় কি?
(আলো ধীরে ধীরে একটু বাড়ে। স্ক্রিনে বড় করে লেখা ওঠে: “AI in Sport: Not Above, But Beside the Player”)
অঙ্ক ৩, দৃশ্য ২ : সত্যের মুখোমুখি
পরিবেশ: একটি কালো ব্যাকগ্রাউন্ড। শুধুমাত্র একেকজন চরিত্রের ওপর হালকা আলো পড়ে। যেন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে একে একে নিজের মনের কথা বলছে।
ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড: নরম গিটার টান, মাঝে মাঝে খেলার শব্দ — স্টেডিয়ামের গর্জন, চিয়ার, শ্বাসরুদ্ধ মুহূর্ত।
(আলো জ্বলে ওঠে – বিরাজ কৌল এর মুখে।)
বিরাজ কৌল : আমি অনেক রানের হিসেব জানি। কিন্তু জানি না—আরেকটা সুযোগ কখন পাব। সেই সিদ্ধান্ত কেউ নিয়ে দিলে… আমি কি খেলোয়াড় থাকি? আমি শুধু চাই—আমার সিদ্ধান্ত আমি নিই। AI-কে সঙ্গে নিয়ে, আমার পাশে। ওপরে নয়।
(আলো বদলায় – রোহন সিনহা)
রোহন সিনহা : খেলার মানে ভুল করা। AI বলবে, ‘ভুল কোরো না।’ কিন্তু আমি জানি—ভুল না করলে, আমি শিখি না। তাই আমি AI-কে প্রশিক্ষক চাই—পুলিশ নয়।
(আলো আসে রাহুল দেব–এর দিকে)
রাহুল দেব : একজন কোচ জানে কাকে খেলাতে হবে। AI সেটা সাহায্য করতে পারে। কিন্তু সিদ্ধান্ত আমার। আমি চাই, খেলোয়াড়ের চোখে আত্মবিশ্বাস থাকুক। ডেটার ওজন নয়।
(আলো আসে ক্রিস্তো রুয়াল–এর দিকে)
ক্রিস্তো রুয়াল : আমি গোল করেছি, আমি গোল মিস করেছি। তবে প্রতিবার আমি খেলেছি নিজের বিশ্বাস নিয়ে। এটাই খেলোয়াড়ের পরিচয়।
(আলো আসে এমবোজে–র দিকে)
এমবোজে : একটা অ্যালগরিদম আমাকে মাঠ থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই রাতেই আমি ঠিক করেছিলাম—
আমার হৃদয়কে কখনো সাইলেন্ট হতে দেব না। আমি খেলব। কারণ আমি বাঁচতে চাই।
(আলো আসে জেদানো–র দিকে)
জেদানো : আমরা কোচ, আমরা মানুষ। আমরা চাই খেলোয়াড়রা মানুষ হয়ে উঠুক—ডেটা নয়। AI যদি আমাদের সাহায্য করে, স্বাগত। কিন্তু নেতৃত্ব আমাদের দিতেই হবে।
(আলো আসে পেপেরো–র দিকে)
কোচ পেপেরো : আমি সবসময় বিশ্বাস করি—প্রযুক্তি থাকা উচিত হেলমেটের মতো। রক্ষা করবে, কিন্তু চালাবে না। আজ আমি শিখলাম—খেলোয়াড়ের মুখের হাসি, তা সে জিতুক বা হারুক, সেটাই আসল জয়।
(আলো আসে নেহা তানেজা–র দিকে)
নেহা তানেজা : আমি একজন প্রযুক্তিবিদ। আমার তৈরি AI খেলোয়াড়দের বাঁচাতে পারবে, জিততেও সাহায্য করবে। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে, আমি চাই—আমার তৈরি কিছু যেন খেলোয়াড়কে ছোট না করে। AI যেন “সাথী” হয়—”সুপারভাইজার” নয়।
(সবশেষে আলো জ্বলে ওঠে সিদ্ধার্থ মালেকার–এর মুখে)
সিদ্ধার্থ মালেকার : খেলা শুধু স্কোর নয়। খেলা একটা গল্প। সেই গল্পে প্রযুক্তি নতুন এক ভাষা এনেছে। কিন্তু কাহিনির কেন্দ্রে থাকবে—মানুষ। তোমাদের সাহস। তোমাদের ভালোবাসা। তোমাদের খেলার প্রতি একরোখা অনুরাগ। এই মঞ্চ থেকে তাই আমরা বলি— খেলো, সিদ্ধান্ত নাও, শেখো। AI পাশে থাকুক। নেতৃত্ব দাও তুমি।
(আলো এক এক করে নিভে যায়। সবার কণ্ঠ একসাথে শোনা যায় ফেডিং ভয়েসে)
সমাপ্তি
“The Final Huddle – AI-এর যুগে খেলা” নাটক তাই শেষ নয়, বরং শুরু—এক নতুন সংলাপের, যেখানে প্রযুক্তি ও খেলোয়াড় একসাথে ভবিষ্যতের দিকে হাঁটে। হৃদয় ও ডেটা মিলিয়ে।
লেখকের দু-কলম
খেলা কখনো শুধু সংখ্যার খেলা নয়; এটি আত্মার খেলা। আজকের এই নাটক তাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রযুক্তি আমাদের সহায়ক হতে পারে, কিন্তু হৃদয়ের জয় শুধু মানুষের হাতেই। যখন আমরা AI-কে পাশে নিয়ে এই খেলার যাত্রা শুরু করি, তখন আমাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে—প্রতিটি সিদ্ধান্তে, প্রতিটি মুহূর্তে, আমরা যেন নিজের ভাবনা, অনুভূতি এবং স্বাধীনতা হারাই না। আমাদের খেলাধুলা হোক মানবিকতার উৎসব, যেখানে প্রযুক্তি যেমন আমাদের শক্তি বাড়ায়, তেমনি যেন আমাদের মনুষ্যত্বকে আরো বেশি করে উজ্জ্বল করে তোলে। তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে খেলি—নতুন দিনের খেলা, যেখানে মানুষ ও প্রযুক্তির বন্ধুত্ব জোরদার হবে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ থাকবে মানুষের হাতে। খেলা হোক আনন্দ, খেলা হোক স্বাধীনতা, খেলা হোক মানুষের।
এককথায় অসাধারণ লেখা। লেখকের চিন্তাশক্তি তথা অনুমান ক্ষমতা নিঃসন্দেহে অতুননীয়। গল্পে এক ঘোর বাস্তবের পূর্বাভাষ পাওয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যতে কি সত্যিই এমনই হতে চলেছে? শুধু সংখ্যা আর যুক্তিই খেলবে…মানুষের আবেগ ভালোবাসার কোনোও স্থান থাকবে নাো? তাহলে তো সেই ভবিষ্যৎ যতো দেরীতে আসে, মানবজাতির পক্ষে ততোই মঙ্গল।