Home গল্প, রহস্য ও ভৌতিক সীমানা ছাড়িয়ে
গল্পরহস্য ও ভৌতিক

সীমানা ছাড়িয়ে

সৌগত চক্রবর্তী

তখন আমার পোস্টিং উত্তর-পূর্বে। সাতটা রাজ্যেই ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। সেবারে গন্তব্য কোলোরিয়াং। অরুণাচল প্রদেশে। চীনা সীমান্ত থেকে একশো কিলোমিটার। নতুন জেলা শহর, কিন্তু পুরো জেলার জনসংখ্যাও দশ হাজার ছাড়ায়নি। গুগল ম্যাপ বলছিল ইটানগর থেকে ঘন্টা ছয়েক, জেলা প্রশাসন জানালো ওটা বারো হবে।

সেইমতো সকাল ছ’টায় ইটানগর ছেড়েছিলাম। তা সত্ত্বেও জীবন আর সংগ্রাম নামের দুটো মিলিটারি ব্যারাক পেরিয়ে কোলোরিয়াং পৌঁছতে যখন শেষ দশ কিলোমিটার বাকি, তখন সূর্যদেব ঢলে পড়লেন। কোলোরিয়াং-এ রাতে থাকার মতো হোটেল নেই। রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয়েছে সার্কিট হাউসে। সেটা একটা টিলার ওপর। মোবাইল সিগনাল অধরা সেখানে।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আমাদের জেনারেল ম্যানেজার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ওখানে বিদ্যুতের কী অবস্থা। কুক বললো “থাকে, যখন যায় তখন দু-তিনদিন আসে না।” বলা মাত্রই অন্ধকার।

কুকের কথা দেখা গেলো সত্যি। আলো আসছে না দেখে ন’টার মধ্যে নৈশভোজ সেরে যে যার নিজের ঘরে শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে উঠে দেখি বাথরুমে জল নেই। পেরেইরা ভোরবেলায় ওঠেন। ওঁর টিকি নেই, থাকলেও তার দেখা নেই। অগত্যা আব্বাসদা আর আমি ইঁদারা থেকে স্নানের জল তুলে আনছি, শুনলাম বাথরুমের খুলে রাখা কল থেকে জল পড়ছে। তখনো বিদ্যুৎ আসেনি। আধিদৈবিক ব্যাপার-স্যাপার কী না ভাবছি, ঘর্মাক্ত কলেবরে কেয়ারটেকার হাজির। বললে পাশের পাহাড় থেকে জলের পাইপলাইন এসেছে। কেউ গতকাল রাতে স্টপকক দিয়েছিল বন্ধ করে। ইনি চালু করতেই গেছিলেন।

“বলে যেতে পারেননি?” জানতে চাইলে বলে, “বড় সাহেবকে বললাম তো। উনি মর্নিং ওয়াক করে ফিরলেন।”

তখন আরেক চিন্তা। যদি ফিরেই থাকেন তাহলে গেলেন কোথায়। এদিকে নটায় ডি এম অফিসে পৌঁছতে হবে।

যাই হোক আমরা দু’জন স্নান করে যখন খুঁজতে বেরুবো, তখন দেখি পেরেইরা চড়াই বেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে উঠে আসছেন। আমার মতো ইনিও প্রাক্তন বক্সার, তার ওপর সৈনিক স্কুলের ছাত্র। ভয় কাকে বলে জানেন না। কিন্তু মুখ দেখে মনে হলো কিছু একটা ঘটেছে। 

আমাকে দেখে বললেন “ঘরে এসো।” গেলাম। বললেন, “মিটিং ক্যানসেলড্, আব্বাসকে বলো সব জিনিসপত্র ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়িতে তুলে দিতে, আমরা এখনি রওয়ানা দেব।”

বললাম, “কী হয়েছে?”

“রাস্তায় বলছি। দেরি করা যাবে না।”

“বেশ।”

আমরা দু’জন বসেছি স্করপিওর পেছনের সীটে। গাড়িতে উঠে আবার জানতে চাইলাম। ইশারায় বোঝালেন আব্বাসদার সামনে বলতে চাইছেন না। শুধু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম যে নীচের পাকদন্ডীতে গাড়ি ঢুকতেই বিড়বিড় করে কী বলছেন। মিশনারীজ অফ চ্যারিটি’র একটা অ্যাম্বুলেন্স আমাদের ক্রস করে কোলোরিয়াঙের দিকে চলে গেল।

কোনো দুর্ঘটনা হয়েছে? বা কেউ গুরুতর অসুস্থ? পেরেইরা কী কোনোভাবে জড়িয়ে পড়েছেন? ভাবছিলাম।

ঘন্টাখানেক পরে সংগ্রাম পেরিয়ে এপেক্স ব্যাংকের শাখা। গাড়ি দাঁড় করাতে বলে পেরেইরা আব্বাসদাকে বললেন ভেতরে গিয়ে খোঁজ নিতে যে ওঁরা নিয়মিত ক্যাশ পান কিনা। বুঝলাম, সরিয়ে দিতে চাইছেন। ড্রাইভার ছেলেটা বাংলা বোঝে না, কিন্তু ওকেও বললেন, “একটু বাইরে হাত পা খেলিয়ে এসো।”

এবার বলা শুরু করলেন। কেয়ারটেকার বেরিয়ে যাওয়ার পরেই একটি ছেলে আসে। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স। স্থানীয় নয়। পেরিয়ারকে বলে একটা জরুরী দরকার, উনি ওঁর সঙ্গে নীচে যেতে পারবেন কি না। আমি তখনো নাকি নাক ডাকছি।

পেরিয়ার বলেন, “এইমাত্র উঠে এসেছি, আবার নীচে যেতে হবে?” ও বলে, “জানি, কিন্তু প্রয়োজনটা আপনাদের। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না, তাই বলছি।”

“আচ্ছা, চলো।”

উতরাইয়ের একটা জায়গা থেকে নীচের রাস্তাটা পুরো দেখা যায়। ওখানেই ছেলেটি দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর বললো, “আপনারা এখানে বহিরাগত। এঁরা ক্ষেপে উঠলে আপনারাও বাঁচবেন না। নীচে দেখুন।” বলতেই দেখেন নীচের রাস্তায় একটা পুলিশের জীপ তীব্রগতিতে ছুটে আসছে। আদিবাসীদের একটা ছোট ছেলে হঠাৎ দৌড়ে রাস্তায় উঠে পড়লো। গাড়ির ড্রাইভার বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু জীপটার সাইডে ধাক্কা লাগলো, বাচ্চাটা লুটিয়ে পড়লো। 

এবার ছেলেটি বললো, “চলুন, বাচ্চাটা বেঁচে যাবে, কিন্তু এখনি ভিড় জমে যাবে। এঁরা থানা ঘেরাও করবে, আপনাদের খবর পেলে এখানেও জমা হবে।”

পেরেইরা তখন হকচকিয়ে গেছেন। 

“তুমি জানলে কী করে এরকমটা হবে?” 

“আমি দেখতে পাই। আগে পেতাম না। উঠতে উঠতে বলছি।” 

পেরেইরাকে সামনে যেতে বলে পেছন পেছন আসতে আসতে বলছিল ছেলেটি,

“আমার নাম জগন। CPWD তে সুপারভাইজাররের চাকরি নিয়ে এসেছিলাম। বিহার থেকে। এখানকারই একটি মেয়েকে ভালোবেসে ফেলি।

ওর নাম দিয়েছিলাম ঝর্ণা। একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলো যে আমি ওঁকে বিয়ে করবো না শহরের বাবুদের মতো শুধু ফুর্তির মতলব। বললাম কী করতে হবে বল্, যাতে বিশ্বাস করিস। বললো, আমার বাবাকে বলো আমাকে বিয়ে করতে চাও। বললাম। বুড়ো শুনেই বেঁকে বসলো। মেয়ে ছোট থাকতেই কোনো পয়সাওয়ালা লোক ওঁকে বিয়ে করবে বলে অগ্রিম দিয়ে রেখেছে। কথার নড়চড় হবে না।

হবে না তো হবে না। ঠিক করলাম ঝর্নাকে নিয়ে একদিন অফিসের জীপে করে রাতের বেলায় পালাবো। যেদিন পালানোর কথা, ঝর্ণা সকালেই হাজির। ওর বাবা ওর মনের ইচ্ছে জানতে পেরেছে। আমাকে ওদের বাড়িতে ডেকেছে। ভাবলাম ঈশ্বর মুখ তুলে চেয়েছেন। গেলাম।

বুড়োকে খুব খুশি মনে হলো। আমাকে দাওয়ায় বসিয়ে বললো, “তোমার জন্যে একটা উপহার আছে। নিয়ে আসি।“ বলে বাড়ির ভেতর চলে গেলো।

বসে আছি। মিনিট খানেক পর পেছন থেকে এসে টাঙ্গির এক কোপে আমার ধড় থেকে মাথাটা আলাদা করে দিলো।”

শেষ কথাটা শুনে পেরেইরা হেসে ওঠেন। 

“দিনদুপুরে ভালোই আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছ।”

ও বলে, “একটু পেছনে ফিরে দেখুন তাহলে।”

দেখলেন জগন দাঁড়িয়ে পড়েছে। দু’হাত দিয়ে নিজের মাথাটা খুলে নিয়ে সামনে বাড়িয়ে ধরলো।

এ পর্যন্ত বলে পেরেইরা বললেন, “তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।”

“মনে নেই মানে? আপনি তো দৌড়ে উঠে এলেন। আমরা সবাই দেখেছি।”

বললেন, “ঠিকই দেখেছ। কিন্তু এই আমি সেই আমি নই।” বলতেই গাড়ির মধ্যে একটা ঠান্ডা হাওয়া খেলে গেল। আর ভদ্রলোক ওঁর সীটেই এলিয়ে পড়লেন। আমি ভয়ে ভয়ে নাকের কাছে আঙুল ধরে দেখি নি:শ্বাস পড়ছে।

ঠিক তখনই আব্বাসদাও ফিরে এলো। বললো, “স্যার কি ঘুমায়ে গেলেন নাকি?” 

উত্তর না দিয়ে বললাম, “একটু জল দিন তো, আমার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে।”

আমরা নেমে আসার পরে পেরেইরা একমাস ছুটিতে ছিলেন। শুনেছি এখনো মাঝে মধ্যেই কী সব বিড়বিড় করেন।

লেখক পরিচিতি

সৌগত চক্রবর্তী

বাড়ির লোকেদের মতে একমাত্র প্যাশন হলো ঘুম। এতোটাই যে ঘুম নিয়ে একটা আস্ত বই লিখে ফেলেছে। 

পড়াশোনা নিতান্তই কম, তাই বিতর্ক দেখলেই দূরত্ব বজায় রাখে। মাটন ছাড়া বিরিয়ানি হয়না এই মৌলবাদে বিশ্বাসী। মুদ্রাদোষ: “একটা গল্প বলি শোনো”।

অমলকান্তিদের একজন।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. জব্বর তো! নীচে পরিচিতিটা পড়ে হো হো করে হাসছি😂🤣

Leave a Reply to বিশ্বনাথ সামন্ত Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!