Home রোমান্টিক, গল্প প্রেমে পড়া
রোমান্টিকগল্প

প্রেমে পড়া

সম্বিত বোস

।। ১ ।।

বিকেলের এই সময়টা বেশ অদ্ভুত। দিনশেষের ক্লান্ত আলো শহরটাকে জড়িয়ে রাখে। ব্যস্ত শহর একটু একটু একটু করে সারাদিনের ক্লান্তির পরে আরামে ঢলে পড়ে। জানলা দিয়ে শহরের এই অদ্ভুত পরিবর্তন দেখছিল ক্যাবলা। সারাদিন এই জানলাটার পাশে বসে এই বিভিন্ন সময়ের শহরটাকেই সে পাল্টাতে দেখে রোজ।আর দেখে ব্যাস্ত নাম না জানা কত মুখ রোজ দৌড়োচ্ছে।

রোজকার মতো আজও সে তার সেই কাজেই মন দিয়েছিল।কি আর করবে যবে থেকে মাথায় চোট পেয়েছে তবে থেকে রাস্তায় বেরোনো প্রায় বন্ধ খুব দরকার পড়লে বাবা বা মা কেউ এনে দেয়। নিজে রাস্তায় বেরোনো আর হয় না। বহুদিন হয়ে গেছে যদিও ঘটনাটার, বেরোনোই যায়; কিন্তু নিজের উপর তেমন কনফিডেন্স পায়ে না একদম। তাই এই জানলাটাই ওর একমাত্র সম্বল।

আজও সেই কাজই করছিল সে। রেডিওতে কি একটা গান বাজছে, মা শুনছে। গানের কলি গুলো বুঝে উঠতে পারে না ক্যাবলা। খুব একটা মন দেয় না ঐদিকে। সে এখন তার শহুরে সভ্যতার বিবর্তনে ব্যস্ত। 

মা এসে ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে “কিছু খাবি”? এক কথায় মাথা নেড়ে সে জানায় “নাহ”। সময় বেড়ে চলে। ক্যাবলা নড়ে না।

“ক্যাবলা এই ক্যাবলা”, মা ডাকছে ক্যাবলা একটু বিরক্তই হচ্ছিল তাও বেশ শান্ত স্বরেই কি হলো জিজ্ঞেস করতে মা বললো একবার বাইরে যেতে।

ওফ! এই অসময় আবার কি চাই! বন্ধুবান্ধব না থাকায় এই সময়টা সে খুব একটা কিছু করে না ঠিকই, তবে তাই বলে তাকে কেউ ডিস্টার্ব করুক এটাও খুব একটা ভালো লাগে না। তা সত্ত্বেও মায়ের ডাক অমান্য করার ইচ্ছে বা সাহস কোনোটাই না থাকায় বাইরে যেতে হল। “বলো”, বলতে গিয়ে ক্যাবলা তিনবার হাই তুললো। মাকে ডাকতে গিয়ে ছাগলছানা মার্কা “ম্যা” বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। ততক্ষনে মা বোঝাতে শুরু করেছে, তার এই অসময়ের ডাকের কারণ। 

কিন্তু ক্যাবলা যে ক্যাবলা সে কি আর বোঝে সে তো তখন সামনের চোয়ারে বসা হলুদ জামা নীল জিন্সে আটকে গেছে। ওদিকে মা বলছে “শোন ক্যাবলা, এই হচ্ছে তিতলি আর ওর মা। নতুন এসেছে এ পাড়ায়। তাই আলাপ করতে এলো। তিতলি তো তোরই বয়সী। যা ওর সঙ্গে গল্প কর। ততক্ষন আমরা একটু গল্প করি।”

ক্যাবলা ততক্ষনে কিছুটা সামলেছে। তুতলেই বললো, “হ্যাঁ হ্যাঁ … মানে, ঠিক আছে … আচ্ছা … কি করবো বললে?”

মা একধমকে বললো “তোকে নিয়ে আর পারি না রে। ওরে, ওকে নিয়ে গিয়ে একটু গল্প কর।” ধমক শুনে তিতলিও হেসে ফেলল।

বেশ লজ্জায় পড়ে গেল ক্যাবলা। আস্তে আস্তে বললো, “আচ্ছা তিতলি, চলো আমার ঘরে”। অমনি তিতলি বাধ্য মেয়ের মতো ক্যাবলার সাথে ঘরে চলে এলো। ঘরে ঢুকে তিতলি বেশ অবাক হলো। অবাক হয়ে বলে উঠলো “তোমার এত বই তুমি সব পড়েছ?”

ক্যাবলাও বেশ কেতা মেরে বললো “তা পড়েছি বৈকি।সব পড়েছি।”

তিতলি অবাক, সে আবার জিজ্ঞেস করলো “আচ্ছা তুমি যে এতো বই পড়ো, তোমার কি খুব ভালো লাগে পড়তে?” তারপর নিজেই কেমন হারিয়ে গিয়ে বলে ফেলল “আমিও পড়তাম।” তার পরেই সামনে রাখা টেডি বিয়ারটাকে দেখে হি হি করে হাসতে হাসতে বললো “ক্যাবলা তুমি এখন টেডি নিয়ে খেলো” এই প্রথম সে ক্যাবলা বলে ডাকলো। 

ক্যাবলা এরকম কোনো বিষয়ের জন্য রেডি ছিল না। সে বেশ লাল হয়ে গেল। রাগে না লজ্জায় তা অবশ্য বোঝা গেল না। মুখ দিয়ে খালি বেরোলো “ওটা আমার ছোটবেলার।” তিতলি আবার বললো, “তা এখন তুমি অনেক বড়ো বুঝি?” বলেই আবার খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো।

এবার ক্যাবলার রাগ হলো। কিন্তু কিছু বলতে পারল না। মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে বললো, “চলো মা ডাকছে।”

বাইরে যেতে মা বললো, “ওদের বাড়ি যাবার সময় হয়েছে।তিতলি অমনি মায়ের পিছু পিছু চলে গেল।”

।। ২ ।।

ওরা চলে যেতেই ক্যাবলা তার মাকে বেশ রাগের সাথে বলে উঠলো, “সবার সামনে ‘ক্যাবলা’ না বললেই হয় না, না তোমার! আর মেয়েটা ভারী বজ্জাত আমার ঘরে গিয়ে আমার জিনিসপত্তর দেখে খুব হাসছিলো”। মা কিছু না বলে শুধু হাসলো। ক্যাবলা অগত্যা রাগ করেই ঘরে চলে গেল।ঘরে এসে বেশ রাগ হচ্ছিল তার।টেডিটার দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই বলে গেল সে “তিতলি না নামটা! আসুক আর এক দিন!”

দিন বেড়ে চলে। ক্যাবলা আজকাল রোজ বিকেলে শহরের ব্যস্ততা দেখার সঙ্গে সঙ্গে আর চোখে পাশেই বাড়ির বারান্দায় তিতলিকে দেখতে একদিনও ভোলেনি সে। যতই রাগ করুক না হলুদ জামা যে ক্যাবলার ‘ক্যাবলামি’ বাড়িয়ে দিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।

রোজ তিতলির ঘুরে বেড়ানো থেকে টিউশন যাওয়া কিছুই মিস হয় না জানলায় বসে নজর রাখা ক্যাবলার। মাঝে মাঝে তার মনে হয়েছে, কেন সে এসব করছে – যে মেয়েটা তার নাম নিয়ে হাসি মজা করেছে, তাও কেন যে সে সারাদিন মেয়েটার জন্য বসে আছে – কিছুই বুঝতে পারছে না। ধ্যাৎ! এসব কি যে সে করছে! থাক। আর করবে না সে এসব। 

কিন্তু তিতলি যে তার মাথা থেকে বেরোচ্ছেই না। অষ্টপ্রহর সেই খিলখিলে হাসি যে তার কানে বেজে চলেছে। রোজ রাতে স্বপ্নে হলুদ জামা। উফফ! 

বেশ দুমাস হয়ে গেছে তার মাথার চোটের। এখন সে পুরোপুরি সুস্থ। আজ বেরোবে। ঠিক সেই সময় সামনে দিয়ে তিতলিকে বেরোতে দেখে তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়ল। বাড়ী থেকে বেরিয়েছে এতদিন পর আর পাড়ার বন্ধুরা ডাকবে না, তা হয়? হরি ডাকতেই যেতেই হলো। ব্যাস্‌! তিতলিও চলে গেল। এরা আর সময় পায় না ডাকার। কিন্তু হঠাৎই বাড়ি যাবার পথে মাথাটা ঘুরতে শুরু করলো ধীরে ধীরে বসতে গিয়ে আর কিছু মনে নেই। চোখ বোজার আগে শুধু দেখলো, একজোড়া পা ছুটে আসছে।

।। ৩ ।।

চোখ খুলতে মা প্রথমেই বলল “ভাগ্গিস তিতলি ছিল। ঠিক সময় ধরে নিয়েছে না হলে পড়ে যেতিস। আর আবার মাথায় চোট লাগতো”। মনে মনে তিতলিকে “থ্যাঙ্ক ইউ” জানালো ক্যাবলা। ইচ্ছে হলো দেখা হলে সরাসরি বলবে।

এরপর ক্যাবলার ক্যাবলামো আর তিতলির এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে দিয়ে আরো কয়েকটা মাস কেটে গেল। ফাইনাল পরীক্ষা আসন্ন আর তার আগে সরস্বতী পুজো। বাঙালির ভ্যালেন্টাইন্স বলে কথা। 

ক্যাবলার মনেও লাড্ডু না ফুল কি যেন একটা ফুটলো। ফুল বলতে মনে পড়লো, ক্যাবলা কিন্তু ফুল দিয়ে নয়, ফল দিয়েই দেবীর মন পাওয়ার চেষ্টা করবে ভাবছে। 

পুজোর দিন সকালে সিনিয়র ভলান্টিয়ার হিসেবে পাজামা পাঞ্জাবি পড়া ক্যাবলা একটা বডিস্প্রের একবোতল শেষ করে মাঠে নেমেছে। তবে ক্যাবলা তো! ক্যাবলামি তো তাকে করতেই হবে। তিতলি এসে পড়েছে। হলুদ শাড়ির মাঝে ক্যাবলা যেন আরো একটু ক্যাবলা হয়ে হাঁ করে দেখতে লাগলো। কাছে আসতেই তিতলি মুচকি হেসে বলে গেল, “মুখটা বন্ধ করো, না হলে ফল ঢুকিয়ে দেব।” ক্যাবলা বেশ লজ্জা পেয়ে গেল । 

অঞ্জলি শুরু হলো। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দুজনে। ক্যাবলা একটু পিছনে সরে এসে বেশ কেতা মেরে যেই না ফুলগুলো তিতলির চুলে ছুড়েছে মিস করে হতচ্ছাড়াগুলো গিয়ে পড়লো কাকিমার মাথায়। ভাগ্যিস বুঝতে পারেনি কাকিমা। সে হাঁফ ছাড়ে। এদিকে পাশে থাকা তিতলি যে পুরোটাই দেখেছে।

পাশে এসে বলে গেল, “শোনো একটু বোলিং টা প্র্যাক্টিস করো। বড় বাজে থ্রো। বুঝলে?” ক্যাবলা লজ্জায় লাল। মনে মনে সে ঠিক করে নিয়েছে, আজই সে সব বলে দেবে। এ অপমান আর নেওয়া যায় না।

পুজোর পর প্রসাদ গুছিয়ে নিয়ে সোজা হাঁটা লাগলো তিতলিদের বাড়ির দিকে। বাড়ির সামনে কয়েকটা ছেলে ক্রিকেট খেলছে, তাদের মঝখান দিয়ে গিয়ে, তিতলিদের দরজার বেল টিপে দাঁড়িয়ে আছে সে। ঘামে পাঞ্জাবিটা ভিজে গেছে। টেনশন আর ধরা যাচ্ছে না। উফফ কত দেরি করছে! ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে গেল। সামনে হলুদ শাড়ি তার স্বমহিমায় বিরাজ করছে।

ক্যাবলা বললো, “এই নাও ফল।” তিতলি থ্যাংকস বলে দরজা বন্ধ করতে যাবে, ক্যাবলা শক্তি সঞ্চয় করে বলে উঠলো “দাঁড়াও তিতলি তোমায় কিছু বলবো।” তিতলি ঘুরে দাঁড়িয়ে “বলো” বলতেই হঠাৎই মাথায় এসে ক্রিকেট বলটা লাগলো আর ক্যাবলা আউট! 

চোখ খুললো যখন, তখন ক্যাবলা হলুদ শাড়ির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে সে। তড়িঘড়ি উঠতে গেল কিন্তু তিতলি বললো “অ্যাই একদম উঠবে না। আরেকটু শুয়ে থাকো। চাপ নেই। মা নেই। মামারবাড়ি গেছে। এই ওষুধগুলো খেয়ে নিয়ে আর একটু শুয়ে রেস্ট নাও। তারপর বাড়ি যেও। 

ক্যাবলা কি বলবে ভেবে উঠতে পারলো না।

“কি ভাবছো”, তিতলি তার চোখে চোখ রেখে বললো, “যেটা বলতে এসেছিলে, সেটা বলা হলো না, তাই না! তাহলে শোনো আমিই বলছি খুব ভালোবাসি। তোমার এই ক্যাবলামিটাকে”।

ক্যাবলা মুখটা একটু বেজার করেও তারপর হেসে ফেলে বললো, “আর আমি ভালবাসি, যার জন্যে ক্যাবলামি করি তাকে।”

 

লেখক পরিচিতি

সম্বিত বোস

বাংলা সাহিত্যের ছাত্র আর গল্প বইয়ের পোকা। টুকটাক লেখা কবিতা গল্প ছোট ছোট ভাবনাদের নিয়ে সময় কাটানো শখ।  সাথে সাহিত্য চর্চা আর সিনেমা বানানোর ভূত মাথায় নিয়ে বেশ চলছে। চুপচাপ একদমই নয়, কথা বলে বেশি। গান, গল্প, আড্ডা, কথা, সিনেমা, শহর ~ মিলে মিশে লেখকের জন্ম।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

Leave a Reply to SRIJIT MITRA Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!