গোপা মিত্র
[যাদের স্নেহচ্ছায়ায়, শিক্ষায়, আদর্শে আমি বেড়ে উঠেছি বা যাদের সাহচর্যে আমার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলি কাটিয়েছি, তাদের কেউই আজ আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। আমার এই স্মরণিকা তাদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের এক ছোট্ট প্রচেষ্টা মাত্র।]
পর্ব-৯
মা
আমাদের মা ছিল অফুরান প্রাণশক্তিতে ভরপুর। জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত থেকে আনন্দ খুঁজে নেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল মায়ের। ছোট ছিলাম, বুঝতাম না, মা সবসময় এত আনন্দে থাকতে পারে কি করে! পরিণতমনস্ক আমি যখন পিছন ফিরে মাকে দেখছি, তখন হয়ত বুঝতে পারছি – মায়ের এই শক্তির উৎস ছিল মায়ের জীবনবোধ। মায়ের মুখের বুলি ছিল, “যখন যেমন তখন তেমন”। মা আরো বলত, “দ্যাখো, জীবন থেকে যেটুকু প্রাপ্য সেটুকুই তোমরা পাবে, তার বেশীও নয়, কমও নয়। কাজেই তোমরা যদি, কি পাওনি ভেবে বসে বসে হাহুতাশ কর, তবে দেখবে হাতের ফাঁক দিয়ে কখন যেন জীবনটা গলে পড়ে গেছে, তোমরা বুঝতেও পারনি। তার চেয়ে বরং যা পেয়েছ তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাক। পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নাও”। এই চিন্তাধারার কারণেই হয়ত মায়ের কোনো কিছুতেই অসন্তোষ ছিল না। যেটুকু পেয়েছে, সেটুকুতেই খুশী ছিল আমাদের মা। স্কুল Excursion এ গিয়ে বম্বে থেকে এনেছিলাম মায়ের জন্য একটা শাড়ী। কিন্তু কি আশ্চর্য, মা সেটা না নিয়ে কি অবলীলায় সেটা তাইমাকে দিয়ে দিতে বলেছিল। বলেছিল “দেখো, কাকু রাজী না হলে তো তোমার যাওয়াই হত না। এই শাড়ীটা বরং তুমি তাইমাকেই দাও, তাইমা খুশী হবে”। এমনই ছিল আমাদের মা, অন্যের খুশীতেই মায়ের আনন্দ। এছাড়াও আরো একটা কারণ অবশ্য ছিল- ঠাকুর দেবতায় অচলা ভক্তি ছিল মা’র। শুধু ভক্তি নয়, ছিল বিশ্বাস, ছিল নির্ভরতা। সেইজন্যই হয়ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কখনও ভেঙে পড়েনি।
মা আর তাইমা পরস্পরকে “আপনি” বলে সম্বোধন করতো। ছেলেমেয়ে ছিল না বলেই হয়ত তাইমার মনে ভবিষ্যতের একটা চিন্তা সবসময়ই কাজ করত। মা সবসময় তাইমাকে বলত “আপনি যদি সারাক্ষণ ভবিষ্যতের চিন্তা করেন, তবে বর্তমানে বাঁচবেন কবে? এই তো ছোট্ট একটা জীবন – মরে যাব তো ফুরিয়ে যাবে, আপনার তো কোনো অভাব নেই, তবে এত চিন্তা কিসের ? তার চেয়ে বরং মন খুলে বাঁচুন, প্রাণ খুলে হাসুন”। তার মানে এই নয় যে মা’র কোনো ভবিষ্যতের চিন্তা ছিল না। ছিল, অবশ্যই ছিল- সে চিন্তা ছিল আমাদের তিন বোনকে নিয়ে। আত্মীয়স্বজনের কথা সবসময়ই কানে বাজত মায়ের “তোমার তিন মেয়ে, তাদের বিয়ে দিতে হবে তোমায়”। এই কারণেই হয়ত মা নিজের চাহিদা সীমিত রেখেছিল। যেটুকু না হলেই নয়, সেটুকুই শুধু চাহিদা ছিল মা’র। আমরা দেখেছি, যে কয়েকটা ভালো শাড়ী ছিল মা’র সে কয়েকটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরে যেত অনুষ্ঠান বাড়ীতে। কোনোদিন শাড়ী বিক্রি করতে বাড়ীতে তাঁতী এলে তাইমাকে বলত “এই শাড়ীটা আপনাকে খুব মানাবে, আপনি বরং এটা কিনে নিন”। নিজের জন্য কিছুই নিত না। নিজের যা গয়না ছিল তাই পরেই সব জায়গায় যেত, অথচ একটু টাকা জমলেই তাই দিয়ে সোনার গয়না গড়াত – সব আমাদের ভবিষ্যতের জন্য। কারণ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন আমদের মা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে নিজের জোরে মেয়েদের বিয়ে দেবে, কারো সাহায্য নিয়ে নয়।
আমরাই ছিলাম মায়ের জগৎ। আমাদের ঘিরেই সবসময় মায়ের চিন্তাধারা আবর্তিত হত। নিজের চাহিদা যতই কাটছাঁট করুক না কেন আমাদের ক্ষেত্রে অবশ্য কোনোরকম কার্পণ্য করত না। আমরা কি খেতে ভালোবাসি কোন পোশাক আমাদের মানায়, সব দিকেই নজর থাকত মা’র। মাংস, দই, লুচি, এসব খেতে ভালোবাসতাম আমরা। মাঝেমধ্যেই ছুটির দিনে বাটি ভর্তি মাংস, ভাঁড় ভর্তি দইএর ব্যবস্থা করেছিল মা। আবার কোনোকোনো দিন আমাদের রাতের খাওয়া ছিল লুচি, বেগুন ভাজা, সাদা আলুর তরকারী আর গুড়। সেসব রাতে মা ময়দা মেখে লুচি বেলে দিত আর হরেকেষ্ট বা পঞ্চানন লুচি ভেজে দিত। গরম গরম সেই লুচি ছিল আমাদের কাছে অমৃত। কোনো গুনতি ছিল না, যে যতগুলো পার খাও – মাখা ময়দা ফুরিয়ে গেলে আবার ময়দা মাখত মা, আবার লুচি ভাজা হত।
গ্রীষ্মকালে রোজ বাড়ীর সবার জন্য আসত আম। আমরা তিন বোনে সেখান থেকে তিনটে আম নিয়ে জলে ভিজিয়ে স্কুলে চলে যেতাম – রীতিমত যে যার আমে চিহ্ন দিয়ে। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরলে সেই আম মা কেটে দিত। কিন্তু সেই একটা করে আম খেয়ে কি আর আমাদের তৃপ্তি হয়! মা সেটা অবশ্যই বুঝত। সেই কারণে বছরে একটা দিন রাঙামামাকে দিয়ে মা বাজার থেকে এক ক্রেট ভর্তি হিমসাগর আম আনাত। তারপর সেই ক্রেট খোলা হলে মা সামনে বঁটি নিয়ে বসত, আম কাটত, আর আমরা খেতাম- যে যত পার খাও। সেদিন আর অন্য কিছু খাওয়া নয়, শুধু আম খাওয়া – আম উৎসব। বাড়ীর কেউই অবশ্য বঞ্চিত হত না, মা সেদিন সবাইকেই আম বিলোত।
আমাদের তিনজনের জামাও হত সবসময় একই রকম। আত্মীয় স্বজন এসে কতসময় বলত যে কি দরকার একই সঙ্গে তিনটে একই রকম জামা বানাবার! বড়র জামা তো ছোট পরতেই পারে! তাহলে তো পয়সাও বাঁচে। মা বলত “তাহলে তো বড়ই সবসময় নতুন জামা পাবে, বাকী দুজন পাবেই না। এতে কি হবে – বোনেদের মধ্যে ঈর্ষা এসে যাবে, ঝগড়া হবে, আমি কিছুতেই সেটা হতে দিতে পারি না”। এমনই ছিল আমাদের মা, কোনো মেয়ের প্রতিই কোনো পক্ষপাতিত্ব ছিল না। তবে শখ ছিল মায়ের খুব। আমাদের নানা ভাবে সাজিয়ে, নানারকম পোশাক পরিয়ে খুশি হত খুব। রোজ পরার সাধারণ জামা থাকলেও নিকটজনেদের বিয়ের নিমন্ত্রণ এলেই মা নিজে ভালো কাপড় কিনে এনে দর্জি দিয়ে নিজের পছন্দমত তিনজনের জন্য একই রকম জামা বানিয়ে দিত। অনেক সময় নিজেই মেশিন নিয়ে বসে পড়ত আমাদের জন্য জামা সেলাই করতে।
খুব ভোরে উঠে চৌবাচ্চা পরিষ্কার করে, স্নান সেরে, ঠাকুর ঘরে শিবের মাথায় জল দিয়ে পূজো সেরে মা আসত ঘরে। ঘরের কোণে এক ছোট্ট কুলুঙ্গিতে রাখা ছিল মায়ের ইষ্ট দেবতা রাধাকৃষ্ণর যুগল মূর্তি। মা এবার তাদের পূজো সারত। কখনো কখনো তাদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলত তাদের সঙ্গে, আবার মাঝে মাঝে তাদের গানও শোনাত। রাধাকৃষ্ণকে জল না দিয়ে মা জলস্পর্শ করত না।
এবার আমরা দুধ পাঁউরুটি কখনো সঙ্গে কলা দিয়ে আর মা বাবা চা পাঁউরুটি দিয়ে জলখাবার সেরে নিয়ে যে যার মত ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। বাবা নিচে নামত ছাত্র পড়াতে, আমরা একে একে স্নান সারতে, মা নামত আমাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা দেখতে। ইতিমধ্যে তাইমা ওপরে উঠে গেছে, কাকু অফিসে বেরিয়ে গেছে। আমরা তৈরী হয়ে এসে খেতে বসলে মা আমাদের খাইয়েদাইয়ে স্কুলে রওনা করিয়ে দিয়ে সংসারের খুঁটিনাটি কাজে মন দিত। দাদিকে সাহায্য করা, রান্নার লোককে হাতে হাতে এগিয়ে দেওয়া, বিকেল বা রাতে আমরা কি খাব, সেসবের দেখ্ভাল করা, স্কুল থেকে ফিরলে আমাদের পরার জামা গুছিয়ে ঠিক করে রাখা – এসব শেষ করতে মা’র প্রায় বারোটা বেজে যেত। এবার ঘরে এসে সেদিনের কাগজে একটু চোখ বুলোতো। ইতিমধ্যে বাবা এসে খেতে বসলে সামনে বসে তদারক করত। তারপর নিচে থেকে খাবারের ডাক পড়লে তাইমার সঙ্গে একসঙ্গে বসে খেয়ে নিত, দাদিও বসত তবে একটু দূরে। খাওয়া শেষে দুপুরে অবশ্যই একটু ঘুমিয়ে নিত। কারণ মা উঠত সবার প্রথমে, ঘুমোতে যেত সবার শেষে। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত আমাদের স্কুল ফেরৎ জলখাবার ছিল, পেট ভরে খাওয়া – আগে থেকে ভেজে রাখা লুচি আর তরকারী। রাতে এক বাটি দুধ খেয়ে ন’টার মধ্যেই শুয়ে পড়া। এর পরে অবশ্য নিয়মটা পাল্টে ছিল। তখন ফিরে দুধ আর ফল মিষ্টি বা অন্য কিছু খেতাম, রাতে রুটি , তরকারী। সন্ধ্যাবেলায় মা নিজের মত সময় কাটাত – কখনো খুচ্খাচ সেলাই করে , কখনো পছন্দের বই পড়ে বা কখনো মামাদের কেউ এলে তাদের সঙ্গে গল্প করে।
আমি তখন ক্লাস টু বা থ্রি, মা আমাকে আর বোনটিকে সমগ্র বৈশাখ মাস ব্যাপী শিব পুজো করিয়েছিল – পরপর চার বছর ধরে। পরে অবশ্য করিয়েছিল আনুকেও। ভোর বেলা নিজে স্নান সেরে গঙ্গা মাটি দিয়ে আমাদের জন্য শিবলিঙ্গ গড়ে আমাদের দিয়ে পুজো করাত। তারপর সেই শিবলিঙ্গ একটা পাত্রে জমা করত । বৈশাখ মাস শেষে সব গিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হত। চার বছর পরে আমাদের শিবপুজোর ঘটা করে উদ্যাপন হয়েছিল। আমাদের জন্য নতুন শাড়ী জামা এসেছিল, ঠাকুর মশাইরা এসেছিলেন, শেষ হয়েছিল আমাদের পুজোপর্ব। শিবের সঙ্গে অবশ্য আমাদের পুন্যিপুকুর ব্রতও করিয়েছিল। তবে সেই প্রথম আর সেই শেষ। মা বলেছিল যে আমার যেটুকু করানোর ছিল, আমি করিয়ে দিলাম, এরপরে তোমরা কোন্ পুজো করবে কোন্টা নয় সেই সিদ্ধান্ত তোমরা নিজেরাই নেবে।
আমাদের দিকে মায়ের সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি থাকত। বোনটি তখন ক্লাস টু, মা দেখল যে বোনটি ঠিকমত খেতে পারছে না, বলছে যে গলায় ব্যথা। একটা টর্চ দিয়ে দেখে মা নিজেই আবিস্কার করল যে গলায় সাদা মত কিছু একটা হয়েছে। বাবাকে বলাতে, কেষ্টবাবু এলেন, ভালো করে দেখে বললেন, “একি এতো ডিপথিরিয়া, এক্ষুনি একে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। নচেৎ বাকী দুই মেয়েকেও রক্ষা করা যাবে না। এযে ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে রোগ”। এর কিছুদিন আগেই আমাদের তিন বোনেরই পর পর হয়ে গেছে বসন্ত। মা’ই আমাদের তিন বোনকে তখন সুস্থ করে তুলেছিল। মায়ের যত্ন যে ঠিক কাকে বলে বুঝেছিলাম সেদিন। আমাদের সঙ্গে মা’ও মশারির মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল, হাতে ছিল একটা নিম ডাল। আমাদের কষ্ট হলেই মা সেই নিমডাল বুলিয়ে আমাদের আরাম দিতে চেষ্টা করত।
এবারেও মা ডাক্তারবাবুকে বলে বোনটিকে বাড়ীতেই রাখার ব্যবস্থা করল। বাড়ীর শেষ প্রান্তে দাদির ঘর, যেতে হয় এক ঢাকা দালান পার হয়ে। মা বোনটিকে নিয়ে সেই ঘরেই থাকতে লাগল, বলা যায় সেই ঘরে বোনটীর সঙ্গে নিজেকেও বন্দি করে ফেলল। আমরা রইলাম দালানের এ পারের ঘরে। রোজ কেষ্টবাবু এসে বোনটির হাতে পায়ে ইনজেক্শন দিতে লাগলেন। বিরাট কাঁচের সিরিঞ্জ, কষ্টকর ইনজেক্শন। বোনটি যন্ত্রণায় চিৎকার করত, মা চেপে ধরে থাকত, বাবা দরজায় চকোলেট বা অন্য কিছু উপহার হাতে অপেক্ষা করত, ইনজেক্শন দেওয়া হয়ে গেলে বাবা সেই চকোলেট বোনটিকে দিয়ে কষ্ট ভোলাতে চাইত। কিন্তু ব্যথা আর যন্ত্রণার সেই কষ্ট কি ভোলবার মত? কারণ পরের দিনই তো আবার ডাক্তারবাবু আসবেন ইনজেক্শন দিতে! যাক্, বোনটি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠল, কিন্তু দু’পায়ের ব্যথায় বেশ কিছুদিন হাঁটতে পারত না – লাঠি নিয়ে চলত। যৌথ পরিবারের গুরুত্ব ঠিক কতখানি এই অসুখই আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল। সেইসময় মা আমাদের কাছেই আসত না, সাংসারিক কোনো দায়িত্বও সেভাবে পালন করত না। মায়ের মত তখন আমাদের আগ্লে রেখেছিল তাইমা, সঙ্গে ছিল দাদি, সাহায্য করেছিল কাজের লোকেরা।
আমাদের সমস্ত রকম আব্দার বা বায়না আমরা মায়ের কাছে করতাম। আশ্চর্য দক্ষতায় মা সেসবের সমাধান করত। ঝম্ঝম বৃষ্টিতে মাকে এসে বললাম যে মা আমরা একটু বৃষ্টিতে ভিজব – দোতলার ছাদ তো রয়েইছে, কেউ দেখতে পাবে না। মা কাকুর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এলো – আসলে কাকুর ভয় ছিল, যদি আমাদের শরীর খারাপ হয়! কালী পুজোয় বাজি ফাটাবো – মা ব্যবস্থা করল, সেজমামা বা রাঙামামা এল, আমাদের সঙ্গে থেকে কাকুর মনের ভয় দূর করল। এতদিন পর্যন্ত মামার বাড়িতে গিয়ে বাজী ফাটাতাম, এবার থেকে বাড়িতেই সকলের সামনে ফাটাব – মা আমাদের সেই নিয়মটাও বদলে দিল। সেজমামার কাছ থেকে তখন আমরা তাস খেলাটাও শিখে নিয়েছি। পরীক্ষা শেষে বা ছুটির অবসরে আমরা দোতলার ছাদে বসে সকলে মিলে তাস খেলতাম। মা, তাইমার সঙ্গে – কখনো আবার বাবাকেও টেনে নিতাম – টোয়েন্টি নাইন, স্ক্রু, ব্রে, ফিশ খেলা চলত প্রায় রাত একটা দেড়টা পর্যন্ত।
এই দোতলার ছাদ ছিল আমাদের বাড়ীর সম্পদ – বৃষ্টিতে ভেজা, বাজী ফাটানো, দোলের রঙ গায়ে মেখে রঙীন জলে গড়াগড়ি দেওয়া, তিন বোনে তিনটে রথ নিয়ে একসঙ্গে টানা, কুমির ডাঙা বা এক্কা দোক্কা খেলা, রাত পর্যন্ত তাস খেলা, গল্প করা, শীতের দুপুরে মাদুর পেতে শুয়ে রোদ পোয়ানো, গরমের রাতে দখিনা বাতাসের আরাম, আচার আমসত্ত্ব রোদ্দুরে দেওয়া, সবই আমরা করতে পেরেছি এই ছাদের জন্য। আমাদের বাড়ীর তিনতলা ওঠার সময় ইঞ্জিনীয়ার যখন বলেছিলেন যে, এই ছাদ থেকেই সিঁড়ি তুলতে হবে মা তখন বাধা দিয়েছিল। মা বলেছিল যে, না ভিতরের ঢাকা দালান থেকে সিঁড়ি ওঠাতে হবে। নিজে এঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, কিভাবে কি করতে হবে। প্রথমে অসম্ভব বললেও, পরে ইঞ্জিনীয়ার বুঝেছিল এবং সেইমতই প্ল্যান করেছিল। মা’র বাস্তব বুদ্ধি এই ভাবেই আমাদের ছাদ বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
সীনেমার পাড়ায় থাকলেও আমাদের বাড়ীতে সীনেমা দেখার তেমন চল্ ছিল না। মায়ের সঙ্গে অবশ্য দু একটা ঠাকুর দেবতার বই দেখেছিলাম, যেমন – কংস, তরণীসেন বধ। বাবার সঙ্গে দেখেছিলাম ইংরাজী ছবি- কিং কং, হেলেন অফ ট্রয়। হিন্দী ছবি? দেখার প্রশ্নই ওঠেনা। আমি তখন ক্লাস এইট বা নাইন, রম্রম্ করে চলছে শাম্মী কাপুর, সায়রা বানুর ‘জংলী’। মা’কে এসে ধরলাম, মা তুমি ম্যানেজ কর, আমাদের সব বন্ধুদের দেখা হয়ে গেছে – আমরাও ‘জংলী’ দেখতে যাব। তারপর গেলাম ‘জংলী’ দেখতে, আমার জীবনের প্রথম দেখা ও মনে থাকা রঙীন হিন্দি ছবি – কাশ্মীরের পটভূমিতে শাম্মী কাপুরের সর্বাঙ্গ ঝাঁকিয়ে অপূর্বনাচ, সঙ্গে গান। এরপর মা’কে ম্যানেজ করে আরো কয়েকটা হিন্দী ছবি দেখেছিলাম – রাজকুমার(শাম্মী কাপুর,সাধনা), সঙ্গম (রাজকাপুর, বৈজয়ন্তীমালা), জিদ্দি(জয় মুখার্জী, আশা পারেখ)। মার সঙ্গে ‘পূর্ণশ্রী’ তে দেখা একটা ইংরাজী সীনেমার কথাও খুব মনে পড়ে ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’। কি প্রচন্ড ভয় যে পেয়েছিলাম!
সাংসারিক নানা দায়িত্বের মাঝেও মা’র আন্মনে গুনগুন করে গান গাওয়াটা কোনোদিনও কিন্তু বন্ধ হয় নি। ‘আমি বনফুল গো, ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে’ ‘মন না রাঙিয়ে কি ভুল করিয়ে কাপড় রাঙালে যোগী’, ‘তুফান মেল’ এমন কয়েকটা গান এখনও কানে বাজে খুব। এসব গান আমি কোনো দিনও শুনি নি, মা যে কোথা থেকে শুনেছিল, কে জানে! তখনও আমাদের রেডিও আসে নি, তাইমার ঘরের রেডিওয় এসব গান বাজার প্রশ্নই নেই। পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা যে সমস্ত বাংলা বা হিন্দী গান আমাদের কানে আসে, তার মধ্যে তো এসব গান ছিল না! মায়ের গলায় শোনা আমার জানা গানের মধ্যে দু’একটা রবীন্দ্রসংগীত মনে পড়ে, ‘রাজপুরীতে বাজায় বাঁশী’ বা ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’।
হঠাৎই একদিন কাঞ্চনদা, আমাদের চেয়ে বয়সে বেশ কিছু বড় মামাতো দাদা (বড়মামার ছেলে), একটা ব্যাঞ্জো কিনে এনে বাজাতে লাগলো। মা’র খুব পছন্দ হল। মা’ও কাঞ্চনদাকে বলে নিজের জন্য একটা ব্যাঞ্জো আনিয়ে নিল। তারপর কাঞ্চনদার কাছ থেকে প্রাথমিক ব্যাপারটা জেনে নিয়ে চেষ্টা করে দিব্যি গানের সুর বাজাতে লাগল। এতদিন যে সুর আমরা মায়ের গলায় শুনে এসেছি, এখন সেই সুর আমরা মায়ের হাতের ছোঁয়ায় ব্যাঞ্জোতে বাজতে শুনলাম।
আমাদের যত্নআত্তি খাওয়া পরার দিকে নজর থাকলেও পড়াশোনার দিকে অবশ্য খুব একটা নজর দিত না মা, বোধহয় ভাবত এ ব্যাপারে মেয়েদের ওপরে ভরসা করাই যায় – তাছাড়া যেন জানত এদিকটা মায়ের দেখার দরকারই নেই, বাবা তো রয়েইছে। তবে পরীক্ষার দিনগুলোতে বাড়ীর নিয়ম অনুযায়ী সকলকে প্রণাম করতে গেলে মা আমাদের দইয়ের ফোঁটা দিতে কখনই ভুলে যেত না। আর পরীক্ষা পাশের পর ঠাকুরকে নিবেদন করে বাড়ীর সকলকে অবশ্যই মিষ্টি বিতরণ করত।
এভাবেই আমাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের মধ্যে দিয়ে আমরা ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে লাগলাম। মা বাবা দুজনের এই বোঝাপড়া, একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, ভরসা, নির্ভরতা, একেই কি বলে ভালোবাসা? মায়ের সাধের প্রিয়, সেই ব্যাঞ্জোটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবে যে কখন হারিয়ে গেল – জানি সময়ের মতই আর কোনোদিনও তা ফিরে পাওয়া যাবে না।
আগামী পর্বে সমাপ্য
গোপা মিত্র
ফিজিক্স অনার্স। একসময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও, প্রকৃতপক্ষে গৃহবধূ – কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। ভ্রমণের নেশা প্রবল। ভারতের বাইরে কোথাও না গেলেও দেশের মধ্যেই প্রচুর ঘুরেছেন। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, ঐতিহাসিক স্থান – কোনোওকিছুই বাদ নেই। এখনও সুযোগ সুবিধে হলেই বেরিয়ে পড়েন। দু-কলমের জন্যে জীবনে প্রথমবার কলম ধরা।
Eagerly waiting for the next part. Daarun lekha.
Thank you .