রোমান্টিকগল্প

অপেক্ষা

সুদেষ্ণা মিত্র

 
।। ১ ।।

এ গল্প সেই সময়ের কথা যখন মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করতো চিঠির মধ্যে দিয়ে। একে অপরকে চিনে নেয়ার জন্যে মনের সূক্ষ্ম অনুভূতি যথেষ্ট ছিলো। এমনই এক সময়ে কলকাতা থেকে বেশ কিছু দূরের শহরতলিতে বড় হয়ে উঠছিলো রনজয়।

রনজয় মেধাবী ছাত্র। ছোট থেকে নয় অবশ্য। ক্লাস সিক্সে বাবার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে চলে যাওয়া, তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কলকাতার পাট গুটিয়ে ছোট ছেলেকে নিয়ে কনা দেবী ঠিক করেন বড় ছেলে-বউয়ের কাছেই থাকবেন পাকাপাকি ভাবে। আমুল বদলে গেলো রনো এই নতুন গড়ে ওঠা টাউনশিপে এসে। তখন এই জায়গাটা এমন ছিলো না। শহরে বড় হয়ে ওঠা রনোর খুব মনখারাপ লাগতো বাবার জন্যে। বাড়ির ঘরগুলোর জন্যে, পেয়ারা গাছের জন্যে। 

একদিন স্কুলে ভর্তি হলো সে। তবে সেখানে বন্ধু হওয়ার আগেই তার প্রথম বন্ধুত্ব হলো এই আধা গ্ৰাম আধা শহরের ছোট ছোট পাহাড়ে ঘেরা পরিবেশ। সামনের সবুজ খোলা মাঠ, বড় বড় গাছ যা রাতের বেলা তার শিশু মনে নানা ভয় এনে দিতো আবার দিনের বেলা সেই বনবাদাড় আর রুক্ষ জমি তাকে টানতো। এই পরিবেশে বড় হতে হতে সে নিজের সাথেই সময় কাটাতে বেশী পছন্দ করতো। ততদিনে সে পরিবেশ অনেকটাই বদলেছে। এখন কলকাতার অনতিদূরে এই মফস্বল অনেকটাই জনবহুল। রনজয় কিন্তু এখন সেই প্রকৃতি প্রেমিকই রয়ে গেছে। কলেজে পড়ে সে এখন। যদিও আজকাল তার ভাবের ঘরে এসে হানা দিয়েছে তার বাড়ির উলটো দিকে গোলবারান্দা ঘেরা বাড়িটির মেয়েটি। 

প্রতিদিনই কলেজ থেকে ফেরার পথে তার চোখ যায় গোলবারান্দায়। মেয়েটিও তাকে দেখে আর সেও। ঠোঁটের কোনে হাসিও ফুটে ওঠে তার মাঝে মাঝে।

।। ২ ।।

“সিমু এই শাড়িটা পরলি!! একদম নতুন!! সেফটিপিন সাবধানে লাগাস।”

মায়ের সাবধানবানীতে ঘাবড়ে না গিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে শাড়ি ঠিক করতে লাগলো সীমন্তিনী। “কিচ্ছু হবে না মা। স্বরস্বতী পুজোতে হলুদ শাড়ি পরতেই হতো, আর তোমার এটাই শুধু হলুদ সিল্ক।” মা অনুরাধা মেয়েকে আরো একবার ভালো ভাবে শাড়িটা পরানো হয়েছে কিনা দেখে নিয়ে আদর করে বললেন, “চল এবার। পৌছোতে সময় লাগবে আর ভিড় ও হবে।”

দুটো পাড়া মিলে একটাই ক্লাব “ঘরোয়া”। আর তাতেই বিশেষ কোনো দিনে কলকাতার কিছু নামকরা গায়ক গায়িকাকে দিয়ে জলসার আয়োজন করে পাড়ার ছেলে বুড়োরা মিলে। স্বরস্বতী পুজো উপলক্ষে তেমনই এক অনুষ্ঠানে আজ চলেছে মা ও মেয়ে।

“সীমন্তিনী। এদিকে আয় জায়গা রেখেছি তোদের।” কেয়া জোরে ডাকলো। কিন্তু কেয়া যে সারিতে বসে সেখানে ঢুকতে গিয়েই থমকে দাড়ালো সে। রনো দা !!! এখানে দেখতে পাবো ভাবিনি!! রনো কিছু বলার আগেই ঘোষণা শুরু হয়ে গেলো, পেছন থেকে লোকজন সীমন্তিনীর ঐভাবে দাড়িয়ে থাকা নিয়ে দু চার কথা বলতে শুরু করলো রনো উঠে দাঁড়িয়ে সীমন্তিনীকে ভেতরের দিকে চলে যেতে সাহায্য করলো।

অনুষ্ঠান শেষে রনজয়ের বৌদি সুতপা আর কনা দেবীর সাথে অনুরাধার আলাপ করালো সীমন্তিনী নিজেই। একথা সেকথার পর সুতপা একদিন বিকেলে সীমন্তিনীর বাড়ির সবাইকে চা খাওয়ার জন্যে নেমতন্ন করলো।

আদতে লাজুক অথচ সপ্রতিভ ছেলেটির ঝকঝকে চেহারা ও কথাবার্তায় ভারী ভালো লাগলো প্রশান্ত বাবুর আর অনুরাধা দেবীর। সুতপা আর কণা দেবীরও সীমন্তিনীর বাড়ির সবাইকে খুবই পছন্দ হলো। কথায় কথায় রনজয়ের প্রসঙ্গে আসতেই তার পড়াশোনার কথা উঠলো। তার দাদা সবসময়েই ভাইয়ের গর্বে গর্বিত। প্রশান্ত বাবু অনুরোধ করলেন রনজয় যদি সীমন্তিনীকে অঙ্কটা একটু দেখিয়ে দেয়। ঠিক হলো সীমুর পড়াশোনায় সাহায্য করবে রনজয়। ক্লাস নাইনের ছাত্রী সে। রনো তখন ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ছাত্র।

।। ৩ ।।

জীবনের প্রথম শিক্ষকতা তার কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা। সীমু শুধু তার ছাত্রীই নয় তার খুব কাছের বন্ধু ও হয়ে উঠেছে। রনো তার ছোটবেলার নানা স্মৃতি উজাড় করে দেয় সীমুর কাছে। এই টাউনশিপে প্রথম এসে তার একাকীত্ব, প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়া, রাতের বেলা অন্ধকারে ঝিঁঝিঁর ডাকে সামনের যে জঙ্গলকে সে ভয় পেতো দুপুরবেলা মা ঘুমিয়ে পড়লে সেখানেই গিয়ে গাছগাছালির সঙ্গে বন্ধুত্ব সব বলতো সে সীমুকে। ভালো লাগতো রনোর সীমুর শোনার আগ্ৰহ, মুগ্ধ হয়ে দেখতো সীমুর বিস্ময়ে ভরা চোখদুটো, মনে হতো এই তার সেই মানুষ যার সাথে সে তার মনের কোণে জমে থাকা সব অনুভূতিগুলো ভাগ করে নেবে। সীমু তার রনোদার গল্পের মাঝে যেমন হারিয়ে যেতো প্রকৃতির মাঝে তেমনই সীমন্তিনীর অর্নগল বলে যাওয়া কথার মধ্যে রনজয় খুঁজে পেতো তার জীবনের শুরুর কিছু বছরকে, তার অনেক পেছনে ফেলে আসা শহুরে জীবনটাকে।

দেখতে দেখতে কেটে গেলো পাঁচমাস। পূজোর ঢাকের আওয়াজ আর শরতের সোনালী রোদ ছড়িয়ে পড়লো এই ছোট্ট শহরতলীর আনাচে কানাচে। পাড়ার বিভিন্ন বয়সী মানুষজন পুজোর খুটিনাটি কাজে ব‍্যস্ত হয়ে পড়লো। আয়োজন কিছু কম নয়। পুজোর জোগাড়ের পাশাপাশি দুবেলা খিচুরি ভোগের আয়োজনও করতে হয়। ভোগ রান্নার দায়িত্ব পাড়ার মহিলাদের। কণা দেবী নিজে কখনো সেভাবে এই যজ্ঞির মধ্যে না থাকলেও সুতপাকে কখনো পূজোর আনন্দ করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াননি। রনো বেশ ভোরবেলা তার বৌদিদিকে পৌঁছে দিতে গেছিলো প‍্যান্ডেলে। বাড়ি ঢুকতে গিয়ে থমকে দাড়ালো। সীমু আর অনুরাধা। সাদা লাল শাড়ি আর কপালে ছোট্ট একটা টিপ, এইটুকু হাল্কা সাজেই আজ রনোর চোখে সীমু অন‍্যরূপে ধরা দিলো। সারা পূজোয় এমন আবেশে চেনাজানা সীমন্তিনী রনজয়কে এক অব‍্যক্ত ভালোলাগায় ভরিয়ে রাখলো। বন্ধুত্বের সীমানা ছাড়িয়ে দুই কিশোর কিশোরীর মনের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়িয়ে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালো প্রেম।

।। ৪ ।।

পুজোর পর থেকেই হালকা ঠান্ডা ভাবটা এসব অঞ্চলে ভোরের কুয়াশা আর বিকেলের মাফলার আর কটসুলের জামাকাপড় পরা পথচারীদের মধ্যে দিয়েই জানান দিয়ে দেয় শীত আসতে আর বেশী দেরি নেই। এবছরও তার ব্যতিক্রম হলো না। শুধু ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় পরীক্ষার পড়া করতে বসতে আগে যেমন সীমুর ভালো লাগতো না, এখন ভালো লাগার ঘোর মনটাকে ভরিয়ে রাখে, কতক্ষণে বিকেল পাঁচটা বাজবে!! সে ছুটে যাবে রনোদার কাছে পড়তে। আজকাল কেন জানিনা বড্ড অভিমান করে রনোদা তার একটু দেরী হলেই। বদলেছে সে নিজেও। খাতায় লিখতে লিখতে মুখ তুলে তাকিয়ে যদি দেখে রনো তার দিকে তাকিয়ে আছে আজকাল সে চোখ সরিয়ে নেয় না। সে ও যে খুঁজতে চায় রনোর চোখে না বলা কথার ভাষা।

দিন যায়। রনো আর সীমু দুজনে নিজেদের তৈরী জগতে আপন খেয়ালে মেতে থাকে একে অপরকে নিয়ে। তাদের এই ঘনিষ্টতা চোখ এড়ায় না কণা দেবীর। তাঁর ধারণা যে অমূলক নয়, তা প্রমাণ হলো রনোর থার্ড ইয়ারের পরীক্ষার সময়। সাধারণত এ সময়টা রনো নিজের ঘরের মধ্যেই থাকতে বেশী পছন্দ করতো দুবেলা খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া। এবারে সেই নিয়মেরই যে শুধু অমান্য হলো তা নয়; সীমু কিন্তু রনোর পরীক্ষার একসপ্তাহ আগেও পড়তে এলো তার কাছে। একদিন থাকতে না পেরে কণাদেবী ছেলেকে জিঞ্জেসও করেছিলেন সীমু আরো কতদিন আসবে পড়তে!!! উত্তর পেয়েছিলেন, “মা আমি তো ওর পড়ার দায়িত্ব নিয়েছি; তাই আমার পরীক্ষা থাকলেও, ওর ক্ষেত্রে গাফিলতি হওয়া ঠিক নয়।” এ নিয়ে আর কথা বাড়াননি তিনি। কোনোদিনই আগ বাড়িয়ে কোনো বিষয়ে মাথা গলানো তার পছন্দ নয়। আর ছেলের প্রতি তার যথেষ্ট বিশ্বাস। 

কাল থেকে ছেলের পরীক্ষা শুরু। আজ তাই নানা কথা ভাবছিলেন দুপুরবেলা ঘুম থেকে উঠে। সাধারণত বিকেলে ছাদের ফুলগাছগুলোর তদারকি করেন আজ গড়িমসি করছিলেন। রনোর বাবার হঠাৎ চলে যাওয়া, শহরের বাড়ির পাট তুলে এখানে চলে আসার সময় ছোট্ট রনোর, মাকে কাঁদতে দেখে অবাক হয়ে বলা “মা, তুমি কেঁদো না মা। আমি অনেক লেখাপড়া করবো আর অ্যাত্তো বড় বাড়ি বানাবো।” তার ছেলেমানুষি মন ভেবেছে যে তারই মতো মায়ের দুঃখ হয়েছে এই বাড়ি ছেড়ে যেতে, পেয়ারা গাছ আর নাম না জানা সাদা ফুলের গাছ – যার মালা গেঁথে সে মায়ের জন্যে নিয়ে আসতো মাঝে মাঝে। এখানে এসেও সে প্রথম প্রথম এসব নিয়ে প্রশ্ন করতো মাকে।

।। ৫ ।।

হঠাৎ সীমুর গলার আওয়াজে তাঁর চিন্তার জাল বোনায় বাধা পড়ে। আজ ও এসেছে!! এবার তাকে বারণ করতেই হবে; না হলে অপরিনত দুই মনের ভুলের খেসারত গুনতে হবে রনোকেই। কিন্তু বেরোতে গিয়েও আটকে যান। রনো পেছন ফিরে টেবিলে বসে পড়ছে আর সীমু পেছন থেকে তার গলা জড়িয়ে কিছু বলছে। কণাদেবী এক জায়গায় দাড়িয়ে রইলেন। যা দেখলেন তা অন‍্যায় কিনা জানেন না কিন্তু রনোর যে এখন এসব দিকে মন দেয়ার সময় নয়। জীবনের কঠিন পথ চলাই যে শুরু হয়নি তার।

রনোর আজ পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। যদিও কাল বিকেলে সীমু চলে যাবার পর সীমুর হঠাৎ পেছন থেকে এসে গলা জড়িয়ে ধরার ছোঁয়াটুকু তার মনে বেশ অনেকক্ষণ একটা শিরশিরে ভাব রেখে গেছিলো তবে তার জন্যেই বোধহয় খুব মন দিয়ে পড়তে পেরেছে। আজ পরীক্ষা সেরে বেরোতে দেরিই হলো। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। সীমু অপেক্ষা করে আছে। আজ আর কাল সীমু নিজেই আসতে চাইলো না। তার নাকি মনে হয়েছে পরশুর পরীক্ষাটা বড্ড গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই দুদিন ঐ বারান্দাটুকুই তাদের সবকিছু। 

সীমু দাঁড়িয়ে আছে। সে হাত নাড়লো। সীমু জিগ্যেস করল্‌ “কেমন হয়েছে পরীক্ষা?” রনো বললো, “ভালো। তুমি পরশু বিকেলে আসবে তো?” মিষ্টি হেসে সীমু “হ‍্যাঁ” বললো। আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো সে, কিন্তু মায়ের ডাকে তার কথা না বলাই রয়ে গেলো। একটু আগে প্রশান্ত বাবুকে রনোর বাড়ি থেকে বেরোতে দেখেছে সীমু, অবাক হয়েছে। এই ক মাসে তিনি ওই বাড়ি সেই প্রথমদিন ছাড়া আর যাননি। তাই বাবার ডাকে তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে যায় সে।

এই দুদিন একবার করে শুধু সকাল বিকেল বেলা গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে রনো। যদি একবার দেখা যায় সীমুকে। কিন্তু সীমু আসেনি একদিনও। নিজের মনেই হাসে রনো। আমার থেকে বেশি চিন্তা ওর আমার পড়া নিয়ে। বারান্দায় আসাও বন্ধ।

আজ তাই একটু জোরেই পা চালিয়ে আসছিলো সে। এসে হয়তো বসে আছে সীমু। ঝড়ের গতিতে এসে গেট খোলে সে। মা বেরিয়ে আসে। ভেবেছিলো মা বোধহয় পরীক্ষার খবর জানতে চায় তাই নিজেই জবাব দেয় “ভালো হয়েছে মা।” কণা দেবী শুধু আচ্ছা বলে যেমন পর্দা সরিয়ে এসেছিলেন তেমনই ভেতরে চলে যান। এক ছুটে এসে ঘরে ঢুকেই অবাক হয় রনো, সীমু তো ঘরে নেই। বৌদিদিকে জিগ্যেস করে জানতে পারে, আসেনি সে আজ। অস্থির হয়ে ওঠে সে। এমন তো করে না সীমু। তবে কি শরীর খারাপ? একবার ভাবলো নিজে থেকে ওর বাড়ি গিয়ে দেখে আসে। তারপর কি মনে করে আর গেলো না। 

।। ৬ ।।

দুদিন খুব অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে কাটলো রনোর। পরীক্ষা দিয়ে ফিরে এসে সে বাড়ি আর গেলো না। সোজা গেলো সীমন্তিনীদের বাড়ি। জানতে পারলো এই কদিন রনোর পরীক্ষা বলে তার পড়া নেই; তাই সে মাসীর বাড়ি বেড়াতে গেছে। অভিমানী রনো কিছুতেই বলে উঠতে পারলো না যে, আমি তো বারণ করিনি ওকে আসতে। সেদিন কিছুই পড়তে পারলো না। সীমু এতো ছেলেমানুষ। একবারও বলে যেতে পারলো না তাকে। আসবে বলে কথা দিয়েও সে কথা রাখলো না। তবে কি সেই স্বপ্ন দেখছিলো সীমুকে নিয়ে!!

পরীক্ষার বাকি দিনগুলো রনো একরকম জোর করেই নিজেকে পড়ার বইয়ের পাতায় ডুবিয়ে রেখেছিলো। ঘরের বাইরে যায়নি। এমনকি একটু ঘুর হলেও কলেজ থেকে অন্য রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরেছে। আজ অনেকদিন পর তার চেনা পথ দিয়ে বাড়ি ফিরলো সে। দুর থেকে তার চোখ গেলো বারান্দায়। সীমু। সে তাকাবে না। থাক দাঁড়িয়ে। যদিও মনে মনে আশা করেছিল সীমু হয়তো চেঁচিয়ে ডাকবে। কিন্তু না। বাড়ির নীচে দিয়ে যাবার সময় কোনো আওয়াজই এলো না। গেট বন্ধ করার সময় তাকিয়ে দেখলো, কেউ নেই।

পর্দার আড়ালে সীমুর চোখদুটো জলে ভরে গেলো। সে জানে অভিমানী রনোদা তাকে আর কোনোদিন ডাকবে না। কিন্তু তার যে কিছু করার নেই। কণা মাসিমা তার বাবাকে বলেছেন যে রনো কোনোদিন বলতে পারবে না তাই তিনি অনুরোধ করছেন যে সীমু যেন আর পড়তে না আসে। কারন রনো নিজে কিছুই পড়াশোনা করছে না। আর এসব কথা তিনি চান না তার ছেলে জানতে পারুক। সে অত্যন্ত জেদী। কোনো কথায় কি কাজ করে বসবে, তা কেউ জানে না। তার বাবা তাকে বলে দিয়েছে যে যেন একবারের জন্যেও ও বাড়িতে না যায়। তাই তাকে মাসির বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো। কালই ফিরেছে সে। আজ তাই থাকতে না পেরে এসে দাঁড়িয়েছিলো বারান্দায়। কিন্তু ওইদিকের বাড়ির একফালি জানলায় চোখ পড়তেই দেখলো সুতপা দাড়িয়ে আছে। তাই একছুটে সে ঘরের মধ্যে চলে আসে।

এই সপ্তাহটা খুবই ব‍্যস্ততার মধ্যে কাটে রনোর। নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হতে আর বেশিদিন বাকি নেই। সময়ের প্রলেপ বোধহয় যে কোনোও ক্ষতের সব থেকে বড় ওষুধ। রনোর এতদিনেও ক্ষতটা কাঁচাই রয়ে গেছে। ভুলতে সে পারেনি সীমুকে। এর মধ্যে দেখা যে একদম হয়নি তা নয়। কিন্তু সীমু কথা বলার সুযোগ দেয়নি আর রনোর সুযোগ খুঁজে নেয়া হয়নি। 

সেদিন দুপুরবেলা রনো শুয়ে ছিলো। ঘুমিয়ে পড়েছিলো। রাস্তায় ট্রাকের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেলো। বাইরে বেরিয়ে দেখে সীমুদের বাড়ির সামনে ট্রাক দাড়িয়ে আছে। সুতপা রান্নাঘরের দিকে যেতে গিয়ে দ‍্যাখে তার দেওর বাইরে দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে বলে, “তোমাকে বলা হয়নি। প্রশান্ত কাকু কলকাতাতে বদলি হয়ে গেলেন। ওরা চলে যাচ্ছে।”

রনোর ইচ্ছে হলো দাঁড়িয়ে থাকে এখানে। সীমুর সাথে কথা বলার এটাই শেষ সুযোগ। কিন্তু পারলো না। মনে হলো মন কি শুধু তারই ছটফট করবে? সে তো কিছু করেনি। তবে সে কেন কথা বলবে!! ঢুকে গেলো সে বাড়ির মধ্যে। গিয়ে দাঁড়ালো মায়ের ঘরের জানলায়। আড়াল থেকে দেখলো সবই। সীমু মায়ের সাথে গাড়িতে ওঠবার আগে একবার তাকালো রনোদের বাড়ীর দিকে। অনুরাধা কিছু বললেন। তারপরেই লক্ষী মেয়ের মতো গাড়িতে উঠে বসে পড়লো সে। 

।। ৭ ।।

কণা দেবী আর সুতপা দুজনেই ঠিক করেন রনোর সাথে কথা বলবেন। চিরকালই রনোর নিজের ভাবের জগতে ঘোরাঘুরি। কিন্তু কেন জানি, সুতপার মনে হয় তার থেকে চার বছরের ছোট এই দেওরটি আজকাল একটু বেশীই চুপচাপ হয়ে গেছে। তার জোরাজুরিতেই কণা দেবী ছেলের ঘরে এসে ঢোকেন। রনো টেবিলের ওপর মাথা রেখে শুয়েছিল। অগোছালো মনটাকে কিছুতেই গুছিয়ে নিতে পারছে না সে। “রনো” মায়ের ডাকে উঠে বসে সে। সঙ্গে বৌদিদি। কনা দেবী ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একবারের জন্যে ভাবেন সব কথা বলা ঠিক হবে কিনা! তারপর মনে হয় সত্যি কখনো চাপা থাকে না। এখন তাঁর নিজেরও মনে হয় ঝোঁকের বশে হয়তো সীমন্তিনীকে একটু বেশীই বকুনি দিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু রনোকে সব জানাতেই হবে। মায়ের কর্তব্য করতে গিয়ে মানুষ হিসেবে নিজের কাছে ছোটো হয়ে যেতে পারেন না তিনি। ছেলেকে এক এক করে সব কথা বলেন। শেষ করতে পারেন না তিনি। “মা” রনো বলে ওঠে এ গলা চেনা কনাদেবীর। এমন ধারাই হবে তিনি জানতেন। নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন কনাদেবী, রনো বলে “তুমি আমাকে এভাবে ছোট করে দিলে একটা সহজ সরল মেয়েকে তুমি এতো কষ্ট দিলে!! কিসের ভয় পেয়েছিলে!! আমার পড়াশোনা আমার ভবিষ্যৎ! সে সব আমার দায়িত্ব। তোমাদের কাউকে আমার চিন্তা করতে হবে না।”

দুজনেই অনেক কিছু বোঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু রনো তখন ভাবছে আর কিছুই করার নেই। মনের তোলপাড় অবস্থা কিভাবে সে কাউকে বোঝাবে তার ভাষা তার জানা নেই। 

তার সবথেকে প্রিয় মানুষ তার মা নিজের ছেলের স্বার্থে প্রশান্ত কাকুর মতো মানুষ কে অপমান করতেও পেছপা হননি। মায়ের এই রূপ সে কেমনভাবে মেনে নেবে!

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় রনজয়। তাকিয়ে থাকে সামনের বাড়ির অন্ধকার বারান্দায়। গলার কাছে জমে থাকা কষ্টটা কান্না হয়ে বেরোলে ভালো হতো। চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে শেষ দিনের দেখা দুটি চোখ। যা বলতে চেয়েছিল, “তোমার ডাকের অপেক্ষায় আছি রনোদা”।

অপেক্ষা যে রনোরও অনাদি অনন্ত কালের। শুধু সীমন্তিনীই তা জানতে পারলো না।

সুদেষ্ণা মিত্র

 

সম্পাদক, Du-কলম

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. Ishh, monta kharap hoye galo pore! Apoorbo golper bandhuni…very touchy and emotional story…🥺

  2. Khub misti akta golpo ar khub sundar misti vasay likhechhis. Shesher dike monta khub anmona hoye gelo.
    Khub valo laglo. Ar ekta katha boli, ankata darun. Bari ar varanda jekhane Simu dariye achhe, seta abikal chhordi ( Amiya da) r Rani Harshomukhi roader barir moto.
    Anekdin pare smriti romonthan karar sujog pelam.
    Thank you so much.

    1. Ar ki chai kaku…Amar lekha jodi tomake nostalgic kore dey seta to sob theke boro paoa….Thank you .

    2. Er theke ar bhalo ki hote pare kaku. Amar lekha tomake nostalgic kore diyeche eta onek boro paoa. Thank you.

  3. Khub sundor golpota porte porte jeno chokher same dekhte pachilam. Khub misti kintu seshtaye mon kharap hoye gelo.

  4. Sotti chobita dekhe kaka choto mashir paikparar barir kotha mone porche Anjankaku thik boleche re.

    1. Tor jonye lekha reply ta kemon kore jeno nicher dike chole geche tai abar likhlam….Tui pashe achis eta khub bhalo lagche…..Ar tui to prothom din thekei bolechis ei page ke nijer kore niyechis….Tai thank you bolbo na…..Amar lekha prothom golpo tor bhalo legeche eta jene amar khub bhalo …..

  5. গল্পটা যেন অসম্পূর্ণ। দ্বিতীয় পর্ব লিখতে পারি ?

    1. গল্প অসম্পূর্ণ নয়। গল্পের প্লট অনেকক্ষেত্রেই বাস্তবমূখী হয়। জীবনের সব অঙ্ক মেলে না। এ গল্পটিও তাই।
      দ্বিতীয় পর্ব তাই না লেখাই ভালো।

  6. আমার খুব ভালো লেগেছে… ছোটো গল্পের এটাই মজা… ” শেষ হইয়াও হয় নাই শেষ” …

Leave a Reply to Anjan Bose Chowdhury Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!