গোপা মিত্র
অন্ধ বিচার
রহস্য ধারাবাহিক (পর্ব-৩)
কোর্টে কেস উঠলো। বিবাদী পক্ষের উকিল স্বনামধন্য কৃষ্ণকিশোর সান্যাল। ভারতের সবাই তাকে এক ডাকে কে.কে. নামেই চেনে। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, রীতিন আগরওয়াল বিখ্যাত ব্যবসায়ী ওমপ্রকাশ আগরওয়ালের একমাত্র সন্তান। মিঃ আগরওয়ালের ব্যবসা শুধুমাত্র ভারতেই নয় বিদেশেও প্রসারিত। একমাত্র ছেলের গ্রেপ্তারীর খবর পেয়ে তিনি ভারতে এসে তার পরিচিত কে.কে.-র সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং ছেলেকে ছাড়াবার জন্য তিনি তাকে প্রায় ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়েছেন।
প্রথমেই বক্তব্য পেশ করলেন, পাবলিক প্রসিকিউটার বা পি. পি.। তিনি কেসের বর্ণণা দিয়ে থামলে, মহামান্য জজ্সাহেব ফিরলেন, বিবাদী পক্ষের উকিল কে.কে.-র দিকে।
কে.কে. শুরু করলেন “মহামান্য জজ্সাহেব, একজন অন্ধ মেয়ের বয়ান অনুযায়ী তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং সেই ধর্ষণ করেছে আমার মক্কেল রীতিন আগরওয়াল। পুলিশ সেই অন্ধ মেয়েটির কথার ওপর ভিত্তি করেই আমার মক্কেলকে গ্রেপ্তার করে একেবারে কাষ্টডিতে নিয়ে নিল। এটা যে একেবারেই ঠিক হয় নি তা প্রমাণের জন্য আমি প্রথমেই তদন্তকারী অফিসারকে একবার কাঠগড়ায় ডাকতে চাই এবং তার বয়ানটি নিজ কানে শুনতে চাই”।
অমলিন বসু কাঠগড়ায় এসে সমস্ত ঘটনাটি আরো একবার বর্ণণা করলেন।
এবার কে.কে. উঠলেন তাকে জেরা করতে।
– আচ্ছা আপনার বয়ান অনুযায়ী আপনি অন্ধ মেয়েটির গড়া মূর্তি দেখেই আমার মক্কেলকে দোষী বলে ধরে নিলেন ও তাকে গ্রেপ্তার করলেন। তাই তো?
– হ্যাঁ…
– আচ্ছা! এমনও তো হতে পারে মেয়েটি নয়, তার বাবাই মূর্তিটি গড়ে দিয়েছে, কারণ তার বাবাও তো একজন কারিগর। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে মূর্তিটি ওই মেয়েটিই গড়েছে তাহলেই বা কি প্রমাণ হয়? হয়ত মেয়েটি একটি মূর্তি গড়েছে যার সঙ্গে আমার মক্কেলের চেহারা মিলে গেছে তার মানে কি আমার মক্কেলই তাকে ধর্ষণ করেছে? যদি তা না হয়ে আমার আপনার কারো সঙ্গে মুর্তির মিল হতো, তাহলে কি আমাদেরই ধর্ষক বলে ধরা হতো! আচ্ছা সনাক্তকরণ প্যারেডে কি মেয়েটি আমার মক্কেলকে সনাক্ত করেছিল?
– হ্যাঁ, করেছিলো।
– বুঝলাম, তা ছেলেটিকে আপনি কোথা থেকে গ্রেপ্তার করলেন? তার বাড়ি থেকে না অন্য কোথাও থেকে?
– না। এয়ারপোর্ট থেকে। সে তখন মুম্বাই যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।
– আপনি জানলেন কিভাবে, সে তখন এয়ারপোর্টে থাকবে?
– ও যে বন্ধুর ঠিকানা খোঁজ করছিলো সেই অজয়ের কাছ থেকেই জেনেছিলাম।
– আচ্ছা, গ্রেপ্তারের সময় সে কি প্রতিবাদ করেছিলো?
– হ্যাঁ করেছিলো। বলেছিলো, যেদিন, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেদিন সেই সময়ে সে বন্ধুদের সঙ্গে দীঘার এক রিসর্টে পার্টি করছিলো।
– আপনি কি তার কথার সত্যতা যাচাই করেছিলেন?
– না। সে সুযোগ হয়নি।
– বাঃ, বেশ কথা! মেয়েটি অন্ধ হয়েও নাকি আমার মক্কেলের একটা মূর্তি গড়েছে, মেয়েটিই যে গড়েছে তার অবশ্য কোনো প্রমাণ নেই। আর পুলিশ তার থেকেই ধরে নিল আমার মক্কেলেই দোষী। তাই মহামান্য আদালতের কাছে আমার আবেদন, শিক্ষিত অভিজাত পরিবারের এই ছেলেটিকে এখনই জামিন দেওয়া হোক, যতক্ষণ না তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে তার গ্রেপ্তারী আইন বিরুদ্ধ। ওনাকে আমার আর কিছুই জিজ্ঞাস্য নেই।
অমলিন বসু নেমে এলেন।
এবার সাক্ষ্য দিতে উঠল সুহাসী। কাঠগড়ায় উঠে সে তার পরিচয় দিয়ে তার বক্তব্য শুরু করলো।
সুহাসীর বলা শেষ হলে কে.কে. তার প্রশ্ন শুরু করলেন,
– আচ্ছা তোমার কথা অনুযায়ী ঘটনার দিন ব্যাঙ্ক থেকে ফিরে, তুমিই প্রথমে অনুপমাকে দেখেছিলে। তাই তো?
– হ্যাঁ…
– এবার বলো, এসে তুমি কি দেখেছিলে?
সুহাসী তার বলা আগের কথাগুলোই আবার একবার বলে গেলো।
– বেশ এবার বলো, তুমি কতদিন ধরে অনুপমাকে চেনো?
– তা বলা যায় প্রায় প্রথম থেকে। দাদাবাবু যেদিন অনুপমা আর বৌদিকে নিয়ে এলেন সেদিন থেকেই তো আমি অনুদিদির সব দায়িত্ব হাতে তুলে নিলাম।
– মানে তুমি বলতে চাইছ, অনুপমার জন্ম থেকেই তুমি তাকে চেনো।
– না না, তা কি করে হবে অনুদিদি তো দাদার মেয়ে নয়। রুমা বৌদির মেয়ে। শুনেছি দাদার স্ত্রী ছেলে নিয়ে দাদাকে ছেড়ে চলে গেছে। তারপর উনি রুমাবৌদিকে বিয়ে করেছেন।
– তার মানে অনুপমা তোমার দাদার নিজের মেয়ে নয়, সৎ মেয়ে। তাই তো? – সুহাসী চুপ।
– আচ্ছা, এবার বল ঐ যে ছেলেটি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে, ওকে কি তুমি চেনো বা আগে কখনো দেখেছো?
– চিনি মানে, ঘটনার আগের দিন সকালে আমি যখন বাগানে দাদাবাবুদের জলখাবার দিচ্ছিলাম, সে সময় ছেলেটি এসে, দাদাকে কি যেন জিজ্ঞেস করছিলো।
– ঘটনার দিন সকালে তুমি কি ছেলেটিকে তোমাদের বাড়িতে ঢুকতে বা বের হতে দেখেছিলে?
– আমি কি করে দেখব? আমি তো তখন ব্যাঙ্কে গেছিলাম।
– তাহলে তুমি কি করে জানলে ঐ ছেলেটিই দোষী?
– কেন? অনুদিদি যে মূর্তিটা গড়েছে, সেটা তো ঐ ছেলেটারই…
– মূর্তিটা যে অনুদিদিই গড়েছে তার কোনো প্রমাণ আছে কি? ওর বাবাও তো গড়ে দিতে পারে।
– বাবা কি করে জানবে? বাবা তো তখন ছিলোই না। বাবাতো মূর্তিটা দেখে ছেলেটাকে চিনতে পেরেছে।
– বেশ। এবার তুমি যেতে পারো।
পরের সাক্ষী পাশের বাড়ীর কাকিমা, যিনি ঘটনার পর অনুর কাছে কিছুক্ষণ বসেছিলেন।
কে.কে. জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি যখন অনুপমার পাশের বাড়ীতেই থাকেন, আপনি নিশ্চয় কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ছেলেটিকে ওদের বাড়িতে ঢুকতে বা বেরতে দেখেছেন!”
– আমি কি করে দেখবো? অনুপমাদের বাড়ীর লাগোয়া বাগান রয়েছে। তারপরে আমাদের বাড়ী। আমার পক্ষে কি ওদের বাড়ীতে কে আসছে বা যাচ্ছে দেখা সম্ভব?
– বুঝলাম। তার মানে আপনি দেখেননি? তাই তো?
– হ্যাঁ-
– বেশ। আপনি এবার নেমে আসুন।
এবার ডাক পড়লো রীতিনের সেই বন্ধু অজয়ের, যার বাড়ীর খোঁজ করেছিলো ছেলেটি।
– কতদিন ধরে তুমি রীতিনকে চেনো?
– আজ্ঞে, সেই স্কুল জীবন থেকে। তখন আমরা একই পাড়ায় থাকতাম। ও থাকতো ওদের নিজেদের বিশাল বাড়ীতে, আমি থাকতাম কাছেই এক ভাড়া বাড়ীতে। কি করে যেন আমাদের দুজনের বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। তারপর আমরা সেখান থেকে চলে এসে এখানে থাকতে শুরু করি আর ও চলে যায় মুম্বাইতে, যদিও ওদের কলকাতার বাড়ীটা রয়েই যায়, আর ফোনেই আমাদের যোগাযোগটাও রয়ে যায়। এবার ও কলকাতায় এসেছিল আমাকে ওর বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে।
– তুমি কি নিশ্চিত যে তোমাকে নিমন্ত্রণ করেই ও ফিরে গিয়েছিলো ওর নিজের বাড়ীতে?
– দেখুন সেটা আমি কি করে বলবো? তবে আমাকে বলেছিলো, দু’ দিন পরে ও কলকাতা থেকে মুম্বাই ফিরে যাবে।
– বেশ, আপনি এবার নেমে আসুন।
জজসাহেব এবার পি পির দিকে ফিরলেন, “আচ্ছা আপনার কাছে কি মেয়েটিকে ধর্ষণের কোনো প্রমাণ, ডাক্তারী সার্টীফিকেট বা এমন কিছু আছে, বা, ফরেনসিক পরীক্ষার কোনো রিপোর্ট যাতে বোঝা যায় যে মেয়েটি ধর্ষিতা হয়েছে? আপনি এখনই সেগুলো কোর্টে সাব্মিট করুন”।
– আছে তো! দাঁড়ান দেখছি।
সামনে রাখা কাগজপত্রগুলো একবার উলটে পালটে দেখে নিয়ে পি. পি. বললেন “ডাক্তারী সার্টিফিকেট তো এখানেই ছিলো। কিন্তু কোথায় যে গেলো, এখন খুঁজে পাচ্ছি না।”
– ঠিক আছে, আপনি বরং পরের ডেটে কাগজগুলো নিয়ে আসুন। ততদিন পর্যন্ত আমি এই ছেলেটির বেল মঞ্জুর করলাম”।