গোপা মিত্র
অন্ধ বিচার
রহস্য ধারাবাহিক (পর্ব-১)
হাতের কলমটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে থানা অফিসার অমলিন বসু সামনে উপবিষ্ট বেদবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার সব অভিযোগই আমি নথীবদ্ধ করে নিলাম। এবার চলুন, অকুস্থলটা একবার দেখা দরকার। সেখানে, যার ওপর এই অত্যাচার ঘটেছে, তার জবানবন্দীটাও নিতে হবে। চলুন সুবোধবাবু, আপনিও আমার সঙ্গে চলুন।”, বলে উঠে দাঁড়ালেন অমলিন বসু।
থানা অফিসার অমলিন বসুর খ্যাতি আছে সৎ অফিসার বলে। তার হাতে কোনো কেস্ এলে তিনি তার সঠিক তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি পাইয়ে দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। সেখানে কোনো রকম হুমকি বা ঘুষের সঙ্গে তিনি কখনো সমঝোতা করেন না। বেদবাবুর সৌভাগ্য তার অভিযোগটা এই থানার অধীনে জমা পড়েছে। সাব ইন্সপেক্টার সুবোধ রায় তার সব তদন্তেরই সঙ্গী থাকে।
থানার সামনে পুলিশের গাড়ী দাঁড়িয়ে। সঙ্গে একজন মহিলা ইন্সপেক্টার নিয়ে চারজনে সেই গাড়ীতে উঠে বসলেন।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই তারা পৌঁছে গেলেন বেদবাবুর বাড়ী ‘ব্যানার্জী ভিলায়’। দোতলা বাড়ী। গেটের তালা খোলা। গেট পেরিয়ে সামনে একটা বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে বাড়ির মূল দরজায়। রাস্তার দুদিকে বাগান। বাঁদিকের বাগানে মালী তখন ফুল গাছগুলোর পরিচর্যায় ব্যস্ত। ডানদিকের বাগানে, একটা টেবিল ঘিরে চারটে চেয়ার পাতা। কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে সকলকে সঙ্গে নিয়ে বেদবাবু মূল দরজায় এসে কলিং বেল বাজালেন।
কাঠের ভারী দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়ালেন একজন মধ্যবয়সী মহিলা। সোফাসেটি দিয়ে বেশ সাজানো গোছানো বসার ঘর। বেদবাবু তাকে বললেন, ভিতর থেকে রুমাকে ডেকে দিতে, সঙ্গে যেন অনুকেও নিয়ে আসে।
একটু পরেই তার সঙ্গে এসে দাঁড়ালেন দুজন মহিলা – একজন মধ্যবয়সী, অন্যজনের বয়স হয়ত হবে সতেরো-আঠারো, লম্বা, ফর্সা এবং অতি অবশ্যই সুন্দরী। বেদবাবু মধ্যবয়সী মহিলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, “ইনি আমার স্ত্রী রুমা আর ওর সঙ্গে আমার মেয়ে অনু – ভালো নাম অনুপমা, আর পিছনে যে দাঁড়িয়ে আছে – আমাদের দরজা খুলে দিল, ও হচ্ছে সুহাসী, অনেকদিন আমাদের সঙ্গে আছে, অনুকে খুব ভালোবাসে।”
এবার তিনি তার মেয়ের দিকে ফিরে বললেন, “অনু মা, দেখো কারা আমার সঙ্গে এসেছেন – ইনি থানা অফিসার অমলিন বসু, সঙ্গে সাব ইন্সপেক্টার সুবোধ বাবু আর উনি মহিলা ইন্সপেক্টার মল্লিকা দেবী। তোমার সঙ্গে গতকাল যে ঘটনাটা ঘটেছে, সেটা ওনারা তোমার মুখ থেকে বিশদে শুনতে চান। তোমার কথা শোনার পরই ওনারা তদন্ত শুরু করবেন। তুমি জেনো, তুমি যা বলবে, সেটা ওনারা তোমার জবানবন্দী হিসেবে নেবেন। কাজেই সবকিছু খুঁটিয়ে বলবে, কোনো কিছুই বাদ দিও না।”
সবাইকে হাতজোড় করে নমস্কার করে অনু তাদের সামনের সোফায় বসল। তার প্রণামের ধরণ দেখে থানা অফিসার বেদবাবুকে নিচুগলায় জিজ্ঞেস করলেন “আচ্ছা, আপনার মেয়ে কি অন্ধ, চোখে দেখতে পায় না?”
বেদবাবু ম্লান হেসে উত্তর দিলেন, “ঠিকই ধরেছেন, ও চোখে দেখতে পায় না।”
“যদি তাই হয়, তাহলে ওর ওপরে যে অত্যাচার করেছে, যার বিরুদ্ধে আপনি অভিযোগ করেছেন, তাকে সে চিনলো কি করে?”
বেদবাবু একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে লাগলেন, “জন্ম থেকেই অনু এমন ছিল না। ওর বয়স যখন, বছর পনেরো, ক্লাস নাইনের ছাত্রী, সে সময় একবার ও প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে, High Fever, মাথার যন্ত্রণা- অনেক চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে উঠলো ঠিকই, তবে চোখের দৃষ্টিটা চলে গেলো। ভগবান ওর দৃষ্টি কেড়ে নিলেন ঠিকই, তবে ওর অনুভব শক্তিটা খুব বাড়িয়ে দিলেন। আপনাকে তো আমি আগেই বলেছি যে আমার একটা কিউরিও শপ্ আছে, যেখানে দেশ বিদেশের নানারকম শ্যো পীস্ ছাড়াও শুধু আমার নয়, আমার মেয়ের হাতে গড়া নানারকম মূর্তিও বিক্রী হয়। খুব ছোটবেলা থেকেই আমি আমার মেয়েকে হাতে ধরে মূর্তি গড়া শিখিয়েছিলাম। আমার মেয়ে এখন অন্ধ হলেও যেকোনো কিছু অনুভব করেই মাটি দিয়ে তেমন জিনিষ গড়ে দিতে পারে। আপনি ভাবছেন তো সেই অত্যাচারী ছেলেটিকে আমি চিনলাম কি করে, ঐ দেখুন আমার মেয়ে কি সুন্দর করে তার মুখাবয়ব গড়ে রেখেছে”। একথা বলে টেবিলে রাখা একটা মূর্তির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন।
অমলিন বসু সেদিকে চেয়ে দেখলেন, সত্যিই সেখানে একজন অল্পবয়স্ক পুরুষের মুখাবয়বের মূর্তি রয়েছে। তিনি আর কিছু না বলে এবার অনুপমার দিকে চেয়ে বললেন যে, “এবার বলুন যে, কাল আপনার সঙ্গে ঠিক কি ঘটেছিল। সব কথাই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলবেন। কোনো কিছুই বাদ দেবেন না।”
আগ্রহ টা অনেক বেড়ে গেল। অপেক্ষায় রইলাম আগামী পর্বের জন্য।
ধৈর্য্য ধরে লেখাটা পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ ।