Home সামাজিক, গল্প নিয়তির খেলা
সামাজিকগল্প

নিয়তির খেলা

তপতী রায়

 

অনিলবাবু একটা প্রাইভেট অফিসে কেরানীর চাকরী করেন। রোজগার সামান্যই, তবে তার মধ্যেও কোনোমতে মাথা গোঁজার জন্যে একটা তিনি জায়গা করেছেন; এই ভাগ্যি। স্ত্রী অনিতা ও দুই মেয়ে রীনা আর তিন্নিকে নিয়ে তাঁর সংসার।

রীনার বয়স একুশ আর তিন্নির ষোলো। রীনা কলেজে পড়ে আর তিন্নি স্কুলের পরীক্ষা দিয়েছে। দুবোনের মধ্যে তিন্নিকেই বেশী সুন্দর দেখতে। পড়াশোনাতেও সে খুব ভালো।

এই ভাবেই বেশ সুখেই দিন কাটছিলো। হঠাৎ একদিন সব বদলে গেলো, অনিলবাবু হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। অনিতা চোখে অন্ধকার দেখলেন। তবে ভাগ্যদেবী খুব বেশী নির্দয় হলেন না। রীনা চেষ্টা চরিত্র করে বাবার জায়গায় কাজ পেলো।

কোনোও মতে দিন দিন কেটে যাচ্ছিলো, এমন সময়ে রীনা-তিন্নির মামা রীনার জন্যে একটা পাত্রের সন্ধান নিয়ে এলেন। কিন্তু তার বিয়ে হয়ে গেলে সংসারটা কে দেখবে, এই ভেবে রীনা, তিন্নির সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দিলো। বিয়ের পর তিন্নি বেশ সুখেই ছিলো, যথাসময়ে সে সন্তান সম্ভবা হলো, কিন্তু প্রসবের সময়ে বাচ্চার মৃত্যু হওয়াতে তিন্নি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। ফলে তিন্নির স্বামী তিন্নিকে বাপের বাড়িতে ফেলে দিয়ে গেলো।

বৃদ্ধা মা আর মানসিকভাবে অসুস্থ বোনকে নিয়ে রীনা হিমশিম খেতে লাগলো। সামান্য রোজগার তার। মা-বোনের ডাক্তার, ওষুধ, চিকিৎসার খরচ – কিভাবে চালাবে সে! চিন্তায় চিন্তায় পাগল হওয়ার যোগাড় হলো তার। তারও তো বিয়ে-থা করে তারও তো সংসার পাততে ইচ্ছে করে। ভীষণই মুষড়ে পড়লো সে।

তখন তার মা, মামা আর অন্যরা মিলে যুক্তি করলেন যে রীনার জন্যে এমন পাত্রের খোঁজ করা হোক যে এই বাড়িতেই থাকতে পারে। পাত্র পাওয়াও গেলো; সমীরণ – একটি সামান্য চাকরী করে। আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়। তবু রীনা সব ভাবনা ত্যাগ করে সমীরণের গলাতেই মালা দিয়ে তাকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে এলো।

সমীরণের সঙ্গে রীনার দিন ভালোই কাটছিলো। কিন্তু রীনার বিয়ের পর থেকেই তিন্নি ক্রমশঃ বিক্ষিপ্ত হতে লাগলো। ওদের দুজনকে একসাথে দেখলেই, কেন জানি না, সে চিৎকার করে ওঠে, কখনোও বা জিনিস পত্র ছুঁড়ে ফেলে। শেষে তাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হলো, ধীরে ধীরে সে ঠিক হতেও শুরু করলো, কিন্তু তবু সে মাঝে মধ্যে উগ্র হয়ে ওঠে।

ইতিমধ্যে একদিন তাদের মাও মারা যান। রীনা তিন্নিকে প্রাণ দিয়ে আগলে রাখে। কিন্তু একদিন তার অনুপস্থিতিতে তিন্নি প্রচণ্ড উগ্র হয়ে ওঠে। সমীরণ তখন বাড়িতে ছিলো, সে তিন্নিকে খুব আদর করে সামলে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু মানসিক ভারসাম্যহীন তিন্নি সমীরণকে আবেগে আবেশে চেপে ধরে, আর সমীরণও নিজের সব অস্তিত্বকে ভুলে তিন্নির সঙ্গে সোহাগের সব গণ্ডী অতিক্রম করে ফেলে। পরে সে আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকে।

ঠিক এই সময়ে তিন্নি অন্তঃস্বত্ত্বা হয়ে পড়ে।

রীনা পাগলের মতো কাঁদতে থাকে। সে বুঝতে পারে যে, তিন্নির এই সর্বনাশের জন্যে সমীরণই দায়ী। সে অসহায়ের মতো সমীরণের দিকে তাকায়। সমীরণ কোনোও কথা বলতে পারে না। চুপ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কিছুদিন পড়ে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। কিন্তু কথা কি চাপা থাকে? আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। ফলে তিন্নিকে নিয়ে রীনা, এই বাড়ি, পাড়া, চাকরী … সব ছেড়ে এক নতুন জায়গায় এসে ওঠে। যেখানে তাদের কেউ চেনে না।

নতুন জায়গায় এসে রীনা পাগলের মতো চাকরী খুঁজতে থাকে, কিন্তু ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই সে পায় না। একদিন বাস-স্টপে দাঁড়িয়ে সে বাসের জন্যে অপেক্ষা করছিলো এমন সময়ে একটা গাড়ী এসে দাঁড়ালো তার সামনে। মুখ বাড়িয়ে একজন জিজ্ঞাসা করলো, “যাবেন আমার সাথে?”

ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত রীনা যন্ত্র চালিতের মতো গাড়িতে উঠে বসলো, এইভাবে তার নতুন যাত্রাপথ শুরু হলো। অনেক টাকা এলো, বড় বাড়ি আর গাড়ি হলো।

তিন্নিকে আবার বড় বড় ডাক্তার দেখানো হলো। সে ক্রমশঃ সুস্থ হয়ে উঠলো। তিন্নি আবার কলেজে ভর্তি হলো। সে ডাক্তারি পাস্‌ করলো।

নিজের জীবন থেকে সে অনেক শিক্ষা পেয়েছে। তাই এই লাইনে এসেছে, মানুষের মনকে জানতে ও বুঝতে। তার বাচ্চা এখন বেশ বড় হয়ে গেছে।

রীনা এখন আর তিন্নির সাথে থাকে না। দু বোন আলাদা থাকে। তিন্নি একদিন হাসপাতালে রুগী দেখতে গেছে, সেখানে নার্স তাকে বললো যে, একজন রুগী শুধু বাচ্চার কথা জানতে চায়। কখনোও কখনোও ভীষণ উগ্র হয়ে পড়ে। সে রুগীর নাম-ঠিকানা জানতে চাইলো। ডাক্তার নার্সেরা কেউই তার নাম-ধাম কিছুই বলতে পারলো না। তারা শুধু জানালো, দশ বছর আগে তারা তাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এসেছে। চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে আর জিনিস ছুঁড়ে ফেলে। তিন্নির তখন তার নিজের কথা মনে পড়ে গেলো। সে স্থির করলো এই রুগীর দায়িত্ব সে নিজে নেবে।

তাদের কাছে শুধু একটা বাড়ির নাম রয়েছে। অনিতা কুটির। তিন্নি চমকে উঠলো। এ তো তাদের বাড়ির নাম ছিলো। দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে রুগীর কাছে গিয়েই সে চমকে উঠলো – সমীরণদা! তার স্মৃতিপটে অনেক কিছু ভেসে উঠলো। যতোই হোক সমীরণই তো তার সন্তানের বাবা। সে সমীরণকে নিজের বাড়ী নিয়ে এলো। মন-প্রাণ দিয়ে তার চিকিৎসা ও সেবা-যত্ন করে কিছুদিনের মধ্যেই তাকে সুস্থ করে তুললো। তারপর থেকে তারা সুখে ঘর করতে লাগলো।

আর রীনা – সে যে অন্ধকার জগতের কোন্‌ গলিতে হারিয়ে গেলো তা কেউ জানতে পারলো না। একেই বলে নিয়তির খেলা। 

লেখিকা পরিচিতি

তপতী রায়

 

জন্ম ও পড়াশুনা অধুনা ঝাড়খণ্ডে। বিবাহসূত্রে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরেছি। উপস্থিত রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরে গত পঁচিশ বছর ধরে বাস করছি। জয়পুরের প্রচুর বাঙালী আছেন এবং তাঁদের মধ্যে সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা যথেষ্টই আছে। আজ আমি গর্বিত বাঙালী বলে ও জয়পুরের বাসিন্দা বলে।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

Leave a Reply to Jayashree bose Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!