প্রবন্ধসাহিত্য ও সংস্কৃতি

কিছুক্ষণ

সুদেষ্ণা মিত্র

রবিবারের সকাল। ভবানীপুরের পূর্ণ সিনেমা হলের ক্রসিং পেরিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের দিকে। আমি ও রোশনী, ননদ-ভাজে চলেছি পরিচিত মহলের প্রিয় মানুষ ‘লালাবাবু’ ওরফে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক বুদ্ধদেব গুহর সঙ্গে দেখা করতে। পেশায় চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট আর নেশায় অরণ্যপ্রেমিক ভ্রমণপিপাসু মানুষটি তাঁর পেশার সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন আর প্রকৃতির রূপ রস গন্ধে বিলীন হয়ে আবিষ্কার করেছেন অজানাকে। তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে রয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের ঘটে যাওয়া নানা ঘটনায়, তাদের দৈনন্দিন জীবনের রোজনামচায়। তাই তাঁর গল্প উপন্যাসে নরনারীর প্রেম, জীবনবোধ, ইন্দ্রিয়গত মানবিক টানাপোড়েন, প্রকৃতির বৈচিত্রের মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

গাড়ি চলছে তার নিজস্ব গতিতে। ভবানীপুর থেকে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের দূরত্ব এমন কিছুই নয়। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে কয়েকশো মাইলের ফারাক। এমন নয় যে, জীবনে কখনোও কোনোও বড় মাপের সাহিত্যিকের সান্নিধ্যে আসিনি। কিন্তু কখনোও এমনভাবে নিজের ‘হার্টবিট’ অনুভব করিনি। গাড়ি এসে দাঁড়ালো বালিগঞ্জ ফাঁড়ির স্টপেজে। ড্রাইভারবাবু আর রোশনীর কথাবার্তা কানে এলো। কোন রাস্তা বোঝাচ্ছে। আমার মন হারিয়ে গেলো পুরনো স্মৃতির বেড়াজালে। আমার জন্মদিনে বাবা উপহার দেন ‘ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে’। পশুপাখি, জঙ্গলের সৌন্দর্য্য এবং তাকে ঘিরে থাকা মানুষদের বিচিত্র ও বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনযাপনের কাহিনীর মধ্যে দিয়ে আমার লেখকের সৃষ্টির সাথে প্রথম পরিচয়। বয়সের সাথে সাথে অন্যান্য অনেক বইয়ের পাশাপাশি কখন যে বুদ্ধদেব গুহর বই ও তাঁর লেখার ওপর টান জন্মে গেছে তা বোধহয় ভেবেও দেখিনি। আজ মনে হয় তৎকালীন সাহিত্যিকদের রচনার মধ্যে থেকে বিষয় ও চরিত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব গুহর বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যের যে মেলবন্ধন ঘটতো, তার মধ্যেই বোধহয় আমি আমার সাহিত্যের প্রতি মনের টানকে অনুভব করতাম। বন-জঙ্গল, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত, গাছ-গাছালি, ফুল-লতাপাতা কোনোও প্রেমের উপন্যাসের পটভূমি হতে পারে, আর নায়ক নায়িকা এবং বিভিন্ন চরিত্র প্রকৃতিরই অংশবিশেষ হয়ে উঠতে পারে রোম্যান্টিক উপন্যাসের, তা ওনার লেখার ভক্ত হিসেবে আজও আমাকে মুগ্ধ করে রাখে।

“ব্যাস্‌, আর পাঁচ মিনিট” – রোশনী বলে উঠলো। “দিদিভাই, কি নিয়ে কথা শুরু করবে, সেটা গুছিয়ে নিয়েছো তো?” উত্তরে শুধুই হাসলাম।

গতকাল আমার মামাশ্বশুরবাড়ি থেকে ওনার ফোন নম্বর জোগাড় করে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়ের নাম বলে ফোন করার সময়ে আমার গলার স্বর নিজের কানেই অস্বাভাবিক লেগেছিল। অথচ কিছুক্ষণ কথা বলার পর যখন আজকের দেখা করার কথা বললাম, উনি নিজেই সময়ে দিলেন। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে অসুবিধে হয়েছিল। এই চব্বিশ ঘন্টা একবারের জন্যেও ভেবে উঠতে পারিনি কিভাবে কথা শুরু করবো অসম্ভব গভীর ও ব্যক্তিত্ববান এই লেখকের সঙ্গে। শুধুমাত্র এটা জানি যে, ওনার কাছে “পাঠক পাঠিকারাই লেখকের জীয়নকাঠি – আবার মরণকাঠিও”। তিনি মনে করেন “মনোযোগী পাঠক পাঠিকাদের প্রশংসা এবং নিন্দাই আসল। তারাই লেখকের প্রকৃত বিচারক।” তাঁর নিজের লেখা এই কথাগুলোর ওপরে ভিত্তি করেই আজ আমাদের এখানে আসা।

এসে পৌঁছলাম গন্তব্যস্থলে। বহু পুরনো অথচ সুদৃশ্য এই ফ্ল্যাটবাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টের বিশাল খোলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে মনে হলো, সত্যিই আসতে পেরেছি তাহলে। সিকিউরিটি গার্ডকে বলাই ছিল। রেজিস্টারে সই করে পৌঁছে গেলাম ওনার ফ্ল্যাটের দরজায়। দরজা খুললো কাজের মেয়ে, মিষ্টি হেসে সে আমাদের অভ্যর্থণা জানিয়ে বললো ভেতরে যেতে; লেখক অপেক্ষা করছেন। সুদৃশ্য ফ্ল্যাটের সুবিশাল হলের মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে চারপাশে নজর করলাম। হ্যাঁ! এমনটাই হওয়া উচিত বুদ্ধদেব গুহ ও তাঁর স্ত্রী স্বনামধন্যা ঋতু গুহর বাসস্থান। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার রুচিপূর্ণ সহাবস্থান। কোথাও কোনোও অতিরঞ্জন নেই। দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই সৌম্যদর্শন, ঋষিসুলভ চেহারার মানুষটি গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, “এসো এসো, বসো।” আমাদের পরিচয় দিতেই জিজ্ঞেস করল্লেন, দিল্লীর কোন অঞ্চলে থাকি আমি। দিল্লী সংক্রান্ত অনেক রকম আলাপ আলোচনা; পরিচিত কিছু আত্মীয়স্বজনের গল্পগুজবের মধ্যে দিয়ে বুঝতে পারছিলাম লেখকের সহজ ও স্বাভাবিক ব্যবহারে আমরা আমাদের জড়তা কাটিয়ে উঠছি। বহুবছরের জমে থাকা প্রিয় লেখককে কাছ থেকে চেনার ছেলেমানুষি মাখা উত্তেজনা আস্তে আস্তে আয়ত্তে আসছে। জিজ্ঞেস করলেন, “এবার বলো, কেন এসেছো আমার কাছে?” বললাম যে, অনেক ছোট থেকে আপনার লেখা পড়েছি। বেশ কিছু লেখা খুবই ভালো লেগেছে। এমন কিছু লেখা আছে যা মেনে নিতে পারিনি। শুধুমাত্র গল্প করবার আর গল্প শোনবার ইচ্ছে নিয়ে আমাদের এখানে আসা। বললেন, “বলো, কি জানতে চাও?” রোশনী ওনার লেখা ছোটগল্পগুলির সংকলন ‘মুহূর্তকাল’-এর কিছু গল্প নিয়ে আলোচনা শুরু করলো। এই বইয়ের ভূমিকায় লেখক লিখেছেন যে, ছোট গল্প লেখা উপন্যাস লেখার চেয়েও কঠিন। তিনি মনে করেন যে, সাহিত্য হলো মনের কোণে চাপা পড়ে থাকা নানা অনুভূতি ও ঘটনার প্রকাশ, যা একজন সংবেদনশীল লেখক তার সাহিত্যে তুলে ধরতে পারেন। আমাদের জানালেন যে, জীবনে এতো লোকের সংস্পর্শে এসেছেন, এতো বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন – তার কিছুই বোধহয় লেখা হয়ে ওঠেনি। আমি যখন বললাম যে, ওনার ছোটগল্পের নাম ও বিষয় নির্বাচন আমার বেশ নতুনত্ব লাগে। কুচিলাখাঁই, জগন্নাথ, সাইকেল, বাবা মা, আমি ও পরমা, সত্‌নারায়ণের সিন্নি ও আরো অসংখ্য ছোটগল্পের ক্ষেত্রে আমি লক্ষ্য করেছি যে, অনেক সময় বিষয় বুঝতে অসুবিধে হয়নি নাম পড়ে, আবার অনেক সময় নাম দেখে বিষয় আন্দাজ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বললেন যে, নানা অভিজ্ঞতা ও কল্পনা মিশিয়ে তাঁর লেখা। প্রত্যেক লেখকই, তাঁর দেখার চোখ ও অনুভূতির রং বয়সের সাথে সাথে যে পরিণতি ঘটে তার ওপর ভিত্তি করে তার লেখার ধরণ বদলায়। তার ক্ষেত্রে সেই বদল তিনি মনে করেন ছোটগল্পে বেশী লক্ষিত হয়েছে উপন্যাসের থেকে। উনি নিজে মনে করেন যে, শুরুর দীকে ওনার লেখা বেশী রোম্যান্টিক বা নরনারীর প্রেম ভালোবাসার ওপর লেখা হয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে তা বদলে যেতে থাকে ব্যক্তিগত জীবনবোধ বা সামাজিক দায়বদ্ধতাতে। এই প্রসঙ্গে বলবো; ওনার ‘পঞ্চাশটি প্রিয় গল্প’-র গল্পগুলি বৃদ্ধাবস্থায় সন্তানসন্ততির সাথে বাবা মায়ের সম্পর্ক, পরিবেশ ও সামাজিক রীতিনীতির ওপর অসম্ভব সংবেদনশীল ও মরমী দৃষ্টিভঙ্গীর ভিত্তিতে রচিত।

ইতিমধ্যে সুন্দর একটি ট্রেতে করে রাবড়ি, মিষ্টি, কুচো নিমকি নিতে কাজের মেয়েটি রেখে গেলো। বললেন, “আগে খেয়ে নাও।” ওনার কমবেশী সব লেখাতেই নানারকম খাওয়ার কথা থাকে।  সে ফরেস্ট বাংলোর কেয়ারটেকার বা বাবুর্চির রান্না করা ডাল আলু চোখাই হোক আর শহুরে সাহেব-সুবোদের পোলাও কোর্মাই হোক; ওনার লেখার ধরনে বোঝা যায় যে, খুবই খাদ্যরসিক এবং আপ্যায়ন প্রিয় মানুষ তিনি। সেই প্রসং তুলতে জানালেন যে, তিনি নানারকম খাবার খেতে পছন্দ করেন এবং অবশ্যই ভালো রান্না। এখন বয়সের সাথে সাথে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। না হলে বাড়িতে সবাই চিন্তা করবে। তারপরেই বললেন, “খাবার ফেলে রাখতে নেই। কথা তো হতেই থাকবে। আমার খুব প্রিয় দোকানের রাবড়ি, খেয়ে নাও।”

‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘সবিনয় নিবেদন’, ‘কোয়েলের কাছে’ এই তিনটি উপন্যাস নিয়ে নানারকম আলোচনা হলো। ম্যাকলাস্কিগঞ্জ, যা এখন ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত তাকে একসময়ে বলা হতো ‘Mini England’, সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ও সহজ সরল মানুষগুলোর মাঝে উপন্যাসের নায়ক সুকুমার ও নায়িকা ছুটি খুঁজে পায় উষ্ণতার আশ্বাস। যতবারই বইটি পড়েছি, মনে হয়েছে চরিত্রগুলো সবটাই কাল্পনিক নয়। বুদ্ধদেব গুহর বর্ণনায় ম্যাকলাস্কিগঞ্জ এতো সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে যা আমরা যারা যাইনি, তারাও ছুটে যেতে চাইবো। উনি নিজেই বললেন, বেশ কিছু চরিত্র বাস্তব। আবার কয়েকটি চরিত্র বাস্তবের সাথে, তাঁর কল্পনার চোখ দিয়ে তৈরী।

ছোট্ট স্টেশন, টালির ছাদের বাংলো, পিটিস ঝোপ নানারকম জংলী ফুল, জঙ্গল আর ছোট ছোট চড়াই উৎরাইয়ে ভরা এই জায়গাটি লেখকের বড়ই প্রিয়। একসময়ে প্রায়ই যাতায়াত করতেন এবং আজও অনেক পরিচিত মানুষের সাথে যোগাযোগ আছে তাঁর। মনে পড়লো ওনারই লেখা কয়েকটি লাইন। “ম্যাকলাস্কিগঞ্জের প্রতিটি সকাল আমার জন্যে কি এক আনন্দের পসরা সাজিয়ে আনে। প্রতিদিন এই ভোরের আলোয় দাঁড়িয়ে পূবের ও পশ্চিমের পাহাড়ের রোঁয়া রোঁয়া সবুজের দিকে তাকিয়ে বারে বারে নিজেকে ভুলে যাই।”

ম্যাকলাস্কিগঞ্জ আমার খুব যেতে ইচ্ছে করে শুনে বললেন, “যাও, ঘুরে এসো। বড়ই ভালো জায়গা। আজও ওখানে মানুষজন সহজ সরল; পরিবেশ খুব সুন্দর।” ‘সবিনয় নিবেদন’ ওনার চিঠির আকারে লেখা একটি উপন্যাস। আমার আর রোশনীর খুবই প্রিয়। রোশনী এই উপন্যাস পড়ে ভাইঝির নাম রেখেছিলো ‘ঋতি’। হেসে বললেন, “আসলে চিঠি লেখা আমার কাছে এক শিল্প।” ওনার লেখার পাঠক পাঠিকা মাত্রেই জানেন যে, ওনার কন বেশী সব গল্প উপন্যাসে চিঠির একটা বড় ভূমিকা থাকে। উনি বললেন যে, প্রযুক্তির এতো উন্নতি ও আধুনিকতা সত্ত্বেও আজও চিঠির গুরুত্ব শেষ হয়ে যাউনি। নিজেও সুন্দর চিঠি লেখেন এবং পাঠক পাঠিকাদের চিঠির জবাব নিজেই দিয়ে থাকেন। ‘কোয়েলের কাছে’-র কথাপ্রসঙ্গে বললেন তৎকালীন বম্বের সুপারস্টার এই উপন্যাসটির নায়ক হতে চেয়েছিলেন; চলচ্চিত্র হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক দূর অবধি এগিয়েও কোনো কারণে আর হয়ে ওঠেনি। একটু সংকোচের সাথে বলেই ফেললাম যে, “সিনেমা এবং বই, এই দুটো সব সময়ে একে অপরের পরিপূরক হয় না। পরিচালকদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান রেখেই বলছি যে, গল্প ও উপন্যাস সার্থক বা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে লেখকের লেখার গুণে আর পাঠকের কল্পনার জগতের সুন্দর মিলমিশের জন্যে। অনেক সময়ে বা বেশীরভাগ সময়েই দেখা যায় যে, লেখকের কল্পনার বাস্তবরূপটি সেভাবে ক্যামেরায় ধরা গেলো না। তখন আমার মনে পাঠকরা সেভাবে সিনেমাটিকে নিতে পারে না। আর আপনার লেখা ‘কোয়েলের কাছে’ বা সব উপন্যাসেই প্রকৃতির বিশাল ভূমিকা থাকে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তো প্রকৃতি প্রধান চরিত্রও হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে যদি ঠিক সেভাবে সিনেমাতে ধরা না যায়, তাহলে আপনার লেখা চরিত্রগুলো বা প্রকৃতি কোনোটাই আবেদনশীল হয়ে উঠবে না।”

একটানা কথাগুলো বলেই স্বীকার করলাম, এগুলো সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ধারনা। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে লেখক বললেন “আমারও তাই মনে হয়। আসলে সিনেমা আর বই দুটো আলাদা কিন্তু জোরালো মাধ্যম। তাই হয়তঃ সবসময়ে একে অপরকে প্রভাবিত করতে পারে না। আর সিনেমার কমার্শিয়াল দিকটাও অস্বীকার করা চলে না।” এ কথায় আমিও সহমত জানাই। মনটা আনন্দে ভরে গেলো যে, কোঠাও আমি ওনার লেখার প্রতি যথেষ্ট নিষ্ঠা রাখি, তাই তাঁর চিন্তাধারার সাথে আমার চিন্তাধারার সূক্ষ্ম একটা মিলও কথার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেলো।

কোথা দিয়ে দু ঘন্টা সময় কেটে গেলো বুঝতে পারিনি। প্রায় দুপুর ১টা বাজছে। ওনার দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে ভেবে বলি, “আজ তা হলে আসি।” বললেন, “হ্যাঁ, অনেক বেলা হলো। তোমাদের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। মেয়ে দিল্লী থেকে মা নিশ্চয়ই দারুণ সব রান্না করেছেন। তারপর আবার আজ রবিবার।”

আমরা কিছু না বলে শুধু হাসলাম দেখে বললেন, “আসলে খাওয়াদাওয়া, আতিথেয়তা আমার বড়ই পছন্দের জিনিষ। বাঙালী খাদ্যরসিক। আমিও তার থেকে আলাদা কিছু নই।” আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই আমার লেখায় নানারকম খাওয়ার প্রসঙ্গ পেয়েছো।” আমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম। ওনার লেখার যারা পাঠক পাঠিকা তারা জানেন যে, উনি শুধু খাদ্যরসিকই নন, দরাজ হাতে খাওয়াতে ভালোওবাসেন। নিজে সবরকমের খাদ্যদ্রব্যের ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী এবং কাজ বা ভ্রমণের সূত্রে নানা দেশের খাবারদাবারের ব্যাপারে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। সে আমাদের দেশের বিভিন্ন রান্নাই হোক বা বিদেশের, আদিবাসী রান্নাই হোক বা শহুরে কিচেন – ওনার লেখায় তার বর্ণনা পাঠকদের কাছে এক আলাদা আকর্ষণ। সেই প্রসঙ্গে বললেন, “একটা সময়ে নানা দেশ দেখেছি ঘুরেছি আর সেই অভিজ্ঞতা বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে দিয়ে নানাভাবে প্রকাশ কপেয়েছে। সে আতিথেয়তার ক্ষেত্রেই হোক আর চরিত্রের মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণই হোক।”

এই প্রসঙ্গে আমার মনে হলো ওনার লেখায় সুদূর ‘মাসাইমারা’-দের খাওয়াদাওয়ার বর্ণনা যেমন আমাদের আকর্ষণ করে তেমনই আবার ঘরের কাছের পুরুলিয়া অঞ্চলের বা বিহারের আদিবাসীদের খাওয়াদাওয়ার বর্ণনা ঠিক সেভাবেই মনকে নাড়া দেয়। এরপর লেখক নিজেই বলতে আরম্ভ করেন তাঁর নানা খাওয়াদাওয়া সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার গল্প। যদিও নিজে বলেই দিলেন, “এখন অবশ্য আমার বয়স হয়ে গেছে। সবই অনেক নিয়ন্ত্রিত, সংযত। না হলে, বাড়ির লোকেরা খুবই চিন্তা ভাবনা করে।”

সময় শেষ হয়ে এলো। সবেলা বেড়ে চলেছে তার নিজস্ব নয়ম অনুযায়ী। ওনার ‘সই’-এর জন্যে দুটো বই এগিয়ে দিলাম। তার মধ্যে একটি বই ছিলো ‘অন্য চোখে’, ‘ভ্রমণ’ পত্রিকায় বেরনো ওনার ‘অন্য চোখে’ লেখাগুলির সংকলন। বইটিতে সই করবার আগে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, “তোমাদের কাছে এই বইটি দেখে খুব ভালো লাগলো। পড়ো। তোমাদের ভালো লাগবে।”

মনে এলো এই বইয়ের ভূমিকায় লেখা ওনারই কয়েকটি কথা “বনভ্রমণ আর বনভোজন যে এক নয়, বনভ্রমণও এক বিশেষ শিল্প – এ কথা বহুদিন ধরে পাঠক পাঠিকাদের মধ্যে গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করে আসছি। তাতে ফল যে হয়েছে, তা জেনে ভালো লাগে।” তাই বোধহয় আমাদের হাতে বইটি দেখে লেখক এক আত্মতৃপ্তির আশ্বাস পেলেন।

গাড়িতে ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিলো, অনেক কথাই জানা হলো না; শোনা বাকি থেকে গেলো, ওনার আরো অনেক অভিজ্ঞতার গল্প। ওনার লেখা যতবারই পড়া হোক না কেন, তার রেশ থেকে যায় বহুদিন। তেমনভাবেই মনে প্রাণে সাজপোষাকে আদ্যন্ত বাঙালী এই মানুষটির ভেতরের সহজ সরল প্রাণখোলা আতিথেয়তার আবেশ বোধহয় সারাজীবন আমাদের পাথেয় হয়ে রয়ে যাবে।

লেখিকা পরিচিতি

 

 

 

সুদেষ্ণা মিত্র

এডিটর, দু~কলম

Author

Du-কলম

Join the Conversation

Leave a Reply to sarbani basu Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!