বিবিধগল্প

খেয়াল

বিশ্বজিৎ সেনগুপ্ত

স্কুল সেরে বাড়ি ফিরতে আজ একটু বেশি রাত হয়ে গেল প্রসন্নর। এমনিতেও ফেরার পথে রোজই আড্ডার প্রাথমিক পর্বটা একটু না সেরে ও আসতে পারে না। ঘরের লক্ষ্মী কতবার বলেছে, আরে তুমি তো আবার যাবেই তোমার আড্ডায়। বাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে তারপর গেলেই তো পারো। নকি ওখানে ইঁট পেতে না এলে, তোমাকে বন্ধুরা ঢুকতেই দেবে না! ওকে অবশ্য এসব বলে কোন লাভ নেই, সেটা শ্বেতার অজানা নয়। তবুও বলে। এমন ক্ষেত্রে দন্ত দু’পাটি যথাসম্ভব প্রসারিত করে প্রসন্ন ঝটপট বলে, তা যখন জানোই বারবার বলে কী লাভ বলো তো! রাস্তায় কারও সাথে দেখা হয়ে গেলে, আমি যে কেটে বেরিয়ে আসতে পারি না, সেটা তো এতদিনে তোমার অজানা নয়। শ্বেতাও এতদিনে বুঝে গেছে, আর যাই হোক সন্ধ্যা গড়িয়ে সাতটার আগে ও ঘরে ঢুকবে না। সে কারণে এসব নিয়ে আজ আর কথা বাড়ায় না শ্বেতা।

আজ ফেরার পথে প্রসন্নর হঠাৎ দেখা হয়ে যায় বাল্যবন্ধু হিতেনের সাথে। একথা সেকথায় আজ বাড়ি ফিরতে আরও রাত হত, যদি না মোবাইলের স্পীকারে শ্বেতার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বরটা ভেসে না আসতো। বাড়ি ফিরে খেতে খেতেই আজ আটটা পেরিয়ে গেল। দ্বিতীয় ক্ষেপে আড্ডায় যাওয়ার আগে রোজকার অভ্যেসমত, বিছানায় গা এলিয়ে টিভির পর্দায় চোখ রেখে নিউজ বুলেটিনগুলো শুনতে শুনতে আজ হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিল প্রসন্ন। ঘুম যখন ভাঙল, ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ন’টা পেরিয়ে গেছে। অস্বস্তিকর গরমে শরীরটাও বেশ ক্লান্ত থাকায়, এই প্রথম আজ আর ঘর থেকে বেরোলো না প্রসন্ন। বিছানা থেকে উঠে চোখেমুখে একটু জল দিয়ে এসে ভাবল, আড্ডায় যখন যাওয়াই হল না, তখন অসমাপ্ত লেখাটা, না হয় শেষ করেই নেবে আজ। মধুমেশানো কন্ঠে শ্বেতাকে ডেকে বলল, আমাকে একটু ওঘর থেকে ল্যাপটপটা এনে দেবে। শ্বেতা বলল, তা হলে আজ তো রেকর্ড করে ফেললে। দেখো আড্ডার সাথীরা আবার কাঁদবে না তো। তবু ভাল একদিন এইসময়টা ঘরেই থাকলে। ক্যালেন্ডারে আজকের তারিখে আমি লাল কালির দাগ দিয়ে রাখছি। এখনই ল্যাপটপ দিয়ে যাচ্ছি। আজ অন্তত শুতে খুব বেশি রাত হবে না। যা লেখার এখনই লিখে ফেলো। তাহলে একদিন অন্তত তাড়াতাড়ি শুতে পারব।

 ক’দিন ফেসবুকে আসেনি প্রসন্ন। ল্যাপটপটা খুলেই প্রথমে ফেসবুকে লগ-ইন করতেই, ইনবক্সে একটা মেসেজ।

– কী করছেন?

পাল্টা উত্তরে প্রসন্ন জানাল – আজ বাড়ি ফিরে এই বসলাম।

– মানে? ফিরতে এত রাত হল বুঝি?

– আরে না না। আমি ফেসবুকে বসার কথা বলেছি।

– ও। তাই বলুন। তা এসময় আপনি তো ‘অন’ থাকেন না। যতদূর জানি, এটা আপনার আড্ডার সময়।তা আজ রেকর্ড ভাঙলেন যে!

– আসলে আজ বড্ড স্টাফি কন্ডিশন। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। সত্যিই এই প্রথম রাতের আড্ডায় আজ আমার যাওয়া হল না।

– এসি চালিয়ে বসুন।

– আমার কুটিরে সে সুখ নেই যে। আমার ওটা সহ্য হয়না। আসলে যেকোনোরকম কৃত্রিমতায় আমি অস্বস্তি ফিল করি। এখন দেখছি, এসির সুখ পেতে, তোমাদের বাড়ি না গেলেই নয়।

– চলে আসুন। নো প্রবলেম। তবে দাদা এসি একটা নিয়েই নিন। দেখবেন অভ্যস্ত হয়ে গেলে আর কোন অসুবিধা হবে না।

কী করে বোঝায় বন্ধুকে, যে যৌথ পরিবারে থেকে একা সুখ ভোগ করা যায় না। তাছাড়া বাড়িতে খুব বড় মাপের একটাও ঘর নেই। থাকলে না হয়, একটা এসি মেশিনেই ঢালাও বিছানা করে সবাই মিলে থাকা যেত। কিনলে ওদের পরিবারে কমপক্ষে তিন-তিনটে এসি মেশিন কিনতে হয়। যেটা আর কোনোভাবেই হয়ে উঠছে না। এসব ভাবলেও, মনের ভেতরে তা গোপন রেখে, প্রত্যুত্তরে প্রসন্ন বলল – ঐ যে বললাম, সে সুখ আমার সয় না। তা হলেও যখন বললে, দেখি ওষুধ সঙ্গে করে যেতে পারি কিনা। হে হে হে।

– হ্যাঁ হ্যাঁ, নির্দ্বিধায় চলে আসুন। এজন্য আমি বা আমার কর্তা কেউই বিচলিত নই। আসুন আসুন। জানি তো আসবেন না। মজা করার দরকার কী?

– তাহলে আসছি। আমরা দু’জনেই আসছি কিন্তু। দেখো,রাত হচ্ছে বলে, তোমরা যেন ঘুমিয়ে পড়ো না। মাঝরাত হলেও, আসব যখন বলেছি,তখন কিন্তু আসছিই। ওয়েট।

গল্পটা শেষ হতেই, মুচকি হেসে শ্বেতা বলল, তুমি পারো-ও বটে। তবে আমি কিন্তু আর ওয়েট করতে পারছি না। হাই উঠছে ভীষণ।

— সমাপ্ত —

Author

Du-কলম

Join the Conversation

Leave a Reply to Megha Sengupta Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!