Home বিবিধ, প্রবন্ধ ভারতীয় ক্লাসিক্যাল নৃত্য
বিবিধপ্রবন্ধ

ভারতীয় ক্লাসিক্যাল নৃত্য

সঞ্চারী গোস্বামী মজুমদার

ভূমিকা

প্রত্যেক মানুষ একে অন্যের থেকে আলাদা হয়। তারা নিজেদের জীবনে বিভিন্ন রকমের কাজ করে থাকে তাদের পছন্দ এবং সামর্থ্য অনুযায়ী। কেউ নাচে ভালো হয় আবার কেউ গানে বা আঁকায়। আমাদের দেশে এইরকম গুণী মানুষের কোনো অভাব নেই। এর সাথে সাথেই এই প্রত্যেকটি গুনের নিজস্ব একটি ইতিহাস রয়েছে। আজ আমি নাচ এবং তার ইতিহাস নিয়ে কিছু বলব।

 

 

ভারতীয় ধ্রুপদী  বা শাস্ত্রীয় নৃত্য

ভারতের ইতিহাসে নৃত্যের উল্লেখ অনেক প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে। দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্ব থেকে একবিংশ শতাব্দীর বৃত্ত সম্পর্কিত প্রচুর পরিমাণে তথ্য আমরা পাই। নাট্যশাস্ত্র নামক এই প্রাচীন গ্রন্থে আমরা যুদ্ধ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের কথা জানতে ও শিখতে চাই। আরো বিস্তারিত জানতে আমরা নৃত্যের ইতিহাসকে সময়ানুসারে তিন ভাগে বিভক্ত করতে পারি। ক্লাসিক্যাল, মিডল এবং মর্ডান পিরিয়ড। এবার একে একে আমি এই তিন পিরিয়ডের কথা সংক্ষেপে বলবো।

 

 

ক্লাসিকাল  পিরিয়ড

ভারত মনির নাট্যশাস্ত্র হলো এখনো অবধি পাওয়া নাচের প্রথম ক্লাসিকাল ম্যানুয়াল। এখানে আমরা নৃত্যের পরিষ্কার এবং বিস্তারিত বিবরণ পাই। বলা হয়েছে যে ভগবান শিব চেয়েছিলাম যে নাচ হয়ে উঠুক নাটকের অংশ এবং তাই তানভীর মনিকে বলা হয়েছিল যে তিনি যেন নাচের রচনা করেন আর তার সাথেই কলাকুশলীদের সবাইকে শেখান। সেই নাচের নামকরণ করা হয় তান্ডব বলে। এই নাচের সমান্তরালে মহিলাদের দ্বারা করা নাচের নাম হয় লাস্য।

 

 

মিডল পিরিয়ড

এই সময়ে নাট্যশাস্ত্রের পরম্পরা ছিল এবং তার সাথে কিছু নতুন আর পুরনো বদল ঘটে। এই সময় আমরা নাচকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছি। প্রথমটি হল শুদ্ধা আর দ্বিতীয়টি হল দেশী। শুদ্ধা মধ্যে শুধু শাস্ত্রীয় এবং একাডেমিক ফর্ম আর দেশীর মধ্যে পড়ে আঞ্চলিক ফর্ম। আঞ্চলিক ফর্মের উত্থান হওয়ার কারণে এই ফর্ম নিজের জায়গা করে নিয়েছে আজ।

 

 

মর্ডান পিরিয়ড

ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের সময় যে শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল তাতে আর্ট ও ক্রাফটের কোন জায়গা ছিল না। যদিও প্রত্যেক ঘরানায় নিজেদের মতো করে অভ্যাস চালিয়ে গেছে। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে পণ্ডিত উদয় শংকর তার নিজের মত করে ভারতীয় ক্লাসিক্যাল নৃত্যকে রূপ দিলেন এবং নৃত্য অরিয়ান্টাল ডান্স হিসেবে খ্যাত হল। তার সাথে সাথে আরও কিছু নৃত্যশিল্পী নৃত্যের পুনরুত্থানের চেষ্টা করলেন এবং সেই চেষ্টায় দর্শকদের আকৃষ্ট এবং আনন্দ দুই দিতে পারলেন।

ভারতের নৃত্যকে আমরা দুটি ভাগে বিভক্ত করতে পারি। প্রথমটি হল শাস্ত্রীয় নৃত্য আর দ্বিতীয়টি হল লোক নৃত্য। সংগীত নাটক একাডেমী দ্বারা চিহ্নিত আটটি শাস্ত্রীয় নৃত্য রয়েছে সেগুলি হল – ভারতনাট্যম, কথাকলি, কত্থক, কুচিপুড়ি, মনিপুরী, মোহিনীঅট্টম ওডিসি ও সত্রিয়া। নাট্যশাস্ত্রও আমরা এই নাচের উল্লেখ পাই। একে একে আমি এই আটটি নাচের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ দিচ্ছি।

 

 

১।  ভারতনাট্যম

এক হাজার বছর খ্রিস্টাব্দ আগে এই নাচের প্রচলন শুরু হয় তামিলনাড়ুতে। তামিলনাড়ু হল ভারতবর্ষের দক্ষিনে এক রাজ্য। এর অনুপ্রেরণা আসে চিদাম্বারাম এর মন্দিরের পুরনো ভাস্কর্য থেকে। প্রথমেই নৃত্যের নাম ছিল সোদিরত্নম। পরে ১৯৩০ এর দশকে এ. কৃষ্ণ আইয়ার আর রুক্মিণী দেবী আরুন্ডেল মিলি ভারতনাট্যম এই নামকরণ করেন। বৃত্তের মধ্যে আমরা মৃত্যু ছাড়া উপায় এক্সপ্রেশন মিউজিক এবং একটা সুন্দর মিশ্রন। ভারতনাট্যম বাফার ডান্স পুরুষ এবং মহিলা শিল্পীদের দ্বারা পরিবেশন করা নাচ এর অন্যতম জনপ্রিয় স্টাইল।

 

 

২।  কথাকলি

অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্যের মত ভারত মনির নাট্যশাস্ত্রে ও আমরা কেরল বা কেরালা রাজ্যের থেকে আসা কথাকলি নৃত্যের উল্লেখ পাই। কথাকলি এই শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ করলে আমরা যে প্রথম অক্ষরটি পাই সেটা হল কথা যার সংস্কৃতে মানে হল গল্প এবং দ্বিতীয় শব্দটি হলো কলি মালায়ালামে অর্থ হল নাটক। সুতরাং কথাকলি এই শব্দটির পুরো অর্থ হলো গল্প অবলম্বনে নাটক। কথাকলি হলো এমন একটি স্টাইলিস্ট আর্ট ফ্রম যেটাতে নাচ গান ও অভিনয় সংমিশ্রণ আমরা দেখতে পাই। এর গল্পগুলি মহাকাব্য থেকে নেওয়া হয়েছে। নৃত্যের পোশাক এবং মেকআপে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাকে আবার অনেক সময় স্কাইডান্স বলা হয়।

 

 

৩।  কত্থক

কত্থক এই শাস্ত্রীয় নৃত্যের জন্ম ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে। কত্থক কথাটি এসেছে সংস্কৃতের শব্দ কথা মানে গল্প থেকে যার মানে হল যে গল্প বলেন। প্রাচীন উত্তর ভারতের যাযাবরদের কে জানা যেত কথক বা গল্পকার নামে।

বলা হয় যে এই নাচের উপরে ভক্তি আন্দোলনের একটি প্রভাব আছে। কথককে ভজন গজল বা ঠুমড়ি এবং অভিনয়ের সাথে নিজস্ব একটা পারফরম্যান্স স্টাইল আছে যাকে বলা হয় “ভাব বাতানা”। কত্থক নৃত্য হিন্দু এবং মুসলিম ঘরানার সাথে যুক্ত এবং প্রত্যেকের নিজস্বতা আছে। তিনটে আলাদা স্থানে এর ঘরানা রয়েছে সেগুলি হল – জয়পুর, বেনারস ও লক্ষ্ণৌ।

 

 

৪।  কুচিপুড়ি

অন্ধপ্রদেশের কৃষ্ণ জেলার অন্তর্গত একটি গ্রামের নামের সাথে মিল রেখে নাম করা হয় এই নৃত্যের। এই ডান্স-ড্রামা পারফরম্যান্স যার সাথে প্রাচীন মন্দির ও আধ্যাত্বিক বিশ্বাসের যোগ রয়েছে। এই বৃত্তের ট্রেডিশনাল পারফরম্যান্স সবসময় ছেলেরাই দিয়ে এসেছে।

বিশিষ্ট এবং খ্যাতনামা গুরুদের চেষ্টায় এই নৃত্য আর প্রসারিত হয়েছে আজ। নৃত্যকে আর্থ ডান্সও বলা হয়। এর জনপ্রিয়তা প্রথমে ভারতের কোণায় কোণায় পৌঁছায় এবং এখন এর বিশ্বজোড়া নাম হয়েছে।

 

 

৫।  মনিপুরী

ভারতের উত্তর পূর্ব রাজ্য মনিপুরের অন্তর্গত নৃত‍্য মনিপুরী। এই নাচের মধ্যে আমরা ভারতের প্রাচীন সব উৎসবের চিহ্ন পাই। এই নৃত্য প্রথমে ভগবান শিব ও পার্বতী দেবী এবং অন্যান্য দেবদেবীরা যারা এই বিশ্ব সৃষ্টি করেন তাদের বন্দনার জন্য তৈরি হয়। ফরেইন আছে আমরা বৈষ্ণব ধর্মের প্রচলন দেখতে পাই। এই নাচে এখন আমরা রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা যাকে রাসলীলা বলে সেটা দেখতে পাই।

এই নৃত্যের আরেকটি নাম হল জাগোই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেষ্টায় এই নৃত্য ব্রিটিশ জমানায় আরেকবার পুনরুত্থানের সুযোগ পায়।

 

 

৬।  মোহিনীঅট্টম

মোহিনীঅট্টম – এই নৃত্যের জন্ম হয় কেরালা রাজ্যে। কুচিপুড়ি এবং মোহিনীঅট্টম দুই নৃত্যই কেরালা রাজ্যের থেকে এসেছে। এই নৃত্যের মধ্যে আমরা লাস্য নৃত্যের আরো কোমল মুগ্ধ করা ভাবের প্রকাশ পাই।  মোহিনীঅট্টম এই নামটি এসেছে ‘মোহিনী’ শব্দ থেকে। ভগবান বিষ্ণুর নারী অবতারের নাম ছিল মোহিনী আর তার থেকেই এই নাচের নাম মোহিনীঅট্টম। 

এতে মহিলা নৃত্যশিল্পীরা একটি নাটক পরিবেশন করেন। যে গানে এই নাটকটি পরিবেশন করেন তার নাম হলো মনিপ্রোভালা। প্রভাত হল সংস্কৃত এবং মালায়লাম এই দুই ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি। এই নৃত‍্যকে এয়ার ডান্সও বলা হয়।

 

 

৭।  ওডিসি

উড়িষ্যা রাজ্যে সবথেকে পুরনো নৃত্যের নাম হল ওডিসি। ওডিসি পুরনো মন্দিরের স্থাপত্যের থেকে উৎসাহ পেয়েছে এই বিশেষ নৃত্য। 

এই নৃত্যে মুখের ভাব, হাত ও শরীরের মুভমেন্টকে ব্যবহার করা হয় মনের ভাব, আবেগকে সুন্দরভাবে ব্যক্ত করার জন্য। নৃত্যের শুরু হয় ধরিত্রী মাতা কে প্রণাম জানিয়ে এবং গণেশ বন্দনা মাধ্যমে। এ নৃত্যেকে ওয়াটার ডান্স ঔ বলা হয়। এই নৃত্য সাধারণত বেশি মহিলা নৃত্যশিল্পী দেখা যায় যদিও এখন পুরুষরাও পারফরম্যান্স করে। এই নৃত্যেতে আমরা বৈষ্ণব অর্থাৎ জগন্নাথ দেবের বন্দনাও দেখতে পাই।

 

 

৮।  সত্রিয়া

সত্রিয়া  নৃত্যের উৎপত্তি হয় ভারতবর্ষের আসাম রাজ্যে। এই নাচ বুদ্ধিস্ট মনেস্ট্রি থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রথমেই নাচ বৈষ্ণব ধর্মের মতে করা হতো এবং ছেলেরাই নাচতো যাদের বলা হত ভোগা। বর্তমান সময়ে ছেলে এবং মেয়ে উভয়েই এই নৃত্য প্রদর্শন করে থাকে। 

হাস্যময় সঙ্গে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই নৃত্যের ধরন। এই নৃত্যে মুদ্রা পায়ের কাজ গান ও পোশাকের জন্য খুব লোকপ্রিয় এবং শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। এই  নাচ স্বীকৃতি পায় ২০০০ সালে এবং একে স্বীকৃতি দেয় সংগীত নাটক একাডেমি। বর্তমান সত্রিয়া নাচ অনেক ধরনের গল্প নিয়ে বিশ্বের দরবারী পারফরম্যান্স দিচ্ছে এবং অডিয়েন্সের মনজয়ও করছে।

 

 

উপসংহার

সংগীত নাটক একাডেমি আজ এই আট ধরনের ক্লাসিকাল নৃত্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে শাস্ত্রীয় নৃত্য হিসাবে। এই প্রত্যেকটি নৃত‍্য একে অপরের থেকে আলাদা এবং প্রত্যেকের নিজস্ব একটি ভাব আছে। 

এই প্রত্যেকটি নাচ আমাদের দেশ ভারতবর্ষকে গর্বের জায়গায় নিয়ে গেছে। এদের প্রত্যেকের মেকআপ ড্রেস গান নাচের ভঙ্গি আমাদের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে। আজ এই প্রত্যেকটি নাচ বিশ্বজোড়া নাম করেছে এবং আগামী দিনেও তা করে যাবে।

লেখিকা পরিচিতি
 
 
 
 
 
 
 
Sanchari Goswami Majumdar
 
Loves to teach and practice dance. Likes to read books.

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. Satyi nrityer samparke anek kichhu jana gelo. Tomake dhonyobad. Ei dekho, kathay kathay tumi bole fellam. Kichhu mone korona. Lekhaguli khub i sundar. Du kalom ke bolchhi, ekebare protham line e ekta banan vul hoyechhe, nrityer badole mrityer hoye gechhe. Ektu dekhe nis.

Leave a Reply to Jayashree bose Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!