Home বিবিধ, প্রবন্ধ গুরু: আমাদের জীবনের এক বহুরূপী আলো
বিবিধপ্রবন্ধ

গুরু: আমাদের জীবনের এক বহুরূপী আলো

ডঃ দীপ্র ভট্টাচার্য

(গুরু পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে বিশেষ নিবন্ধ)

আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি, জীবন এক শিক্ষাপ্রবাহ। তবে এই প্রবাহে কারা শেখায়, কেমন করে শেখায়, আর সেই শিক্ষাকে আমরা কীভাবে গ্রহণ করি — তা নিয়ে খুব কমই ভাবি। আমরা ভাবি শিক্ষক মানেই শ্রেণী কক্ষের কেউ, যিনি বইয়ের পৃষ্ঠা পড়ে শোনান। কিন্তু গুরু কি শুধুই একজন শিক্ষক? নাকি, গুরু হলেন সেই অনুচ্চারিত পথপ্রদর্শক, যিনি জীবনকে অন্যরকম চোখে দেখতে শেখান?এই লেখাটি কোনো একজন গুরুকে নিয়ে নয়। এটি সেই গুরুতত্ত্ব-এর সন্ধান, যা প্রতিটি মানুষের জীবনে কোনো না কোনো রূপে এসে পড়ে — নীরবে, নিঃশব্দে, কিন্তু গভীর ছাপ রেখে যায়।

গুরু কেবল মানুষ নন, এক উপলব্ধি

অনেক সময় গুরুরা আমাদের জীবনে ঢুকে পড়েন এমনভাবে, যাকে আমরা প্রথমে “গুরু” বলে ভাবিই না। কখনো তিনি হয়ে ওঠেন এক বন্ধুর রূপ, কখনো মায়ের স্পর্শ, বাবার কঠোরতা, কখনো হারিয়ে যাওয়া কারো অভিজ্ঞ কথায়। কখনো একটি বই, একটি ব্যর্থতা, অথবা জীবনের গভীর একাকিত্ব—সবই গুরু হতে পারে। কারণ গুরু মানে শুধুই শেখানো নয়, শেখার দিশা দেখানো। গুরু মানে প্রশ্ন তৈরি করা, উত্তর নয়। গুরু মানে জ্ঞানের বোঝা নয়, আত্মজিজ্ঞাসার আলো।

গুরু কত রকম?

জীবনে আমরা নানা রকমের গুরুর মুখোমুখি হই—তাঁরা সবাই একে অপরের থেকে আলাদা, অথচ সমান গুরুত্বপূর্ণ।

১. জ্ঞানগুরুতিনি আমাদের বই পড়া শেখান, তথ্য দেন, কিন্তু তার বাইরেও — একজন ভালো জ্ঞানগুরু সেই, যিনি আমাদের শেখান কীভাবে চিন্তা করতে হয়, নিজের মত গড়ে তুলতে হয়।

২. আত্মিক গুরুএই গুরু নিঃশব্দ, অনেক সময় চেনাও যায় না। কিন্তু তাঁর ছায়ায় আমরা নিজের ভেতরের দ্বিধা, দুঃখ, ভয় কাটিয়ে উঠতে শিখি। তিনি আমাদের আত্মার আয়নাকে পরিষ্কার করে দেন।

৩. সময়ও এক গুরুআমরা প্রায়ই বলি — “সময় অনেক কিছু শেখায়”। ঠিক তাই, সময় যেমন ধৈর্য শেখায়, তেমনি অনুশোচনার মাধ্যমে আত্মসমালোচনার দিকেও ঠেলে দেয়। সময়ের শিক্ষা গভীর এবং নীরব।

৪. ভুল মানুষ, ভুল সিদ্ধান্তও গুরু হতে পারেএকজন বিশ্বাসভঙ্গকারী, কিংবা একটি ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক, হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা দিয়ে যায় — কে আপন, কে নয়; কোথায় থামতে হয়, কাকে ছেড়ে দিতে হয়। এমন গুরু কষ্ট দেয়, কিন্তু গড়ে তোলে।

৫. নিজের ভেতরের গুরুআমাদের সকলের ভেতরেই একটি কণ্ঠ থাকে, যা সবসময় সঠিক বলে না, কিন্তু জিজ্ঞাসা করে। এই “অন্তর্গুরু” আমাদের ভুল থেকে শেখায়, সচেতন হতে শেখায়। কেউ এই কণ্ঠকে দমন করে রাখে, কেউ  আবার এটাকেই জীবনের দিশারী করে তোলে।

গুরু মানে আলো দেখানো

একজন প্রকৃত গুরু আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করবেন না, বরং শিখিয়ে যাবেন কীভাবে নিজের উপর ভরসা করতে হয়। তিনি আপনাকে স্বাধীন ভাবনার দিকে ঠেলে দেবেন, না-শেখার মধ্যেও শেখার ইঙ্গিত রাখবেন। আপনি যখন ভুল করবেন, তখন তিনি আপনাকে দোষ দেবেন না, বরং বুঝিয়ে দেবেন—ভুলের মধ্যেই রয়েছে সবচেয়ে বড় শিক্ষা। তিনি আপনাকে আপনার মত করে ভাবতে শেখাবেন, কিন্তু কখনোই আপনাকে তাঁর মতো করে বানাবেন না। এটাই প্রকৃত গুরুর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।

গুরু পূর্ণিমার তাৎপর্য

গুরু পূর্ণিমা কোনো একদিনের পূজা নয়, এটি আত্মদর্শনের দিন। এটি সেই দিন, যেদিন আমরা মাথা নিচু করি শুধু একজন মানুষের সামনে নয়, সব কিছুর সামনে যা আমাদের গড়ে তোলে। জীবনের প্রতিটি শিক্ষা, প্রতিটি ব্যথা, প্রতিটি মানুষ—যে কোনো সময় গুরু হয়ে উঠতে পারে, যদি আমরা গ্রহণ করতে শিখি। তাই গুরু পূর্ণিমা একধরনের কৃতজ্ঞতা — শুধু গুরুর জন্য নয়, জীবনের প্রতি, শেখার ক্ষমতার প্রতি।

গুরু মানে কোনো চেয়ারে বসা মানুষ নাও হতে পারেন। তিনি হতে পারেন এক নিঃশব্দ সন্ধ্যা, একটি হারিয়ে যাওয়া কবিতা, অথবা ভাঙা আয়নার প্রতিবিম্ব। গুরু মানে শুধুই শিক্ষা নয়—গুরু মানে মুক্তিও। জীবনজুড়ে গুরু অনেকবার আসেন, রূপ বদলান, চলে যান। কিন্তু রেখে যান সেই আলো, যা আমাদের ভিতরে জ্বলে থাকে — কখনো ধীরে, কখনো তীব্র হয়ে। তাই, যখনই কোনও অভিজ্ঞতা আমাদের থামায়, ভাবায়, ভাঙে — মনে রাখতে হবে, সেখানেও হয়তো কোনো এক গুরু তাঁর নিঃশব্দ পাঠ রেখে যাচ্ছেন।

আপনার জীবনে নিশ্চয়ই বিভিন্ন গুরুর দেখা পেয়েছেন।  সবাইকে নয়, অন্তত নিজেকে প্রশ্ন করুন। সেই প্রশ্নই হয়তো একদিন আপনার নিজের অন্তর্গুরুকে জাগিয়ে তুলবে। মনে রাখবেন— গুরু মানে নিয়ন্ত্রণ নয়, মুক্তি। যিনি শেখান কী ভাবতে হবে না, শেখান কীভাবে ভাবতে হয়। আর তিনি একজন কেউ নন। জীবন আমাদের প্রতিটি বাঁকে কোনো না কোনো রূপে একজন গুরুকে ঠিক পাঠিয়ে দেয়।

আজ গুরু পূর্ণিমায় প্রনাম জানিয়ে কৃতজ্ঞ হই সেইসব গুরুর প্রতিযারা আমাদের গড়েছেন, ভেঙেছেন, আলো দেখিয়েছেন।

লেখক পরিচিতি

Dr. Dipra Bhattacharya

Management Consultant & AI Strategist

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. খুব মননশীল লেখা। প্রকৃত গুরু / শিক্ষক যে কেউই হতে পারে। সমাজের যে কোনোও স্তরের মানুষ, যে কোনোও জীব – এমনকি জড় বস্তুও গুরু বা শিক্ষক হতে পারে। রবার্ট ব্রুস যেমন এক মাকড়শার কাছ থেকে জীবনের এক অমূল্য শিক্ষালাভ করেছিলেন।

  2. মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা পড়লাম। শিক্ষার বয়স নেই। প্রকৃত গুরু খুঁজে না পেলে শিক্ষার আলো থেকে আমরা বঞ্চিত হই। লেখাটি পড়ে ভারি সুন্দর এক অনুভূতি হলো। এমন লেখার জন্যে লেখককে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

  3. Great. এই লেখাটি কিম্বা লেখক এক ধরণের গুরু হয়ে এক জীবনের সকল স্তরের গুরুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। গুরু পূর্ণিমার দিনে এক আদর্শ লেখা, সত্যিই যা ভাবায় এবং বিনম্র শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে মন।👌👌🙏🙏

  4. খুবই সুন্দর লেখা ও মনোগ্রাহী কারণ জীবন গড়তে সত্যিই বিভিন্ন সময় কোনো না কোনো গুরুর আবির্ভাব হয় ও তাদের অবদানও ভোলার নয়। জীবনের সন্ধা পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন স্মৃতি রোমন্থন করি আর ওনাদের অন্তর থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করি, কারণ বেশির ভাগ গুরুর আর পৃথিবীতে অস্তিত্ব নেই। তাদেরকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই শুধু গুরু পুর্নিমার দিনেই নয় প্রতিদিনে। 🙏🙏🙏🙏🙏

Leave a Reply to Srijit Mitra Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!